মনের কোণে পর্ব ৩৭

মনের কোণে পর্ব ৩৭
আফনান লারা

ফুল দিয়ে বাসর সাজানো হয়নি।কেমন নিরামিষ টাইপের হয়ে আছে নাবিলের রুমটা।এলোমেলো রুমটাতে প্রবেশ করে লিখি মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে ছিল কিছু সময় ধরে।এলোমেলো বিছানা,এলোমেলো খোলা আলমারি,এলোমেলো আয়নার সামনের টেবিলখানা।রুমটা দেখার সব ইন্টারেস্টই নষ্ট করে দিয়েছে।
নাবিল লজ্জা পেয়ে সব ঠিক করতে করতে বললো,’আসলে আমি চলে যাবার পর বাবা রাগ করে আমার রুমে তালা লাগিয়েছিল।এরপর ঐদিন এসে আমি আমার কাজ সেরে আবার বরিশাল চলে গেছিলাম তারপর আজ এলাম।সবাই টায়ার্ড বলে গোছাতে পারেনি,রুমটাকে সাজাতেও পারেনি,তুমি এক মিনিট অপেক্ষা করো।আমি রুমটা ঠিক করছি।’

লিখি এগিয়ে এসে বিছানার চাদর টেনে ঠিক করে সেখানে বসলো।সকাল সাতটা বাজে এখন।সবে তারা বাসায় ফিরেছে।চোখে ঘুম তার খেলা করছে।বাকিরাও ঘুমিয়ে পড়েছে,এদিকে লিখির ও জমপেশ ঘুম আসছে।নাবিলের কাজ দেখতে দেখতেই সে ঘুমিয়ে গেলো।
নাবিল জামাকাপড় সব গুছিয়ে পেছনে ফিরে দেখলো লিখি ঘুমায়।
সে গিয়ে জানালার সামনের পর্দা সবগুলো টেনে দিলো।অনেক আলো আসছিল ঐদিকটা থেকে।
লিখির গায়ে এখনও নাবিলের শার্টটা।ভাগ্যিস বাবা -মা কেউ দেখেনি।
নাবিল ব্যাগ থেকে লিখির সেলোয়ার সুট একটা বের করে ওর পাশে রেখে নিজে গোসল করতে চলে গেছে।
গোসলটা করে বেরিয়ে মাথা মুছতে মুছতে নাবিল নিজের রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল,পাক্কা এক মাসের বেশি সময় ধরে রুম ছেড়ে বাহিরে ছিল সে।তার রুমটা তার ভীষণ প্রিয়।নিজের রুম ছেড়ে কোথাও যেতো না সে।
আজ আবার রুমে ফিরে এসে তার কি যে শান্তি লাগছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লিখি আটটার দিকে চোখ মেলে তাকালো।আশেপাশে কোথাও নাবিল নেই।পাশে হাত রাখতেই নিজর জামা দেখে হুশ ফিরলো তার।লাফ দিয়ে উঠে বসে নিজের গায়ের দিকে একবার তাকিয়ে দম ফেললো।নাবিলকে চোখের সামনে না দেখে প্রথমে চিন্তা হয়েছিল।
বিছানা ছেড়ে নেমে এসে জানালা থেকে পর্দা সরাতেই বাগানে নাবিলকে দেখে তার চিন্তা দূর হলো।
মুখে হাসি ফুটিয়ে এক দৃষ্টিতে ওকে দেখছিল সে।নাবিল বাগানে বসে নিউজপেপার পড়ছে।সামনে দাঁড়িয়ে কেউ তাকে দেখলে সে বুঝতে পারে,এখনও বুঝতে পারছিল বলে পেপার সরিয়ে মুখ তুলতেই লিখিকে দেখতে পেলো ওখানে দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হেসে যাচ্ছিল।
নাবিল ইশারা করে ওকে চেঞ্জ করতে বলায় লিখি আর দেরি না করে পর্দা টান দিয়ে জানালার কাছ থেকে সরে গেছে।
মিসেস সামিয়া আর জনাব অনাবিল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।নাহিদ তার রুমে গিয়ে সেও ঘুমাচ্ছে।আর রিনতি সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে।গাড়ীতে কেউই ভাল ভাবে ঘুমাতে পারেনি।তাই এখন সবাই ঘুমাচ্ছে।

ফ্রেশ হয়ে এসে লিখি রুম থেকে বেরুলো।বিশাল একটা বাড়ি নাবিলদের।ঠিক লিখিদের মতন।
তবে বুয়া নেই।দুজন শেফের সুট পরা লোক রান্নাঘরে রান্না করছিল।লিখি তাদের রান্না করা দেখছিল দাঁড়িয়ে থেকে।
রুটি বানাচ্ছে একজন আর আরেকজন ভাজি বানাচ্ছে।অন্য একটা লোক হেঁটে হেঁটে আসবাবপত্র মুছতেছে খালি।সবাইকে দেখে নিয়ে লিখি বাগানের দিকে চলে গেলো।নাবিল পেপার রেখে রঙ চা খাচ্ছিল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বাগানের ফুলগুলোর গোড়া দেখছে আর বলছে পানি দেয়া হয়নি।
লিখি কাছে এসে বললো,’আমায় চা দেবেন না?’
‘রঙ চা এই এক কাপই বানিয়েছিল’
কথাটা বলে নাবিল চায়ের বাকি অর্ধেক লিখির দিকে ধরে খেতে বললো।সে ভেবেছিল লিখি হয়ত ওর মুখের চা খাবেনা।কিন্তু লিখি তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে চায়ের কাপটা নাবিলের হাত থেকে নিয়ে ওর সাথে হাঁটা ধরেছে।
কিছু সময় পর নাবিল লিখির দিকে ফিরে বললো ‘আচ্ছা তুমি চুরি কেন করতে?’
কথাটা যেন লিখির হজম হলোনা।রোবটের মতন দাঁড়িয়ে পড়লো হঠাৎ।নাবিল ওর এমন হাবভাব দেখে জানতে চাইলো কি হয়েছে।

‘আসলে আমি তখন সবে অনার্সে ভর্তি হয়েছিলাম। চাকরি পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছিল।এরপর একদিন আমার দেখা হলো খালার সাথে।উনি বললেন কিছু টেকনিক ইউজ করে আমি টাইমলি চুরি করতে পারি যাতে কেউ সন্দেহ ও করবেনা।খালাকে পেতে অনেক চড়াই উতড়াই যেতে হয়েছিল আমার।তারপর খালাকে পেয়ে কাজটা প্র‍থমে না না করেছিলাম বটে কিন্তু সয়ে গিয়েছিল।এরপর থেকে আমি এক্সপার্ট চোর।’
‘দারুণ।চুরি না করলে এতদিন তোমার সাথে আমার দেখা হতোনা, বিয়ে হতোনা।কিছুই হতোনা’
‘কার নিয়তি কোথায় লেখা আছে, কে জানে!!”
সেসময়ে মিসেস সামিয়ার ডাকে দুজনে পেছনে তাকালো।তিনি ওদের খাওয়ার জন্য ডাকছেন।নাবিল বললো পরে খাবে।কিন্তু লিখি বললো সে এখন খাবে তার খিধে পেয়েছে অনেক।তাই বাধ্য হয়ে নাবিল ও ওর সাথে চললো।
সামিয়া খাবারের টেবিলে বললেন,’আমি চাচ্ছি তোমাদের রিসিপশানটা হোক।তারপর বাসর ঘর ও সাজানো হলোনা তাড়াহুড়োতে।এক দিক দিয়ে তোমাদের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যাবে আরও একবার,আত্নীয় স্বজনদের ও জানানো যাবে সব।কি বলো লিখি?’
‘আপনারা যেমন ভাল বুঝেন’
নাবিলও সাঁই দিলো।

খাবার শেষ করে নাবিল উঠে বললো সে আজ কিছু ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করতে যাবে।ফিরতে রাত হবে, কথাটা বলেই ফোন পকেটে ঢুকিয়ে সে চলে গেলো,লিখির সাথে কোনো কথা বললোনা।লিখি মন খারাপ করে শুধু ওর চলে যাওয়া দেখেছে। সামিয়া বুঝতে পারলেন লিখির মন খারাপ, তাই ওকে ব্যস্ত রাখতে তিনি বললেন,’শোনো লিখি চলো শপিং করতে যাই।কাল রিসিপশানে কি পরবে সেটা আজ কিনবো, যাবে?’
লিখি খুশিতে গদগদ হয়ে বললো যাবে। তেমনটাই হলো।সকালের
নাস্তাটা সেরে তারা দুজন মিলে মার্কেট করতে বের হলো।
মার্কেটে তেমন একটা সময় কাটেনি।
গেলো আর শাড়ী পছন্দ করে কিনে তারা আবার চলেও আসলো।এগারোটার বেশি আর বাজলোনা।
লিখি নাবিলের রুমে এসে রিনতির বকবকুনি শুনছে অনেকক্ষণ।রিনতি বসে বসে নাহিদকে নিয়ে গল্প করছে।নাহিদ নাকি ওর দিকে ঢিল ছুড়েছিল এটা নিয়ে কত নালিশ তার।
শেষে রেগে গিয়ে লিখি বললো রুম থেকে বের হতে।এত বকবক ভাল লাগেনা তাও অসংগত কারণের।

নাবিল ফোন ধরছেনা,লিখির বিরক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
আর সহ্য হয়না এসব কিছু।
নাবিল আজ ইচ্ছা করেই চলে গিয়েছিল,সে লিখির মুখ থেকে ভালবাসার কথাটা বের করাতে চায়।লিখি আজ সারাদিনে একা থেকে বুঝে যাবে কত ধানে কত চাল হয়।
লিখি এখন গাল ফুলিয়ে টিভি দেখেছে,নতুন আনা শাড়ীটা উল্টো পাল্টে দেখেছে, নাবিলকে আরও কয়েকবার কল করেছে,,, রিনতির আজাইরা আলাপ শুনেছে।সময় আর কাটেনা।দুপুরবেলা সবার সাথে খাবার খেয়ে হালকা সময় কাটলো এরপর বিকাল থেকে আবারও সে একলা।
মিসেস সামিয়া রিসিপশানের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।সোফায় বসে বসে দু ঘন্টা ধরে কেবল আত্নীয়দের কল করে যাচ্ছেন তিনি।
রিনতি নাহিদের সাথে খেলছে।অনাবিল অফিসে।
লিখি রুমে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়লো।
রাত অনেক হবার পর নাবিলের আগমন ঘটেছে বাসায়।সে ভাবলো লিখি হয়ত ঘুমে।কিন্তু না!সে এসে দেখলো লিখি খাটের এক কোণায় বসে নিরবে কাঁদছে আর চোখ মুছছে।
চোখ মুছার গতি অনেক বেশি তারমানে বেশি করে কাঁদছে।
নাবিল বুঝলো সে আজ লিখিকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে।মাফ চাইতে হাঁটু গেড়ে নিচে বসে ওর হাত ধরতে যেতেই সে হাত সরিয়ে বিছানায় পা উঠিয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেলো।

‘আই এম সরি লিখি,আসলে অনেকদিন পর বন্ধুদের দেখা পেলাম তো তাই তারা সারাদিন আসতে দেয়নি’
লিখি কিছু বলছেনা,শুদু কাঁদছে।নাবিল বিছানায় উঠে ওর সামনে এসে বসলো।
সে রাগ রে আবারও ঘুরতে যেতেই নাবিল দুহাত আটকে থামালো ওকে।ঠোঁট এগিয়ে ওর কপালে চুমু দিয়ে বললো,’প্লিজ মাফ করে দাও।আমি ইচ্ছে করেই কল কাটছিলাম।এটার জন্য সরি’
লিখি চুপ করে আছে।নাবিল ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আবারও সরি বলতে গেলো কিন্তু তার আগেই লিখি বিছানা থেকে নেমে চলে গেছে।সোজা রিনতিকে যে রুম দেওয়া হয়েছে সে রুমে গিয়ে ওর সাথে শুয়ে পড়লো।নাবিল ওর পিছু পিছু এসে দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে বললো,’কানে ধরবো?’
লিখি কথা বলছেনা।নাবিল ওর পাশে বসে হাত ধরতে যেতেই সে উঠে বসে বললো,’আপনি রুম থেকে যাবেন?’
‘সরি একসেপ্ট কেন করছোনা?’
‘সেটার যোগ্য না আপনি।যান এখন’

নাবিল গেলোনা বরং ওকে ঠেলে ওর পাশেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে।এদিকে রিনতি সবেমাত্র ঘুমিয়েছিল।ওকে জাগানোটা মোটেও ঠিক হবেনা।নাবিল ও নাছোড়বান্দা।রিনতির যাতে ডিস্টার্ব না হয় তাই লিখি উঠতে বাধ্য হলো।
চলে গেলো বাহিরে।নাবিল মুচকি হেসে সেও বের হলো।কিন্তু নাহ!লিখি রাগ কমানোর মানুষ না।সে সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে এবার।
নাবিল টেবিল থেকে পানি খেয়ে এসে লিখির সামনে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো।লিখি কুশন দিয়ে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে।
‘দেখো লিখি, যদি আমার সাথে রুমে না আসো তবে খুব খারাপ হয়ে যাবে’
লিখির কোনো সাড়া নেয়।নাবিল শার্টের হাতা উপরে তুলে নিচু হয়ে লিখিকে কোলেই তুলে নিলো এবার।লিখি আচমকা নিজেকে শূন্যো পেয়ে মুখ থেকে কুশন সরিয়ে দেখলো নাবিল ওকে রুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
‘এটা আপনি চিটিং করছেন!!আমার রাগ এভাবে ভাঙ্গানোর অধিকার আপনার নেই’
‘আমি স্বামী।আমার সব অধিকার আছে।ফলাতে পারি’
‘ছাড়ুন,নাহলে চেঁচাবো’

মনের কোণে পর্ব ৩৬

নাবিল লিখিকে বিছানায় এনে হাত ছেড়ে দিতেই লিখি ঠাস করে পড়লো নিচে।কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’আপনাকে ছেড়ে দিতে বলছি বলে এমন করে ছাড়বেন?আপনি খুব খারাপ একটা লোক।সারাদিন আমাকে কম কষ্ট দেন নাই। এখনও কষ্ট দিয়ে যাচ্ছেন।এটা ঠিক করছেননা!!’

মনের কোণে শেষ পর্ব