ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪২

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪২
সাইয়্যারা খান

রোদের রিপোর্ট হাতে থম মে’রে বসে আছে আদ্রিয়ান। খুশি হবে না কাঁদবে তাই ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছে না যেন। এতটা অসহায় আদৌও ও কখনো ছিলো কি না জানা নেই। এদিকে ফোনটা বারবার বেজেই চলেছে। রিংটোনটা আদ্রিয়ানের কানে ডুকলেও রেসপন্স করার মতো শক্তি বা ইচ্ছে কোনটাই নেই যেন৷ ডক্টর ভেতরে রোদকে চেকআপ করছেন। ভয়ংকর কিছুর আভাস পাচ্ছে আদ্রিয়ান।

আদ্রিয়ানের আকাশ পাতলা চিন্তার মাঝেই কেউ এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর বুকে। আদ্রিয়ান ধরলো না। ধরার শক্তিটুকু ও পেলো না। ঠাই বসে আছে। চোখের পাতাটুকুও যেন নড়লো না। বুকের মাঝে ভেজা অনুভব হলো। সাদা শার্টটা ভেদ করেই প্রিয় মানুষটার অশ্রু কণাগুলো ওর বুক ভেজাতে সক্ষম হয়েছে। রোদ তখনও আদ্রিয়ানের বুকে মুখ গুজে নীরবে কেঁদে যাচ্ছে। আদ্রিয়ান যেন পাথর বনে গিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কি করবে? হারিয়ে যাওয়ার ভয় ওর শিরা উপসিরায় ছুটোছুটি করছে। হঠাৎ করে নিজের ঠোঁটে কারো ভেজা ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই যেন হুসে এলো আদ্রিয়ান। রোদ ততক্ষণে আদ্রিয়ানের ওষ্ঠাধর নিজের আয়ত্তে নিয়ে ফেলেছে। আদ্রিয়ান কিছু না বুঝে রোদের মাথার পেছনে হাত দিয়ে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে রাখলো। মত্ত হলো প্রেমসুধা পানে। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে আদ্রিয়ানই রোদকে ছাড়লো। এদিকটা আলদা থাকায় প্রাইভেসি পাওয়া গিয়েছে। রোদ আদ্রিয়ানের চুমু খেয়ে কান্না ভেজা গলায় বলে উঠলো,

— আই লাভ ইউ।
আদ্রিয়ান প্রতিত্তোরে প্রতিবারে যেটা বলে সেটা এবার বলা হলো না। নিজেও যে কতটা ভালোবাসে সেটা প্রকাশ করতে পারলো না। গলাটা ধরে আসছে যেন। তখনই ডাক্তার কেবিনে প্রবেশ করলো। ডক্টর মিহা যেহেতু রাদের ফ্রেন্ড সেই সাথে ঢাকা শহরের বেস্ট গাইনেকোলজিস্ট সেহেতু অন্য ডাক্তার দেখানোর প্রশ্নই উঠে না। ডক্টর মিহা বেশ চিন্তিত হয়ে চেয়ারে বসে আদ্রিয়ানকে বলে উঠলো,

— মি.জোহান আপনার সাথে কিছুকথা ছিলো।
আদ্রিয়ানের গলা শুকিয়ে কাঠ তখন। একটু পানির ভীষণ প্রয়োজন। রোদ আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই সেটা বুঝে ফেললো। এতদিনে যদি এতটুকু না বুঝে তাহলে কি হয়? ব্যাগ থেকে ওয়াটার বোতলটা বের করে আদ্রিয়ানকে দিয়ে বললো,
— একটু পানি খেয়ে নিন।
আদ্রিয়ান সাথে সাথেই নিয়ে একঢোকে প্রায় পানিটা শেষ করলো। কিছুটা ধাতস্থ করলো নিজেকে। রোদ আদ্রিয়ানের হাত টেবিলের নিচ থেকে ধরে আছে। ডক্টর মিহা জানে পরিস্থিতি কতটা খারাপ। নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে রোদের দিকে তাকিয়ে বললো,

— রোদ। বোন তুমি বাইরে একটু অপেক্ষা করবে আমি মি.জোহানের সাথে একটু কথা বলি।
রোদ হাসি মুখেই বললো,
— আমি থাকলে কি সমস্যা?
আদ্রিয়ান রোদের দিকে তাকাতেই রোদ উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ড.মিহা মুচকি হেসে বললো,
— বেশিক্ষণ অপেক্ষা করাবো না বোন।
রোদ উঠে বাইরে বের হতেই দেখলো ইয়াজ দাঁড়িয়ে আছে। এই হসপিটালটা প্রাইভেট। ইয়াজ সপ্তাহে তিনদিন এখানে বসে। রোদ বের হতেই সাবধানে ওর হাত ধরে বললো,

— চল।
— আরে কোথায়?
— আমার কেবিনে।
— দাঁড়া। উনি বের হবেন তো। এখানেই বসি।
— কোন কথা না রোদ। চুপচাপ চল।
অগত্যা রোদ ইয়াজের পেছনে হাটা দিলো। খুব সাবধানে ইয়াজ ওকে নিজের কেবিনে নিয়ে বসিয়ে দিলো। তখনই একজন ওয়ার্ড বয় জুস নিয়ে ডুকলো। উনি যেতেই ইয়াজ রোদের হাতে সেটা দিয়ে বললো,

— চুপচাপ ফিনিস করবি।
— এখন না। তুই জানিস না আমি..
— চুপ! ফিনিস ইট রোদ।
ধমক খেয়ে রোদ কিছু বললো না। বুঝতে পারলো না ইয়াজ কেন এমন রেগে আছে। এদিকে ইয়াজের চোখ ভীষণ ভাবে জ্বালাপোড়া করে যাচ্ছে। এই রোদ শুধু ওর বান্ধবী না। বোন না। ভিন্ন একটা টান আছে রোদের প্রতি। বয়সে বড় হলেও সম্পর্কটা সমবয়সীদের মতো।
আদ্রিয়ান কেবিনে মাথা নিচু করে বসে আছে। ড.মিহা ওকে সাহস দেয়ার জন্য বললো,

— মি.জোহান আপনি শান্ত হন। আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হবেন। প্রথম তিনমাস যদি ঠিক হয় তাহলে আর সমস্যা হওয়ার চান্স নেই। বাকিটা আল্লাহর কাছে।
আদ্রিয়ান তখন অশান্ত। বুকটা অস্বাভাবিকভাবে উঠা নামা করছে। তবুও জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
— বলুন। শুনছি আমি।

— দুই মাস আগে রোদের অতিরিক্ত ব্লা*ড যাওয়ার কারণ হলো ছোট্ট একটা মিসক্যারেজ। ছোট্ট বলার কারণ হলো ভ্রুণ হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু একদমই অপক্ক। রোদের তো আগের ও সমস্যা ছিলো সেটার জন্যই ওর ডিম্বাণুতে ভ্রুণটা টিকতে পারে নি। আপনি তখন যেই ডক্টর দেখিয়েছিলেন তিনি প্রথমত কোন টেস্ট করেন নি যার দরুন শুধু ব্লাড কমার মেডিসিন ই দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আমার এখানে টেস্ট করানোর সময়ই ধরা পরে সেটা। আমি রাদকে জানাতেই ও নিজেই অনেকটা আঘাত পায়। আপনাদের জানাতে নিষেধ করে কারণ কষ্ট পাবেন। বিশেষ করে রোদ। মেয়েটা এ নিয়ে তো আর কম ভুগে নি।

আদ্রিয়ান শান্ত ভাবে শুনেই গেলো। ডক্টর অপরিপক্ক ভ্রুণ বললেও আদ্রিয়ানের মনে হচ্ছে ওর সন্তান একটা দুনিয়ায় আসার আগেই চলে গিয়েছে। একটা প্রাণ দুনিয়ার এলো। চলে গেল। আদ্রিয়ানের অস্তিত্বের অংশ চলে গেল অথচ আদ্রিয়ান কি না জানলোই না। একটা বার ঐ পেট ছুঁয়ে অনুভব করতে পারলো না। এর থেকে বড় কষ্ট কোন বাবার কাছে আছে কি? আদ্রিয়ানের চোখ দিয়ে টাপটুপ করে পানি পরছে। কাঁদছে না আদ্রিয়ান শুধু অনবরত পানি ঝরছে। ড.মিহা টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বললো,

— ভাইয়া। আজ নাহয় যান। আপনাকে টায়ার্ড লাগছে।
— আপনি বলুন। শুনছি আমি।
ড.মিহার ও খারাপ লাগছে। কতটুকু মেয়েটা রোদ। অথচ জীবন তাকে কোথায় দাড় করালো।
— রোদ বর্তমানে ৯ সপ্তাহের প্রেগন্যান্ট। এবারেও সেম মনে হচ্ছে। ৯ সপ্তাহের ভ্রুণ সাধারণ যতটা বড় বা সুস্থ থাকে রোদের ততটা না।দূর্বলতার কারণে এটা গ্রো করছে না আর এটা কতদিন সার্ভাইব করবে তাও সিউর বলতে পারছি না। সবচেয়ে বড় কথা রোদের ডিম্বাণুর অবস্থা ভালো না। যদিও বেবি গ্রো করে রোদের লাইফ রিস্ক বেড়ে যাবে।

আদ্রিয়ান থম মে’রে গেলো একদম। কি বলবে? ওর রিএকশন আদৌ কেমন হওয়া উচিত ও নিজেই বুঝতে অক্ষম। মাত্র ই তো গেলো রোদ। এমন তৃপ্তিময় খুশি রোদ জীবনে কখনো হয়েছে কি? আদ্রিয়ানের সামনেই তো খুশিতে কেঁদেছে কতক্ষণ। কেঁদে কেঁদে আবার হেসে নিজের পেটেই হাত বুলিয়েছে। আদ্রিয়ানের হাত ধরে নিজের পেটে ছুঁয়িয়েছে। অথচ আদ্রিয়ান শুরু থেকেই ইয়াজের কথায় জেনেছে রিপোর্ট ভালো আসে নি।

সেই কথার জেরে পরে আদ্রিয়ান খুশি হয়েও হতে পারে নি। কিভাবে হবে? যেখানে ও জানছে হয়তো অনাগত সন্তান অথবা ওর জীবনের চেয়ে প্রিয় ভালোবাসা বউ। এতই কি সোজা এই কথাগুলো? ডক্টর তো বলেই খালাস এদিকে রোদ খুশি হয়ে আছে। অতিখুশিতে মেয়েটা শুধু কেঁদে কেঁদে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছে। আদ্রিয়ানকে বলেছে,একসাথে নফল পরবে শুকরিয়া আদায় করার জন্য। তাহাজ্জুদ একসাথে পরবে। কিভাবে করবে আদ্রিয়ান এসব? ওর জানের বিনিময়ে কি এসব পাওয়া যাবে না? যদি পাওয়া যায় তাহলে তাই হোক। রোদ আর অনাগত সন্তানটা ভালো থাকুক।

ডক্টর মিহা আদ্রিয়ানকে প্রথম তিনমাসের মধ্যে কিভাবে কি করতে হবে সহ সব মেডিসিন ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলো। এরমধ্যে বেড রেস্ট মাস্ট। এটা শুনেই এবার আদ্রিয়ান চোখ তুলে তাকালো। বেড রেস্টে থাকলে মেডিকেলের ক্লাস? ড.মিহা’কে বলতেই তিনি চিন্তিত কন্ঠে বললো,

— আপাতত মেডিক্যাল অফ রাখার চেষ্টা করন। এই অবস্থায় জার্নি যতটা কম করা যায়। আর রোদের কনডিশনও ভালো না। তাই যতটা রেস্টে রাখা যায়। আর খাওয়া দাওয়া ও সব টাইমলি করতে হবে চার্ট অনুযায়ী। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।
আদ্রিয়ান কাঁপা হাতে রোদের রিপোর্ট গুলো হাতে তুলে ড.মিহা থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বের হলো। রোদকে না দেখেই অস্থির হয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো। না পেয়ে রোদকে কল করতেই রোদ জানালো ও ইয়াজের রুমে। আদ্রিয়ান তারাতাড়ি পা চালিয়ে ওখানেই গেলো। ইয়াজের সামনেই বসে থাকা রোদকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— না বলে এখানে কেন এসেছো? আমি খুঁজছিলাম না?
রোদ অনুভব করতে লাগলো আদ্রিয়ানের বুকের ধুকপুকানি। ইয়াজ তখন বললো,
— ভাই ওখানে একা বসা ছিলো তাই আমি এখানে নিয়ে এলাম।
আদ্রিয়ান তখনও ছাড়ে নি। রোদ ও চুপ করে আছে। হঠাৎ আদ্রিয়ান ওকে ছেড়ে আস্তে করে হাত ধরে বললো,
— চলো। বাসায় যাব এখন।
ইয়াজ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বের হলো। রোদ আদ্রিয়ানের বাহু জড়িয়ে ধরে রাজ্যের আলাপ জুড়ে দিলো। এটা ওটা বলেই যাচ্ছে।

— বাসার সবাই শুনলে কত্ত খুশি হবে বলুন। মিশান আর মিশি তো লাফাবে। নাম মিশানই রাখবে। আমাকে বলেছে। জানেন মিশি কি বললো?বলে ওর বোন চাই কিন্তু মিশানের ভাই চাই। আবার বলে দু’টোর একটা হলেই হবে। আর…
রোদকে আলগোছে গাড়িতে উঠাতে উদ্যত হলো আদ্রিয়ান। রোদ কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসলো। ড্রাইভার স্টর্ট দিতেই আদ্রিয়ান রোদের হাতটা ধরে বসে রইলো। খুশিতে আত্মহারা রোদ কি আর থেমে? মোটেও না। সে নিজের মতো তার পেটের ভিতর থাকা সন্তান নিয়ে পরিকল্পনা করতে ব্যাস্ত।

রোদের বাসায় সবাই থম ধরে আছে। শক্ত রাদও কিছুটা নড়বড়ে বটে। রোদের মা এদিকে কেঁদেই যাচ্ছেন। মিহা ফোন করে রাদকে সবই জানিয়েছে। রাদ ভাষার খেই হারিয়ে ফেললো। কি করবে? মিহা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে হোপ নেই বললেই চলে। তাও তিনমাস দেখতে হবে। তিনমাস যে ফিটাস টিকবে তারও নিশ্চয়তা নেই। আর রোদের মিসক্যারেজ এর কথা শুনে একপ্রকার বাকরুদ্ধ হয়ে গেল বাসার সবাই। রাদ এতদিন এটা লুকিয়ে ছিলো। আজ বলতে বাধ্য হয়েছে। যেই মেয়ে দীর্ঘ বছর খানি মানসিক সমস্যায় ভুগেছে শুধু মাত্র এই কারণে যেটাতে ওর কোন হাতও নেই সেখানে কি না একটা বাচ্চা এসে পরেও গেলো কেউ টের পেল না?

রোদকে দেখার জন্য ওর মা ছটফট করে লাগলেন। একটা মেয়ে। কত আদরের। রাদ নিজেকে সামলে বলে উঠলো,
— আম্মু রোদ কিছুই জানে না। শান্ত থাক। সময় দাও। এখন না বিকেলে যাব।
রোদের মা নিজেকে সামলে রাখতে বরাবরই ব্যার্থ হলেন। আজ রোদের বাবা চোখ ভর্তি পানি। মেয়ের জীবনের ব্যাপার এটা। কি করবেন?
জাইফা ভেঙে যাওয়া রাদকে সাহস দিতে লাগলো। কতটুকু কাজে লাগলো আল্লাহ জানে।
আপাতত এই বাড়ীর পরিস্থিতি ও ভার হয়ে আছে। চাচার বাসায় ও খবর হয়ে গেল। সবাই একপ্রকার ভীত হয়ে আছে।

রাতুল আজ তারাতাড়ি বাসায় ফিরেছে। দিশাকে নিয়ে বের হবে একটু। শপিং করবে কিছুটা। বাসায় ডুকেই দেখলো দিশার চোখে পানি। বাসার ড্রেস পরেই হারতার করে বের হচ্ছে। রাতুল ওকে ধরে ভ্রু কুচকে বললো,
— কি হয়েছে? কোথায় যাচ্ছো?

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪১

দিশা এবার নিজেই কেঁদে উঠলো। এই রোদ নামক বোনটা যে বাসার সবারই কলিজার টুকরো। তার কি না এই অবস্থা?
দিশা রাতুলকে সব বলতেই রাতুল ওর বাহু ছেড়ে দিলো। দিশাকে ছেড়ে বিছানায় ধপ করে বসে পরলো। কি শুনলো এটা ও? মিসক্যারেজ? রোদ এখন প্রেগন্যান্ট? মাথা ভনভনিয়ে উঠলো রাতুলের। দুই হাতে চুল খামড়ে বসেই রইলো। দিশা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো রাতুলের দিকে পরপরই দৌড়ে বেরিয়ে গেল। রোদকে দেখতে হবে। এতটুকু মেয়েটা জানেও না কি হয়েছে আর কি হতে চলেছে ওর সাথে।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৪২ শেষ অংশ