মনের পিঞ্জরে পর্ব ৪১+৪২+৪৩ || Ariyana Nur

মনের পিঞ্জরে পর্ব ৪১+৪২+৪৩
Ariyana Nur

কেউ হাসে কেউ কাদে এই দুনিয়ার নিয়ম। সুখের সময় আসতেও যেমন সময় লাগে না।তেমনি সেটা দুঃখে পরিনত হতেও সময় লাগে না।এক দমকা হওয়া এসেই সুখের মুহূর্তকে তছনছ করে দিয়ে যেতে পারে।দুঃখে,কষ্টে থেকেও কিছু মানুষ চাতক পাখির মত একটু সুখের ঝিলিক দেখার জন‍্য আশায় বাসা বাধে।
সকাল বেলা জিদান ঘুম থেকে উঠতে দেড়ি হয়ে যাওয়ায় কারনে জিদান তাড়াহুড়ো করে রেডি হচ্ছে।জিদান রেডি হতে গিয়ে পুরো হুলস্থুল বাধিয়ে দিয়েছে।জিদান রেডি হচ্ছে আর বলছে……

—সব দোষ তোর ইশু।সব তোর দোষ।একে তো তোর বায়না রাখতে আমাকে দিয়ে গল্প করিয়েছিস তার উপরে সকালে ডেকে দিস নি।একটু ডাক দিয়ে দিলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত তোর?দেখ এখন দেড়ি করে ঘুম থেকে উঠে এখন আমার কি হুলস্থুলই না করতে হচ্ছে।জানিস তোর জন‍্য প্রতিদিন আমার ছোট মায়ের সামনে মাথা নিচু করে থাকতে হয়।চাচ্চু তো সরাসরিই বলে আমি বউ পাগল হয়ে গেছি।
জিদান বেডে শুয়ে থাকা ইশরার দিকে তাকিয়ে রাগি গলায় বলল…….

—একদম আমাকে দেখে হাসবিনা ইশু।হাসলে একেবারে দাত ভেঙে দিব।একে তো তোর জন‍্য লোকের কাছে লজ্জায় পরতে হচ্ছে তার উপরে আবার আমার উপরে হাসা হচ্ছে না।
জিদান রেডি হচ্ছে আর একা একা এটা সেটা বলেই চলেছে।কেননা তার কথার প্রতি উওরে কথা বলার মানুষটা তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।এই ঘুম থেকে আদো উঠবে কিনা কারো জানা নেই।
ইশফা অনেকক্ষন ধরে খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে দরজায় আড়ালে দাড়িয়ে জিদানের কান্ড দেখছে।জিদান কি সুন্দর বুকে পাথর বেধে মুখের মাঝে মিথ‍্যে রাগি ভাব নিয়ে ইশরার সাথে রাগ করে যাচ্ছে।কথা বলে যাচ্ছে। ইশরা যে জিদানের কোন কথা শুনতে পারছে না বা বুঝতে পারছে তা জিদান ভালো করেই জানে।তারপরেও কত সুন্দর সুখি দম্পতির মত মিথ‍্যে রাগের মাঝেও ভালোবাসার বহ্নিপ্রকাশ করে যাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইশরার এক্সিডেন্টের তিন মাসের উপরে হয়ে গেছে।এক্সিডেন্টের পর থেকে ইশরা এখন পযর্ন্ত একবারের জন‍্য চোখ খুলে তাকায়নি।তাকাবে কি করে?সে তো কোমায় চলে গিয়ে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।ইশরাকে হাসপাতালে ২মাসের মত রেখে জিদান সকল ব‍্যবস্থা করে ইশরাকে বাসায় নিয়ে এসেছে।ইশরা যতদিন হাসপাতালে ছিলো ততদিন জিদান ইশরাকে ছেড়ে কোথাও নড়েনি।সব সময়ই হাসপাতালে পরে রয়েছে।ইশরাকে বাসার নিয়ে আসার কিছুদিন পর থেকে জিদান নিজ ইচ্ছাই কলেজে জয়েন করে।জিদানের সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলা,নরমাল ব‍্যবহার করা,ইশরার সাথে মিছে মিছে রাগ করা।জিদানের এই সব ব‍্যবহার দেখে ইশফার চোখে না চাইতেও পানি চলে আসে।
ইশফা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে দরজায় নক করে বলল…..

—ভাইয়া আসবো?
জিদান দরজার দিকে তাকিয়ে ইশফাকে একপলক দেখে নিজের হাতের কাজ করতে করতে বলল……..
—বুচি দাড়িয়ে কেন ভিতরে আয়।
ইশফা রুমের ভিতরে ঢুকে ট্রেটা বেডের এক পাশে রেখে হাসি মুখে বলল…….
— হুলস্থুল করো না তাহলে আরো বেশি দেড়ি হয়ে যাবে।
জিদান হাত ঘড়ি পরতে পরতে বলল……
—দেড়ি তো হয়েই গেছে আর কি দেড়ি হবে। তুই নাস্তা নিয়ে যা বুচি খাওয়ার সময় নেই।আমি কলেজে গিয়ে খেয়ে নিব।
ইশফাঃমোটেও না তুমি নাস্তা না করে এখান থেকে এক পাও বের হতে পারবে না।
জিদানঃসত‍্যি বলছি বোন খেয়ে নিব কেন্টিন থেকে।
ইশফা, ইশরার দিকে তাকিয়ে নালিশের সুরে বলল…..

—দেখ ইরু ভাইয়া আমার কথা একটুও শুনছে না।তুই একটু বকে দে তো।আর বলে দে,না খেয়ে যেন কলেজে না যায়।
জিদান হাতের কাজ সেরে মুচকি হেসে খাবারের ট্রেটার সামনে বসে একটু খাবার খেয়ে উঠে যেতে নিলেই ইশফা ট্রে থেকে জুস এর গ্লাস হাতে নিয়ে জিদানের দিকে বাড়িয়ে দিল।জিদান করুন চোখে ইশফার দিকে তাকাল। ইশফা চোখ রাঙিয়ে জিদানের দিকে তাকাতেই জিদান ভীত ফেস করে ইশফার থেকে জুসের গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোকে সবটা শেষ করে গ্লাসটা ইশফার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল……
—হয়েছে এবার?
ইশফা মুচকি হেসে বলল…..
—আবার জিগায়।

জিদান মুচকি হেসে ইশরার সামনে গিয়ে ইশরার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল……
—আসছি।বকার জন‍্য সরি।সাথে সাস্তি সরূপ আজ রাতেও অনেক গল্প করবো।
কথাটা বলে জিদান, ইশরার মাথায় আদর দিয়ে পাশ থেকে ব‍্যাগ হাতে নিয়ে ইশফাকে উদ্দেশ্য করে বলল……
—আসছি।ইশুর খেয়াল রাখিস।কোন দরকার হলে সাথে সাথে আমাকে জানাবি।
ইশফা মাথা নাড়িয়ে হ‍্যা বলতেই জিদান ইশরার দিকে এক পলক তাকিয়ে চলে গেলো।
ইশফা,জিদানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চাপা এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ইশরার মাথার সামনে বসে ইশরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল…….

—দেখ ইরু।কি অবস্থা করেছিস তুই আমার ভোলাভালা ভাইটার?ভাই আমার তোর দিওয়ানা হয়ে গেছে।মিস করে যাচ্ছিস রে ভাইয়ার এই পাগলামো গুলো মিস করে যাচ্ছিস।আর কত ঘুমিয়ে থাকবি এবার তো চোখ খুলে তাকানারে বোইন।একবার তাকিয়ে দেখ, তুই যার জন‍্য পাগল। তোর সেই জিদ ভাইয়াও তোকে পাগলের মত ভালোবাসে।চোখ খুলে তাকা না বোইন প্লিজ চোখ খুলে তাকা।তোকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখতে যে বড্ড কষ্ট হয়রে বড্ড কষ্ট হয়।
কথাগুলো বলতে বলতে ইশফা চোখ দিয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরতে লাগলো।

ছাদের এক কোনে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে নিরবে চোখের জল ফেলছে ইশফা।ইশফার নিজেকে নিজের কাছে এখন রোবট রোবট মনে হয়।কেননা কষ্ট পেলেও সে কারো সামনে কান্না করতে পারে না।বাবা,মায়ের সামনে কান্না করলে, মন খারাপ করে থাকলে তারা কষ্ট পারে, আরো বেশি ভেঙে পরবে। তাই সব সময়ই তাদের সামনে নরমাল থাকার চেষ্টা করে।সারাদিন সব মুখ বুজে সহ‍্য করলেও দিন শেষে রাতের আধারে এখানে এসে কান্না করে মনটাকে কিছুটা হালকা করে নেয় ইশফা।
হঠাৎ কাধে কারো হাতের স্পর্স পেতেই ইশফা তড়িঘড়ি চোখ মুছে পিছন দিকে তাকাতেই সান কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ইশফা হকচকিয়ে বলল…….

—আপনি?
সান ইশফার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল……
—কান্না করছিলে?
ইশফা সান এর কথার উওর না দিয়ে বলল…….
—কখন এসেছেন?আপনি জানলেন কিভাবে আমি এখানে?
সান একটা চাপা নিশ্বাস ফেলে বলল…….
—আমার কাছে কোন কিছু লুকিও না বাঘিনী।তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী।আমি তোমার শুধু সুখের না দুঃখের সাথীও হতে চাই।তোমার খুশিতে যেমন খুশি হতে চাই।তেমনি তোমার দুঃখ ভাগ করে নিতে চাই।দুঃখের ভাগ যদি নিতে না পারি তাহলে নিজের বুক পেতে দিতে চাই। যাতে মাথা রেখে কান্না করে তুমি তোমার অবুঝ মনটাকে কিছুটা হলেও হালকা করতে পারো।একটা কথা মনে রাখবে গোটা মানুষটাই আমি তোমার।তাই নিজের থেকে কখনো কোন কিছু লুকাবে না।

ইশফা কিছু না বলে আস্তে আস্তে সান এর সামনে গিয়ে সান এর বুকে নিজের মাথাটা রেখে ডুকরে কেদে উঠল।সান এক হাতে ইশফাকে জড়িয়ে ধরে অপর হাতে ইশফার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।
ইশফা কিছুক্ষন কান্না করার পর কিছুটা শান্ত হলে সান নরম গলায় বলল……..
—নিজেকে শক্ত কর।তুমি ভেঙে গেলে বাবা,মাকে কে সামলাবে বল?এখন তুমিই তো তাদের সব।তাদের কথা ভেবে নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।দেখবে আল্লাহ্ অতি তাড়াতাড়ি সব ঠিক করে দিবে।ইরু আবার আগের মত হয়ে যাবে।
ইশফা ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলল……

—পারছিনা আমি নিজেকে শক্ত রাখতে।ইরুর ঐ মলিন মুখটার দিকে তাকালে দম বন্ধ হয়ে যায়।তখন মনে হয় আল্লাহ্ ওকে কষ্ট না দিয়ে ওর জায়গায় আমাকে কেন দিলো না।ওকে ভালো রেখে আল্লাহ্ কেন আমাকে নিয়ে গেলো না।আমি পারছিনা নিজেকে শক্ত রাখতে আর একটুও পারছি না।অসহায় লাগে নিজেকে খুব অসহায়।
সান একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল……
—আমি যেই বাঘিনীকে চিনি সে তো এমন ভিতু নয়?সে তো সব পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে।তাহলে আজ কেন সে ভেঙে পরছে?জানো তো আল্লাহ্ সব সময় তার বান্দাদের বিপদ দিয়ে পরিক্ষা করেন।আল্লাহ্ দেখেন তার বান্দারা কতটুকু ধর্য‍্য ধরতে পারেন।বিপদ দেখে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় কিনা।ধর্য‍্য ধর বাঘিনী ধর্য‍্য ধর।দেখবে একদিন আল্লাহ্ সব ঠিক করে দিবেন।জানোই তো ধর্য‍্যের ফল মিঠা হয়।

ইশফা কিছু না বলে নিরবে কান্না করতে লাগল।
সান একটু চুপ করে থেকে করুন কন্ঠে বলল……
—প্লিজ বাঘিনী মরার কথা আর কখনো বলো না।তোমার মুখে মরার কথা শুনলে কলিজা কেপে উঠে।জিদান ভাইয়া মত অত শক্ত আমি নই।জিদান ভাইয়া তো নিজেকে ভালোবাসার মানুষটাকে ঐ অবস্থায় দেখেও নিজেকে শক্ত রাখছে।তোমার কিছু হলে আমি পাগল হয়ে যাব।পারবো না নিজেকে শক্ত রাখতে।
ইশফা মাথা তুলে সান এর মুখের দিকে ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে বলল…….
—এতোক্ষন আমাকে জ্ঞানী লোকদের মত সান্তনা দিয়ে নিজে এখন ভীতুদের মত কথা বলছেন কেন?
—এতোক্ষন আমাকে জ্ঞানী লোকদের মত সান্ত্বনা দিয়ে নিজে এখন ভীতুদের মত কথা বলছেন কেন?সাহসী লোকদের মুখে কিন্তু ভীতুদের মত কথা মানায় না মিঃ।

ইশফার কথা সুনে সান, ইশফার মুখের দিকে পলকহীন তাকিয় মোলায়েম কন্ঠে বলল…….
—কারন এই রাগি,সাহসী, বুঝবান ছেলেটা তার বাঘিনীর ব‍্যপারে পুরোই ভীতু হয়ে যায়।সব সময় তাকে হাড়ানো ভয় তার মনে ঝেকে বেধে থাকে।অন‍্যকে জ্ঞান দেওয়া, সান্ত্বনা দেওয়া সহজ।কিন্তু নিজে তা পালন করা খুব কঠিন।(চাপা নিশ্বাস ফেলে)জানো যেদিন থেকে এই সাহসী ছেলেটা তার বাঘিনীকে দেখেছে সেদিন থেকেই তার সর্বনাশ শুরু।
ইশফা চোখ রাঙিয়ে সান এর দিকে তাকাতেই সান মুচকি হেসে ইশফার নাক টেনে দিয়ে বলল……
—রাগ করার কিছু নেই। এই সর্বনাশ সেই সর্বনাশ না। যেটা তুমি মনে করছো।যেদিন এই সর্বনাশের খাতায় তুমিও নাম লিখাবে সেদিন বুঝতে পারবে আমি কোন সর্বনাশের কথা বলেছি।

সান এর কথা শুনে ইশফা মাথা নিচু করে ফেলল।মুহূর্তেই ঠোটের কোনে চলে এল এক চিলতে হাসি। সাথে সাথেই ইশফা হাসিটাকে ধামাচাপা দিয়ে মনে মনে বলল……
—নতুন করে সর্বনাশের খাতায় কি আর নাম লিখাবো?আপনি কি জানেন?অনেক আগেই যে আমি সেই খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছি।
জিদান ইশরার মাথার সামনে বসে ইশরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর সারাদিন কি করেছে না করেছে সব ইশরাকে বলছে।জিদানের কথার মাঝে দরজায় নক পরতেই জিদান দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো ইশফা, সান দরজায় দাড়িয়ে আছে।জিদান তাদের দেখে হাসি মুখে বলল…..

—আরে দরজায় দাড়িয়ে রয়েছো কেন? ভিতরে আসো।
ইশফা,সান ভিতরে ঢুকতেই জিদান বলল……
—ধন‍্যবাদ ভাই।সারাদিন খাটাখাটনি করেও কষ্ট করে এতো রাতে এখানে মেডিসিন নিয়ে আসার জন‍্য।
সানঃএটা কিন্তু ঠিক না ভাইয়া।ভাই ও বলছেন আবার ধন‍্যবাদও দিচ্ছেন।ইরু তো আমারও ছোট বোন তাই না।মেডিসিন নিয়ে আমি আগেই চলে আসতাম।আসলে অফিসের কাজের চাপে মেডিসিনের কথা মাথাই ছিলো না।পরে মনে হতেই তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে নিয়ে এসেছি।তাই একটু দেড়ি হয়ে গেছে।

জিদানঃআরে সমস‍্যা নেই। এনেছো তাতেই অনেক।তাছাড়া এটা আজকে লাগবে না কাল সকালে লাগবে।মেডিসিনটা এদিকের পাওয়া যায় না।আমার ও বাসায় আসার পর মনে হয়েছে।তাই তোমাকে ফোন করে……।
সানঃআপনি আমাকে ফোন করে মেডিসিন এর কথা জানিয়েছেন তাতে আমি অনেক খুশি হয়েছি ভাইয়া।কোন সমস‍্যা হলে কিছু লাগলে বিনা সংকোচে জানাবেন আমায়।আমি আমার সাধ‍্য মত করার চেষ্টা করবো।

জিদানঃসাধ‍্যর থেকেও অনেক বেশি করছো তুমি।এভাবে বলে আর লজ্জা দিও না আমায়।
ইশফা জিদান আর সান এর কথা শুনে সান এর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল……
— তোমারে দেখতে মন চাইছে তাই এই রাত বিরাতে ছুইটা তোমার কাছে আইসা পরছি।দেখো না তোমার ঘ্রাণে ঘ্রাণে ছাদেও চলে আসছি।চাপাবাজ।আগেই বুঝতে পারছি কাহিনীতে ভেজাল আছে।
সান ইনোসেন্ট ফেস করে জিদানের দিকে তাকিয়ে বলল……..
—ভাইয়া মেডিসিনটা তো দিয়েই দিয়েছিলাম। এখন আবার মেডিসিনের কথাটা বলার কি দরকার ছিলো?
ইশফা ভেঙচি কেটে বলল……

—ভাইয়া বলছে বেস করছে।ভাইয়া মেডিসিনের কথা না উঠাইলে তো আপনার চাপাবাজিতে ধামাচাপা পইরা যাইতো।আমি যে ছাদে ছিলাম সেটাও যে আপনারে ভাইয়া বলছে তা আমার জানা হয়ে গেছে।
সান কিছু না বলে ইনোসেন্ট ফেস করে জিদানের দিকে তাকিয়ে রইল।
জিদান মুচকি হেসে বলল…….
—বুচি তুই যে এতো সুন্দর ঝগড়া করতে পারিস তা তো আগে জানতাম না।যখনই দেখি সান এর সাথে শুধু ঝগড়া করিস।
সানঃভাইয়া শুধু ঝগড়া না ঝগড়ার সাথে হাতও বেশ চালাতে পারে।
ইশফা সান এর দিকে চোখ রাঙিয় তাকাতেই সান শুকনো ঢোক গিলে বলল…..
—ভাইয়া আজ তাহলে আসি।এখান কার আবহাওয়া বেশ ভালো দেখা যাচ্ছে না।কখন ঘূর্ণিঝড় শুরু হয় ঠিক নেই। ঘূর্ণিঝড় এর পূর্বে কেটে পরা ভালো।

জিদান সান এর কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।শত কষ্টের মাঝেও ইশফা আর সান এর এই মিষ্টি ঝগড়া দেখলে জিদান এর মুখে হাসি ফোটে উঠে।তার বোনটা যে সানকে পেয়ে খুশি আছে তা ইশফা মুখে না বললেও জিদান ঠিকই বুঝতে পারে।

সান কিচেনের দরজার সামনে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। ইশফা খাবার গরম করতে করতে দরজার দিকে তাকাতেই সান কে মুখ লটকিয়ে দরজায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে ইশফা বলল…….
—আপনি গিয়ে বসুন না আমার হয়ে গেছে।
সান বিরক্ত হয়ে বলল…….
—কি দরকার ছিলো এসব করার।সারাদিন এমনিতেই কত খাটাখাটি করো।আমি চলে যেতেই এখন তুমি একটা ঘুম দিতে পারতে।শুধু শুধু আমাকে আটকে রেখে এখন কষ্ট করছো।

—মুখটা একটু বন্ধ করে গিয়ে চেয়ারে বসুন না ভাই।আমার হয়ে গেছে।
সান কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ চেয়ারে গিয়ে বসল।একটু পর ইশফা ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এসে খাবারের ট্রে টেবিলের উপর রেখে নিজে এক চেয়ার টেনে সান এর পাশে বসল।
সান খাবার এর দিকে তাকিয়ে চাপা নিশ্বাস ফেলে বলল…….
—এসব না করলে হতো না।শুধু শুধু কষ্ট করলে।
—কোন কষ্টই হয়নি।এখন কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নিন তো।যত দেড়ি করবেন তত আপনার যেতে লেট হবে।
—আমি বাড়িতে গিয়েও খেয়ে নিতে পারতাম।
ইশফা একটা প্লেটে খাবার দিতে দিতে বলল……

—আপনি যে কত খাবেন তা আমার ভালো করেই জানা আছে।ভার্সিটি,অফিস দুটো একসাথে চালাতে গিয়ে আপনার কি অবস্থা হয়েছে দেখেছেন?নিজেই যদি ঠিক না থাকেন তাহলে এত কাজ করে কি লাভ।
(অফিসে কিছু সমস‍্যার কারনে সান এখন বেশির ভাগ সময়ই অফিসের কাজে ডুবে থাকে।)
সান চেয়ারে হেলান দিয়ে ইশফার দিকে পলকহীন তাকিয়ে রয়েছে।ইদানিং ইশফার ছোট ছোট কেয়ার গুলো সান এর বড্ড ভালো রাগে।

সময় ও স্রোত যেমন কারো জন‍্য থেমে থাকে না তেমনি কারো জীবনও কারো জন‍্য থেমে থাকে না।
দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো।সবারই জীবন টেনেটুনে চলে যাচ্ছে না চলার মত।সবাই এই টানা পোড়ার জীবনে আল্লাহ্ কাছে এখন শুধু একটাই ফরিয়াদ,ইশরাকে যেন আল্লাহ্ সুস্থ করে দেয়।ইশরার অবস্থা এখনো সেই আগের মতই আছে।ইশরা এখনো তার মন মত শান্তিতে ঘুম দিচ্ছে।

জিদান বুকে পাথর বেধে হাসিমুখে সব করছে।কলেজের সময়টুকুই জিদান ইশরার থেকে দূরে থাকলেও বাকি সময় সে ইশরার সাথেই কাটায়।সারাদিন কি করেছে না করেছে একা একাই ইশরার সাথে বসে তা বলতে থাকে।মাঝে মাঝে একা একাই ইশরার সাথে মিছে মিছে ঝগড়া করে।জিদান ইশরার সামনে থাকলে শত কষ্ট হলেও কান্না করে না।জিদান ভাবে ইশরার সামনে কান্না করলে যদি ইশরা কোন ভাবে তা বুঝতে পেরে কষ্ট পায়?জিদান চায় না তার পাগলীটাকে আর কোন কষ্ট দিতে।এখন জিদানের সব কান্না সব অভিযোগ একমাত্র আল্লাহ্ কাছে।তাই তো সে রাতের আধারে জায়নামাজে বসে নিজের পাগলীটাকে ফিরে পাওয়ার জন‍্য, তাকে সুস্থ করে দেওয়ার জন‍্য আল্লাহ্ এর দরবারে বুক ভাসিয়ে কান্না করে।

সান সকল ব‍্যস্ততার মাঝেও ইশফা,ইশরার খবর নিতে ভুলে না।যেভাবেই হোক শত কাজের মাঝেও সময় বের করে প্রতিদিন তাদের বাসায় গিয়ে তাদের সাথে দেখা করে আসে।দিন শেষে সবাই অপেক্ষায় থাকে আগামীকাল নতুন সূর্য উদয়ের সাথে সাথে যেন তাদের জীবনেও এক চিলতে সুখ ফিরে আসে।সবার ঠোটের হাসির কারন যেন তাদের মাঝে পুনরায় ফিরে আসে।
—ইশু…..ইশু……
ফাজিল মেয়ে কোথায় পালিয়েছিস তুই?সামনে আয় একবার।থাপ্পড় মেরে তোর কাধের সব ভূত তাড়াবো আমি।
জিদানের চেচামেচি সুনে ইশরা দরজার বাহির থেকে হালকা একটু পর্দা সরিয়ে মাথাটা একটু বের করে উকি দিয়ে বলল…….
—এই যে মিষ্টার খান।এটা ভদ্র লোকের বাড়ি।তাই ইশু ইশু করে ষাড় এর মত চেচানো বন্ধ করুন।হুহ…..
জিদান দরজার দিকে তেড়ে যেতে নিয়েও থেমে গিয়ে রাগি গলায় বলল…….
—দরজার বাহিরে না দাড়িয়ে থেকে ভিতরে আয়।কানের নিচে দুটো দিয়ে তোকে ভদ্রতা দেখাচ্ছি।বেয়াদব মেয়ে আমাকে ভদ্রতা শিখাতে আসছে।এতোই যখন ভদ্রতা জানিস তাহলে আমার কাবাডের সকল জামা-কাপড় এলোমেলো করেছিস কেন?আমার রুম এমন গরুঘর বানিয়েছিস কেন?

ইশরা অরেকটু মাথা বের করে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে বলল……
—হায় আল্লাহ্…..এটা মানুষের রুম না ডাস্টবিন।ভাইয়া তুমি বাচ্চাদের মত রুমের এমন তেরোটা বাজিয়ে রেখেছো কেন?
জিদান ইশরার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বলল……
—নাটক করিস আমার সাথে?দু’চারটা থাপ্পড় গালে পরলেই তোর সকল নাটক ছুটে যাবে।
—আমি কি করলাম?
—বেয়াদব মেয়ে এসব যে তুই করেছিস তা আমার ভালো করেই জানা আছে।
ইশরা ভেঙচি কেটে বলল…..
—যা করেছি বেশ করেছি।তুই আমাকে চকলেট কিনে দিবি বলে চকলেট কিনে দিসনি কেন?কবের থেকে বলছি আমাকে একটা গুলুমুলু টেডি কিনে দিতে তাও দিস নি।ফকিরা সবার জন‍্য সবটা কেনার সময় তোর কাছে টাকা হয় আমার জন‍্য কিছু কিনতে গেলেই ওর টাকা নাই হয়ে যায়।তাই আমি নিজের টাকা দিয়েই চকলেট, চিপস কিনে খেয়ে সেগুলোর পেকেট এই রুমে সুন্দর করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রেখেছি তোকে দেখানোর জন‍্য।

—ভালোয় ভালোয় পুরো রুম তাড়াতাড়ি পরিষ্কার কর ইশু।তা না হলে হাত আর দাত কোনটাই তোর আস্ত থাকবে না।
—আমার অতো ঠেকা পরেনি।হুহ…..
জিদান ইশরার দিকে তেড়ে যেতে নিলেই ইশরা ভৌ দৌড়।
জিদান ইশরার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে গজ গজ করে ইশরাকে বকতে লাগল।
পুরন কথা মনে পরতেই ঠোটের কোনে হাসি ফুটে উঠল জিদানের।ইশরার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ইশরার মাথায় হাত বুলিয়ে বিরবির করে বলল……
—পাগলী একটা।ছোট থেকে তো কম জ্বালাসনি।নতুন করে নতুন ভাবে এখন আবার জ্বালানো শুরু করেছিস।ব‍্যপার না তোর সব জ্বালাতন সহ‍্য করার ধয‍্য আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছে।আল্লাহ্ এর দরবারে লক্ষ কুটি শুকরিয়া।যেভাবেই হোক আল্লাহ্ যে তোকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে এটাই অনেক।

ওহ্ আপনাদের তো বলাই হয়নি আল্লাহর মেহবানীতে সকলের দোয়ায় ইশরার আজ ১৮ দিন ধরে জ্ঞান ফিরেছে।ইশরার কিছুটা রেসপন্স করার কারনে ডাঃ এর কথা মত ইশরাকে পুনরায় হাসপাতালে নিয়ে এডমিট করা হয়েছিলো।জ্ঞান ফেরার পর দুদিন পযর্ন্ত ইশরা কারো সাথেই কোন কথা বলেনি।তারপর থেকে শুরু হয় ইশরার পাগলামো।প্রথম প্রথম সবাইকে চিনতে না পারলেও আস্তে আস্তে সবাইকেই চিনতে পেরেছে।জ্ঞান ফেরার পর ইশরাকে সব ধরনের চেকাপ করার পর ডাঃ জানিয়েছে, ইশরা মেমরি লস না হলেও মাথায় আঘাত পাওয়ার কারনে মানসিক সমস‍্যা হয়ে গেছে।ট্রিটমেন্ট এর উপর থাকলে,মাথায় কোন চাপ না পরলে আস্তে আস্তে সেটাও সেরে যাবে।

অফিসে কাজের চাপের কারনে সান এর বাসায় ফিরতে একটু বেশিই দেড়ি হয়ে গেছে।ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজের রুমে ঢুকে লাইট অন করে ডানে বামে না তাকিয়ে কাবাড থেকে নিজের কাপড় নিয়ে সোজা ওয়াসরুমে চলে গেলো।কিছুক্ষনের মধ‍্যে ফ্রেস হয়ে এসে বেডে বসতে না বসতেই সিনথিয়া খাবার নিয়ে হাজির হয়ে বলল…..
—খবরদার ভাইয়া না খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করবি না।আমি খাবার নিয়ে এসেছি।
সান ঘাড় ঘুড়িয়ে সিনথিয়াকে দেখে কাপালে ভাজ ফেলে বলল……
—তুই!এতো রাতে খাবার নিয়ে এসেছিস? তাও আবার আমার রুমে?
—কোন সন্দেহ আছে?

—সন্দেহ মানে?ঘোর সন্দেহ আছে।যে মেয়ে ১০টা বাজতেই ঘুমের দেশে চলে যায় সে আজ দেড়টা বাজে আমার রুমে দাড়িয়ে আছে তা আবার খাবার নিয়ে।আমার তো মনে হচ্ছে তোর বেস ধরে কোন পেত্নী আমার রুমে এসেছে আমার ঘাড় মটকাটে।
সিনথিয়া খাবারের ট্রেটা বেডে রেখে হাই তুলতে তুলতে বলল…..
—ঘাড় মটকাতে চাইলেও পারবো না।কেননা তোর কিছু হলে আমার বেচারী ভাবি কষ্ট পাবে।
—কি বুঝাতে চাইছিস তুই? ভাবি কষ্ট পাবে দেখে তুই আমাকে ছেড়ে দিচ্ছিস?
—দেখ ভাইয়া শুধু শুধু ঝগড়া করার চেষ্টা করিস না।এখন বিন্দু পরিমান ও ঝগড়ার মুডে নেই।অনেক ঘুমে ধরেছে।
—ঘুমে ধরেছে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে থাক। না করেছে কে।আর যাওয়ার আগে এগুলো নিয়ে যা।
সিনথিয়া রাগি গলায় বলল…..
—নেওয়ার জন‍্যই কি সাধের ঘুম বাদ দিয়ে কষ্ট করে এগুলো এখানে নিয়ে এসেছি।
—এনেছিস কেন আমি আনতে বলেছি?

—তুই বলিসনি কিন্তু ভাবি বলেছে।ভাবি তোর দায়িত্ব আমার উপর দিয়েছে।তাই তো এসব করছি।তা না হলে কে করতো এসব।হুহ….
সান একটা কুশন নিয়ে আরাম করে বসে বলল……
—তা কি দায়িত্ব দিয়েছি শুনি।
সিনথিয়া বিরক্ত হয়ে বলল…..
—তোর মাথা।এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে আমায় উদ্ধার কর।আমি ঘুমাবো।
—তুই গিয়ে ঘুমিয়ে থাক আমি খেয়ে নিচ্ছি।
—জ্বি না তা হবে না।তুই তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর তোর খাওয়া হলেই আমি যাব।
সান আর কথা না বাড়িয়ে খাবারে হাত দিলো।নিজে খাওয়ার সাথে সাথে সিনথিয়ার মুখেও জোর করে কয়েক বার খাবার তুলে দিল।গপাগপ কোন মত খাওয়া শেষ করেই সান বিছানায় গা এলিয়ে দিল।শরীর ক্লান্ত থাকায় মুহূর্তের মধ‍্যে ঘুমের দেশে চলে গেলো।

মনের পিঞ্জরে পর্ব ৩৮+৩৯+৪০

বেডে সাথে হেলান দিয়ে বসে ইশরার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিদান ঘুমিয়ে পরেছিল।মুখের মধ‍্যে পানির ঝাপটা লাগায় জিদান ধরফর করে উঠে বসল।জিদান সামনে তাকাতেই দেখে ইশরা কোমরে হাত দিয়ে রাগি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।জিদান ইশরার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল…….
—কি হয়েছে ইশু?এভাবে বসে রয়েছো কেন?
ইশরা গাল ফুলিয়ে বলল……
—সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি?
—আমি তো কলেজে ছিলাম।ভুলে গেছো সকালে না আমি তোমাকে বলে গেলাম।
ইশরা মাথা চুলকিয়ে বলল……
—বলেছিলে হয়ত মনে নাই।
জিদান ইশরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল…..
—তুমি না ঘুমিয়ে ছিলে উঠলে কেন?
ইশরা কিছু না বলে ঠোট উল্টিয়ে বসে রইল।
ইশরাকে চুপ করে থাকতে দেখে জিদান পুনরায় বলল……
—এভাবেই বসে থাকবে?ঘুমাবে না?

ইশরা মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে না বলল।যার মানে সে ঘুমাবে না।জিদান কিছু না বলে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল।কেননা একবার যখন ইশরা বলেছে সে ঘুমাবে না তাহলে আর কোনমতেই সে ঘুমাবে না।এখন তাকে দ্বিতীয় বার ঘুমানোর কথা বললেই তার পাগলামী শুরু করে দিবে।তাই জিদান কোন কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘুম বাদ দিয়ে ইশরার আবদার পূরন করার জন‍্য বসে রইল।
ইশরার সাথে ভালো ভাবে কথা বললে তার মন মত সব কাজ করলে ইশরা পুরো সাভাবিক আচারন করে।কিন্তু তার কথার একটু হেরফের হলেই তার পাগলামো শুরু হয়ে যায়।তখন ইশরা আর ইশরার মধ‍্যে থাকে না।কি থেকে কি করে ফেলে সে নিজেও জানে না।তাই বাড়ির সবাই ইশরার মন মত চলার চেষ্টা করে।

মনের পিঞ্জরে পর্ব ৪৪+৪৫+৪৬