শেষটা সুন্দর পর্ব ৪০

শেষটা সুন্দর পর্ব ৪০
জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

রাবীর নাস্তা খেয়ে কোনো একটা কাজে বেরিয়ে যায়। আর মেহুল নাস্তা খেয়ে তার রুমে চলে আসে। বিছানায় বসে ফোনটা হাতে নেয় রিতাকে কল করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু রিতার নাম্বারে কল করে দেখে তার নাম্বার এখনো বন্ধ বলছে। মেহুল এবার চিন্তায় পড়ে ভাবে, নাম্বার বন্ধ থাকলে রিতার সাথে যোগাযোগ করবে কী করে। এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও পাচ্ছে না সে।

মেহুল রুমে এই নিয়েই দুশ্চিন্তা করছিল। তখন তার শাশুড়ি মা এলেন। তিনি এসে বললেন,
‘মেহুল, গোসল সেরে তৈরি হয়ে নাও। পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই তোমাকে দেখতে আসবেন।’
ব্যাপারটা মেহুলের কাছে খুব বিরক্তির হলেও সে মুখে হাসির রেখা টেনে বলল,
‘আচ্ছা, মা।’
তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। মেহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল করতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আমি কিছু খাব না।’
‘না খাইলে সাহেব বকবেন।’
‘বকলে বকবে। আমি খাব না বললাম তো। নিয়ে যান এগুলো।’
‘মা গো, এমন কইরেন না। আপনি না খাইলে সাহেব আমারে শাস্তি দিবেন। দয়া কইরা এইটুক খাইয়া ফেলেন।’
রিতা চোখ মুখ কুঁচকে বলল,

‘আচ্ছা, এই লোকটা এত খারাপ কেন? উনার মধ্যে কি নূন্যতম বিবেক নেই। এত খারাপ একটা মানুষ হয় কী করে?’
মধ্য বয়স্কা মহিলাটি হাসলেন। তিনি হাসলে তার পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো কুৎসিত লাগে। তিনি বললেন,
‘মানুষ এমনি এমনি খারাপ হয় না। মানুষরে খারাপ বানানো হয়। জানেন তো, প্রত্যেক মানুষের সাথেই একটা শয়তান থাহে। যে সারাডাদিন খালি চিন্তা করে কেমনে মানুষরে খারাপ বানাইবো। আর হেই মানুষ যদি একবার শয়তানের ধোঁকায় পইড়া যায়, তাইলেই শেষ। আর হেই মানুষরে তহন খারাপ হওয়া থেইকা কেউ বাঁচাইতে পারে না। বুঝছেন?’
রিতা তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বলে,

‘খালা, আপনার ঐ সাহেবকে বোধ হয় শয়তানও দেখে মনে মনে ভাবে, এই মানুষটা দেখি তার থেকেও বড়ো শয়তান।’
খালা আবারও হাসলেন। বললেন,
‘আপনি বুঝেন নাই কিছু। থাক, আপনি খাইয়া লন।’
‘আমি খাবো না খালা। নিয়ে যান এগুলো।’
‘না খাইলে শক্তি কই পাইবেন? খাইতে হইব। শরীরে শক্তি করতে হইব। তাইলেই না লড়াই করতে পারবেন। শক্তি ছাড়া কেমনে দাঁড়াবেন?’

‘লড়াই? কার সাথে? সাদরাজ আহমেদের সাথে? আপনার মনে হয়, আমার মতো একটা মেয়ে ঐ সাদরাজ আহমেদের সাথে লড়াই করে পারবে? কখনোই না।’
খালা নিচে পা ছড়িয়ে বসলেন। রিতা বলল,
‘নিচে বসলেন কেন? উপরেই বসুন।’
‘না। হুনেন একটা কথা। মাইয়া মানুষের সবথেকে বড়ো শক্তি কি জানেন?’

রিতা কপাল কুঁচকে বলল,
‘কী?’
‘ভালোবাসা।’
‘ভালোবাসা?’
রিতা অবাক হয়। খালা বলে,
‘হ, ভালোবাসা। জানেন, মাইয়া মানুষের ভালোবাসার অনেক ক্ষমতা। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না এই ভালোবাসা কী করতে পারে। মাইয়া মানুষ তার এই ভালোবাসার অস্ত্র দিয়া নিজের সবথেইকা বড়ো শত্রুরেও অনায়াসে খু ন করতে পারে। এই ভালোবাসা অনেক শক্তিশালী।’

রিতা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে,
‘এই ভালোবাসা দিয়ে আমি কী করব?’
‘খুন করবেন।’
রিতা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলে,
‘খুন করব? কাকে?’
‘সাদরাজ আহমেদরে।’
রিতা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজায়। সময় নিয়ে বলে,
‘আপনি ঘুরে ফিরে এখন এটা বলতে চাইছেন যে, আমাকে এখন সাদরাজ আহমেদ ভালোবাসতে হবে?’

‘হ, হেডাই।’
‘বেঁচে থাকতে এটা আমার জন্য সম্ভব না।’
‘আরে খালা, আপনি দেহি কিছুই বুঝেন না।’
‘খালা, মাথা ধরেছে খুব। আমি এখন কিছু বুঝতে চাই না। তুমি এসব নিয়ে যাও এখান থেকে।’

‘খালা গো, আমি তো আপনার ভালোর জন্যই কইতেছিলাম। ভালোবাসা দিয়া সব সম্ভব। আপনারে তহন কইলাম না, মানুষ এমনিই খারাপ হয় না। তারে খারাপ বানানো হয়। তেমনিই আমাগো সাহেব। জন্ম থেইকাই কেউ খারাপ হইয়া জন্মায় না। শয়তান খারাপ বানায়। আর আপনি যদি আপনার ভালোবাসা দিয়া একবার সাহেবের মনরে ভুলাইতে পারেন, তাইলেই দেখবেন চারদিকে কত সুখ, কত শান্তি। আমার কথাডা মাথায় রাইখেন খালা। আর খানাডি খাইয়া ফেলান। আমি নিচে যাই। আমার অনেক কাজ।’

খালা চলে গেলেন। রিতা মুখ ভার করে বসে থাকলেও বেশিক্ষণ খাবার না খেয়ে থাকতে পারল না। কাল রাতেও সে কিছু খায়নি। খুব খিদে পেয়েছে। তাই আর রাগ না দেখিয়ে চুপচাপ খাবারটা খেয়ে নিল সে।
খাবার খাওয়ার মাঝেই খালার বলা কথাগুলো মাথায় বাজতে লাগল তার। সাদরাজ আহমেদ এমনিতে খারাপ হননি? তাকে খারাপ বানানো হয়েছে? আর সে কি আদৌ কোনোদিন তাকে ভালোবাসতে পারবে? না, কোনদিনই না। তার মনে তো এখনও শুধু সিয়াম। সে তাকে ছাড়া অন্য আর কাউকে নিয়েই ভাবতে পারবে না। ঐ সাদরাজ আহমেদকে তো ভুলেও না। যেভাবেই হোক সে এখান থেকে পালাবে।

রিতা খেয়ে আস্তে করে দরজা খুলে বাইরে বের হলো। উপরের তালায় কেউ নেই। সে এদিক ওদিক ভালোভাবে খেয়াল করল। তারপর সিঁড়ির কাছে যেতেই নিচে কাজের লোকদের দেখল। তারা মোছামুছি করছেন। রিতা আর নিচে নামল না। তার ফোনটাও সে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। সাদরাজ আহমেদ এটা কোথায় রেখেছে কে জানে। রিতা এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে একটা রুমে যায়। রুমটা একটু অন্ধকার ছিল। তাই সে লাইটের সুইচ খুঁজে বের লাইট জ্বালায়।

রুমে আলো আসতেই সে দেখে রুমটা বেশ অগোছালো। অনেকগুলো ফাইল এখানে স্তুপ করে রাখা। কিছু ভাঙ্গা ফার্নিচার আছে। আর কিছু ময়লা কাপড় চোপড়। অনেকটা স্টোর রুমের মতো। রিতার কী মনে হলো, সেই এই রুমেই বিভিন্ন জিনিস নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখতে লাগল তার ফোনটা আছে কিনা। কিন্তু মোবাইল সে কোথাও পায়না। পরে একটা ভাঙ্গা কাবার্ড খুলে সে।সেখানের ড্রয়ারগুলো খুলে দেখে ভেতরে আছে কিনা। তবে সেখানেও কিছু ফাইল ছাড়া আর কিছু পায়নি।

তবে তখন আরেকটা জিনিস হঠাৎ তার চোখে পড়ল। একটা ছবি। সে ফাইলের নিচ থেকে ছবিটা বের করল। খুব ময়লা পড়ে আছে বিধেয় ছবিটা কার বোঝা যাচ্ছে না। সে ছবিটা তার ওড়না দিয়ে পরিষ্কার করে। যদিও মানুষগুলোর মুখ স্পষ্ট না। তাও সে মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। ছবির মধ্যে সাদরাজকে সে চিনতে পারে। অনেক আগের ছবি হয়তো, সাদরাজকে তাই এই ছবিতে অন্যরকম লাগছে। তবে তার পাশে আরেকটা ছেলে দাঁড়ানো।

যার কাঁধে হাত রেখে সাদরাজ চমৎকার ভাবে হেসে আছে। ঐ ছেলেটাকে রিতার খুব চেনা চেনা লাগে। চেহারাটা খুব পরিচিত তার। কে হতে পারে ভাবতে ভাবতেই হুট করে তার মনে হয়, আরে, এটা তো রাবীর ভাইয়া। সে চমকে যায়। হ্যাঁ, এটা রাবীর। তখন রাবীরের দাঁড়ি ছিলনা। একদম ক্লিন সেইপ ছিল বলে প্রথমে বোঝা যাচ্ছিল না। আশ্চর্য, উনারা দুজন এভাবে কবে ছবি তুলেছেন। দুজনের মুখেই চওড়া হাসি। যেন একজন অন্যজনের ভীষণ আপন। রিতা ব্যাপারটা বুঝতে পারে না।

তাই সে ছবিটা নিয়ে দ্রুত নিচে নামে। খালাকে খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে যায়। খালাকে জিজ্ঞেস করে,
‘খালা, এই ছবিতে এই ছেলে দুজন কে?’
খালা ছবিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে। পরে হেসে বলে,
‘চিনতে পারেন নাই?’
‘না।’

‘আপনার শোয়ামি গো মা।’
‘আর সাদরাজের সাথের জন কে?’
খালা হাসলেন। বললেন,
‘উনি? উনি তো আপনার শোয়ামির খুব কাছের মানুষ।’
‘কে খালা, বলেন।’
‘রাবীর খান।’

রিতা অবাক হয়ে আবার ছবিটা দেখে। জিজ্ঞেস করে,
‘উনারা এই ছবি কখন তুলেছেন?’
‘এডা অনেক আগের ছবি। উনারা তহন ভার্সিটিত পড়তেন।’
‘আচ্ছা, উনারা কি দুজন বন্ধু ছিলেন?’
‘হ। খালি বন্ধু না; একজন অন্যজনের জানের জিগার আছিল। আহা, কী যে ভালোবাসতো একজন অন্যজনেরে।’
রিতা অবাক হয়ে বলল,

‘তাহলে উনাদের মধ্যে এত শত্রুতা তৈরি হলো কীভাবে? এখন তো উনারা একজন অন্যজনকে দুই চোখেও সহ্য করতে পারে না।’
‘কেমনে পারব? আমি কইছিলাম না, মানুষেরে দিয়া সব ভুল কাজ করায় শয়তান। উনাদের মাঝেও শয়তান আছিল। শয়তান আইয়া উনাদের সুন্দর সম্পর্কডারে ধ্বংস করে দিছে।’

শেষটা সুন্দর পর্ব ৩৯

‘খালা, আপনি আমাকে সবকিছু খুলে বলুন না।’
রিতা অস্থির হয়ে পড়ে। খালা বলে,
‘হে তো অনেক বড়ো ইতিহাস। এহন আমার অনেক কাজ। পরে কমু।’
রিতার বিস্ময় যেন এখনো কাটছেই না। সাদরাজ আর রাবীর একসময় বন্ধু ছিল?

শেষটা সুন্দর পর্ব ৪১