অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩০

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩০
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

সকাল সকাল গোয়েন্দা বিভাগের অফিসে এসে হাজির হলো তুহিন। ঠান্ডাটা অতিরিক্ত বেশি পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। রাস্তায় নিজের চার-পাঁচ হাত পর আর কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। ঘন কুয়াশা যেন কোন সযত্নে আচ্ছাদিত করে রেখেছে গোটা শহরটাকে। নিজের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে প্রবেশ করতেই হঠাৎ শরীরটা গরম হয়ে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘেমে গেল নাকের চারপাশটা। ঘরে তমাল আর একটা লোককে দেখেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। জ্যাকেটটা খুলতে খুলতে বলল, ‘স্কেচ ডান?’

তমাল উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘ না স্যার। লোকটা একটু আগেই এসেছে এখানে। আর্টিস্টকে ডেকেছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে।’
তুহিন নিজের চেয়ারটাতে বসে চোখ তুলে তাকাল পাশে বসা লোকটার দিকে। মধ্যবয়স্ক লোক। গায়ের রঙ শ্যামলা কিন্তু স্বাস্থ্য সুন্দর। তুহিন বলল, ‘আপনার নাম এমদাদ। তাইতো?’
লোকটা নিজের জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল। ঢোক গিলল পরপর দুবার। তারপর মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বোঝালো। তুহিন বুঝল লোকটা ভয় পাচ্ছে। পাওয়াটা স্বাভাবিক। এরকম পুলিশি ঝামেলায় এর আগে পড়েনি হয়তো। তুহিন লোকটাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘ভয় পাবেন না। আপনাকে কোন ঝামেলায় পড়তে হবেনা। জাস্ট কয়েকটা প্রশ্ন করব আপনাকে। আর একটু সময় নেব। আশা করছি আপনি আমাদের সাথে কোঅপারেট করবেন।’
এমদাদ খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘খু’নটাতো পাশের বিল্ডিং এ হয়েছে স্যার। আর ঐদিনতো আমি ছিলাম না বাড়িতে। আমিতো_’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লোকটাকে থামিয়ে দিয়ে তুহিন বলল, ‘আমরা সেসব জানি এমদাদ সাহেব। চিন্তা করবেন না। এসবের মধ্যে আপনাকে জড়ানো হবেনা। শুধু একটু সাহায্য দরকার। একটা কথা বলুন, আপনার বিল্ডিং এর তিন তলায় একজন যুবক দুদিনের জন্যে ছিল। তাকে চেনেন আপনি?’
এমদাদ খানিকটাটা চিন্তায় পড়ল। চোয়ালের কাছটা চুলকে কিছুটা ভাবুক হয়ে উঠল। তাকে সাহায্য করতে তমাল বলে উঠল, ‘চারদিন আগে।’
এবার একটু নড়েচড়ে বসল এমদাদ। প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘মনে পড়েছে, স্যার। চারদিন আগেই রাতের বেলায় এলো। বলেছিল তো মাসখানেক থাকবে। ব্যাটা না-কি দুদিন থেকেই চম্পট দিয়েছে? সে দিক। আমার আর কী? ভাগ্যিস আগেভাগে টাকা সব রেখে দিয়েছিলাম।’
কথাটা বলে পানের বদৌলতে লাল হওয়া দাঁত বের করে হাসল এমদাদ। তুহিন বলল, ‘এসে ফ্ল্যাট চাইল আর আপনি ভাড়া দিয়ে দিলেন? তাও সেদিন থেকেই?’

‘ফাঁকা ঘর পড়ে ছিল, স্যার। তারওপর এডভান্স বিশ হাজার ধরিয়ে দিল হাতে। আপনিই বলুন পনেরো হাজারের ঘরের জইন্যে বিশ হাজার দিলে কোন পাগলে না করবে? কেনই বা করবে?’
হাসল তুহিন। বলল, ‘কথা সত্যি। কিন্তু একটা লোক হঠাৎই রাতের মধ্যেই ঘর নিল। পাঁচ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিল, তাও এডভান্স। আপনার সন্দেহ হলোনা? জিজ্ঞেস করলেন না এমন কী দরকার?’
আবার থুতনি চুলকালো এমদাদ। মুখের হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে আবার বিজ্ঞ রূপ ধারণ করেছে। চিন্তিত কন্ঠে বলল, ‘আপনাকে মিছে কথা বলবোনা, স্যার।’
‘ একদমই বলবেন না।’ বলল তুহিন।
‘ সন্দেহ খানিকটা হয়েছিল বটে। জিজ্ঞেসও করেছিলাম। এতো কী দরকার। লোকটা কোন কথা না বলে আরও দশ হাজার ধরিয়ে দিল হাতে। ব্যস! আমি মুখে কুলুপ এঁটে দিলাম।’
ভ্রু কোঁচকালো তুহিন। তমাল বলল, ‘একটু আগে আপনি না বললেন বিশ হাজার দিয়েছে?’
লজ্জিত দেখাল এমদাদের মুখটা। ইতস্তত করে বলল, ‘মিথ্যা বলেছিলাম। ভেবেছিলাম ভাড়া বেশি নেওয়াতে যদি কিছু বলেন।’

তমাল রেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। ইশারায় থামিয়ে দিল তুহিন। এমদাদের উদ্দেশ্যে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘এরকম মিথ্যে আর বলবেন না। অযথাই বিপদে পড়বেন। যাই হোক, লোকটাকে দেখেছেন নিশ্চয়ই?’
‘হ্যাঁ দেখেছিতো।’
ওর চেহারাটা ভালোভাবে মনে আছে? হুবহু বর্ণনা দিতে পারবেন? চোখ, নাক, মুখ সব?’
আবারও নোংরা লালচে দাঁতগুলো বের করে হাসল এমদাদ। বলল, ‘ একদম ঠিক ঠিক পারবো স্যার। দেখতে_’
এমদাদের কথায় বাধ সেধে তুহিন বলল, ‘আমাকে নয়। একটু পরে যে আসবে তাকে বলবেন। যা যা জিজ্ঞেস করবে ঠিক তাই তাই বলবেন। একদম নিখুঁতভাবে।’
মাথা নাড়ল এমদাদ। এরপর খানিকটা ঝুকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কিন্তু ব্যপারখানা কী বলুন তো স্যার? ঐ ব্যাটাই খু’ন করেছে নাকি?’
‘ সম্ভবত।’
কথাটা বলে উঠে দাঁড়াল তুহিন। এরমধ্যে আর্টিস্ট চলে এলো। তুহিনকে দেখে সৌজন্যমূলক হাসি হেসেছে সালাম দিল। মুখে গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই সালামের জবাব দিল তুহিন। তমালকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ওনাকে নিয়ে স্কেচ টা রেডি করতে থাকো। আমি ডিজি স্যারের সাথে কিছু কথা সেরে আসছি।’

শাফায়াত হোসেইন গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে ল্যাপটপের দিকে। কপালে রেখাত্রয় গভীর হয়ে উঠেছে। পাঁচ মিনিট যাবত এসে বসে আছে তুহিন। এরমধ্যে ‘কাম ইন’ শব্দ দুটোই উচ্চারণ করেছে কেবল। এরপর আবার মগ্ন হয়েছে ল্যাপটপে। তুহিনও অপেক্ষা করছে লোকটার কাজ শেষ হওয়ার। মাঝে কথা বললে ধমকে উঠতে পারে। কাজের সময় ডিসটার্বেন্স পছন্দ করেনা সে। আরও তিন মিনিট ল্যাপটপে মগ্ন থেকে চোখ তুলে তাকাল শাফায়াত। সঙ্গে সঙ্গে সোজা হয়ে বসল তুহিন। শাফায়াত নিজের চশমাটা ঠিক করে বলল, ‘কতদূর এগোলো কেইসটা?’
তুহিন জানতো এই প্রশ্নটাই সবার আগে করবে। তাই প্রস্তুত ছিল ও। বলল, ‘ স্যার, লক্ষ্মীবাজারের খু’নটা যখন সম্পূর্ণ আলাদা একটা দলের লোকের হল তখন আমারও মনে হচ্ছিল হয়তো পুলিশের ধারণা ভুল। খু’নগুলো কানেক্টেড নয়। কিন্তু কাল গুলশান যাওয়ার পর আমি যেটুকু জানতে পারলাম তাতে আমি এখন নিশ্চিত খু’নগুলো শুধু কানেক্টেডই নয় সাতটা খু’নের কারণও অভিন্ন।’

‘ কী এমন জানতে পারলে?’ নিরুৎসুকভাবে জানতে চাইল শাফায়াত।
‘ স্যার দ্য সোলার সিস্টেম গ্রুপের লিডার রাশেদ বা.. আই মিন রাশেদ আমের গোপন কোন এক প্রজেক্টে হাত দিয়েছিলেন। আর সেটা ব্লাক হোল বা ডার্ক নাইট দুই দলের পক্ষেই ক্ষতিকর ছিল। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সব দলের জন্যেই সমস্যার ছিল ব্যপারটা। কিন্তু ঐ দুই দল ছাড়া আর কারো ক্ষমতা ছিল না সোলার সিস্টেমের মুখোমুখি হওয়ার।’
‘ ঐ দুই দলেরও ছিলোনা। তবে দুটো দল একসঙ্গে সোলার সিস্টেমের সম্মুখীন হলেই কেবল মোকাবেলায় করা সম্ভব ছিল। যাই হোক, পরে?’
‘ আমার মনে হচ্ছে মূল সমস্যার সূত্রপাত সেখানেই। ঐ প্রজেক্টটাই এই সাতটা খু’নের কারণ। হয়তো আরও বেশি। আমাদের হাতে লা’শ সাতটা এসেছে তারমানে এই নয় যে খু’নও সাতটাই হয়েছে। আর আমি শিওর আরও খু’ন হবে বা হচ্ছে। আর তাই আমার ঐ তিনটে গ্রুপের সব ডিটেইল প্রয়োজন, স্যার। আজ অবধি ঐ দলগুলোর বিরুদ্ধে যতজন গোয়েন্দা কাজ করেছে সকলের রিপোর্ট চাই আমার। শুধু গোয়েন্দা বিভাগের নয়, পুলিশের দেওয়া সকল রিপোর্ট দেখা দরকার আমার। আমাদের ডেটায় থাকা সবগুলো কেইস, সবগুলো ক্রিমিনালের ডিটেইলস আজকের মধ্যেই আমায় পাঠানোর ব্যবস্থা করুন, স্যার।’

গম্ভীরভাবে তুহিনের বক্তব্য শুনে গেল শাফায়াত। এরপর ল্যাপটপটা বন্ধ করতে করতে বলল, ‘ রাশেদ যে ভয়ানক কিছু একটা করতে যাচ্ছে সেটা আমরা জানতাম। ভবিষ্যত বিপদ টের পেয়েছিল পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও একটা সুত্রও পাওয়া যায়নি। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তিনটা দল। বাট আর ইউ শিওর খুনগুলোর কারণ ঐ প্রজেক্ট?’
তুহিন তাকিয়ে রইল শাফায়াতের দিকে। হ্যাঁ, খু’নগুলো তো ও করেছে কি-না। একদম নিশ্চিত হয়ে বলে দেবে হ্যাঁ ভাই এইজন্যই খু’নগুলো হয়েছে। ভাগ্যিস খু’নির নাম, ঠিকানা, বউ-বাচ্চা কতজন এসব জিজ্ঞেস করে বসেনি। এতোটা গ্যারান্টিতো মানুষ ডেটলের কাছেও এক্সপেক্ট করেনা যতটা এই লোকটা ওর কাছে করে। ডেটলও গ্যারান্টি দেয় নাইটি নাইন পয়েন্ট নাইন পার্সেন্ট কিন্তু এনার চাই হান্ড্রেট পার্সেন্ট। মুখে বলল, ‘এখনো অবধি যতটুকু জানতে পেরেছি তার ভিত্তিতে বলছি স্যার। খু’নিকে ধরতে পারলে বোঝা যাবে। স্কেচ রেডি হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই খু’ নির চেহারা অবধি প‍ৌঁছে যাব আমরা। ডক্টর মহিউদ্দিনও ডেকেছেন আমাকে। কোন জরুরি ইনফরমেশন নিশ্চয়ই পেয়েছে।’
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালো শাফায়াত।

ডিজির রুম থেকে সোজা নিজের কেবিনে ফিরে এলো তুহিন। স্কেচটা এখনো রেডি হয়নি। তুহিন কথা বলে সময় নষ্ট না করে পাশে গিয়ে দাঁড়াল পকেটে হাত গুজে। স্কেচটা কম্প্লিট হতেই ভয়ানক হতাশ হলো। ছবিটা রুদ্রর নয়। এটা নিজের কাছে থাকা রুদ্রর ছবিটার সঙ্গে না মিলিয়েও অনায়াসে বলে দিতে পারে তুহিন। তমালও বিন্দুমাত্র সময় না নিয়ে বুঝে ফেলল এটা রুদ্র নয়। ঐ চেহারা একবার যে দেখেছে সে কোনদিন ভুলবে না। এটা রুদ্র হতেই পারেনা। তমাল হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকাল তুহিনের দিকে। তুহিনের ভাবলেশহীন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ও নিজেও ভীষণ চমকেছে। ও ধরেই নিয়েছিল খু’নি রুদ্র ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু এতো অন্য লোক। বিস্মিত তমাল এমদাদকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি নিশ্চিত? এই লোকটাই ছিল?’
এমদাদ আবার সেই বিশ্রী হাসি হেসে বলল, ‘একদম স্যার! মোটামুটি এরকমই দেখতে। দারুণ এঁকেছে।’
আর্টিস্টকে বিদায় দিয়ে এমদাদের দিকে তাকাল তুহিন। বলল, ‘ সাহায্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ এমদাদ সাহেব। প্রয়োজনে আবার ডাকতে হতে পারে আপনাকে। আবার কোথাও উধাও হয়ে যাবেন না।’
‘ কোথায় আর যাব স্যার? বাড়ি, ঘর, ব্যবসা সবতো এখানেই।’
‘আপনি আসুন আজ।’

এমদাদ বেরিয়ে যেতেই তমাল বলল, ‘কেসটাতো ঘুরে গেল স্যার।’
তুহিন খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল স্কেচটা। স্কেচটার দিকে তাকিয়ে থেকেই চিন্তিত কন্ঠে বলল, ‘কিছু গোলমাল হয়ে গেছে তমাল।’
হঠাৎই একটা চিন্তা চলে এলো তুহিনের মাথায়। মেকআপ! মেকআপ করে চেহারা পাল্টে ফেলা বাঁ হাতের কাজ। একজন দক্ষ মেকআপ আর্টিস্ট চাইলে চেহারার ঘোল একশো আশি ডিগ্রি বদলে দিতে পারে।
‘ কী ভাবছেন স্যার?’
তমালের ডাকে ভাবনা থেকে ফিরে এলো তুহিন। আরও একবার স্কেচটার দিকে মনোযোগ দিয়ে বলল, ‘যা ভাবছি সেটা কেবল একটা সম্ভাবনা। এক কাজ করো। এই স্কেচটা আর রুদ্রর ছবিটা সবগুলো থানা, চেকপোস্ট, হোটেল আর গেস্টহাউজে পাঠিয়ে দাও। দুজনের মধ্যে যে কাউকে দেখলেই যেন আটকে দিয়ে আমাদের ইনফর্ম করা হয়।’
‘ রুদ্রকে কেন স্যার?’
‘ ওর সাথে কথা বলা প্রয়োজন আমার। আমার বিশ্বাস আমার সব প্রশ্নের উত্তর পাবো ওর কাছে। যদি এখনো অবধি বেঁচে থাকে তো। ‘
জ্যাকেটটা হাতে তুলে নিল তুহিন। বলল, ‘চলো গিয়ে দেখি আমাদের ডক্টর সাহেব কী বলে।’
মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল তমালের। মিনমিন করে বলল, ‘সকালে যাওয়ার কথা ছিল স্যার, প্রায় দুপুর করে ফেললেন। নির্ঘাত ক্ষেপে আছে পাগলা। আপনাকে তো কিছু বলবেনা। সব ঝাল আমার ওপর দিয়ে মেটাবে।’
মৃদু হাসল তুহিন। সঙ্গেসঙ্গে মুখটা গম্ভীর করে অনেকটা ধমকে বলল, ‘চলো!’

ডক্টর মহিউদ্দিন শেখ হাঁটছেন ল্যাবময়। কখনও কম্পিউটারের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ কিবোর্ড চালাচ্ছে। আবার কখন টেস্টটিউবে লাল-নীল ক্যামিকেল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। কখনও ডেডবডির কাছে গিয়ে কীসব চেক করছে।
চেয়ারে পায়ে পা তুলে বসে, গালে হাত দিয়ে মহিউদ্দিনের সমস্ত গতিবিধি লক্ষ করছে তুহিন। না তুহিন কিছু বলছে আর না এই মহিউদ্দিন।
তুহিন আসার পরেই গোমড়া মুখ করে কাজে অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়েছে মহিউদ্দিন। একটা কথা বলারও যেন সময় নেই তার। তুহিনের অপরাধ একটাই। আসতে বলেছে সকাল সকাল অথচ এসেছে দুপুর করে। নিজের দরকারি সব কাজ সেরে তারপর এসেছে। কেন? তার কাজের কোন দাম নেই না-কি?
এদিকে তুহিনও ভাবছে, আমিও দেখি বাছাধন তুমি কতক্ষণ চুপ করে থাকতে পারো। তোমার এক হাত মোটা ভুড়িতে যে কোন কথাই বেশিক্ষণ থাকেনা সেটা আমার চেয়ে ভালো কে জানে?
ওখানেই মুখ কাচুমাচু করে বসে আছে তমাল আর ফারিয়া। ফারিয়া হতাশ কন্ঠে বলল, ‘এই দুজনের মৌনব্রত ভাঙবে বলে মনে তো হচ্ছেনা।’

ভ্রু কুঁচকে ফেলল তমাল। কৃত্রিম বিরক্তি দেখিয়ে বলল, ‘তুমি কিছু করছো না কেন?’
‘আপনিও তো করতে পারেন তাই না?’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল ফারিয়া। এরপর দুজনেই অসহায় চোখে তাকাল অটল দুই পুরুষের দিকে।
অদৃশ্য এক প্রতিযোগিতা চলছে দুজনের মধ্যে। কেউ কারো চেয়ে কম যাচ্ছে না। “বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী” এমনই ব্যপার। অবস্থা বেগতিক দেখে অনেক সাহস জুগিয়ে এবার তমাল নিজেই মুখ খুলল, ‘ স্যার, কী জন্য ডেকেছিলেন?’
কটমটে চোখে তাকাল মহিউদ্দিন তমালের দিকে। পারলে এক্ষুনি চিবিয়ে খায় ওকে। তারপর একই দৃষ্টি তুহিনের দিকে দিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘তোমাকে বলেছিলাম না ওসব বাচ্চাদের শুনতে নেই। তোমার বসকে বলতাম। কিন্তু তার মধ্যেতো কোন আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি না। আমি যেচেপরে বলব কেন?’
এবার লম্বা একটা হাই তুলে সোজা হয়ে বসল তুহিন। মহিউদ্দিন এর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হয়ে গেছে? এবার বলে ফেলুন।’

হালকা গলা ঝাড়ল মহিউদ্দিন। রাগ ঝাড়তে ঝাড়তে ড্রয়ার থেকে দুটো কাগজ বের করে এগিয়ে দিল তুহিনের দিকে। তুহিন কাগজগুলো নিল। মহিউদ্দিন বলল, ‘কাল যে লাশটা পাঠিয়েছো ওটা সায়ানাইড গিলে মরেছে। লোকটার হাতের ছাপ পাওয়া গেছে আমাদের রেকর্ডে। ডার্ক নাইটের ছোকরা।’
তুহিন কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, ‘ সেটা জানি আমি। নতুন কোন খবর?’
চোখ তুলে তাকাল মহিউদ্দিন। চশমাটা নাক থেকে ঠেলে চোখে নিয়ে বলল, ‘ আছে। চমকে দেওয়ার মতোই খবর আছে। কিন্তু এইযে সকাল থেকে খবরটা পেটে চেপে রেখে পেট ব্যথা করে ফেললাম, তার বেলা?’
একবার ঘড়ি দেখে নিল তুহিন। তারপর বলল, ‘লাঞ্চ টাইম হয়ে যাবে শীঘ্রই। আজ লাঞ্চটা আমি আপনাকে করাবো। স্পেশাল ট্রিট। আপনার পেটও ভরবে। পেট ব্যথাও কমবে। হ্যাপি?’
মহিউদ্দিন ভ্রু উঁচু করে সন্দিহান কন্ঠে বলল, ‘সত্যি তো?’

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ২৯

‘ একদম!’
হেসে ফেলল মহিউদ্দিন। ফারিয়া আর তমালও হাসল। তুহিনও হেসেছে, মুচকি হাসি। মহিউদ্দিন এবার সিরিয়াস হয়ে গেল। প্রফেশনাল ভঙ্গিতে বলল, ‘সুজনের নখে যে র’ক্তের চিহ্ন পাওয়া গেছে তার সাথে রাশেদ আমেরের চুলের যেই স্যাম্বল তোমরা নিয়ে এসছিলে তার ডিএনএ কোনভাবেই ম্যাচ করেনি। অর্থাৎ ঐ র’ক্ত আর যারই হোক রাশেদ আমেরের রক্তের সম্পর্কের কারো নয়। সন্তানতো নয়ই।’
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল তুহিন। স্হির চোখে তাকিয়ে রইল মহিউদ্দিনের দিকে। স্কেচ না মেলার পেছনে শক্ত এক যুক্তি দাঁড় করিয়েছিল ও। মেকআপ। কিন্তু ডিএনএ? ডিএনএ না মেলার পেছনে কী যুক্তি দেখাবে ও? কেউ নিজের ডিএনএ তো আর বদলে ফেলতে পারেনা। অর্থাৎ? সত্যিই তাহলে রুদ্র খু’নগুলো করেনি!

অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ৩১

2 COMMENTS

Comments are closed.