মনের কোণে পর্ব ৩৬

মনের কোণে পর্ব ৩৬
আফনান লারা

ছোটখাটো সভার আয়োজন হয়েছে বাগানে।এক পক্ষ হলেন রুহুল আমিন আর অন্য পক্ষ অনাবিলদের।
অনাবিল কি আর নিজের মত প্রকাশ করবেন,তিনি বসে বসে পান চিবোচ্ছেন।সামিয়া হাজার চেষ্টা করেও তার পান চিবানো থামাতে পারেনি।সকাল থেকে পাঁচটা পানের খিলি তার খাওয়া হয়ে গেছে অলরেডি। রুহুল আমিন খুশি হলেন এটা দেখে,তিনি ভেবেছিলেন হয়ত তার পান খাওয়া বেয়াইয়ের পছন্দ হবেনা।এখন তো তার সব উল্টা হচ্ছে।বেয়াই দেখি একসের মনের মতন।

‘আসলে আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি আর বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করে?তারা তো কেবল নিজেদের পছন্দটাই বোঝে।’
‘ঠিক বলেছেন অনাবিল সাহেব।লিখির জন্য যে ছেলে আমি পছন্দ করেছিলাম তাকে ওর পছব্দ হয়নি,আমি জোর করায় সে দুইটা বছর বাড়ি থেকে কত দূরে গিয়ে ছিল এবার ভাবেন কেমন তেজ’
‘আর আমার ছেলেকে ভাল একটা পজিশনে নেওয়ার জন্য আমি বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিলাম।অথচ সে কি করলো!সে বাসা থেকে পালিয়ে গেলো।আমার সামনে ধরাই দেয়নি মাসা-মাসি।’
‘কিন্তু নিয়তি তাদের দুজনকে এক করে বিয়ের বন্ধনে আটকে দিলো।এটাই তাদের জন্য উচিত হয়েছে বলে আমি মনে করি ‘
‘আমার কাছেও উচিত মনে হলো।যা হয়েছে একেবারে ঠিক হয়েছে’
‘আমি তো মেনে নিয়েছি সেদিনই।আপনি কি মানলেন?’
‘আমার শুধু দেখার ইচ্ছা ছিল আপনাদের পরিবার কেমন সেটা।দেখা হয়ে ভালোই লাগলো।আমার আর কোনো আপত্তি নেই কোনোকিছুতে’
‘আলহামদুলিল্লাহ ‘

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মা নিজের হাতে বিরিয়ানি রান্না করছেন সবার জন্য।লিখি পাশেই তাকে বসে চিপস খাচ্ছিল।নাবিল নাহিদকে নিয়ে ঘুরতে গেছে এগারোটার দিকে,আর মিসেস সামিয়া নিচে বাগানে অনাবিলের কাছে।
লিখির কাছে এই সময়টা এত বোরিং লাগছিল।নাবিল কাছাকাছি না থাকলে তখন ওর কাছে সময়টা বড্ড বোরিং লাগে।একেবারে বিরক্ত।এর আগে তার এমন লাগত না,যখন সে নাবিলকে চিনতোনা তখন কি করে যে সময় কেটে যেতো।

পা দোলাতে দোলাতে চিপসের প্যাকেটে হাত ভরে সে মায়ের রান্না করা দেখছিল।কি সুন্দর রান্না করে মা।আর সে কেবল একটু একটু পারে,পুরোটা পারেনা।হঠাৎ তখন সামিয়ার আওয়াজ পেয়ে লিখি পা দোলানো বন্ধ করে তাক থেকে নিচে নেমে গেলো।উনি লিখির হাত ধরে ওখান থেকে নিয়ে আসলেন।ওকে নিয়ে তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা রুমে নিয়ে এসেছেন সোজা।লিখি ভয়ে শেষ।সকালের সেই কান্ড নিয়ে না জানি বকাবকি করে ফেলে আবার।সেজন্যই বুঝি এতদূর নিয়ে আসা।
কিন্তু নাহ।উনি ট্রলি ব্যাগের চেইন খুলে কিছু গয়না আর একটা লাল টুকটুকে শাড়ী বের করে ওর সামনে ধরলেন।লিখি তার হাত থেকে যথারীতি নিলো সেগুলো।এবার তিনি বললেন,’এগুলো এনেছি তোমাকে বউয়ের বেশে বরণ করে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব বলে, এভাবে তো নতুন বউকে নিয়ে যাওয়া যায়না।আর তুমি কোনোদিন আমাদের বাড়িতে যাও ও নি।

তাি সাজিয়ে নেবো ভেবে আমি আসার সময় এগুলো গুছিয়ে এনেছিলাম,ধরো এখন।আজ রাতে আমরা ঢাকায় ফিরে যাবো।তুমি তখন সেজে নিও’
লিখি মাথা নাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তখনই মা পেছন থেকে এসে ঠাস করে ওর মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে বললেন,’সালাম কর! ‘
লিখি জিভে কামড় দিয়ে সালাম করলো তারপর ওগুলো নিয়ে তার রুমে চলে গেছে।লিখির মা এবার মিসেস সামিয়ার পাশে বসে গেছেন গল্প করতে।

লাল শাড়ীটাকে গায়ে জড়িয়ে লিখি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিল, তাকে কেমন লাগে দেখতে।
এর আগে লাল শাড়ী তার পরা হয়নি।আসলেই লাল শাড়ীতে একটা গুণ আছে।এটা সৌন্দর্য অধিক বাড়িয়ে দেয় এবং নতুন বউকে নতুনের মতন করে রাখে।লিখির আর তর সইছেনা শাড়ীটা পরার।কি সুন্দর কিণারায় পুতির কাজ করা।মন চাইছে এখনই পরে ফেলতে।কিন্তু সে তো শাড়ী পরতে জানেনা।উল্টে নিজে পরতে গেলে শাড়ীটার ভাঁজই নষ্ট হয়ে যাবে।

নাবিল আসলে ওর হেল্পে পরে নিবে।আর দেরি করা তার পক্ষে অসম্ভব।
ফোন নিয়ে তাই নাবিলকে একটা কল করলো সে।নাবিল ততক্ষণে বাসায় এসে গেছিলো।
লিখি ভাবলো নাবিল ইচ্ছা করে ওর কল ধরেনি তাই রাগ করে ফোন রেখে শাড়ীটা নিজে নিজেই পরা শুরু করেছে।সে ভেবেছে নাবিল আসেনি এখনও।নাবিল ফোন দেখতে দেখতে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দুজন দুজনকে দেখে অন্যদিকে ফিরে গেলো।
নাবিল দূরের ফ্লাওয়ার ভাসের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,’চেঞ্জ করার আগে দরজা লক করতে হয়’
‘আমার রুমে কেউ আসেনা।আর আমি কি জানতাম নাকি যে আপনি হুট করে এসে পড়বেন?’
‘আমি এই জন্য কল কেটেছিলাম’

‘আচ্ছা এসেছেন যখন, আমাকে শাড়ীটা পরতে হেল্প করুন’
নাবিল হাত ভাঁজ করে বললো,’ঠিক ঠাক হয়ে দাঁড়াও তারপর।’
লিখি আঁচল ঠিক করে গায়ে দিয়ে বললো,’এবার ফিরেন’
নাবিল এবার রুমে এসে দরজা লাগিয়ে চুপচাপ কুচি করতে মন দিয়েছে।লিখি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললো,’আপনি শাড়ী পরাতে জানেন কি করে?’
‘নাহিদকে ২০০বারের মতন বউ সাজিয়েছিলাম।আমার একটা ছোট বোনের অনেক শখ ছিল।কিন্তু সেই শখ পূরন হয়নি বলে নাহিদকে দিয়ে মেটাতাম।ওকে বউ সাজাতাম ইচ্ছে হলেই।তো আম্মু আমাকে শাড়ী পরানো শিখিয়েছিল একদিন এরপর থেকে আমি নিজেই শাড়ী পরাতে জানি নাহিদকে।’
‘ওহ এই ব্যাপার’
‘তো তুমি কি ভাবলে?’
‘ভাবলাম প্রাক্তনকেও শাড়ী পরিয়েছেন’
‘ওর সাথে আমার যে সম্পর্ক ছিল ওটা ছিল ধরা ছোঁয়ার বাহিরে’
‘হইছে আর সাফাই গাইতে হবেনা।’

লিখিকে শাড়ীটা খুব সুন্দর করে পরাতে পারলো নাবিল।লিখি আয়নার সামনে গিয়ে অবাক চোখে নিজেকে দেখছে।নাবিল শাড়ীটা চিনতে পেরে বললো,’এটা মা দিয়েছে তাই না?আমি অনেকবার দেখেছি এটা।আমাকে দেখিয়ে মা বলতো এটা আমার বউয়ের’
‘সুন্দর অনেক’
লিখি মাথার ক্লিপটা খুলে চুলগুলো ছেড়ে মাথা নাড়াচাড়া করছে এখন।ওর চুল তেমন লম্বা না হলেও অনেক ঘন।খোলা চুলে খুব সুন্দর লাগছিল ওকে।

নাবিল গয়না গুলো সরিয়ে রাখার সময় একবার সেদিকে তাকিয়েছিল।এই সুন্দর দৃশ্য দেখলে যেকোনো স্বামী এসেই জড়িয়ে ধরতো।নাবিলের ও ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু ভয়ে আর লজ্জায় চেয়েও পারেনি,যেটা পারার সেটা হলো শুধু চেয়ে থাকা।
লিখি কোমড়ে হাত রেখে ঘুরতে ঘুরতে বললো,’কি স্বামী মশাই?মাথায় কি ঘুরছে?কি করতে মন চাইছে আপনার?’
নাবিল এগিয়ে এসে কাছে দাঁড়ালো,ওর খুব কাছে।লিখি তো শীতল হয়ে গেছে।নাবিল তখন ফিসফিস করে বললো,’আমার কি ইচ্ছে করছে জানো?’
‘কি?’
‘আমার ইচ্ছে করছে….. ‘

কথাটা বলতে বলতে নাবিল ওর চুলে মুখ ডুবালো।লিখি চোখ বন্ধ করে থরথর করে কাঁপছে।নাবিল আবারও বললো,’আমার ইচ্ছে করছে চুল গুলো জোরে টেনে দিতে।ভূতের মতন দেখায় তো তাই’
লিখি চোখ মেলে নাবিলের দিকে ফিরে বললো,’সবসময় ভাল মুডটা নষ্ট করতে আপনার ভাল লাগে তাইনা?কি সুন্দর রোমান্টিক ছিলাম আমি,দিলেন তো সব খারাপ করে!’
‘যাক বাবা!!যেটা সত্যি সেটাই তো বলবো, মিছে মিছি কেন বলবো?’
‘মিছে মিছি?বউকে মনকাড়া কথা বলতে মন চায়না আপনার?আমি তো আপনারই বউ।আরেকজনোর তো না।আমাকে বলবেন না তো কাকে বলবেন?’
‘কিছু বলতে ভয় করে,আবার বলে না বসো যে এটা বলা মানে ভালোবাসা’

লিখির পুরো পরিবার চাইলো ওনাদের আরও কটাদিন রেখে দিতে কিন্তু জনাব অনাবিলের অফিসের অনেক কাজ বলে তিনি আজ রাতেই চলে যেতে চাইলেন।কারণ ঢাকা যেতে যেতে গোটা রাত লেগে যাবে।পরেরদিন সকালে রওনা হলে ঐদিনটা নষ্ট হবে।
তাই আর কেউ বাধা দেয়নি।সবার কাছে বিদায় নিয়ে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।
নাবিলদের কারে জায়গা হচ্ছিলোনা।লিখির এক কাজিন সহ যাবে ওর সাথে।তাই রুহুল আমিন তার একটা গাড়ী নিয়ে যেতে বললেন ড্রাইভার সহ।
সেটাতে নাবিল,লিখি আর ওর কাজিন উঠেছে।তার নাম রিনতি।
রিনতি ক্লাস ফাইভে পড়ে।নিয়ম বলে তাকে লিখির সাথে পাঠিয়েছে লিখির আম্মু।
পথে সে সবার আগে ঘুমিয়ে পড়েছে, এদিকে লিখি বারবার গলা, হাত চুলকাচ্ছে।তার অস্বস্তি হচ্ছে শাড়ী পরে থাকতে।খুলে ফেললে বিশাল শান্তি লাগতো।
নাবিল ওকে নড়চড় করতে দেখে বললো,’কি বিচুটি পাতা লাগলো নাকি গায়ে?’

‘সেটার চেয়েও অসহ্য।’
‘কি হয়েছে?’
‘শাড়ীতে সমস্যা হয়।কেন যে পরতে গেলাম’
‘খুলে ফেলো’
কথাটা শুনে ড্রাইভার কারের ফ্রন্ট মিররে চোখ রাখলো।নাবিল মাথা ঘুরিয়ে বললো,’পরেছো যখন এভাবেই থাকতে হবে।কিছু তো করার নাই,এভাবে তো চেঞ্জ করতে পারবানা
লিখি হাত চুলকাতে চুলকাতে হেলান দিয়ে বসলো।নতুন শাড়ী বলে তার সমস্যা হচ্ছে এত।
নাবিল কারের ভেতরের আলো নিভাতে বললো ড্রাইভারকে তারপর গাড়ী থামিয়ে একটা দোকানে চা খেতে নামলো তারা।নাবিল দরজা খুলে বের হবার সময় নিজের গায়ের শার্টটা খুলে লিখির দিকে ধরে বললো,’শাড়ীটাকে স্কার্টের মতন পরো আর আমার শার্টটা পরে নাও ওপরে।আমি ড্রাইভারকে নিয়ে ঘুরে আসছি’

লিখি মুখে হাসি ফুটিয়ে ওর থেকে শা্র্টটা নিলো।
শার্টটা পরে ওর এত শান্তি লাগলো যে নাবিল আসার আগেই সে গাড়ীতে ঘুমিয়ে গেছে।নাবিল চায়ের কাপ নিয়ে এসে দেখলো তার বউ পা তুলে বসে জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমায় তাই ওর জন্য আনা চা’ টা ও খেয়ে উঠে বসলো গাড়ীতে।এরপর লিখির আঁচল টেনে ওর গায়ে জড়িয়ে দিলো।খুব শীত বেড়ে গেছে এই জায়গায়।নাবিলের গায়ে কেবল টিশার্ট একটা,তাও পাতলা।সে হাত ঘঁষতে ঘঁষতে ফোন টিপছে।
রিনতির তো খবরই নেই,সে আরও আরামে ঘুমায়।মাঝ দিয়ে নাবিলের ঘুম নেই।
লিখির জামাকাপড়ের ব্যাগটা বাবাদের কারে রয়ে গেছে।

মনের কোণে পর্ব ৩৫

ভোর রাতের দিকে এসে ওর চোখ লেগে গেলো।লিখির কাঁধে মাথা রেখে সে ঘুমিয়েও গেছে।
অনেকক্ষণ পর একটা বড় ধাক্কায় লিখি জেগে গেছিলো।মাথা ফেরাতেই নাবিলের মুখের সাথে তার মুখ লেগে যাওয়ায় সে আশ্চর্য হয়ে দু মিনিট তাকিয়েই ছিল।
নাবিল ওর এত কাছে এই মূহুর্তে!! এতটা কাছে আজ পর্যন্ত তারা আসেনি।

মনের কোণে পর্ব ৩৭