ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১২

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১২
Suraiya Aayat

কফিটা ওনার হাতে দিয়ে চলে যেতে নিলেই উনি ডেকে উঠলেন,
‘এই মেয়ে শোনো। ‘
ওনার এই মেয়ে বলে পিছু ডাক শুনে আমি চোখ মুখ কুঁচকে নিলাম। ওনার কাছে গিয়ে মিনমিন করে বললাম,
‘হ্যাঁ বলুন! ‘

উনি ইশারায় আমাকে ঝুকে যেতে বললেন। আমি ওনার ইশারা পেয়ে খানিকটা ঝুকে যেতেই উনি আমার কপালে হাত ঠেকিয়ে তারপর হাত সরিয়ে নিলেন, আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতেই উনি বলে উঠলেন,
‘ এখনো অবধি জ্বর নেই। জ্বর আসলে ওষুধ খাবে জলদি। এখন আমার সামনে চুপচাপ বসো। আমি যতখন না বলছি এখানেই বসে থাকো। ‘
আমি চোখ মুখ কাচুমাচু করে বললাম,
‘আর আপনার কথা না শুনলে কি করবেন? ‘

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি কৌতুহলী হয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম ওনার উত্তরের আশায়। উনি আমার দিকে স্বল্প তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন নিজের ফোনের দিকে। আমি বিরক্ত হয়ে বসে আছি, এখনো আমার ভেজা চুল শোকানো হয়নি, গলায় ওনার দেওয়া নীল রঙের স্কাফটা জড়িয়ে বসে আছি আর গায়ে পশম ওয়ালা সোয়েটার।
এই মুহূর্তে আমার নিজেকেই বাংলাদেশের বৃষ্টির দিনের ভাল্লুক মনে হচ্ছে। উনি বলে উঠলেন,

‘ আমার কথা না শুনলে থাপ্পড় দিবো। আর তুমি যদি আরও বেশি পানিশমেন্ট চাও তো আই হ্যাভ নো প্রবলেম। ‘
আমি জোরে বলতে লাগলাম,
‘হ্যাঁ আমার তো সরকারি গাল যে যখন খুশি ঠু/স/ঠা/স করে চ/ড় মারবেন। আগের বার ওই হিটলারি থা/প্প/ড় খেয়ে এখনো আমার দাঁতে ব্যা/থা! ‘
কথাটা বলতেই দেখলাম উনি গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, আমি ভাবলাম এই সুযোগে বেরিয়ে যাবো কিন্তু উনার দৃষ্টির হাব ভাবে আমি আর ওঠার সাহস পেলাম না। উনি এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে আমি আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,

‘ ঠিক আছে ঠিক আছে। এভাবে তাকানোর কি হলো। আমি যাচ্ছি না কোথাও।’
উনি এবার চোখ ছোট করে করে তাকাতেই আমি ভয়ে চেয়ারে পা গুটিয়ে বসলাম। আর তোতলিয়ে বললাম,
‘এই আপনার কি এই ভরবিকালে জ্বিন ভূতে আসর করেছে? ঝাটা আনবো? ‘
কথাগুলো আমি এমনিই মজা করে বললাম না, ওনাকে এই মুহূর্তে দেখে আমার সুবিধার মনে হচ্ছে না। আমার এমন কথা শুনে উনি একটা ধমক দিতেই আমি কান চেপে ধরলাম। উনি বলতে শুরু করলেন,
‘এই মেয়ে ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো না তুমি? রক্তে তো হিমোগ্লোবিন নেই। চোখ মুখ এমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কেন? আর এক্সামের এক্সকিউজ দেবে না একদম। ‘

আমি অবাক হয়ে আমার হাত আর পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একবার। নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম তারপর কিছু না ভেবেই বললাম,
‘ মিথ্যা কথা। আমি ফরসা হয়ে গেছি আগের থেকে আর আপনি আমার মতো অতো ফরসা না বলে আপনার হিংসা হচ্ছে তাইনা? ‘
উনি কিছু বলতে গিমেও বললেন না। আমার এমন লজিকলেস কথার কোন উত্তর নেই ওনার কাছে। আমার খাতার পেজে একটা ওষুধের নাম লিখে দিয়ে বললেন,
‘ এটা মামুকে বলবে এনে দিতে। আর এক সপ্তাহ পর তোমার এইচএসসি, তার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলে খবর আছে। ‘

ওনার লিখে দেওয়া ঔষুধটার দিকে তাকালাম আমি, ওনার হাতের লেখা বুঝতে গিয়েই যেন আমার র/ক্তের অর্ধেক হিমোগ্লোবিন উবে গেল, আমি চোখ মুখ ফ্যাকাশে করে বললাম,
‘ এসব কি? ‘
উনি জবাব দিলেন না, কফিতে এক চুমুক দিয়ে বললেন,

‘যখন ডাক্তার হবে তখন বুঝবে এটা কি। এখন নো মোর বকবক, চুপ করে বসো। ‘
আমি বসে রইলাম ওনার সামনে, উনি ফোন ঘাটছেন। আমাকে এভাবে ওনার সামনে বসে রাখার সায়েন্স আমি আজও বুঝলাম না। তবে এটা নতুন নয়। উনি এমনটাই করেন, যতখন ইচ্ছা এভাবে আমাকে পুতুলের মতো করে ওনার সামনে বসিয়ে রাখেন। নিজেকে আমার তখনই একমাত্র এলিয়েন মনে হয়। না জানি আজকেও কতোখন এভাবে বসে থাকবো। এতোটা সময়ে একটা লম্বা ঘুম দেওয়া যেত কিন্তু তাতেও ব্যাটার আপত্তি।

এভাবে প্রায় দেড় ঘন্টা ওনার সামনে বসে রইলাম। ঘুমে চোখ আমার ছোট ছোট হয়ে আসছে। উনি ফোনটা নিজের পকেটে রেখে আমার দিকে তুড়ি মেরে আমার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করে বললেন,
‘এই মেয়ে? ‘
আমি ঘুম ঘুম চোখে তাকালাম। উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘ এভাবে চুপচাপ বসে থাকাও একটা ব্যায়াম বুঝলে।’
আমি মনে মনে ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম,
‘ লাগতো না আমার এমন ব্যায়াম। অভদ্র ছেলে! ‘
আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি বলে উঠলেন,
‘তা দেড় ঘন্টা ধরে কি কি ভাবলে শুনি? ‘
আমি চোখ মুখ উল্টে বললাম,

‘আপনি সত্যিই অনেক ইনটেলিজেন্ট। এই এতোটা সময় আমাকে দিলেন তার জন্যই বললাম। জানেন এই এতোটা সময়ে যে আপনাকে কতোগুলো কথা শুনিয়েছি হিসাব নেই। মাঝে মাঝে এমন করবেন আমার ভাল্লাগে আপনাকে মনে মনে কথা শোনাতে। ‘

আমার এমন কথা শুনেও উনি রেগে গেলেন না। হো হো করে হেসে উঠলেন। ওনার হাসাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে চুল গুলো এলোমেলো করে দিতেই চুলগুলো আমার মুখের ওপর ঝোপড়ির মতো আছড়ে পড়লো, আমি চোখ ছোট ছোট করে ওনার দিক চেয়ে আছি। উনি উঠে দাঁড়ালেন।
‘ ফার্স্ট এক্সামের দিন তোমাকে আর সানা কে আমি দিয়ে আসবো রেডি থেকো। আর এই কদিন মন দিয়ে পড়াশোনা করো। এটা মনে রেখো গোল্ডেন এ প্লাস না এলে বিয়ে দিয়ে দেবো পেট মোটা জামাই দেখে। ‘

আমি ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অবশেষে বলেই ফেললাম,
‘আপনার সাথে এক সপ্তাহ আমার দেখা হবে না। ‘
উনি কিছু বললেন না, শুধু বললেন,
‘ অল দা বেস্ট মিস টুইটুই! ‘
আমি ওনার দিকে চেয়ে রইলাম অপলক। অপেক্ষার সময়গুলো এতো দীর্ঘ হয় কেন?

আরিশ ভাইয়া আজ আসবেন না, এমনকি আমার এক্সামের আগেও উনি আসবেন না। খাবার সামনে রেখে আম্মু আমাকে হাজারো কথা শোনাচ্ছে তার মধ্যে কয়েকটা হলো,
‘আমাদের সময় আমরা অন্যের বইখাতা নিয়েও পড়ালেখা করেছি, ঝড় বৃষ্টি বন্যার মাঝেও স্কুল কলেজ গেছি, পায়ে হেটে কলেজ যেতাম রিকশা নিতাম না,তোমরা তো এখন চার চাকা ছাড়া যাও না।’
আমি আম্মুর কথায় মন দিয়ে শুনতে লাগলাম হঠাৎ করে ফিক করে হেসে বলে উঠলাম,

‘ তুমি তো দেখি বিদ্যাসাগরের নাতনি। ‘
আমার কথাতে আম্মু ধমক দিতেই বাবা এলেন আর আমার পাশে এসে বসলেন।
‘ হ্যাঁ তোর আম্মু তো এসব বলবেই কারন এগুলো তো মিথ্যা নয়। ‘
আমি বাবার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই বাবা আমাকে আশস্ত করে বললেন,
‘ আরে এতো তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে যাস কেন মা পুরো কথা টা তো শোন।’
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
‘হমম হমম হমম। ‘

‘ তোর আম্মুকে তো রোদ বৃষ্টি ঝড়ের মধ্যেও কলেজে আসতে হতো কারন আমার সাথে রোজ তো দেখা করতে হতো। তারপর অন্যর কাছ থেকে বই চেয়ে পড়তো কারন বই কেনার টাকায় সে ফুচকা খেয়েছে, শপিং করেছে। তোর আম্মু ছিল বিশ্ব ফাঁকিবাজ বুঝলি। ‘
বাবার এমন কথা শুনতেই আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। আম্মু রাগে গজগজ করে উঠলো।
‘হ্যাঁ মেয়ের সামনেও আমার এমন বেজ্জাতি না করলে কি আর তোমার ভাত হজম হয়?’
কথাটা বলে আম্মু উঠে গেল। বাবা আর আমি মুখ চেপে হাসছি। আম্মু যেতেই দুজন সশব্দে হেসে উঠলাম। আমি বাবার বুকে মাথা রাখলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,

‘জানিস তো মা। তোর মা আমাকে খুব ভালোবাসতো আর এখনো বাসে। রোদ বৃষ্টি ঝড় যখন যে সময় আসতে বলতাম তখনই চলে আসতো, আমার খারাপ সময়েও তোর মা অনেক সাহায্য করেছে আমাকে। তার বইয়ের টাকায় সে আমাকে বই কিনে উপহার দিতো। তোর মায়ের অনেক ইচ্ছা ছিল স্বাবলম্বী হওয়ার, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, কিন্তু তোর নানাভাইয়ের জন্য আর হয়ে ওঠেনি সেটা। আমি যখন তোর মা কে বিয়ে করি তখন আমি বেকার। আমার পরিবার থেকে তোর মা কে সবাই মেনে নিয়েছিল। তোর ফুপি আর ফুপা অনেক খারাপ সময়ে আমাদের পাশে ছিল। তেমনি আরিশও। ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো। ছেলেটা এক আকাশ সমান কাওকে ভালোবাসতে পারে। আমি ওর চোখে সে ভালোবাসা দেখেছি। সেই মেয়ে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী।

আমি বাবার বুকে মাথা রেখে নিরবে সবটা শুনছি। আমার মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে হয়, কে সেই ভাগ্যবতী?
আমি চোখ বন্ধ করলাম।্যএকদিন আশরাফ চাচা আমাকে বলেছিলেন,
‘ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু জয় করা যায়, শুধু মানুষটা ভালো হওয়া চাই যে ভালোবাসতে পারে নিঃস্বার্থ ভাবে।
বাবা আমার ভাবনা ভাঙিয়ে বললেন,
‘আমার মেয়েও একদিন এমন সৌভাগ্যবতী হবে। তাকে কি না ভালোবেসে পারা যায়? ‘

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১১

আমি শিউরে উঠলাম। বাবার কথার জবাবে কি বলবো আমার জানা নেই। আচ্ছা আমি কি কাওকে ভালোবাসি? আর ভালোবাসলেই বা কেমন অনুভুতি হয়?

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১৩