মনের কোণে পর্ব ১২

মনের কোণে পর্ব ১২
আফনান লারা

‘ছোকরা কিছু বলবে?ওমন চেয়ে আছো কি জন্যি?’
নাবিল চুপ করে শুধু দেখছে লোকটাকে।অফার চেয়ে বসবে নাকি বসবেনা সেটার অংক কষাকষি করছিল মনে মনে।লোকটা ঠিক বুঝে গেলো।বাম পাশের খালি সিটটাতে পা তুলে বসে বললো,’বুঝলাম সবই।চোখের ভাষা একটু আকটু জানা আছে,আদিমকালে আমার বাপ দাদা জৌতিষী করতেন।আমি তাদের থেকে কিঞ্চিত ক্ষমতা লাভ করে এই যুগে এসে প্রকাশ করতে পারি।
তবে চোখের ভাষা বলছে তোমাদের নকল রেজিস্ট্রি লাগবে কিন্তু তার কারণ যে আমায় খোলসা করে বলতে হবে,তা নাহলে আমি বাপু এইসবে নামবোনা’
নাবিল লিখির দিকে ফিরে বললো,’কি বলো?’

লিখি চটে গেলো।রেগে মেগে বললো,’নকল নাহয় বাহিরের মানুষ জানবেনা,কিন্তু আমরা তো জানি।এভাবে অবিবাহিত হয়ে দিনের পর দিন একই ঘরে থাকা খাটে??আপনি নিজের বিবেককে প্রশ্ন করুন’
‘দেখ মা!দা বটি সবার ঘরেই আছে,তাই বলে কি সবাই ডাকাত?তুমি যদি শুদ্ধ হও,তোমার মন যদি শুদ্ধ হয় এই ছেলে যদি ভাল হয় তবে এক ঘরে থেকেও তোমরা একে অপরকে স্পর্শ ও করবেনা।আমি যতদূর জানি আর কি।এই জামানাতে তো একজন আরেকজনের পাশে বসলেও আকর্ষণ সৃষ্টি হয় একে অপরের প্রতি।তোমাদের জীবন,তোমাদের সিদ্ধান্ত আমি শুধু আগাই দিব ব্যস”
লিখি চোখ কঠিন করে নাবিলের দিকে তাকিয়ে আছে।
এই নিয়ে আর কোনো কথা হয়নি দুজনের মাঝে।ঐ লোকটা উঠে একটা স্টেশনে নেমেও গেছিল।ঢাকা আসতে আসতে রাত বারোটা বেজে গেছে।
যেন রাত বারোটার সাথে তাদের ভাল সম্পর্ক।বেছে বেছে এই সময়টাতেই তাদের পথে উপস্থিত হতে হবে।
লিখি একাই হোস্টেলে ফিরে এসেছে।গেট দিয়ে ঢুকবে এমন সময় দারোয়ানের ডাক শুনে পিছু হটলো।
‘মা তুমি যাইওনা,তোমারে সবাই মিলে খুঁজতেছে।মনে হয় তোমার পরিবারের কেউ এসেছে দলবল নিয়ে, তোমাকে পেলে নিয়ে যাবে’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লিখির ভয় হলো।মনে পড়ে গেলো দেড় বছর আগের ঘটনাটার কথা।
সদ্য অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছিল সে।বাবার সবসময় লোভ থাকতো টাকাপয়সার প্রতি,তিনি চাইতেন তার একমাত্র মেয়ের জন্য কোটিপতি এক ছেলের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আসবে।কিন্তু ছেলে সুন্দর হলে ঐ ছেলের ইনকাম সুন্দর হয়না।
একদিন এমন একটা ছেলে পেলেন যে সুন্দর আছে,টাকা পয়সা আছে কিন্তু বয়স কিঞ্চিত বেশি।ছেলেকে দেখার পর লিখি মানা করে দিয়েছে সাথে সাথে।কিন্তু বাবা তার কথার তোয়াক্কা না করে বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিলেন।শুধু তাই নয়!পরেরদিন কাবিন করার ঘোষণাও দিলেন।পুরো বাড়ির মানুষ ব্যস্ত হয়ে গেলো আয়োজনে।
লিখির হাতে বারো ঘন্টা ছিল।একা থাকার অভ্যাস তার কখনও ছিলনা কিন্তু নিজের ক্যারিয়ার,নিজের জীবন বাঁচাতে হলে তাকে এই জায়গা ছাড়তে হতো।

নিজের জামাকাপড় ব্যাগ ভর্তি করে নিজের গলার স্বর্নের চেইনটা নিয়ে সে বেরিয়ে এসেছিল “মহসিন ভিলা” থেকে।আর পেছনে ফিরে তাকায়নি।রাতের অন্ধকারে ঢাকার বাসে উঠে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল।ভেবেছে এটাই শেষ দুঃখের।কিন্তু নাহ!
কয়েকটা মাস গেলেই এই দূর্গম অতীত হানা দেয়।কেড়ে নিতে চায় সকল সুখকে।যেমনটা আজ হলো।আজ বেশি হচ্ছে।কেমন করে যেন তারা যেন গেলো এই গার্লস হোস্টেলের কথা!
দারোয়ানের কথায় পিছিয়ে গেলো সে।যতদূর পেছানে যায় ততদূর।কোথায় যাবে!অন্য হোস্টেলে ঢুকতে হলে তো আবারও কাগজপত্র লাগবে।এই হোস্টেলে নাহয় হেনার বাবা -মা সাহায্য করেছিলেন।কিন্তু অন্য হোস্টেলে কে সাহায্য করবে?

নাবিলের ও এলই পরিণতি।ছাত্রাবাসের ধারের কাছেও যেতে পারেনি।সয়ং বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন গেটের বাহিরে।তিনি আজ ওকে নিয়েই ছাড়বেন।
নাবিল ও সরে আসলো।চন্দ্রাহাট দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলো লিখিকে আর ঐ মহিলাকে।লিখি তার কাছে মিনতি করছিল থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার।
‘দেখো মেয়ে!আমি নিজেই থাকি কুঁড়েঘরে।আমার আবার পাঁচটা পোলাপান।তোমায় কি করে রাখবো ওদের মাঝে?সবগুলো জোয়ান পোলা আমার।চেয়েও তো রাখতে পারবোনা।কি করি?’
লিখি চুপ করে আছে।নাবিল পাশে এসে দাঁড়ালো তখন।ওকে দেখে লিখি নিজের চোখের পানি লুকাতে অন্যদিকে ফিরে মুছে ফেললো।
নাবিল বুঝতে পেরেছে ও কাঁদছে।

ফোন বের করে একটু দূরে সরে এসে মাকে কল করলো সে।
‘কিরে নাবিল?ঠিক আছিস বাবু??তোর বাবা তো নাকি আজ ছাত্রাবাস থেকে ফিরবেইনা,খেয়েছিস কিছু?’
‘মা একটা ঘটনা বলছি তোমায়।আমায় শুধু সমাধান দেবে?’
‘কিসের ঘটনা?’
‘ধরো,একটা ছেলে যে পরিস্থিতিতে পড়েছে একই স্থানে একটা মেয়ে ও একই পরিস্থিতিতে পড়েছে।ছেলেটার সাথে মেয়েটার কদিনের পরিচয় হয়।তারপর দুজনে আবার আলাদা।এখন এমন একটা পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ালো যে তাদের দম ফেলাও দায়ের।এই সময়ে তাদের একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন নিজেকে সমাজের থেকে আলাদা রাখতে।লুকিয়ে রাখতে।
জানোই তো অবিবাহিত ছেলে মেয়ে একসাথে থাকা অন্যায়।তবে কি করা উচিত তাদের?’
‘এটা কার কাহিনী?’
‘আমার চেনা একজনের।তুমি শুধু বুদ্ধি দাও’

‘কদিনের পরিচয়ে কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ত ঠিকনা।যদি আশ্রয়ের একান্তই দরকার পড়ে তবে আমি প্রিপার করবো ওদের বিয়ে করে নেওয়া উচিত,লিগালি।
এরপর তারা একসাথে থাকলেও সেটা অন্যায় হবেনা যেহেতু তারা পরিস্থিতির শিকার। পরিস্থিতিতে পড়ে অন্যায় কাজ না করে যদি হালালটা করে হবে আই থিংক সেটাই বেটার।’
নাবিল ফোন রেখে দিলো।মা হয়ত সত্যি ধরে নিয়েছে কাহিনীটা ওর না।যদি ওর হতো এবং মা সেটা বিশ্বাস করত তবে কখনওই এই উপদেশ দিতেননা।
‘লিখিকে লিগালি বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।আমি কোনো জব করিনা,আমার ক্যারিয়ার গড়িনি।ইভেন ওকে আমার স্ত্রী হিসেবে পছন্দ ও না।কিন্তু এভাবে ওকে রেখে আমি নিজের ব্যবস্থা করতে যাব সেই মনমানসিকতাটুকু ও তো আমার নেই।আসছেনা’
মন খারাপ করে নাবিল পকেটে ফোনটা ঢুকাতে গিয়ে দেখলো সেই লোকটার কার্ড।এই মানুষটা ছাড়া আর কেউ সাহায্য করতে পারবেনা যা বোঝা যাচ্ছে।লিখি মন খারাপ করে হাঁটা শুরু করেছিল,নাবিল পেছনে তাকিয়ে ওকে অনেকদূরে দেখলো।দেরি না করে ফোন কানে ধরে ছুটে গেলো ওর কাছে।

‘লিখি ওয়েট’
‘কি?’
‘হ্যালো আঙ্কেল।আমি নাবিল’
‘কেঠা তুমি?কোন বিল?’
‘আমি ঐ যে বাসে কথা বলেছিলাম,কার্ড দিয়েছিলেন।আমাকে রেজিস্ট্রি করার কথা বলেছিলেন,পরে পাশের জন মানা করলো’
‘ওহ হ্যাঁ।মনে পড়েছে।হঠাৎ এত রাতে?’
‘লাগবে’
‘ঐ মেয়ের মত আছে তো?’
‘ওর মতকে ওর বাবা গুরত্ব দেয়নি বলে পালিয়ে এতদূর এসেছে। আমওপ ওর মতকে গুরুত্ব দিব না, কিন্তু আমার থেকে পালাতে পারবেনা এটা সিওর।আপনি কাল একবার দেখা করতে পারবেন?আপনার অফিসের লোকেশান বলেন।আমরা আসবো’
‘ওরকম অফিস থাকলে আমি এতদিনে জেলে থাকতাম।আমি তোমাদের একটা জায়গার নাম বলবো, ওখানে আসবে।কাজটা আমি করবোনা, আমার কর্মচারী করবে।নিজেদের জন্মনিবন্ধন কার্ড,আইডি কার্ড এসব নিয়ে আসবে।আর বাবা মায়ের গুলা সব ফেক বসিয়ে দেবো সমস্যা নাই।এখন রাখছি, আমি বেশিক্ষণ কারোর সাথে কথা বলিনা’

নাবিল ফোন রাখতেই দেখলো লিখি রেগে মেগে গাল ফুলিয়ে রেখেছে।
‘কি করতেছেন কি আপনি?আপনাকে বলছিনা, আমি মিথ্যে সম্পর্কে জড়াবো না?’
‘তবে থাকো এই পথে।আমি যাচ্ছি’
নাবিল সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে।লিখি অনেকক্ষণ ধরে ওর চলে যাওয়া দেখলো,এরপর হঠাৎ কি মনে করে ছুটে গেলো ওর কাছে।তারপর বললো,’ঠিক আছে আমি রাজি’
নাবিল নিচের ঠোঁট উল্টে বললো,’তাও আজকের রাতটা সএই ফুটপাতেই কাটাতে হবে।থাকার জায়গা থেকেও নেই,পাহারাদারে ভর্তি।
রাতটা কোনোমতে দুজনে কাটিয়ে নিলো।সকাল হতেই কিছুটা তড়িগড়ি করেই দুজনে পৌঁছে গেলো সেই জায়গায় যে জায়গাতে ঐ লোক আসতে বলেছিল।
একটা পরিত্যাক্ত কারখানাতে।অথচ ভেতরে একটা অফিসের মতন করে রাখা।বাহিরে থেকে বোঝা যাবেনা ভেতরে কি তৈরি হয়ে আছে।ভেতরে সাজানো অফিস,কম্পিউটার, দলিল দস্তাবেজ। লোকজনে ভর্তি।কিন্তু ঐ লোকটা তো বলেছিল তার কোনো অফিস নেই।তবে কি যেখানে- সেখানে এমন অফিস করে তুলতে পারে?আজব একটা লোক।দেখে মনে হয় অফিসিয়াল’

নানারকম ভাবনা চিন্তা মাথায় নিয়ে ভেতরে ঢুকে দুজনে চেয়ার টেনে বসলো।যে কাজ করবে সে আসতে দেরি করছিল।আধ ঘন্টা পর অবশেষে তারও দেখা মিললো।সাদা পোশাক পরা ছেলেটি দ্রুত হেঁটে এসে চেয়ারে বসেই ওদের হাত থেকে কাগজ গুলা কেড়ে নিয়ে বিড়বিড় করে পড়ে নিলো।এরপর কম্পিউটারে টাইপ করে ওদের সামনে মোটা পৃষ্ঠার একটা বই এগিয়ে দিয়ে বললো সই করতে।
এরপর আবার ওদের দুজনের জন্মনিবন্ধনের কাগজ দেখে ছেলেটা টপাটপ আবারও টাইপ করে নিলো।বাহিরে থেকে দুই জোড়া কাপল এসে হাজির ওদের পাশে।এরাও বিয়ে করতে এসেছে।কিন্তু তাদের এখন আসার কারণ হলো তারা স্বাক্ষী হিসেবে সই দিবে।
লিখির মনে সংশয় বাসা বেঁধে ছিল তাও সেই সংশয়কে দূরে ঠেলে সই করলো সে।নাবিল ও সই করলো।একে একে সেই কাপলরাও স্বাক্ষী হিসেবে সই করলো।
পেছন থেকে হঠাৎ শোনা গেলো ঐ লোকটার গলার আওয়াজ।তিনি হাতে ফুলের মালা নিয়ে এসে ওদের দুজনের গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন,’বিবাহের জন্য শুভকামনা’
‘আপনি এমন ভাব করছেন যেন সত্যি সত্যি’

লিখির কথা শুনে লোকটা খিলখিল করে হেসে দিলো।হাসতে হাসতে চেয়ার টেনে বসে ইশারা করলো বাকি কাপলদের।তারা বাহিরে চলে গেছে তার ইশারা দেখে।
‘আমি একজন সমাজসেবক।এছাড়াও আমার পরিচয় হলো আমি একজন উকিল।আমি সমাজের একটা বিশেষ উন্নয়নের অংশীদার হতে চাই বলে একটা পরিকল্পনা করে ফান্ড তৈরি করেছি।এতে কাজ করে আমার পঞ্চাশ জন কর্মচারী। আমরা শুরুতে বলি নকল রেজিস্ট্রি। আসলে কিন্তু সেটা নয়।তোমাদের মতন কিছু যুবক- যুবতীরা সমাজে অন্যায় ফলানোর জন্য নকল রেজিস্ট্রি করে সংসার করে,একসাথে বসবাস করে।তোমাদের পাপ থেকে দূরে রাখতে আমার এই পরিকল্পনা।তোমরা ভাবলে নকল বিয়ে অথচ তোমরা কি জানো আজ তোমাদের রেজিস্টার করে লিগালি বিয়ে হয়ে গেছে??

মনের কোণে পর্ব ১১

আজ থেকে তোমরা নকল না,সত্যিকারের স্বামী -স্ত্রী। এই জন্য প্রবাদ আছে—
সই করার আগে ভেবো
সই করার পর কেঁদোনা।
তোমাদের হাল হলো সেরকম।তবে আমার সৎ কাজের বোঝা বাড়লো।তোমাদের ইল-লিগাল থেকে লিগালে নিয়ে আসলাম’
লিখির মাথায় যেন বা*জ পড়েছে।মাথয় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে গেছে সে।

মনের কোণে পর্ব ১৩