অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু তুমি পর্ব ৩৮

অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু তুমি পর্ব ৩৮
সুমাইয়া সানজুম ঐশী

_কিন্তু এরকম বা*জে এম এম এস গুলো আঁধার ভাইয়ার কাছে পাঠালো টা কে!তাছাড়া যেদিন তোকে ভাইয়া থা*প্পড় মেরেছে ওইদিন ও নিশান আর তোর কতগুলো চিপ*কে থাকা ছবি ভাইয়ার কাছে আসে। হয়তো ভাইয়া সেগুলো দেখে রে*গে গেছিলো। পরে ভাইয়া আমার কাছ থেকে জানতে পারে তুই ওই জামা পরে আমার সঙ্গেই শপিং এ গিয়েছিলি।কিন্তু এডিট করে ভিডিও আর ছবি এগুলো ভাইয়ার কাছে পাঠাচ্ছে কে?

আলো আপুর প্রশ্নে আমিও চিন্তায় আছি।আমার সাথে তো কারো তেমন গভীর শ*ত্রুতা নেই।তাহলে কে করবে!আমার ভাবনার মাঝেই আলো আপু আবার বলল,
_দেখ পাটকাঠি,আমি সরি।আমি চেয়েছিলাম ভাই আর তোর মাঝে সব ভুল বুঝা বুঝি দূর করতে কিন্তু হিতে বিপরীত হবে এটা ধারণা ছিলো না।আমাকে মাফ করে দিস।আর নিদ্রা আপুর ও দো*ষ নেই।উনি তো আমার সাথে তাল মিলিয়েছে।প্লিজ ক্ষমা করে দে। আমি না ননদিনী! এতটুকু তো করতেই পারিস!প্লিজ, বিশ্বাস কর এরপর আর মিথ্যা বলবো না।নোরা ফাতেহির কসম!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আপুর লাস্ট কথায় আমি ফিক করে হেসে দিলাম। নীল ভাই আর আপু একই রকম। হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
_তো তুমি এখানে এলে যে?
__ভাই বলেছে আসতে। তুই একা। তাই তোর সঙ্গ দেওয়ার জন্য।
_তোমার ভাই আমাকে এভাবে আ*টকে রেখেছে কেনো বলতে পারো?আর কতদিন এই নাটক দেখাবে সে?
আমার কথায় আলো আপু আমার হাত ধরে বললেন,

__তুই তো জানিস ভাইয়ের রা*গ সম্পর্কে। রাগের বসে একটু ভুল করেই ফেলেছে।তাছাড়া তুই যদি নিজের সম্পর্কে ফাল*তু শব্দ ইউজ না করতি তাহলে ভাই চ*ড় দিতো না।তোর জায়গায় আমি কথাটা বললে ভাই আমাকে আরও বেশি শাসন করতো। আর তুই তো বউ, তুই ভুল করলে রাইট আছে ভাইয়ের শাসন করার। ঐশী, দেখ ভাই তোকে ভীষণ ভালোবাসে।আমি দেখেছি তার চোখে তোর জন্য অনুভূতি। তাহলে তুই কেন বুঝছিস না?এবার ক্ষমা করে দে ভাইকে।একটা চান্স তো দিতেই পারিস।

আপুর কথা গুলো আমাকে ভাবাচ্ছে।তাকে ক্ষ*মা করে দিবো!কিন্তু আমি তো দো*ষী ছিলাম না।তাহলে কেন আমিই শুধু ভুক্ত*ভোগী হয়েছি!!সত্যিই কি সে আমায় ভালোবাসে??নাকি অভিনয় করছেন! আঁধার নিজেও বলেছেন সে নাকি আমায় ভালোবাসেন। আবার,আমিই নাকি তার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা। কিন্তু কিভাবে সম্ভব! আমি তো উনাকে আগে কখনো দেখি নি।চিনিও না।এই প্রশ্ন গুলোর দরকার!

_তুমি আবারও পালানোর চেষ্টা করছিলে? গতকালের ঘটনা তোমার মনে নেই? এভাবে নিজের ক্ষ*তি করে আমাকে শাস্তি দিতে চাইছো তুমি?
তার কথায় আমার হাত থেকে গিট দেওয়া পর্দা দুইটা পড়ে গেলো।উনি আবার উল্টো কিছু ভাবছেন নাকি!আমি আমতাআমতা করে বললাম,
_নাহ,আপনার ভুল হচ্ছে।আমি ত,,তো
আমাকে বলতে না দিয়েই সে বলল,

_মিথ্যে বলছো!একবার রাস্তায় বোকা বানিয়েছিলে।আবার ও তাই করার চেষ্টা করছো!
_আপনি শুধু শুধু ভুল ভাবছেন! আমি তো তেমন কিছুই করছি না।
আমার কথায় সে শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন

__শাস্তি দিতে চাইছো। এতো বার বলেছি আমার ভুল হয়েছে তারপরও শাস্তি দিতে চাইছো। তোমার প্রতি দুর্বল তাই বারবার সেই সুযোগ টা কাজে লাগাচ্ছো!চ*ড় মেরেছি তাই দূরে সরে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছো তাই না।ওকে ফাইন,আমি অপরাধ করেছি তাই শাস্তি আমার প্রাপ্য। কিন্তু তুমি নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কি দরকার! এই হাত দিয়ে মেরেছি না তোমায়?

তার কথায় আমি তার দিকে তাকালাম। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে পাশের ড্রেসিংটেবিল এর আয়নার সেই হাত দিয়ে ঘুশি দিলো।আমি ভয়ে কেপে উঠলাম কি করছেন উনি!
_এই হাতের শাস্তি পাওয়া উচিত। কঠিন শাস্তি পাওয়া দরকার।
একথা বলে তৃতীয় বার হাত নিবার আগেই আমি ধরে ফেললাম। কিন্তু তার শক্তির সাথে টিকে থাকতে পারছিলাম না।আমার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিতেই আমি তাকে জরিয়ে ধরে কেদে দিলাম। কেনো করলাম জানি না।তবে তার হাতের রক্ত একদম সহ্য হচ্ছিল না আমার। তাকে থামানো প্রয়োজন।কান্না মিশ্রিত স্বরে বললাম,

_থামুন প্লিজ, আমি সত্যিই পালাচ্ছিলাম না।আপনার এই অতিরিক্ত রাগের কারণেই আমি আপনার থেকে পালানোর চেষ্টা করি।আপনি না থামলে আমি এবার সত্যি সত্যিই চলে যাবো
আমার কথায় যেন কাজ হলো। আঁধার একেবারে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে ছেড়ে দাড়ালাম। তার হাতের পিঠ চুয়ে রক্ত ফ্লোরে ঝরছে। এরই মাঝে সারভেন্ট আন্টি আসলো,

__একি আম্মা আপনে পর্দা গুলোসব নামাই ফেলছেন।ধন্যবাদ আম্মা,অনেক উপকার করলেন।
আন্টি সেগুলো নিয়ে যাওয়ার সময় ফ্লোর খেয়াল করে বললো,
_আল্লাহ,হাত কাটসেন কেমনে বড় বাবা!কত্ত র*ক্ত পড়তাছে।
তার কথার মাঝেই আমি বললাম,

_আন্টি,হাতের ওগুলো রাখুন ,তাড়াতাড়ি আমাকে ফাস্ট এইড বক্স টা খুঁজে এনে দিন।এখানে কোন জিনিস কোথায় আছে তা তো আমি জানিনা। কষ্ট করে একটু দ্রুত এনে দিন আর শেফালীকে বলুন দ্রুত এখনের কাচ গুলো পরিষ্কার করে ফেলতে।
আমার কথায় আন্টি দ্রুত গিয়ে ফাস্ট এইড বক্স এনে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

_নেন আম্মা, আমি শেফালী রে পরে পাঠামু নে।
আন্টি চলে যাওয়ার পর আমি তার হাত টেনে তুলো দিয়ে পরিষ্কার করতে নিলেই সে হাত সরিয়ে নিতে চাইলো। কিন্তু আমার অ*গ্নিদৃষ্টি দেখে আর কিছু না করে চুপচাপ আমার কান্ড দেখতে লাগলেন। তার হাত বেধে দিয়ে বললাম,

__এবার বিশ্বাস হয়েছে।বলছিলাম যে আমি পালাচ্ছিলাম না,তাও রাগ ঝাড়তেই হবে।
_এই হাত শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। আরো আগে করা উচিত ছিলো কাজটা করা ।এই হাত দিয়েই তো আমার প্রেয়সীকে আঘাত করেছি।
তার কথায় আমি সরে আসলাম। উনি প্রতিনিয়ত আমাকে তার প্রতি দুর্বল করে যাচ্ছেন।

ঘুমের মধ্যেই মনে হচ্ছে আমি হাওয়ায় ভাসছি।ঘুম হালকা হতেই চোখ খুললাম। তাকিয়ে আমি হতবাক! আমি উনার কোলে! এটা দেখেই আমি নড়েচড়ে উঠলাম,
__আরে আমাকে এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? নামান,,দ্রুত।
আমার কথায় সে তো আমার দিকে তাকালোই না বরং তার পায়ের কদম বাড়িয়ে দিয়েছে।
_আরে ভাই নামান? কই নিয়ে যাচ্ছেন?
বলেই আমি ছটপট করতে লাগলাম।

_আর একবার সাপের মতো মোচড়ালে এখুনি নিচে ফেলে দিবো।
এ কথা বলেই হাত আলগা করতেই আমি তার গলা ভালো ভাবে জড়িয়ে ধরি।সে আমাকে ছাদে এনে নামিয়ে দেয়
এরকম অন্ধকারে এতো রাতে উনি আমাকে ছাদে কি ভুতের কাছে পাচার করার জন্য এনেছে। উনি আমার কাছ থেকে সরে যেতে নিলেই আমি তার হাত চেপে ধরি,

_আরে আমাকে এভাবে ভুতের আস্তানায় রেখে আপনি চলে যাচ্ছেন যে!
উনি তার ব্যান্ডেজ করা হাত দিয়ে আমার হাত ধরেই সুইচের কাছে গিয়ে লাইট জ্বালানেল।
পিছনে ফিরতেই আমি চমকে উঠলাম। পুরো ছাদ লাইটিং করা।ছাদের মাঝ বরাবর অনেক গুলো লাভ সেইপের বেলুন। এখন এইসব আজাইরা কাজ কেনো করছেন সে।আমার ভাবনার মাঝেই সে আমার কাধে থুতনি রেখে বললেন,

মায়াদেবী
সবাই তো সুখ হয়!
তুমি আমার এক বুক কষ্ট হবে?
হৃদয়ের রক্তক্ষয়ী কষ্ট?
শেষ রক্তবিন্দু অব্দি আগলে রাখবো,
কি? হবে আমার কষ্ট?
হৃদয়ক্ষয়ী বিষন্নতা বিহীন সেই অমূল্য কষ্ট?
তার বলা প্রতিটা শব্দে আমি যেন ঘোরের মধ্যে আছি। আমার ঘোর কাটিয়ে সে বলল

__Happy birthday, sweetheart 💙
তার কথায় আমি এবার হুশে ফিরলাম।তারিখ মনে করলাম । বললাম
_আপনার ভুল হচ্ছে। আমার জন্মদিন জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে আজ নয়।
_তুমি এতদিন ভুল জানতে।তুমি আজকের এই দিনেই জন্ম নিয়েছিলে।
কি বলছে উনি!আমি আজকে কেমনে কি! হাত কেটেছে, মাথায় তো কিছু হয় নি।তাহলে এরকম আবোলতাবোল বকছে কেনো!!

এরই মাঝে সামনে তাকিয়ে দেখি আমার শশুর বাড়ির সব লোকজন, সাথে আব্বু -আম্মুও আছে।কিন্তু আম্মু আসলো!এতেই আমি ভীষণ অবাক হলাম।হঠাৎ উদয় আর আরাফ ভাইয়া এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এবার আমি হত-বিহবল। এবার তো আঁধার আমাকে থাপ্পড় এর ঝুড়ি সহ মারবেন। কিন্তু তিনি নিশ্চুপ, মুখে মুচকি হাসি। কোনো রিয়্যাকশন নেই।অথচ সেদিন নিশান এর সাথে দেখে কি পরিমাণ রাগ দেখালেন। গিরগিটি,লেজঝুলা বান্দর,হিটলার।

__ happy birthday, পিচ্চি।ফাইনালি তোকে পেয়ে গেলাম। আমার পিচ্চি ফুল।
উদয় ভাইয়া চোখের জল মুছে বললেন কথাটা। তাদের এই কথা গুলো পুরোপুরি আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।মেঝো মারও চোখে পানি।আমার সামনে এসে আমার কপালে চুমু খেলেন, জরিয়ে ধরেই শব্দ করে কেদে উঠলেন,
_আমার মেয়ে,আমার ফুল।তুই জানিস তোকে ছাড়া আমাদের দিন কীভাবে কেটেছে?আমরা তো তোকে পাওয়ার আশা ছেড়েই দিয়েছি।আমরা কীভাবে তোকে হারিয়ে ফেললাম, ফুল। আমার দোষে তুই হারিয়ে গেলি।আমি তোর কাছে দোষী রে মা।আমাকে ক্ষমা করে দে।

মেঝো মা আমার ছেড়ে দাড়াতেই মেঝো কাকা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আমি আমার আব্বুর দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে কান্না জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
_আব্বু উনারা কি বলছেন? আমি কি তোমার মেয়ে নই!
আব্বু আমার কথায় মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

__তুমি আজীবন আমার মেয়ে হয়েই থাকবে মা।কিন্তু এটা সত্যি আমি আর তোমার আম্মু তোমার প্রকৃত বাবা মা নই।উনারা ঠিক বলেছেন। তুমি তোমার মেজো মায়ের মেয়ে।উনারা তোমার আসল বাবা মা।তোমাকে ছোট বেলায় আমরা পেয়েছিলাম। যেটা এতদিন পর্যন্ত বাড়ির সবাই গোপন করেছিলো তোমার কাছে।তোমার গলায় ছোট বেলা থেকে যেই লকেট টা ছিল তা আমি দেই নি।ওটা আগে থেকেই তোমার গলায় ছিলো। সেটা দেখেই ধ্রুব আমার কাছ থেকে তোমার ছোট বেলার ছবি সহ বাকি ইনফরমেশন নেয়।

আব্বুর কথায় আমি অবাক হলাম। তাহলে এই কারণে মেজো মা আমার দিকে সেদিন একধ্যানে তাকিয়ে ছিলেন।
__আরে তোমরা আজকেই ফুল কে সব সারপ্রাইজ একসাথে দিয়ে দেবে নাকি!আগে ওকে কেকটা কাটতে দাও।ফুল কে পেয়েই গেছো।বাকি ইতিহাস বাসায় গিয়ে বোলো।নয়তো তোমাদের ইতিহাস শুনতে শুনতে কেক বাসি হয়ে যাবে।
দাত কেলিয়ে রোজা আপু কথা টা বললেন।
বেকার সমাজ কেক টেবিলে রেখে আমাকে ওখানে টেনে নিয়ে গেল।

কেক কাটার পর্ব শেষ করেই আব্বু আর আম্মু বিদায় নিচ্ছিলেন। আমি আব্বুকে জরিয়ে ধরে কান্না করে দিলাম। আমার আসল বাবা না হলেও ছোট থেকে উনাকে আমি আমার আব্বু-আম্মু দুটোই জেনেছি। আম্মু অবহেলা করলেও আব্বু কখনোই তা করেনি।যতক্ষণ পেরেছে আমায় সময় দিয়েছে।

_মা, এখন তোর সুখের দিন।ও বাড়ির মতো কেঊ তোকে আর এখানে অবহেলা করবে না।এতদিন এই বাড়ির মানুষ সব তোর নিজের ছিল আর এখন পুরোপুরি তোর আপন তারা।এর চেয়ে বেশি আর কি হতে পারে বল!সামথ্য থাকার পরও তুই কষ্টে মানুষ হয়েছিস।আমাকে ক্ষমা করে দিস, মা।

আম্মু আব্বুকে আমার থেকে ছাড়িয়ে নিজে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন,আমি এবার অবাকের চূড়ান্ত পযার্য়ে আছি।আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরলেন! যিনি আজ পর্যন্ত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন নি।আমাকে দেখলে গা ঘিন ঘিন করে দূরে সরে দাড়াতেন।দুইদিন আগেও নিচুস্তরের নিকৃষ্ট বাক্য শুনাতেও পিছপা হননি। আর আজ উনি!তবে কি আম্মু বদলে গেছেন।

অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু তুমি পর্ব ৩৭

__ঐশী মা, আমার। নতুন বাবা মা পেয়ে আমাদের ভুলে যাইস না।আমি তোকে ছোট বেলা থেকে কত কষ্ট করে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি।নিশু আর তোর মাঝে কখনোই বিভেদ তৈরি করিনি।সবসময় তোকে আগলে রেখেছি।তোকে নিজের মেয়ে থেকেও বেশি ভালোবেসেছি।

অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু তুমি পর্ব ৩৯