ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৭

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৭
সাইয়্যারা খান

রোদকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে আদ্রিয়ান। ঘুমাতে পারছে না রোদ। অসস্তি’তে এখন ওর কান্না আসছে। ছটফট করছে বারবার। আদ্রিয়ানের সামনে যতটা পারছে নিজের অসুস্থতা লুকানোর বৃথা চেষ্টা করছে। এই আদ্রিয়ান রোদকে কিছু হলে সহ্য করতে পারে না আর রোদ নিজের ব্যাথা দাঁত চেপে সহ্য করলেও আদ্রিয়ানের অস্থিরতা সহ্য করতে পারে না।

এমনিতেই ইদানীং আবার বুকে ব্যাথা হয় হালকা আদ্রিয়ানের। রোদের সব দিকে খেয়াল রাখবে অথচ নিজের বেলায় শূন্য। রোদ বলে বলে মেডিসিন খাওয়ায়। নিজের প্রতি কেমন অনীহা লোকটার। মুখটা তুলে একবার তাকিয়ে দেখলো নিজের স্বামী’কে। কয়জন স্বামী এমন হয় জানা নেই রোদের। এতদিন জেদ ধরে থাকলেও এখন রোদ দিন দিন ভীতু হয়ে থাকে। রোদের কিছু হলে আদ্রিয়ান আর বাচ্চা’রা যে বাঁচবে না এটা ওর ঢের ভালো বুঝা হয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই যে আদ্রিয়ানের উদাম বুকে মাথা এলিয়ে বসে আছে রোদ। এত রাতে কয়জন স্বামী স্ত্রী’র অবস্থা ভেবে এমন ভাবে ঘুম বাদ দিয়ে বসে থাকবে? রোদ দেখে ওর আদ্রিয়ান’কে। ভালোবাসা’কে। ফর্সা লোকটার চোখ দুটো গর্তে পড়ে গিয়েছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। রাত গুলো যে লোকটা তাহাজ্জুদেই কেঁদে কেঁদে কাটায় তার সাক্ষী বহন করে আছে চোখ জোরা।

অথচ রোদের সামনে যথাসম্ভব নিজেকে সামলে চলে আদ্রিয়ান। ড.মিহা যখন থেকে বলেছে রোদ’কে স্ট্রেস থেকে দূরে রাখতে তখন থেকেই আদ্রিয়ান রোদে’র সামনে সামলে চলে। রোদ হাত বাড়িয়ে আদ্রিয়ানের বড় বড় দাঁড়িতে বুলিয়ে দিলো। এতদিন একটা সাইজে ছিলো দাঁড়িগুলো। এখন কেমন অগোছালো আর বেসাইজ হয়ে আছে। দাঁড়ি নাড়তে নাড়তেই রোদ মিনমিন করে বললো,

— দাঁড়ি যাতে কাল সাইজ পাই। আমার কত পছন্দের এগুলো। এমন জংগল কেন বানিয়েছেন? গোফ রাখলে তো রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর লাগবে একদম।
বলেই হালকা হাসলো রোদ। আদ্রিয়ানের চুপসে যাওয়া গালে মুখ বাড়িয়ে চুমু খেয়ে বললো,
— আপনি ঘুমান।
— আগে তুমি ঘুমাও।
রোদ জানে ও না ঘুমালে আদ্রিয়ান ও ঘুমাবে না। না পেরে বললে,

— চলুন বেডে।
আদ্রিয়ান রোদ’কে ধরে উঠালো। রুমে রোদের অসস্তি লাগাতেই বারান্দায় বসে ছিলো এতক্ষণ। বিছানায় শুয়ে ও ঘুমাতে পারছে না রোদ। ওর এখন উপুড় হয়ে ঘুমাতে মন চাইছে। অনেক দিন সেভাবে ঘুমানো হয় না। ওর মনে হচ্ছে ওভাবে ঘুমাতে পারলে হয়তো শান্তি পেত। যেই ভাবা সেই কাজ অল্প করে কাঁত হয়ে সেভাবে ঘুমাতে চেষ্টা করছে রোদ। ওমনি ধমকে উঠলো আদ্রিয়ান। মাত্র ওয়াসরুম থেকে বের হতেই রোদকে ওভাবে শোয়ার চেষ্টা করতে দেখেই ধমকটা দিয়েছে। ধমক খেয়েই রোদ সোজা হয়ে শুয়ে পরলো। আদ্রিয়ান এগিয়ে এসে বললো,

— কি করছিলে?
— কই?
— মাইর খাবা রোদ। মাথা খারাপ হয়েছিলো। উবুড় হচ্ছিলে কেন হ্যাঁ?
কাঁদো কাঁদো গলায় রোদ বললো,
— ঘুম আসছে না। এভাবে অসস্তি লাগে। কি করব? ক্ষুধা লেগেছে কিছু অনুন, যান খাই একটু। পুচকে দুটো কান্না করছে ক্ষুধায়। দৌড় দিয়ে কিছু নিয়ে আসুন। ভাগ মিলখা ভাগ!

বলেই হাসতে লাগলো রোদ। আদ্রিয়ান আড় চোখে তাকালো। পরপরই গটগট করে বেরিয়ে গেল। আদ্রিয়ান যেতেই রোদের হাসি মিলিয়ে গেলো। এভাবে না বললে এখন অস্থির হতো আদ্রিয়ান। রোদ যথাসম্ভব লুকাতে চায় কিন্তু পারে না। চোখ গলিয়ে পানি পরলো কয়েক ফোঁটা। এত ভালো কিভাবে বাসে আদ্রিয়ান? এত ভালোবাসা সইবে কি রোদের কপালে? হারিয়ে যদি যায় তখন কিভাবে সামলাবে আদ্রিয়ান নিজেকে?

ওর ভাবনার মাঝেই হাতে গরম গরম শর্মা নিয়ে ডুকলো আদ্রিয়ান। রোদ খাবে বলেই বাসায় বানানো হয়েছিলো অথচ বিকেলে এক কামড় খেয়েই বমি করেছিলো আর খাওয়া হয় নি।
রোদ বসে বসে খাচ্ছে পাশেই জুস হাতে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান। পরপর চারটা শর্মা খেয়ে জুসটাও খেয়ে বড় একটা ঢেকুর তুললো রোদ। আদ্রিয়ান হাত বাড়িয়ে ওর মুখটা যত্ন করে মুছে দিলো। পাঁচ মিনিট ধরে ধরে হাটালো নাহলে খাবার পুরো পুরি হজম হবে না ওর।

বেশ সময় নিয়ে রোদকে বুকে নিয়ে আদর করে চুলের ভাজে হাত বুলিয়ে দিলো আদ্রিয়ান। রোদের তাতেও ঘুম আসছে না। পেটে মিঠা মিঠা ব্যাথা করছে। নিজেই পেটে হাত বুলাচ্ছে ও। তা দেখেই অন্ধকারে আদ্রিয়ান বুঝে গেলো। হাত গলিয়ে দিলো রোদের ঢোলা পোশাকের ভিতর। আলতো হাতে আদর দিলো সারা পেটে। একসময় গিয়ে ঘুমালো রোদ। আদ্রিয়ানের চোখে অকারণেই পানি চলে এলো। একটু যন্ত্রণা কি স্ত্রী থেকে ভাগ করে নেয়া যায় না? কেন যায় না? অচেতন মন বারবার এটাই বলে উঠে। আদ্রিয়ানের হঠাৎ পুরোনো কিছু মুহূর্ত মনে পরলো। যদিও ও এগুলো মনে করে না তবুও জীবনের সবচেয়ে করুণ মুহূর্তগুলো তো আর চাইলেই ভুলা যায় না।

মাইশা যখন মিশিকে রাখতে রাজি হয়েছিলো তখন খুশির ঠিকানা ছিলো না আদ্রিয়ানের। তখন তো ওর হাত টান ও অল্প সল্প। নতুন নতুন ব্যাবসা। চাইলেই বেশি টাকা উঠাতে পারতো না। তবুও কিছুতে কমতি রাখে নি। রোজ হাত ভরে নিয়ে আসত। মাইশার পেট ছুঁয়ে একটু নিজের প্রথম অস্তিত্বকে নিজের স্পর্শ দিতে চাইতো কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি। হবে কিভাবে? মাইশা ছুঁতে দিলে তো?

খাটের এক কোণায় মিশান’কে বুকে নিয়ে ঘুমাতো আদ্রিয়ান অন্যদিকে মাইশা। দেখতে দূরত্ব অল্প মনে হলেও ছিলো সেটা হাজার মাইল। মাইশার অবশ্য তেমন ভোগান্তি হয় নি। যেহেতু দ্বিতীয় বার ছিলো তাই মাইশা কিছুটা এক্সপিরিএন্স ও ছিলো। আদ্রিয়ান তো তখন নব যুবক। হাজার হলেও প্রথম সন্তান কিন্তু মাইশা কোনদিন সেভাবে অনুভব করতে দেয় নি। আদ্রিয়ান ই যেচে পড়ে এটা ওটা এনে খাওয়াতে।হাত পা টিপে দিতো। কষ্ট গুলো হয়তো তখন বেশি ছিলো যখন আদ্রিয়ানের ই স্ত্রী তার সন্তান নিজের ভেতর ধারণ করে পর পুরুষের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতো। যদিও মাইশা ফ্রেন্ড বলত কিন্তু আদ্রিয়ান তো জানতো সেটা কি ছিলো।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রোদের কপালে চুমু খেয়ে আবার পেটে চুমু খেল আদ্রিয়ান। উঠে ওযু করতে গেলো। এই ই আছে যেটা আদ্রিয়ান পারে। নামাজে দীর্ঘ সেজদায় সেই স্থান ভেজাতে থাকে আদ্রিয়ান। প্রতিটা মোনাজাত এখন শুধু তিনটা প্রাণের ভিক্ষা চায় আদ্রিয়ান। ওর মনে হয় তিনটা প্রাণ না বরং ছয়টা প্রাণ। তাই তো এত আঁকুতি মিনতি সব আল্লাহর নিকট।

সারারাত ঘুমাতে পারে নি রাতুল। দিশা ছাড়া ঘুম ধরা দিচ্ছে না। মেয়েটার ঘ্রাণ ছাড়া এখন থাকাটাই দায় যেন। বিরক্তিতে “উফ” উচ্চারণ করলো রাতুল। উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে উঁকি দিলো শশুর বাড়ী যদিও জানে দিশা বাসায় নেই। আছে হসপিটালে।

দুধের মধ্যে খেজুর দিয়ে সেটা ফুটিয়ে গ্লাসে ঢাললো আদ্রিয়ান। গর্ভবতী অবস্থায় এটা খুবই উপকারী খাবার। যারা নরমাল ডেলিভারি করতে ইচ্ছুক তাদের জন্য আরো বেশি উপকারী। রোদ তখন রুমে মিশিকে খাওয়াচ্ছে। খাবার হাতে বসে আছে মিশান। সে ও আজ মায়ের হাতে খাবে। তাই দুই ভাই-বোন খাবার নিয়ে রুমে এসেছে। মিশিকে খাওয়াতে খাওয়াতে মিশানের পড়াশোনার খবর নিলো রোদ।

মিশির খাওয়া হতেই পাশ থেকে এলফাবেট এর পাজেল ধরিয়ে দিলো সলভ করার জন্য। খেলার ছলে এখন মিশি অনেক শব্দ শিখেছে। মায়ের মুখে মুখে আরবি ও শিখেছে। এতটুকুন মেয়ে অথচ মেধা দারুণ। মিশির শেষ হতেই মিশান এসে রোদের হাতে প্লেট ধরিয়ে দিলো। রোদও মন খুলে গল্প করতে করতে ছেলে’কে খাওয়াচ্ছে। কে বলবে দু’জনের বয়সের পার্থক্য খুবই নগন্য। ওদের কথার মাঝেই আদ্রিয়ান ট্রে হাতে রুমে ডুকলো। ওকে দেখেই রোদ মুখ কুচকালো কিন্তু কিছু বললো না। একমনে মিশান’কে খাওয়াচ্ছে। আদ্রিয়ান পাশে বসে আছে। মিশানের যেতেই ও রোদের সামনে দুধের গ্লাস’টা এগিয়ে দিলো। রোদ মাথা নেড়ে বললো,

— দেখুন দুই একদিন ফাইন কিন্তু রোজ রোজ সকালে এই ছাতার মাথা আমার ভালোলাগে না।
— খেতেই হবে। ধর।
— মাদার্স হরলিক্স দিন।
— ওটা সন্ধ্যায়।
— প্লিজ।
— সোনা জেদ করে না। এটাই খেতে হবে। বেবিদের জন্য। ওদের দরকার এটা।

একদম নিশানায় তীর মারলো আদ্রিয়ান। ও জানে এই কথা বলে রোদকে দিয়ে সব করানো যায়। হলোও তাই। রোদ মুখ ভোতা করে গ্লাস’টা হাতে তুলে নিলো। মুখে দেয়ার আগেই “ওয়াক” “ওয়াক” করে উঠলো। আদ্রিয়ান ওকে ধরে বললো,
— মধু মিশিয়ে দিব?
— এই না না। এভাবেই খাব।

বলে নাক চেপে কয়েক ঢোকে খেয়ে নিলো। মিশান হা করে তাকিয়ে আছে। ও বুঝে না যেখানে মা ওদের’কে কত বাহানা দিয়ে ধমকে ধামকে দুধ খাওয়ায় সেখানে নিজে খেতে নিলেই বাহানা শুরু। আদ্রিয়ানের কল আসাতে ও ফোন নিয়ে বারান্দায় গেলো। মিনিট পাঁচ এক পর আসতেই এক দৃশ্যে চোখ আটকালো। রোদ বেডে পা ছড়িয়ে বসে আছে আর মিশান ওর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। আদ্রিয়ান অবাক হয় এটা ভেবে যে রোদ কিভাবে আদর আদায় করে নেয়? ছোট নেই বড় নেই এই মেয়ে আদর আদায় করে নিবে।

গাড়িতে বসেই এক মনে জিলাপি খাচ্ছে রোদ। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকেই রোজ খাচ্ছে ও। এতটা ক্রেভিং কখনো ছিলো না জিলাপির প্রতি ওর কিন্তু এখন রোজ লাগবেই তাও গরম গরম। নিজের খাওয়ার মাঝেই আবার আদ্রিয়ানের মুখে ও ডুকিয়ে দিলো দুই একটা। আঙুল চেটেপুটে খেতেই আদ্রিয়ান গাড়ি সাইড করে বোতল এগিয়ে দিলো। রোদ ও জানালা খুলে হাত ধুয়ে নিলো।

হসপিটালে পৌঁছাতেই হঠাৎ করে ইয়াজের সামনে পরলো রোদ। কিছু বলার আগেই ইয়াজ মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। রোদের নাকের পাটা ফুলে উঠলো। কান্না আসছে ওর। আবেগে পরে মানুষ কত কিছুই তো করে সেখানে নাহয় রোদ ও একটা ভুল করেছে তাই বলে ইয়াজ এমন করবে? এত বড় পেট ওর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না তাই আদ্রিয়ান ওকে ধরে বসিয়ে দিলো। এদিকে রুগী অনেক। ওদের সিরিয়াল মে’বি আরো একটু পর। গরম লাগছে রোদের যদিও এসি অন৷ মুখের নেকাব’টা খুলতে চাইলেই আদ্রিয়ান বাঁধা দিলো। ভয় পায় আদ্রিয়ান যে সুন্দর হচ্ছে রোদ যদি নজর লেগে যায়? সবাই তো আর মাশআল্লাহ বলে না। তখন? এই চিন্তায় ও রোদকে নেকাব খুলতে দিবে না। পাশে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। হঠাৎ একজন নার্স এসে মিষ্টি হেসে বললো,

— স্যার আপনাদের ড.ইয়াজের কেবিনে যেয়ে রেস্ট নিতে বলা হয়েছে।
— লাগবে না। এখানেই ঠিক আছি।
কথাটা রোদ বলে উঠলো। নার্স আরো দুই একবার বলেও লাভ হলো না। নার্স যেতেই আদ্রিয়ান বললো,
— তোমার সুবিধা হতো কেবিনে।
— ঠিক আছি আমি৷
তখনই গটগট পায়ে ইয়াজ এসে আদ্রিয়ান’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

— ভাই আমার কেবিনে চলুন প্লিজ নাকি এতটুকু অধিকার ও আমার নেই?
কথা বলার সময় একটা বারও রোদের দিকে তাকায় নি ইয়াজ। আদ্রিয়ান রোদ’কে ধরে উঠালো। ভারী শরীরটা নিয়ে রোদের উঠতে কষ্ট ই হয়। ইয়াজ একবার ধরতে চাইলো পরপরই কিছু মনে পরাতে ঘুরে দাঁড়ালো। সবসময়ের চঞ্চল, খুশি ছেলেটার চোখে পানি জমা হলো। সকলের অগচড়ে সরে ও গেলো।

রোদ নেকাবটা খুলে বসলো। তখনই নার্সের হাতে ফ্রুট জুস পাঠায় ইয়াজ। রোদ রুক্ষ কন্ঠে বললো,
— ড.ইয়াজকে বলুন তিনি যদি না আসে তাহলে খাব না।
পিছনে ইয়াজ দাঁড়িয়ে নার্সের হাত থেকে গ্লাসটা নিজের হাতে নিলো। এগিয়ে দিলো রোদের দিকে। রোদ নিলো। ইয়াজ মুখ নামিয়ে আছে। রোদের দিকে তাকায় না ও। এতসবে আদ্রিয়ানের মনে হয় ও নিজে দোষী এমন একটা পরিস্থিতির জন্য।

আজকে রোদের ইনজেকশন নিতে হবে সেটা শুনার পর থেকেই ওর হাত-পা কাঁপছে। আলট্রা’তে আজ প্রথম দুইজন বেবিদের দেখেছে। একদিকে রোদ কেঁদেছে তো একদিকে আদ্রিয়ান। ছোট্ট ছোট্ট দুটো পুচকু। হার্ট বিট ও আজ শুনেছে ওরা। রোদের কিছু টেস্ট করানো হয়েছে। এরমধ্যে ডায়াবেটিস টেস্ট ও ছিলো। সেটা দেখেই ড.মিহা’র মাথায় হাত। ভরা পেটে রোদের ডায়বেটিস এগারো। তিনি শুধু জিজ্ঞেস করলেন,

— রোদ মিষ্টি কিছু খেয়েছিলে আসার আগে?
রোদ কিছু বলার আগেই আদ্রিয়ান বললো,
— হ্যাঁ জিলাপি খেয়েছে ঘন্টা খানিক আগে। কেন? এনিথিং রং? ডায়াবেটিস এর পয়েন্ট কত?
উত্তেজিত হচ্ছে আদ্রিয়ান কিছুটা। ড.মিহা ওকে শান্ত হতে বলে বললেন,
— রিল্যাক্স মি.জোহান। প্রেগন্যান্সিতে অনেকের ই ডায়াবেটিস হাই হয়ে যায়। কারো কারো প্রেশার হাই হয়ে যায়। ইটস টোটালি ফাইন।

— কত পয়েন্ট ডায়াবেটিস?
কথাটা জিজ্ঞেস করেই আবার ইশারা করলো কিছু। ড.মিহা কিছুটা অবাকও হয়। আদ্রিয়ান রোদের কোন সমস্যা ই রোদের সামনে বলতে দেয় না। হোক সেটা ছোট বা বড়। ড.মিহা নার্স’কে ডেকে রোদ’কে ধরে বাইরে পাঠালো। রোদ প্রতিবার যাওয়ার সময় একটু ঘাড় তেড়ামি করে কিন্তু সেটা আদ্রিয়ানে’র সামনে টিকতে পারে না। রোদ যেতেই ড.মিহা বলা শুরু করলো,

— ওর ডায়াবেটিস এগারো। ইটস মাচ হাই। আর র*ক্তে হিমোগ্লোবিন তো আগের ই কম ছিলো এখন আরো কমেছে। এজন্য ই মাথা এত ঘুরাচ্ছে। ওর তো এনিমিয়া আগেরই ছিলো সেটা এখন বেড়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আজ’কের আলট্রা।
আদ্রিয়ানের শ্বাস আটকে আসছে। ড.মিহা বুঝলো। ভরসার স্বরে বললো,

— আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
— ভরসা আছে। আপনি বলুন।
— বেবিদের গ্রোথ ঠিক নেই। এই সময়ে যতটা গ্রোথ থাকার কথা তার থেকে অনেকটা কম। সাধারণ টুইনদের ক্ষেত্রে এমনই হয় বাট আপনার বেবি দুটোরই গ্রোথ খুবই কম। অনেকটা দূর্বল ওরা। আর রোদের সমস্যা এতদিন যা যা ছিলো তা খুবই কম ছিলো ওর অবস্থা অনুযায়ী। সামনের গুলো বলতে পারছি না। আশা করি ভালো হবে। বাট সি নিড প্রপার বেড রেস্ট। মেন্টালি ও চাপ নেয়া যাবে না।

— ওর মেডিক্যাল আছে। পড়াশোনা আছে।
— আ’ম সরি টু সে বাট ওর অবস্থা তেমন নেই। আমি আগেই বলেছিলাম সাফার করতেই হবে। রোদ এখন কতটুকু সহ্য করতে পারবে বা ওর বডি কতটুকু নিতে পারবে সেটা আ’ম নট সিউর। নতুন ডায়েট চার্ট দিচ্ছি। স্টিল বলছি ইটস ক্রিটিকাল। মাচ রিস্কি মি.জোহান।

আদ্রিয়ান ভালো করেই জানে ড.মিহা কি বলতে চাইছে। সব ডক্টর’রা এটাই বলেছে। বড় বড় শ্বাস টেনে নিজেকে সামলে নিলো আদ্রিয়ান। ভাঙলে চলবে না। টুকটাক আরো কথা বলে কেবিন থেকে বের হলো ও। রোদ এখানে নেই। তাই হেটে গেলো ইয়াজের কেবিনে। সেখানেই রোদ সাথে একজন নার্স আছে অবশ্য। আদ্রিয়ান এগিয়ে গিয়ে রোদকে আগলে নিলো। উঠে বাইরে যাচ্ছে ওরা। রোদের মন খারাপ দেখে আদ্রিয়ান জিজ্ঞেস করলো,

— মন খারাপ কেন?
রোদের কান্না আসছে। তবুও বললো,
— ইয়াজ’কে ডাকলাম আবারও। ও জবাব দিলো না। আমার ভালোলাগছে না।
— ঠিক হয়ে যাবে। সময় দাও।
— ও কখনো আমার সাথে এমন করে নি।
আদ্রিয়ান কিছু বললো না আর। ইয়াজ রোদ থেকে আঘাত টা ভালোই পেয়েছে। যেখানে অধিকার আর ভালোবাসা বেশি সেখানে রাগটাও বেশি।

হসপিটালে একেবারে রাদ আর জাইফার বাবুর সাথে কিছু সময় কাটিয়ে রোদকে নিয়ে বিদায় হলো আদ্রিয়ান। কাল অবশ্য জাইফার রিলিজ হবে যেহেতু নরমাল ডেলিভারি। সকালে রাতুল এসেছিলো দিশা দূর থেকে দেখেই সরে গিয়েছিলো। যার নিকট তুমি মূল্যহীন তার নিকট নিজেকে প্রদর্শন করা আর নিজের অমর্যাদা করা একই কথা।
রাতুল বার কয়েক দিশার কথা জিজ্ঞেস করলেও তেমন কিছু জানতে পারলো না কারণ দিশা তখন সেখানে উপস্থিত ছিলো না। রাতুলের মনের কোথায় একটু যেন চিনচিন করেছিলো যেটা ছিলো খুবই তীক্ষ্ণ।

জারবা’র ফোন বাজতেই মিশান গলা উঁচিয়ে বললো,
— পুত্তি তোমার কল আসছে।
জারবা মাত্রই রুম থেকে বের হয়েছিলো। মূলত সব বাচ্চাদের নিয়ে মুভি দেখছিলো ও। কিচেন থেকে ড্রিংক্স আনতে যেতেই মিশানের ডাকে তেঁজী গলায় বললো,
— মিশাইন্না ঠিক করে ডাক। কে কল করেছে?
— পুত্তা কল করেছে।

এবার রেগে লাল হয়ে গেল জারবা। বোকা জারবার কথা ওকে নাহয় মিশান পুত্তি ডাকে সেটা কোনমতে পানি ছাড়া হজম করে নেয় জারবা তাই বলে জারবার একমাত্র হবু জামাই’কে মিশান পুত্তা ডাকবে? এ ও কি জারবার মানতে হবে? কান্না পায় জারবার। পুত্তা কেমন ডাক? ওর মনে হয় মিশান ওর জামাই’কে কুত্তা ডাকে। এসব ভেবেই রাগে বো’ম হয়ে হনহনিয়ে রুমে ডুকলো জারবা। ছেঁ মে’রে ফোন’টা নিয়ে বললো,

— এই পুত্তা ডাকবি না মিশাইন্না।
— রেগে যাও কেন?
— বল ডাকবি না।
— আরে এখানে আসো।
বলে জারবাকে নিজের পাশে বসালো। নিজের আধ খাওয়া চকলেটটা জারবাকে দিয়ে বললো,

— তুমি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তাই না?
— হু।
— আচ্ছা বলো তো রাদ মামা’র বউ মানে জাইফা ফুপ্পি’কে আমি কি ডাকি?
— মামি।
— তুমি আমার কি?
— পুত্তি।
— পুত্তির জামাই আমার কি?
— পুত্তা।

চকলেটটা মুখে চুষতে চুষতে বলে উঠলো জারবা। মিশান সহ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আরিয়ানও হো হো করে হেসে উঠলো। জারবা যখন বুঝলো ও কি বলেছে তখনই অতি রাগে,দুঃখে চলে গেল। এদিকে মিশান আর আরিয়ান হাসতে হাসতে শেষ। এই বোকা জারবাকে বাচ্চারাও বোকা বানিয়ে ফেলে।

কল ধরতেই জারবার নাক টানার আওয়াজ পেয়ে ইয়াজ দীর্ঘ হতাশার সুর ঢেলে বললো,
— কি হলো জারবা? কেউ কিছু বলেছে আমার বউ’কে।
–ইটস হবু বউ ফর ইউ।
বলে আবারও নাক টানলো। ইয়াজ এবার আরেকটু হতাশ হয়ে গেল। আফসোস করে বললো,
— ঐ দিন বিয়েটা সেরে নিলেই ভালো হতো। অন্তত বউ তো ডাকতে পারতাম।
অপরপাশ থেকে এবার ও নাক টানার আওয়াজ ই এলো। ইয়াজ সিরিয়াস করে বললো,

— বলো কি হয়েছে?
— মিশাইন্না আপনাকে পুত্তা ডেকেছে।
জারবার নাক টেনে বলাতে ইয়াজ ঠিক ঠাক বুঝলো না। আশ্চর্য হয়ে বললো,
— কু*ত্তা কেন ডেকেছে? আমি কু*ত্তা! এটা কেমন কথা জারবা? তোমার সামনে আমায় কু*ত্তা ডাকলো? ওরা মা-ছেলে আমাকে কি পেয়েছে। মা যা খুশি তাই বলে আর ছেলে ডাকে কুত্তা!

— আরে আরে থামেন। ইটস পুত্তা। পুত্তির হবু জামাই পুত্তা নট কুত্তা। বুঝেছেন?
— ওহ্। তাই বলো। ডাকটা খারাপ না। কিউট আর আনকমন ডাক। আমি তো আমার বাচ্চাদের ও বাবা না ডাকিয়ে বুত্তা ডাকাবো আর তোমাকে মুত্তা ডাকবে।
জারবা তীব্র নিন্দা জানালো ইয়াজের প্রস্তাবে। এক পুত্তি ডাকে ই ওর জান হারাম হয়ে আছে সেখানে কি না আরো এমন ডাক! ইয়াজ এবার হেসে দিলো। বোকা জারবা বুঝলো ইয়াজ দুষ্টামি করছে। সিরিয়াস হয়ে বললো,

— ছোট ভাবী’র সাথে কথা হয়েছে?
শক্ত গলায় ইয়াজ বললো,
— না।
— ছোট ভাবী কাঁদছিলো আপনার জন্য।
— অন্য কথা বলো।
— শুনুন না ছোট ভাবী….

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৬ শেষ অংশ 

টুটটুট শব্দ হলো। জারবা বুঝলো কল কেটে দিয়েছে ইয়াজ। হয়তো আঘাতটা জোরেই পেয়েছে ইয়াজ। নাহলে নরম মনের হাসিখুশি মানুষ এতটা রাগ কখনো করে থাকে না।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৭ শেষ অংশ