ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫৩

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫৩
সাইয়্যারা খান

রাত পেরুলেই ভোরের আলো ফুটবে সেই সাথে নব জীবনের সূচনা ঘটবে একটা ছোট্ট প্রাণের। রোদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাড়ির পেছনে রাখা গরু তিনটি’র দিকে দেখছে। ছেলেদের ক্ষেত্রে দুটি খাসি আর মেয়েদের জন্য একটি বরান্ধ থাকলেও আদ্রিয়ান এনেছে তিনটি। সবাই অবশ্য দুই একবার জিজ্ঞেস ও কেরেছিলো উত্তর মেলেনি। রোদ জানে এর কারণ।

আদ্রিয়ান বলে নি যদিও। আদ্রিয়ান শুধু বলেছে একটা গরু শুধু গরিবের হক। কেন দিবে তা জানায় নি। রোদ সেই দিকেই নজর দিয়ে আছে। হৃষ্টপুষ্ট গরু তিনটি। আকিকা দেওয়ার নিয়ম যদিও সাত দিনের দিন করা কিন্তু সামর্থ না থাকলে তা পরে দিলেও হয়। এমনকি বাবা মা না পারলে নিজের আকিকা নিজেও দেয়া যায়। যদি তা ও সম্ভব না হয় তাহলেও কোন সমস্যা নেই। আল্লাহ মহান। তিনি মাফ করে দিবেন। এছাড়াও মাথার চুল ফেলে দিতে হয় এবং সেই ওজনের স্বর্ন, রুপা অথবা অর্থ দান করতে হয়, ইসলামিক নাম রাখতে হয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছোট্ট পুঁচকে’টা যেহেতু এতদিন অসুস্থ ছিলো বা ওমন পরিস্থিতি ছিলো না তাই লেট হলো করতে।
নিজের পেছনে কারো অস্তিত্ব টের পেল রোদ। পরপরই শক্ত হাতের স্পর্শ। কেউ একজন গভীর ভাবে ওর ঘাড়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে। শিউরে উঠলো রোদ। ধরে আটকালো সেই হাতের বিচরণ। ঘাড় না ঘুরিয়েই প্রশ্ন করলো,

— কেন এসেছেন ওকে একা রেখে?
— মিশান আছে।
— ওহ্।
— রোদ?
এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো রোদ। আদ্রিয়ান কিছুটা ক্লান্ত। চেহারাতেই তা ফুটে আছে। রোদ আদ্রিয়ানের হাতটা ধরে তার উল্টো পিঠে চুমু খেয়ে বললো,

— ভালোবাসি।
আদ্রিয়ান হাটু গেড়ে বসলো রোদের কাছে। আলতো হাত ডুবিয়ে দিলো রোদের নরম ফোলা গালে। আগে থেকেই ছিলো ফুলা ফুলা হাওয়াই মিঠাই এর মতো গাল এখন তা হয়েছে একদম রসমালাই এর মতো। মন চায় টুপ করে খেয়ে ফেলতে। করলো ও তাই। একটু উঠে ডাবিয়ে চুমু খেলো। রোদ ওকে সরিয়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠেই বললো,

— রুমে বাচ্চারা না?
— তাতে কি?
— অসভ্য হচ্ছেন দিনদিন।
— চার বাচ্চার বাপ কি আর ভদ্র হয়ে থাকলে হতে পারতাম?
— কি সব কথা? যান এখান থেকে।
— যাব তো। তার আগে বলো কি ভাবছিলে এতো?

— আমার সাড়াটা ভাবনা জুড়ে শুধু আপনি থাকেন। এতটাই আপনাতে বিভোর থাকি যে অন্য কাউকে ভাবার সময় পাই না। আসলে আমি অন্য কিছু ভাবতেই চাই না। আমার আপনি টা যে আমার অনেক প্রিয়।
কথাগুলো বলতে বলতে চোখ জ্বালা উঠলো রোদের। লাল হচ্ছে তা ক্রমশ। আদ্রিয়ান হাত রাখলো রোদের গালে। বয়সের পার্থক্য থাকলে নাকি ভালেবাসা হয় না। মনের মিল হয় না। বিবাহিত হয়ে নাকি প্রেম হয় না। মনের খবর রাখা হয় না।

অবহেলা স্হান নেয়। কই রোদ আদ্রিয়ানের তো এমন হয় না? রোদ তো পাগলের মতো ভালেবাসে তাকে। কেমন ছটফট করে আদ্রিয়ান একটু কাছে না থাকলে। আদ্রিয়ান বলতে সে এতটা পাগল যে নিজেকে নতুন ভাবে গড়েছে সে। কে এমন নিজেকে শূন্য করে অন্য’কে ভালোবাসবে? কেউ কি আদৌ সেটা করে এই যুগে? আদ্রিয়ানের রোদ করে।
আদ্রিয়ান রোদের কপালে গাঢ় চুম্বন করে আদুরে স্বরে বললো,

— সোনা আমার চলো ভেতরে। বাবু একা না?
— হুম।
রোদকে ধরে উঠালো আদ্রিয়ান। রোদ মূলত আকিকার পশু দেখতেই বারান্দায় এসেছিলো। আদ্রিয়ান ওকে নীচে নামতে দেয় না। অবশ্য এই সময়ে রোদের এতটা হাটাহাটি ও ডক্টর নিষিদ্ধ করেছেন। এমনিতেই দুই বার সিলি ছুটেছিলো। তার মধ্যে র*ক্ত ক্ষরণ। রোদকে নিয়ে ভেতরে ডুকতেই সুন্দর একটা দৃশ্য দেখলো দু’জন। তিন ভাই বোন একসাথে শুয়ে আছে। মিশানের বুকের উপর ঘুমন্ত পুঁচকু আর পেটে’র উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে মিশি। একজন বাবা-মা হিসেবে এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কি বা হতে পারে? রোদ আদ্রিয়ানের কাঁধে মাথা এলিয়ে বললো,

— ওরা যেন এভাবেই থাকে সারাজীবন।
— থাকবে ইনশাআল্লাহ।
রোদ এগিয়ে পাশে বসতেই আদ্রিয়ান ও বসলো। মন ভরে দুজন মিলে তাদের সন্তানদের দেখছে।
আদ্রিয়ান ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো,

— রোদ?
— হুম।
— কাল ভোরের দিকে আমি একটু বের হবো। জারবা’কে রেখে যাব অবশ্য। তবুও খেয়াল রেখো।
— কোথায় যাবেন?
— একটু বাইরে কাজ আছে সোনা।
বলেই উঠে দাঁড়ালো আদ্রিয়ান। পাশ থেকে বড় একটা বাটি ভর্তি আনারের দানা এনে রোদের হাতে দিয়ে বললো,

— সবগুলো ফিনিস চাই।
— ইই এখন না? রাতের খাবার না খেলাম?
— র*ক্ত কতটা গিয়েছে আর যাচ্ছে তার হিসেব আছে তোমার?
— শিং মাছের ঝোল দিয়েই না রাতে খাওয়ালেন? দেখুন শরীরে কত র*ক্ত হয়েছে।

বলেই দুষ্ট হাসলো রোদ। আদ্রিয়ান এবার দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। কিভাবে যে এই মেয়েকে বুঝাবে ও? বাটি নিয়ে সরতেই রোদের খুশি দেখে কে। এমনিতেই মুখে স্বাদ পাচ্ছে না ও কিছু তারমধ্যে আদ্রিয়ান এটা ওটা সব খাওয়াচ্ছে ওকে। ওর খুশি একমিনিট ও স্থায়ী হলো না কারণ হাত ধুঁয়ে এসে সবগুলো দানা চটকাচ্ছে। রোদের বুঝতে বাকি নেই আদ্রিয়ান এগুলো ওকে দিয়েই গিলাবে। ওর মন খারাপের মাঝেই আধ গ্লাস লাল লাল পানি নিয়ে এলো আদ্রিয়ান। রোদ’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মুখ চেপে ধরে ডুকিয়ে দিলো অগত্যা সব গিলে ফেললো রোদ। মুখ মুছাতেই রোদ কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

— দিলেই খেতাম। এমন করার কি আছে? আর আমি কি বুড়ো না বাবু যে রস করে খাওয়াতে হবে।
আদ্রিয়ান বাঁকা চোখে তাকালো। এই মেয়ে’কে নাকি দিলেই খেত? আদ্রিয়ানের জীবন ঝালাফালা না করে সহজে কিছু গলা নামে না যেই মেয়ের সেই মেয়েকে তো এভাবেই খাওয়ানো উচিত।গ্লাস’টা সাইডে রাখতে রাখতে আদ্রিয়ান বললো,
— তুমি হলো আমার বুড়ো বাবু বউ।
— ই ছিঃ এটা কেমন নাম? খবরদার এই আলতু ফাতলু নামে ডাকবেন না। ইয়াক।
আদ্রিয়ান হাসছে। রোদ পাশের ড্রয়ার থেকে মেসিডিনের পাতা খুলতে খুলতে বললো,

— আচ্ছা বাবা নাকি আপনাকে যেতে বলেছে?
— আমি কাল কথা বলব?
— ওহ্। নিন এগুলো।

আদ্রিয়ান পানি ভর্তি গ্লাস নিয়ে আসতেই রোদ হাতের মেডিসিন গুলো ওর মুখে তুলে দিলো। গিলে ফেললো আদ্রিয়ান। এই ছোট রোদটা ওর যত্নে কোন ত্রুটি রাখে না। ঘুমাতে যাবেই এমন সময়ই সশব্দে চেঁচিয়ে উঠলো বাবু। রোদ হাত বাড়িয়ে নিতে চাইলো। কিন্তু পারছে না। আদ্রিয়ান এগিয়ে এসে তুলে রোদের কোলে দিলো। আসলে রোদ এখনও বাচ্চা সামলাতে শিখে নি কিন্তু আদ্রিয়ান থাকতে তার দরকার ও নেই। এক হাতে দুই সন্তান পেলেছে আদ্রিয়ান। দুধের বাচ্চা পেলেছে। সেখানে ছোট্ট জানটাকে পালা ওর নিকট সহজেই বটে।

আদ্রিয়ান সময়টা বেশ উপভোগ ই করছে। এই যে ওর সামনেই ওর উনিশ বছর বয়সী বউ যে কিনা কিছু মাস পরই বিশ এ পদার্পণ করবে সে কেমন বাচ্চা’কে খাওয়াতে কেমন হাসফাস করছে। আদ্রিয়ানের সামনে লজ্জায় লাল হচ্ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। এসব ভাবতেই হাসি পায় আদ্রিয়ানের। এগিয়ে এসে রোদের পাশে বসে বললো,
— চার বাচ্চার মা হয়েও কি না এত লজ্জা?
রোদ ঠোঁট ফুলিয়ে চুপ রইলো। অল্প শব্দে হাসলো আদ্রিয়ান। আরেকটু কাছে এসে রোদের মাথাটা বুকে চেপে নিলো। পুঁচকে’টা পিটপিট করে দেখছে তার বাবা মা’কে।

ফজরের একটু আগেই ঘুমিয়েছে রোদ। আদ্রিয়ান ছোট্ট ছেলের দিকে একবার তাকালো। আজও পুঁচকে’টা বাবা-মা’কে ভীষণ ভাবে জ্বালিয়েছে। আদ্রিয়ান ফজরের নামাজ পড়েই রোদের আর ছেলের মাথায় চুমু খেয়ে রুম থেকে বের হলো। এরটু পরই জারবা এসে পাশে শুতেই রোদ চোখ মেললো। ঘুমায় নি রোদ। অপেক্ষায় ছিলো আদ্রিয়ান কখন যাবে। আস্তে করে উঠে জারবা’কে বললো,

— জারবা বোন আমার একটু পুঁচকে’টার পাশে থেকো প্লিজ। মামনি আসবে একটু পরই।
বলতে বলতেই ফোন বেজে উঠলো রোদের। রোদ ফট করে তা রিসিভ করে নিলো কারণ শব্দে বাচ্চাটা উঠে যেতে পারে। অপর পাশ থেকে কথা বলতেই রোদ ফিসফিস করে বললো,

— পাঁচ মিনিট। আসছি আমি।
ফোনটা রেখেই জারবার সাহায্য ফ্রেশ হলো রোদ। পরণের ঢোলা ফ্রকটা’র উপর একটা বড় ঘোমটা দিয়ে ওরণা পড়ে নিজেকে ঢেকে দিলো। ওর মধ্যেই ওর শাশুড়ী ডুকে বললো,
— রোদ আম্মু তারাতাড়ি আসবি কিন্তু।
— হুম।
— আর শুন….
— জানি কাঁদব না একদম। আমি শুধু দেখব মামনি।

বলেই আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলো রোদ। দরজা থেকে বাকিটুকু আরিয়ান ই এগিয়ে নিয়ে গেলো। গাড়িতে আরিয়ান বিভিন্ন ভাবে বুঝাচ্ছিলো রোদকে। রোদ শুধু হু হা করেছে। আদ্রিয়ান থেকে লুকিয়ে না আসলে কোন দিনই আসা হতো না ওর। তাই এভাবে আজ সুযোগ পেয়েই এসেছে।

গাড়িটা থামলো সোজা কবরস্থানের সামনে। ফজরের নামাজ শেষে কয়কজন মুসল্লি শুধু মসজিদ থেকে বের হচ্ছিলো। গলা ভেজালো রোদ। হাত পা ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে কেমন। মাথা ঘুরাচ্ছে। গাড়ি থেকে নামার শক্তিটুকু ও যেন পাচ্ছে না। বুকে কেমন ধক ধক করছে। বুক ফেটে আর্তনাদ বের হচ্ছে অথচ এমনটাতো হওয়ার কথা না।

আরিয়ানের সাহায্য বের হলো রোদ। একপ্রকার আরিয়ানের উপর ভর দিয়েই সামনে এগুলো ও। কবরস্থানের পাশের গেইট দিয়ে একদম বারাবর ছোট্ট একটা কবর। রোদ যেহেতু কবরস্থানে ডুকতে পারবে না তাই আরিয়ান এই দিকটাতেই এনেছে। রোদকে আরিয়ান কিছু বলার আগেই রোদ কাঁপানো গলায় জিজ্ঞেস করলো,

— ভাইয়া এটাতে না আমার মেয়ে?
রোদের কন্ঠে সম্পূর্ণ কাঁপুনি। ওর শরীর যে মৃদু কাঁপছে তা ও ওকে দেখেই টের পাচ্ছে আরিয়ান। কিছু বলার আগেই রোদ গেটের জালি ধরে উঁচু জায়গাটাতে বসে পরলো। হাত বাড়ালো কবরটা ছুঁতে কিন্তু পারলো না। অতটাও কাছে না। রোদ কান্নারাত থমকানো গলায় ডাকলো,

— মা? মায়ের জান। আমার কলিজার টুকরো।
কেউ জবাবে কিছু বললো না। শুধু ভোরের কিছু পাখির কিচিরমিচির শুনা গেলো। রোদ আবেগ জড়ানো গলায় আবারও বললো,

— আমার মা কি রাগ করেছে? মা এতদিন আসি নি বলে এত রাগ? মা চেয়েছিলাম তো সোনা কিন্তু আসতে পারি নি। এই আম্মু আমাকে কেন দেখা দিলো না? আমার কি দোষ? বাবা’র মেয়ে বাবাকেই দেখা দিলা শুধু? একটা বার আমার জন্য অপেক্ষা করা গেলো না। আমি কি…..
আর কিছু বলতে পারলো না রোদ। কেঁদে উঠলো হাউমাউ করে। আরিয়ান ধরেও সামলাতে ব্যার্থ হলো। রোদকে সরাতেই চেষ্টা করছে এমন সময় কেউ এগিয়ে এসে দুই বাহুতে আটকে নিলো রোদকে। ঝাপসা চোখে কিছুই দেখলো না রোদ। আস্তে আস্তে চোখ বুজে নিলো।

চোখ খুলতেই নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে রোদ। এদিক ওদিক তাকালো। তাহলে কি স্বপ্ন দেখলো। পরক্ষণেই মনে পরলো না স্বপ্ন না সত্যি ছিলো। তাহলে রুমে কিভাবে এলো ও? আরিয়ান আনলো? হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে কেউ বলে উঠলো,
— বাবু খায় নি অনেকক্ষণ। খাবে এখন।

রোদ দেখলো পর পাশেই ছেলেকে বুকে নিয়ে আদ্রিয়ান বসা। আশে পাশে আর কেউ নেই। ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললো রোদ। আদ্রিয়ান আস্তে করে রোদের দিকে হাত বাড়াতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো ও। কিন্তু না তেমন কিছু হলো না। আদ্রিয়ান ছেলেকে খাওয়ানোর জন্যই হাত বাড়িয়েছে। রোদের দিকে বাচ্চাকে শুয়িয়েও ধরে আছে আদ্রিয়ান। বাবুটা এতক্ষণ পর মা’কে পেয়ে চুপটি করে খাচ্ছে। আদ্রিয়ান কিছু না বলাতে রোদ যেন আরো ভয় পাচ্ছে। একবার তাকিয়েও আবার চোখ সরিয়ে নিলো। আদ্রিয়ান শান্ত কন্ঠে বললো,

— আমিই নিয়ে যেতাম। ভেবেছিলাম তুমি সুস্থ হলে নিয়ে যাব। একটু সময় দিতা। এভাবে যদি কিছু হতো রোদ? তখন কি করতাম আমি? আমি তো আমার ছেলে’কে তোমার ভরসায় রেখে গিয়েছিলাম আর তুমি কি না অন্য জনের ভরসায় রেখে গেলে?

রোদ ফুঁপিয়ে উঠলো। হাজার চেয়েও মেয়েকে একটা বার দেখার জন্য নিজের মন’কে শান্ত করতে পারে নি। অনেক কষ্টে আরিয়ান আর শাশুড়ী’কে রাজি করিয়েছিলো যখন জানলো আদ্রিয়ান একটু ভোরে বাইরে যাবে। হলো কি? সেই তো জেনেই গেলো আদ্রিয়ান। রোদের ফুঁপানোতেই পুঁচকে ও কেঁদে দিলো। যেন মা’য়ের কান্নায় সেও দুঃখ প্রকাশ করছে। রোদ ওভাবেই এবার বুকের উপর তুলে নিলো ছেলেকে। মুখে চুমু খেয়ে ছোট্ট ছানা’কে আবারও খাওয়াতে লাগলো। এই প্রথম রোদ হয়তো খাওয়াচ্ছে বুকের উপর তুলে। প্রতি বার আদ্রিয়ানের সাহায্যেই খাওয়ায়। সময়ের সাথে সাথে মা মা ভাবটা এসেই যায় প্রত্যেকটা নারীর। আদ্রিয়ান ঝুঁকে রোদের চোখের পানি মুছিয়ে চুমু খেল ঠোঁটে। গালে আদর করতে করতে বললো,

— এই বোকা, কাঁদছো কেন? ছেলেকে বুঝাতে চাও ওর আব্বু পঁচা?
— উহু বেস্ট আব্বু আপনি আমার চার সন্তানের। এতটা বেস্ট আম্মু হয়তো কোনদিন হতে পারব না আমি।
— হুস। আমার রোদ বেস্ট বউ। বেস্ট মাম্মা। বেস্ট মা। বেস্ট আম্মু ও হবে।
— রেগে?
— একটু না।
— সত্যি?
— তিন সত্যি।
— ও কি অনেক ছোট্ট ছিলো?
— একদম ছোট্ট রোদ ছিলো আমার। এই যে পুরো বুকটা জুড়ে গিয়েছিলো। গোলগাল। কেমন জানি গোলাপি আর লাল লাল।

— রোদ যেন আদ্রিয়ানের চোখে নিজের মেয়েকে দেখে। কল্পনা করে।
— আপনি ওখানে ছিলেন?
— দেখা করতে গিয়েছিলাম। বলবে কেমন পঁচা বাবা আমি। কতদিন পর দেখতে গেলাম।
— আমি জানি আপনি না বললেও তৃতীয় গরুটা কেন।

বাসায় মেহমান ভর্তি। আকিকাহ্ সম্পূর্ণ হয়েছে। বাবা মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে মিশান রেখেছে”আদ্র”। পুরো নাম “আহিয়ান জোহান আদ্র”। বিপত্তি বেঁধেছে চুল কাটতে। সেই যে আদ্রিয়ান কাটার সময় থেকে কাঁদছে থামছেই না। আদ্রিয়ান সেই থেকে পাগলের মতো ছেলে নিয়ে ঘুরছে। “ওয়া ওয়া” করে গলা ফাটাচ্ছে আদ্র। তার মোটেও পছন্দ হয় নি তাকে এমন বেল বানানোতে। রোদ কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। এতটুকু পুঁচকু অথচ কাঁদার সময় গলায় তার জোর বেড়ে যায়। না পেরে আদ্রিয়ান আরিয়ানকে বললো,

— এই তুই তো ডক্টর দেখ তো একটু। কিছু হলো কি?
— আমি কি শিশু বিশেষজ্ঞ?
— কিছুই কি জানিস না? কি হলো এফসিপিএস করে?
— এই তুই কি আমার খিল্লি উড়াচ্ছিস? আমি হার্ট সার্জন আর তুই মজা নিস? জানস কত কষ্ট?
— কি হলো এত কষ্ট করে সেই তো ঘরের বাচ্চাকেও চেকআপ করতে পারিস না।
আরিয়ান এবার ভয়াবহ রেগে গেলো। আদ্রিয়ান ছেলে নিয়ে কেটে পরলো। আরিয়ান কিছুটা রেগে বললো,

— দেখেছো আম্মু তোমার ছোট ছেলে কি বললো?
ওর মা এই ঝামেলায় মধ্যে নেই। এমনিতেই প্রচুর কাজ।
আদ্রিয়ান রুমে ডুকেতেই রোদ বললো,
— তোমরা অন্য রুমে যাও আম্মু। ওকে খাওয়াবো।
— যেতে হবে কেন?
— ই যাও। লজ্জা লাগে আমার।

আদ্রিয়ানের মা সহ দিশা তিশা ফিক করে হেসে উঠলো। ওর চাচি তো বলেই ফেললেন,
— তিন বাচ্চার জননী কি না এই কথা বলে?
— চার বাচ্চা চাচি।
বেশ স্বাভাবিক উত্তর রোদের। ওর চাচি ওর কপালে চুমু খেয়ে সবাইকে নিয়ে বের হলেন। আদ্রিয়ান রোদের কাছে দিতেই রোদ ছেলেকে বুকে নিলো। আদর করলো। হায় থামলো কই এই ছেলে? রোদ ছেলের ঠোঁটে চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বলতে লাগলো,

— এই যে বাবা। আমার মা তাকাও। এই যে আমি। কেন কাঁদছে মায়ের কলিজা? বাবা কি করেছে? আমার জানের চুল কেটেছে? মা বকে দিবে তো আব্বু’কে। কেন ফেলেছে আমার বাবা’র চুল?
মায়ের এমন ঠোঁট নেড়ে নেড়ে আদুরে কথা হয়তো ভালো লাগছে আদ্র’র। পানি ভরা ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে মায়ের কথা শুনছে সে। আদ্রিয়ান পাশে বসে বললো,
— আমি কত আদর দিলাম থামলো না।
রোদ ছেলেকে খাওয়াতে খাওয়াতে জিজ্ঞেস করলো,

— আমার বিচ্ছু দুটো কোথায়?
আদ্রিয়ান হাসলো। রোদের অগোছালো চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললো,
— নীচে বাগানে আছে। সমস্যা নেই ইয়াজ ওরা সবাই আছে। রাতুল এসেছে।
— শুনেছি। দিশা আপু বলেছে। আমি কি রেগে আছেন?
— রাতুলের জন্য? মোটেও না রোদ। আগে করা আমার আচরণের জন্য দুঃখীত রোদ। তুমি তো বেহুস ছিলে, রাতুল অনেক করেছে আমাদের জন্য। ভাগ্য আমার ভালো ছিলো তাই তুমিটা আমার আমার হলে।

রাতে আদ্রিয়ানের বাবা ওকে ডেকে পাঠালেন। আদ্রিয়ান আসতেই ওর বাবা বসতে বলে বলে উঠলেন,
— এবার নাহয় চট্টগ্রামে একটু যেতে। দুটো ডিল আটকে আছে।
— সম্ভব না আব্বু।
— আমারা আছি। আদ্র’র জন্য চিন্তা করো না।

— এটাই তো সমস্যা আব্বু। তোমরা আছো। আদ্র’র চিন্তা করতে হবে না আমার। সবাই ওকে দেখে রাখবে। কিন্তু আমার রোদ? ওর তো আমাকে দরকার। সবাই ওকেও দেখে রাখবে সেটা জানি আমি কিন্তু আমার মতো করে রাখতে পারবে না। আমার রোদটার কখন কি দরকার সেটা ও নিজেও জানে না। আমি করে দেই। ওর অন্য কারো যত্ন না আমাকে দরকার। আমার কোম্পানিতে এমন ডিল আরো দুটো চলে গেলেও ব্যাপার না।
আদ্রিয়ানের বাবা ছেলের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে গর্বের সহিত বললেন,
— আ’ম প্রাউড অফ ইউ বাবা।

দিন গেলো। মাস গেলো। এই তো তীব্র রোদের মাঝে এখন ধুমসে বর্ষণ হয়। সকালে অল্প ঠান্ডাও অনুভূতি হয়। এটা অবশ্য শীতের ঠান্ডা না। সারারাত বৃষ্টি হওয়াতেই এই ঠান্ডা। আজ ঠিক কাটায় কাটায় ছয় মাস আদ্র’র। আগের তুলনায় সুস্থ অনেকটা কিন্তু তবুও রেসপন্স এখন বেশি করে। স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতোই চঞ্চল তবে কিছুটা কম। অল্পতেই কেঁদে ফেলবে। ধরে বসিয়ে রাখলে বসবে কিন্তু ছেড়ে দিলেই অন্য বাচ্চারা যেমন সেটা ধরে রাখতে পারে আদ্র সেটা পারে না।

ড.মিহা বলেছে সেটা কোন সমস্যা না। ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে সেটা হলো বড় কথা। প্রথম প্রথম বুঝা যেত না কিন্তু এখন স্পষ্ট বুঝা যায় আদ্র’র গালেও মায়ের মতো টোল পড়ে। ছেলেদের টোল পড়া গাল একটু বেশিই সুন্দর। চেহারায় সাইড আসে আদ্রিয়ানের। বাবা মা যেখানে এতটা সুন্দর সেখানে সন্তান সুন্দর না হয়ে যাবে কই? এর মধ্যে আবার অসুস্থও হয়েছিলো বার কয়েক। একদিকে ছেলেকে সামলেছে তো একদিকে রোদকে। রোদ থাকে ভয়ে ভয়ে। না জানি ছেলেটার কিছু হয়?

আদ্রিয়ান রুমে ডুকতেই দেখলো ছোট্ট একটা নেংটি পড়ানো আদ্র। মিশানের কোলে বসে আছে। মুখ দিয়ে আআআআ শব্দ করছে আর মিশান আলত হাতে মুখে হাত দিচ্ছে আর সরিয়ে দিচ্ছে ফলে আওয়াজ আসছে আবাবাবা আবাবাবা। আদ্রিয়ান হাসতে হাসতে ভেতরে ডুকলো। আদ্র অনেক মানুষ চিনতে না পারলেও মা,বাবা, ভাই, বোনের ঘ্রাণ চিনে। অপরিচিত কোলে গেলেই তার কান্না৷ আদ্রিয়ান ওদের সাথে যোগ দিতেই রোদ মিশিকে গোসল করিয়ে বের হলো।

আধ ভেজা মিশি মাকে ধরেই আছে। রোদ এখনও কোলে তুলতে পারে না ওকে। মিশি অনেক মর্জি করলে বেডে বসিয়ে কোলে নেয়। আদ্রিয়ান তাকিয়ে দেখছে রোদকে। মিশি লাফিয়ে কুঁদিয়ে যাচ্ছে বাবা,ভাইদের কাছে যাবে। রোদ ধরে বেঁধে ওকে মুছিয়ে কাপড় পড়াচ্ছে। আদ্রিয়ান দেখছে তার বউকে।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫২

এই যে বড় লম্বা লম্বা চুলগুলো খোঁপা করা যা ঘাড়ে পরে আছে। কেমন একটা ঢোলা পোশাক পরে আছে যার অর্ধেক ভেজা। একদম পাক্কা গৃহিণী যাকে বলে। আদ্রিয়ানের গৃহিণী। ওর ভাঙা সংসার যে সামলাতে সাহায্য করেছে সেই তো এই রোদ। আদ্রিয়ানের ভালোবাসা যার ভিন্ন ভিন্ন রং এ রঙিন হয়েছে আদ্রিয়ানের জীবন।

ভালোবাসার ভিন্ন রং পর্ব ৫৪