ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৬ শেষ অংশ 

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৬ শেষ অংশ 
সাইয়্যারা খান

অবশেষে দীর্ঘ নয় মাস তিন সপ্তাহ প্রতিক্ষায় অবসান ঘটিয়ে নিজের স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো ছোট্ট একটি প্রাণ। সে জানান দিচ্ছে পৃথিবীতে তার অবস্থান। ছোট্ট ছোট্ট হাত পা ছড়িয়ে কেঁদে যাচ্ছে সে। সবার প্রথম যার হাতে তাকে তুলে দেওয়া হলো সে হলো তার বাবা। অদ্ভুত ভাবে বাবা’র সানিধ্য পেয়েই চুপ করে গেলো সে। আদো আদো চোখ খুলে বাবা’কে দেখতে ব্যাস্ত সে। রাদ ঝুঁকলো। চুমু খেল ছেলের কপালে। মুখে আওড়ালো,

— মাশাআল্লাহ।
পাশেই জাইফা অর্ধ জ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম দরকার ওর। ড.মিহা হেসে রাদের পিঠ চাপড়ে বললো,
— ইউ হেব ডান ইট রাদ। আলহামদুলিল্লাহ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাদ একপলক মিহা’কে দেখে নিলো। নার্স এসে রাদের ছোট্ট ছেলেকে কোলে তুলে নিলো পরিষ্কার করার জন্য। রাদ এবার জাইফা’র কাপলে উষ্ণ স্পর্শ দিলো। নরমাল ডেলিভারি হয়েছে জাইফার। পুরোটা সময় রাদ ছিলো পাশে। স্ত্রী’র হাত ধরে সাহস জুগিয়েছে প্রতিনিয়ত। ক জন পুরুষ পারে এমন? রাদ পেরেছে। প্রিয়তমা’র পাশে থেকেছে। তীব্র যন্ত্রণায় যখন জাইফা ছটফট করছিলো তখন রাদ ই ছিলো যার কথায় সাহস পেয়েছিলো মেয়েটা। প্রথম মা-বাবা হয়েছে দুজন। খুশিতে রাদের চোখে পানি জমলো। কেবিন থেকে রাদ বের হতেই দেখলো নিজের সব আপনজনদের। শুধু নেই আদরের ছোট্ট বোনটি। আদ্রিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। রাদ খুশি মনে এগিয়ে এসে জানালো তার ছেলে হয়েছে এবং মা আর সন্তান দুজনই সুস্থ। সকলেই খুশি হলো।

“আমাকে দেখাও। কই? এই ফোন ধরেন ঠিক করে।”
হঠাৎ এমন আওয়াজে রাদের বুঝতে বাকি রইলো না তার পাগল বোন ভিডিও কলে আছে। রাদ হেসে এগিয়ে আদ্রিয়ান থেকে ফোন নিয়ে বললো,

— এখনো কেউ দেখে নি। আমি দেখেছি শুধু আর ডক্টর’রা।
— কখন দেখাবে?
রোদের বলতে বলতেই নার্স বাচ্চা নিয়ে হাজির। রাদ সবার আগেই রোদকে দেখালো। রোদ যে কতটা উচ্ছাসি তা হয়তো সকলেই আন্দাজ করতে পারলো। একে একে সবাই দেখলো। রাত হওয়াতে বাকিরা বাসায় ফিরে গেলো। থেকে গেলো দিশা,রাদের মা আর জাইফার মা। রাদ ছেলে আর বউকে নিয়েই ব্যাস্ত রইলো।

বাসার সবাই যে যার রুমে। আদ্রিয়ান এখনও আসে নি। কিভাবে আসবে? রোদের প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে আদ্রিয়ান বাসায় বেশি সময় দেয়। অফিসের কাজ বাসা থেকেই করে। যতটুকু না গেলেই না ততটুকু অফিসে গিয়ে করে আসে। মিটিং গুলো ভার্চুয়াল ভাবেই করে তবে সব তো আর বাসা থেকে সম্ভব না। এই কোম্পানির ষাট পার্সেন্ট আদ্রিয়ানের করা। বাকি চল্লিশ পার্সেন্ট ওর বাবা’র। যার মালিক ওরা তিন ভাই বোন।

আদ্রিয়ান সেখান থেকে নিবে না আগেই জানিয়েছে কিন্তু সমস্যা হলো আরিয়ান আপাতত ব্যাবসায় হাত দিতে চাচ্ছে না। সময় হচ্ছে না আর জারবা ছোট। না চাইতেও দায়িত্ব ঘুরে ফিরে আদ্রিয়ানের উপরই। ওর বাবা’র বয়স হয়েছে ইদানীং। উনি ও সব একহাতে সামলাতে পারেন না। তাই আদ্রিয়ানের অফিসে যেতেই হচ্ছে। নাহলে এই অবস্থায় নিশ্চিত ও বউ ছেড়ে নড়তো না।

রোদের হঠাৎ করেই পেটে ব্যাথা অনুভব হলো। মাত্রা বাড়তেই রোদের ঘাম ছুটে গেলো। আদ্রিয়ান থাকলে এখন একটু সুবিধা হতো। রোদের এখন এমন হয়েছে যে এক মুহূর্ত ও আদ্রিয়ান ছাড়া থাকা দায়। কাকে ই বা ডাকবে? ডেকেই বা কি হবে? দিন নেই রাত নেই এই ব্যাথা হয়েই থাকে। বাচ্চা দুটো যত বড় হচ্ছে ততই রোদের ভোগান্তি বেড়ে চলছে। মা হওয়া মোটেও সহজ কিছু না। রোদ তা হাড়ে হাড়ে টের পায় এখন। মাঝে মধ্যে হাসি পায় ওর। কোন এক সময় ও কাঁদতো কেন মা হতে পারবে না এটা ভেবে। ভুগেছিলো ডিপ্রেশনে। অথচ এখন ভুগে মাতৃকালীন যন্ত্রণায়। অদ্ভুত।

হঠাৎ কান্নার শব্দ পেলো রোদ। বুঝতে দেড়ী হলো না কার কন্ঠ এটা। পেটে ব্যাথা ও করছে। না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে গেল রোদ। দেয়াল ধরে ধরে সামনে হাটা দিলো। ইদানীং একা নিচে নামে না ও। আদ্রিয়ান ধরে ধরে নামায়। প্রয়োজন ছাড়া অবশ্য নামায় ও না। রোদ উঁকি দিয়ে দেখলো মিশি ফ্লোরে বসে কাঁদছে। আশেপাশে ও কেউ নেই। রোদ হাঁক ছেড়ে ডাকলো,

— মিশি।
মিশি শুনলো না। একমনে বসে কাঁদছে ও। উপায়ন্তর না পেয়ে সিড়ির রেলিং আঁকড়ে রোদ নামতে লাগলো। পেট যথেষ্ট উঁচু হওয়াতে নিচের দিকে ভালো দেখতে পায় না। মনে হয় এই বুঝি পরে গেলাম। এদিকে পেট ও ব্যাথা করছে। মাথা ঘুরাচ্ছে। ঘেমে উঠেছে রোদ। অনেক কষ্টে নিচে নামলো। একবার শাশুড়ী’কে ডাকও দিলো। সাড়া এলো না। হেঁটে হেঁটে বেশ সময় লাগিয়ে মিশির কাছে গেলো রোদ৷ এখন ঝুঁকা তো সম্ভব না। চেয়ার ধরে হাঁপাচ্ছে রোদ। এতদূর হেটে বেশ ক্লান্ত হয়েছে ও। তবুও আদর লাগিয়ে ডাকলো,

— মিষ্টু মা আমার উঠে আসো বাচ্চা। মা ঝুঁকতে পারছি না সোনা।
মিশি উঠছে না। ওর কথা পরে গিয়েছি এখন তো মায়ে’র কোলে তুলে নেয়ার কথা। তাহলে কেন মা নিচ্ছে না। রোদ একবার চেষ্টা ও করলো কিন্তু সম্ভব হলো না। আবারও বললো,

— মাম্মার কিশমিশ উঠে এসো মা। এই দেখো তেমার ভাই-বোন’রা ডাকছে তোমায়।
মিশি তাকালো একবার। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। রোদ হাত বাড়াতেই তা ধরে উঠলো মিশি। উঠেই হাত বাড়িয়ে দিলো মায়ে’র দিকে। মানে কোলে নাও। ব্যাথা পেয়েছে মিশি। এখন কোলে উঠা ফরজ কাজ ওর। রোদের নিজেকে অনেক অসহায় মনে হচ্ছে। কিভাবে কোলে তুলবে ও? তাই বললো,
— মা মাম্মার হাত ধর। চলো সোফায় বসে মাম্মা কোলে নিব।

মিশি যাবে না। ও এখনই উঠবে। রোদ এক হাত পেটে দিয়ে আরেকহাতে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে মিশি মায়ে’র কোমড় জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে। রোদ এবার রীতিমতো ভালো করেই হাঁপাচ্ছে। ওর মাথা ঘুরিয়ে যাচ্ছে। মিশি’কে ধরবে নাকি নিজেকে তাই বুঝতে পারলো না। আদ্রিয়ান ঠিক তখনই বাসায় ডুকলো। দরজা পর্যন্ত এসে মিশি’র কান্নার শব্দ শুনে বাকিটুকু আর হেটে না এসে কিছুটা দৌড়েই এলো।

ডুকেই এমন দৃশ্য দেখে আদ্রিয়ান চমকে গেলো। কয় ঘন্টা ই বা বাইরে ছিলো ও? তাতেই এই অবস্থা? রোদ চেয়ার ধরে হাঁপাচ্ছে আর মিশি ওর কোমড় জড়িয়ে কাঁদছে। ছুটে এলো আদ্রিয়ান। মিশিকে কোলে তুলে নিয়ে রোদের দিকেও হাত বাড়িয়ে দিলো। মিশি বাবা’কে পেয়েই অভিযোগ করলো মা কোলে তুলে নি তাকে।

সে ব্যাথা পেয়েছে। রোদ মাথা এলিয়ে দিলো আদ্রিয়ানের কাঁধে। আদ্রিয়ান পরলো বেকায়দায়। জোরে ডাক দিলো ওর মা’কে। হয়তো তিনি বাসায় নেই তাই আদ্রিয়ানের ডাকে জারবা আর মিশান বেরিয়ে এলো। রোদ ততক্ষণে শরীর ছেড়ে দিয়েছে। মিশিকে মিশান কোলে তুলে নিয়ে। রোদকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে আদ্রিয়ান রুমে হাটা দিলো। মুখে পানি ছিটিয়ে বার কয়েক ডাকলো। ক্লান্ত রোদ চোখ খুলে আবারও বুজে নিলো। আদ্রিয়ানের হাতটা নিজের বুকে চেপে নিলো। এই আদ্রিয়ান এখন যে কতটা অস্থির হয়ে আছে তা রোদ ছাড়া কে ই বা জানে?

রাতুল বাসায় ডুকলো বেশ রাতে। ডুকতেই ভ্রু কুচকে এলো ওর। খাবার টেবিলে দিশা নেই। রোজ তো থাকে। আজ কোথায়? তবুও ততটা না ভেবে রুমে ডুকলো। এখানেও না দেখে এবার রাতুল হাতের ব্যাগটা সোফায় ছুড়ে জোরে ডাক দিলো,

— দিশা! দিশা!
জবাব এলো না৷ রাতুল বিরক্ত হলো। শার্ট খুলতেও ভীষণ আলসেমি লাগছে ওর। ও আসলে তো দিশাই বোতাম খুলে দিতো। কোমড়ে হাত গুজে ওয়াসরুম,ব্যালকনিতে চেক করলো। না নেই। কিছুটা জড়তা নিয়েই মায়ে’র রুমের দিকে গেলো। মায়ে’র সাথে ভালোভাবে কথা হয় না অনেক সময় ধরে। তাই কিছুটা সঙ্কোচ নিয়েই নক করে বললো,

— আম্মু দিশা কি এখানে?
— না তো। কেনো?
— কোথাও নেই তো।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৬

কথাটা বলেই রাতুল সারা বাড়ী খুঁজলো। না পেয়ে কল করলো। দিশা ধরলো না। অস্থির হলো রাতুল।দিশা কোথায়? ওদের তো কোন ঝগড়া ও হয় নি। তাহলে? তিশা’কে কল দিতেই ও ধরলো৷ দিশা’র কথা জিজ্ঞেস করতেই তিশা জানালো দিশা হসপিটালে আছে জাইফার কাছে। রাতুল আচ্ছা বলে ফোন রাখলেও রেগে উঠলো এটা ভেবে কেন একবার বলে গেলো না। রাতুল কে কি একবার বলা যেতো না?

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪৭