মধুবালা পর্ব ১১

মধুবালা পর্ব ১১
ফারজানা আক্তার

তুইও তো ভালোবাসিস ছোঁয়াকে। তুই তো বুঝিস ভালোবাসার মর্ম তবে কেনো এমন করছিস আমার সাথে? ছোঁয়া তার জেটাতো ভাই শুভ্রকে ভালোবাসে শুধু। প্লিজ ফিরিয়ে দিসনা আমায়। ভীষণ ভালোবাসি তোকে।
কান্নারত কন্ঠে তানহা কথাগুলো বলে রকিকে। রকি কানে ফোন চেপে রেখে শুনছে সব।

ছোঁয়া শুভ্রকে ভালোবাসে কথাটা শুনতেই জলে চোখ ভরে উঠলো রকির। রকি যে ছোঁয়াকে মন থেকেই ভালোবেসে ফেলেছে। তানহা রকির কোনো রেসপন্স না পেয়ে চুপ করে শুনছে রকির নিশ্বাসের শব্দ। এই অদ্ভুত রকমের শব্দ টাই যে তানহাকে আরো পাগল করে তুলেছে।
রকি কিছু না বলেই কল কেটে দেয়। তানহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছোঁয়া কিছুতেই মানতে পারছেনা আলিফ লিলির সম্পর্ক। ছোঁয়ার মোটেও ভালো লাগেনা আলিফ নামের পুরুষটাকে। আলিফের নাম শুনতেই ছোঁয়ার মুখে ফুটে উঠে বিরক্তির রেখা। আলিফকে যেনো ছোঁয়ার শ’ত্রু’র মতো মনে হয় কিন্তু এর কারণ সে নিজেও জানেনা।

ছোঁয়া মুখ গু’মো’ট করে বসে আছে। লিলি বসে আছে অপরাধীর মতো। লিলির বেলকনিতে একটা দোলনা আছে। এই দোলনাতেই দু’জন বসে আছে আর নীরবতা পালন করছে।
সব নীরবতা ভে’ঙে লিলি বলে “এই ছোঁয়া প্লিজ এমন মুখ করে বসে থাকিস না। আলিফ স্যার সত্যিই অনেক ভালো রে। আলিফ স্যারের বোন আলিয়া আমাদের সানিয়ার সাথে একই কলেজে একই সেকশনে পড়ে। আর আমার নাম্বার টা নাকি আলিয়া সানিয়ার থেকে নিয়ে আলিফ স্যারকে দিয়েছে।

তুই শুধু শুধুই চিন্তা করছিস।
আলিফ স্যার মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হলেও মনটা বেশ ভালো আলিফ স্যারের। খুব ভালোবাসে আমায় আলিফ স্যার।
এই ছোঁয়া। ”

লিলি কথা বলেই যাচ্ছে। ছোঁয়া এসব কথায় পাত্তা না দিয়ে বাগান বিলাশ করছে।
লিলির বেলকনি থেকে বাগানের ফুলগুলো বেশ দারুণ লাগে দেখতে। ছোঁয়ার রুম নিচে হওয়ায় তেমন ভালো করে উপভোগ করতে পারেনা সে। ছোঁয়াকে চুপচাপ দেখে লিলি খুব শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে ছোঁয়াকে। মুহুর্তেই ফিক করে হেসে দেয় ছোঁয়া। লিলিও হাসে।

টিয়া শুভ্রর রুমে আসে ওকে গুডনাইট বলার জন্য কিন্তু শুভ্র ওকে পাত্তা দেয়না। এতে টিয়ার খুব ক্ষোভ হয় ছোঁয়ার উপর। টিয়া জেনে গেছে শুভ্র যে ছোঁয়ার সাথে জেদ ধরেই এই বিয়েতে মত দিয়েছে। টিয়া তার ফুফি নাজমা বেগমকে অনেক দিন ধরেই বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে এই বিয়ের জন্য। তারপর নাজমা বেগম বেলাল মির্জাকে বলে শুভ্রকে জানিয়েছে।

টিয়া নিজের রুমে গিয়ে রা’গে ফুঁসছে আর ছোঁয়াকে বাজেভাবে গা’লি দিচ্ছে। টিয়ার বাবা মা কোনোভাবে ওকে বুঝানোর চেষ্টা করছে। টিয়া রা’গি কন্ঠে বলে উঠে “আরে আব্বু আম্মু তোমরা বুঝতেছো নাহ। এই মির্জা বংশের একমাত্র আঙ্গুর শুভ্র। ওকে হারালে কিভাবে চলবে বলো? এই মির্জা বংশের সব ধন সম্পদ শুভ্রর। শুভ্রকে জিততে পারলে আর পিঁছু ফিরে তাকাতে হবেনা আমাদের। তোমরা কিছু না করলে আমি কিন্তু ওই ছোঁয়াকে শেষ করে দিবো, খু’ন করে ফেলবো আমি ওকে মনে রেখো তোমরা।

ছোঁয়ার মতো দুই টাকার মেয়েকে গু’ম করতে আমার ১সেকেন্ডও লাগবেনা।”
“দেখো আম্মু মাথা ঠান্ডা করে কাজ করতে হবে এখন। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে তো সব তোমার হাতে। আর শুভ্র বাবা যদি একবার জানে ছোঁয়ার জন্ম পরিচয় তবে ছেলেটা নিজেই ছোঁয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।”

টিয়ার বাবা কথাটা শেষ করতেই টিয়ার মা উনার হাত চেপে ধরে বলেন “দেখুন ওইদিকে। দরজার বাহিরে মনে হয় কেউ আছেন। আমাদের কথা কেউ শুনে ফেললো না তো?”
টিয়া ওর মাকে থামিয়ে দ্রুত দরজা খুলে দেখে কেউ নেই। টিয়ার মনে এক অজানা সন্দেহ বাসা বাঁধতে শুরু করলো।
আর কয়দিন পরেই তো বিয়ে। এটা ভেবেই নিজেকে সান্তনা দেয় টিয়া।

শুভ্র ছোঁয়ার মা সেলিনা পারভীনের কাছে গিয়ে বসে আছে। কোনো কথা বলছেনা। সেলিনা পারভীন কফি করে এনে দিলেন। শুভ্র কফিতে চুমুক দিয়ে সেলিনা পারভীনের দিকে তাকিয়ে “মেজু আম্মু একটা সত্যি কথা জানতে চাইলে বলবে কী আমায়। প্লিজ মেজু আম্মু না না করিওনা।”

রাত হয়েছে অনেক। ছোঁয়ার ঘুম আসছেনা। সে এখনো ভাবছে সত্যি কী বিয়ে করে ফেলবে শুভ্র ভাই অন্যকাউকে? এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেলো ছোঁয়া। বুকটা যেনো শূন্য হয়ে আছে ভীষণ।
সকালে ঘুম ভা’ঙ’তে’ই ছোঁয়া উঠে ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজ পড়ে নিলো।
মোনাজাতে চাইলো শুধু শুভ্রকে আর বালা জোড়া।
পরে নিজের এমন চাওয়াতে নিজেই হেঁসে উঠলো।

সবাই উপস্থিত আছে নাস্তার টেবিলে কিন্তু সেলিনা পারভীন নেই। ছোঁয়া ওর মায়ের রুমে গিয়ে দেখে ওর মা ঘুমিয়ে আছেন।
ছোঁয়া অনেক ডাকাডাকি করলো সেলিনা পারভীন কে কিন্তু সেলিনা পারভীন আর উঠলেন না। শান্তির ঘুম দিয়ে চলে গেছেন সবাইকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য।

ছোঁয়া কাঁদতে কাঁদতে বারবার চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। পরিবারের সব মহিলা/মেয়েরা ছোঁয়াকে সামলাতে ব্যাস্ত। কিন্তু সামলাতে বেশ কষ্ট হয়ে পরছে ওকে। একমাত্র মা ছাড়া আর কারো কাছে ছোঁয়া ছোটবেলা থেকে নিঃস্বার্থ আদর ভালোবাসা পায়নি। শুভ্র দূর থেকে দেখছে সব কিন্তু কাছে এসে ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরার মতো সাহস সে পাচ্ছেনা। শুভ্র নিজেও কাঁদছে।

মুহুর্তেই মির্জা বাড়িতে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। কিন্তু কারো নজরে পরেনি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা টিয়ার রহস্যময় হাসি।
মান্নান মির্জা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত। সেলিনা পারভীনকে কবর দিয়ে এসে বসে আছেন অসহায়ের মতো।
ছোঁয়া ছুটে গিয়ে মান্নান মির্জাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভে’ঙে পরেন। কাঁদতে কাঁদতে আবারো জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ছোঁয়া।
সোহার চোখের জল যেনো শুকিয়ে গেছে। অষ্টাদশীর মনটা একেবারেই ভে’ঙে গিয়েছে মায়ের হঠাৎ মৃত্যুতে।
ছোঁয়া আর সোহা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছে কিন্তু ছোঁয়া এখনো কান্নায় লুটিয়ে থাকলেও সোহা মূর্তি হয়ে বসে আছে এক কোণে।

কেটে গেলো কয়েকদিন। আজ শুভ্রর বিয়ে। গায়ে হলুদ আর করা হলোনা বড় অনুষ্ঠান করে।
শুভ্র বিয়েটাও বন্ধ করতে চেয়েছিলো কিন্তু বেলাল মির্জা রাজি হয়নি।
বেলাল মির্জা বলেছেন অনুষ্ঠান পরে হোক কিন্তু বিয়েটা হয়ে যাক। সবাই সেটা মেনে নিয়ছেন।
একবার এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়ে পিঁছিয়েছে তাই এখন আর পিঁছাতে চাননা তিনি বিয়েটা। শুভ কাজ নাকি এভাবে বারবার পিঁছানো ঠিক না। তাই মান্নান মির্জা আর কিছু বলেননি কিন্তু উনি জানিয়ে দিয়েছেন ছোঁয়া সোহা আর উনি এই বিয়েতে উপস্থিত হতে পারবেননা।

এবার কিন্তু আনজুমা খাতুনও চেয়েছিলেন বাড়ির শোক কেটে গেলে তারপর বিয়েটা নামাতে কিন্তু কারো কথায় পাত্তা দেননি বেলাল মির্জা। বেলাল মির্জার মনে টিয়া ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে দেরি হলে ছোঁয়া শুভ্রকে বস করে নিতে পারে আর বেলাল মির্জা ছোঁয়াকে মোটেও সহ্য করতে পারেননা।

টিয়া বঁধু সাজার জন্য পার্লারে চলে গিয়েছে। বাড়ির ছোটদের মনেও আনন্দের ছিটাফোঁটা নেই। লিলি তো সকাল থেকেই দরজা বন্ধ করে বসে আছে একা। শুভ্র লিলির দরজায় কয়েকবার নক করেছে কিন্তু লিলি ইচ্ছে করেই দরজা খুলেনি।
জায়েদা বেগম ছোঁয়ার চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে। চুলগুলো এখনও কোমর ছুঁতে পারেনি তবে আগে থেকে কিছুটা লম্বা হয়েছে। ছোঁয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জায়েদা বেগম অনেক বুঝিয়েছেন তবুও ছোঁয়ার কান্না থামছেনা।

জায়েদা বেগম নিজেও কাঁদছেন আঁচলে মুখ লুকিয়ে কিন্তু ছোঁয়াকে তা বুঝতে দিচ্ছেননা উনি।
টিয়া বঁধু সেজে ফিরেছে পার্লার থেকে। শুভ্রকে বর সাজে সাজিয়েছেন ওর ছোট চাচা জীবন মির্জা। যদিও জীবন মির্জারও মনমানসিকতা ভালো নেই তবুও এইটুকু করা যে তার কর্তব্য।

মধুবালা পর্ব ১০

কাজিও চলে এসেছেন। শুভ্রর মনে হচ্ছে সব যেনো খুব দ্রুত গতিতে এগুচ্ছে। আরেকটু দেরি হলেও মন্দ হতোনা। শুভ্রর বুকটা ভার হয়ে উঠেছে হঠাৎ। পাশাপাশি বসানো হয়েছে শুভ্র টিয়াকে। টিয়ার মুখে রহস্যময় হাসি।
এইদিকে কাজি এসেছে শুনে জায়েদা বেগমকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয় ছোঁয়া। তখনই দরজায় কেউ নক করতেই সেদিকে তাকায় দু’জনেই।

মধুবালা পর্ব ১২