মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৩৮

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৩৮
সাদিয়া জাহান উম্মি

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।সবাই বললে ভুল হবে।শুধু দুজন মানুষ এখনও পৌছায়নি।ইহান আর অথৈ ওরা এখনও আসেনি।ওদের জন্যেই অপেক্ষা করছে সবাই।পিহু বিরক্ত হয়ে বলে,’ এই মেয়েটা ওলওয়েজ লেট করে।আজ তো একটু তাড়াতাড়ি আসবে।একটু পরেই ট্রেন ছেড়ে দিবে।’
রিধি বিরবির করল,’ যেমন ভাই, তেমন বোন।লেট লতিফ কোথাকার।’

ঠিক তখনই দূর থেকে অথৈকে আসতে দেখা গেলো।মেয়েটা দৌড়ে দৌড়ে আসছে।পিছনে ইহান দুহাতে দুটো ল্যাগেজ টেনে নিয়ে আসছে।আর বার বার অথৈ দৌড়াতে মানা করছে।সাদা লম্বা গোল জামা পরেছে অথৈ।দৌড়ে আসার ফলে অথৈয়ের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।ঠোঁটের কোণে ঝলমলে হাসি।স্নিগ্ধ,কোমল মুখটা দেখেই রুদ্রিকের যেন প্রাণ জুড়িয়ে গেলো।দৌড়ে আসা তার প্রাণপ্রিয়াকে মন ভরে দেখছে সে।নির্নিমেষ তাকিয়েই রইলো।এদিকে অথৈ দৌড়ে এসে ওদের সামনে থামলো।হাটুতে দুহাত রেখে ভড় দিয়ে হাপাতে লাগল।বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করে।ও হাপানো কণ্ঠে বলে,’ সরি,সরি দেরি হয়ে গিয়েছে।আমি ইচ্ছে করে করেনি।’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ততোক্ষণে ইহানও এসে পরেছে। ইহানের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তির আভাস, ‘ হ্যা, ইচ্ছে করে করিস নি।আমি বলেছিলাম অথৈ জার্নির আগের দিন রাতে ভালোভাবে ব্যাগ গুছিয়ে নেহ।তোর তো এটা সেটা মনে থাকে না।পরে হুরোহুরি করিস।কিন্তু কে শুনে কার কথা।সকাল থেকে সে একপ্রকার পুরো বাড়িতে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলো।তার এটা পায় না। ওটা পায় না।’

ইহান অথৈয়ের ল্যাগেজটা রুদ্রিকের কাছে দিয়ে বলে,’ নেহ তোরটাকে এইবার তুই সামলা।আমি আর পারবো না।’
অথৈ মুখ ভেংচি কাটলো।রুদ্রিকের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,’ হুহ্ মনে হয় আমার ল্যাগেজটা এই পর্যন্ত এনে দিয়ে উদ্ধার করেছ তুমি।’

‘ একেই বলে কারো উপকার করতে নেই। যেই ভাড় তোর ব্যাগ।দুনিয়ার সব মনে হয় ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছে।আমরা যাচ্ছি মাত্র পাঁচদিনের ট্যুরে।আর ও মনে হয় মাস অবদি থাকার সব নিয়ে নিয়ে ব্যাগ একেবারে ভরে ফেলেছে।’
অথৈ মুখ বাকিয়ে বলে,’ তোমার কারনেই তো একটা ব্যাগই নিয়েছি। আমার তো আরও কিছু নেওয়ার ইচ্ছে ছিলো।’
‘ নিতি না করেছে কে?শুধু আমাকে বলতে পারতি না যে ভাইয়া আমার ব্যাগটা একটু নেও নাহ।ইনফেক্ট আমি তোর কোনো ব্যাগই টানতে পারবো না।আমাকে কিছু বলবি তো তোর ব্যাগ শুদ্ধ তোকেও মেঘালয়ের পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো।’

অথৈ কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,’ তুমি এমন করতে পারবে ভাই?’
‘ হ্যা পারবো।’
দু ভাই বোনের খুনশুটি দেখে হাসলো রুদ্রিক।অথৈয়ের এলোমেলো চুলগুলো দুহাতে সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিলো।হঠাৎ সবার সামনে রুদ্রিকের এহেন কান্ডে লজ্জা পেলো অথৈ। রুদ্রিক বলল,’ এইটুকু এনে দিয়েছিস সেইজন্যে ধন্যবাদ তবে আমার বউয়ের সব কিছুর দায়িত্ব আমি নিতে পারবো।সো তোকে চিন্তা করতে হবে না।’
ইহান বলে,’ হ্যা তা হলেই ভালো।এখন চলো ট্রেনে উঠা যাক।’

ইহানের কথায় সবাই সম্মতি দিলো।ওরা মোট বারোজন।জেনি আসেনি।ও ওর ইগো নিয়ে আছে।তাই মানা করে দিয়েছে।বারোজনের জন্যে দুটো ডাবল কেভিন ওরা বুক করেছে।একেকটা কেভিনে ছয়জন করে থাকবে।পাশাপাশি দুটো কেভিন।অনলাইনে টিকিট কাটার কারনে বেশি ঝামেলায় পরতে হয়নি ওদের।একটা কেভিনে অথৈ রুদ্রিক আর সাফাত একসিটে।আরেক সিটে প্রিয়ান,পিহু আর আহিদ বসেছে।আরেকটা কেভিনে মারিয়া,নীল আর অনিক অপরপাশে রিধি,ইহান আর সিয়া।সাফাত মূলত এখানে বসতে চায়নি।

কিন্তু ইহান ওকে কানে কানে বলেছে ও যেন দ্রুত গিয়ে ওই সিটটায় বসে পরে। নাহলে যে রিধি গিয়ে সেখানে বসে পরবে।আর এটা হলে ও রিধির সাথে বসার সুযোগ পাবে না।ইহান ওর বন্ধুদের অনেক আগেই বলে দিয়েছে ও রিধিকে ভালোবাসে।আর সাফাত এই কারনেই না চাইতেও বন্ধুর কথা ভেবে মেনে নেয়।এদিকে জানালার কাছে বসেছে সিয়া। ওর একটু প্রবলেম হয় যানবাহনে চরলে।তাই জানালার পাশে বসেছে মাঝে বসেছে রিধি আর তার পাশে ইহান।ইহানের সাথে বসে রিধির একদিকে ভালোও লাগছে আবার কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে।

ও তো দূরে থাকতে চায় ইহানের থেকে।কিন্তু ভাগ্য বোধহয় তা চায় না তাই তো ঘুরে ফিরে ওকে ইহানের কাছে এনেই ফেলে।কাউকে যে বলবে জায়গা অদল বদল করতে সেটাও সম্ভব না।সবাই যদি অন্যকিছু ভেবে বসবে আর তাছাড়া ইহান তো আর তার মনের কথা জানে না। যদি ইহানের খারাপ লাগে রিধি উঠে চলে গেলে।সিয়াকেও তো বলতে পারবে না এই বিষয়ে।তার প্রবলেম হবে।তাই চুপচাপ বসে রইলো।কি আর করার।

এদিকে অনিক করুন চোখে সিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।ওর খুব করে ইচ্ছে করছে সিয়ার পাশে গিয়ে বসতে।ওর ওই হাতটা শক্ত করে ধরতে।অন্যান্য কাপলরা যেভাবে একে-অপরের সাথে বসেছে ওরও বসতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটাকে নিজের বাহুতে আগলে নিয়ে ভড়সা দিতে।কিন্তু সেটা করার সাহস যে ওর নেই।সিয়া আশেপাশেও যে সে যেতে পারবে না।মনের কষ্ট মনের মাঝে লুকিয়ে রাখলো অনিক।দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর কাজে লেগে পরলো।সিয়া আঁড়চোখে তাকালো অনিকের দিকে।

অনিকের হাতটার দিকে তাকিয়ে ফের নিজের হাতের দিকে তাকালো।আগে কখনও কোথাও গেলে অনিক ওর হাতটা শক্ত করে ধরে রাখতো।ভীষণ ভালো লাগতো তখন সিয়ার।ভালোবাসার মানুষটার ওই ভড়সাযোগ্য হাতের স্পর্শে সবকিছুর কথা ভুলে যেতো।কিন্তু কে জানতো?লোকটা তো ওর যাথে ছলনা করতো।ভালোবাসতো না লোকটা ওকে।যা করতো সব ছিলো লোক দেখানো।কিন্তু বেহায়া মনটা মানলে তো?তার মনটা এখনও চাইছে সেই আগের মতো আবারও অনিকের হাতটা যেন তার এই ছোট্টো হাতটা শক্ত করে ধরে।তাকে নিজের বাহুডোরে যেন আগলে নেয়।কিন্তু না তা সম্ভব না।অনিকের কাছে সিয়া আর কখনও ফিরে যাবে না।এটা আর হবার নয়।সিয়া লম্বা শ্বাস ফেলে চোখ সরিয়ে নিলো।দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো জানালার বাহিরে।

মারিয়া ভীষণ খুশি।ও সচরাচর ঘুরাঘুরি করতে পারে না।ওর বাবা, মা কিছু না বললেও ওর বড়ো ভাইয়ের কারনে পারে না।ওর ভাই বোনকে ভীষণ ভালোবাসে।তাই তো বোনকে একা ছাড়তে ভয় পায়। আজও দিতো না।একমাত্র রুদ্রিক,আর ইহান এই দুইজন ওর ভাইকে অনেক বুঝিয়েছে। তবে গিয়ে রাজি হয়েছে। মারিয়ার ঠোঁট থেকে যেন হাসি সরছেই না।আর নীল অপলক তাকিয়ে থেকে সেই হাসি দেখছে।প্রিয়তমার ঠোঁটের মিষ্টি হাসি দেখতে কারই বা না ভালো লাগবে?মারিয়া এটা সেটা বলে যাচ্ছে।নীলের কোনো জবাব নেই।নীলকে এমন চুপচাপ থাকতে দেখে মারিয়া এইবার তাকালো নীলের দিকে।নীলের সেই মুগ্ধ দৃষ্টির মাঝে সে আবদ্ধ বিষয়টা বুঝতে পেরেই লজ্জা লাল হয়ে যায় মারিয়া।লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে বলে,’ কি দেখছো এভাবে?’

নীল মারিয়ার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে মুচঁকি হাসে।মাথা নুইয়ে মারিয়ার কানে ফিসফিস করে বলে,’ দেখছি তোমার গোলাপি ঠোঁটজোড়ার মিষ্টি হাসিটাকে।যা আমাকে বড্ড বেষামাল করে দিচ্ছে।আমার ঠোঁটজোড়া তোমার ওই ঠোঁটজোড়াকে স্পর্শ করতে চাইছে ব্যাকুলভাবে।’

মারিয়া লজ্জায় সরে আসলো নীল থেকে।অন্যদিকে তাকিয়ে একহাতে মুখ ঢেকে হেসে দিলো।নীল নিজেও হাসলো
পিহু বার বার নড়াচড়া করছে।তার অসস্থি লাগছে এখানে বসতে।পিহুর এমন কান্ডে আহিদ বিরক্ত হয়ে বলে,’ এমন নড়ছিস কেন?চুপ করে বসতে পারছিস নাহ?’
পিহু নাক মুখ কুচকে বলে,’ ভাই আমার এখানে বসতে ভালো লাগছে না।কেমন যেন লাগছে।’
‘ তুই তো শুচিবায়ুগ্রস্ত স্বভাব বদলা তাহলেই হবে।সবখানে তুই এমন করিস।’
আহিদের কথায় পিহু রেগে বলে,’ তুই এমনভাবে বলছিস যেন আমি অকারনেই এমন করি?জানিস কতো শতো প্যাসেঞ্জারর আছে যারা গাড়িঘোড়া চড়তে পারে না।বমিটিং এর প্রবলেম থাকে।তো এখানে যে কেউ এমন কিছু করেনি গ্যারেন্টি কি?’

আহিদ রেগে বলে,’ হ্যা ট্রেনের মালিক তো সেগুলো রেখে দেয় তোর জন্যে?তুই আসবি আর এসে তা পরিষ্কার করে দিবি। তাহলে এখন কর পরিষ্কার।’
আহিদের এহেন কথায় পিহু নাক মুখ কুচকে বলে,’ ছিঃ ভাই তুই এসব কি বলছিস?’
অথৈ হাসছে। অথৈকে হাসতে দেখে পিহু রেগে বলে,’ তুই হাসছিস কেন?’
‘ তোর অবস্থা দেখে।আহিদ একদম ঠিক বলেছে।যেমন কুকুর তেমন মুগুর।’
‘ এই তুই কি আমাকে কুকুর বললি?’

‘ আরে এটা তো প্রবাদ বাক্য বললাম জাস্ট।’
পিহু অথৈয়ের দিকে রাগি চোখে একপলক তাকিয়ে আহিদের দিকে ফিরলো।বলে,’ ভাই তোর কাছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার স্প্রে আছে?আমারটা আনতে ভুলে গিয়েছি।’
আহিদ বলল,’ আমি কি তোর মতো এতো শুচিবায়ু নাকি?সে হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে ঘুরব?’
‘ ভাইয়া প্লিজ।’

আহিদ শ্বাস ফেলল।নিজেকে শান্ত করে বলে,’ এনেছি কিন্তু সেটা বড়ো ব্যাগে।নামাতে ঝামেলা হবে।’
পিহু হতাশ হয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো।তবুও ওর হাশফাশ কমছে না।ওর কারনে আহিদ বিরক্ত হচ্ছে তা দেখে প্রিয়ান এইবার বলে উঠল,’ আহিদ তুই এইপাশে আয়।আমাকে ওখানে যেতে দে।আমি ওকে দেখছি।’
আহিদ উঠে দাঁড়লো।বলে,’ প্লিজ শান্ত কর ওকে।’

আহিদ গিয়ে বসল প্রিয়ানের জায়গায় আর প্রিয়ান আহিদের জায়গায়।আহিদ প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্টো একটা হ্যান্ড স্যানিটাইজার স্প্রে পিহুর সামনে ধরল।তা দেখেই পিহু চওড়া হাসল।প্রিয়ান বলে,’ নেহ এইবার উঠে দাঁড়া।আমি তোর জায়গাটাতে এইটা স্প্রে করে মুছে দিচ্ছি।’
পিহু প্রিয়ানের কথা একবাক্যে মেনে নিলো।ও উঠে দাঁড়াতে প্রিয়ান পিহুর সিটটাতে স্প্রে করে দিলো।তারপর টিশ্যু বের করে পুরো সিটটা মুছে দিলো।প্রিয়ানের কাজ শেষ হতেই পিহু ধপ করে সিটে বসে পরল।

‘ আহ, আরাম।’
প্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ থ্যাংকিউ দোস্ত।’
প্রিয়ান দুহাত বুকে আড়াআড়িভাবে ভাঁজ করে করে বলে,’ আমি তোর জন্যে এতো কিছু করলাম।আর বিনিময়ে শুধু ধন্যবাদ?এই ধন্যবাদ দিয়ে আমি কি করব?’
পিহু চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো।
‘ তো? তাহলে এখন কি এই কাজের জন্যে তোকে আমি নোবেল পুরুষ্কার দিবো?’
প্রিয়ান বাঁকা হেসে বলে,’ এমন কিছু দে যেটা দিলে নোবেল পুরুষ্কার দেওয়ার থেকেও আমি বেশি খুশি হবো।’
পিহু বুঝল না।তাই বলে, ‘ কি সেটা?’

প্রিয়ান ঝুকে আসল একটু পিহুর দিকে এমন ভাণ করল যেন সে পিহুর সিটটা আরেকটু ভালোভাবে মুছে দিচ্ছে।এইদিকে প্রিয়ান পিহুর এতোটা কাছে আসায় পিহু একেবারে সিটের শেষপ্রান্তে লেগে গিয়েছে।শ্বাস কেমন আটকে আটকে আসছে প্রিয়ান এতোটা কাছে আসায়।কিন্তু এমনটা কেন হচ্ছে?ওরা তো হারহামেশায় একে-অপরের সাথে থাকে।পাশাপাশি একসাথে বসে।কতো মারামারি করে।কই আজকের মতো অনুভূতি তো কোনোদিন হয়নি।এদিকে প্রিয়ান ফিসফিস করে বলে,’ আমাকে ধন্যবাদ সরূপ তোর ওই ঠোঁটজোড়া দিয়ে আমার গালে একটা চুমু খেলেই পারিস।আমি এতে খুশি হবো।’

প্রিয়ানের এহেন লাগামছাড়া কথায় পিহু হতভম্ব হয়ে গেলো।দু ঠোঁট আপনা-আপনি হা হয়ে গেলো।বুকের হৃৎপিণ্ডটা ধরাস ধরাস করছে।গাল,কান লাল হয়ে গিয়েছে।পিহুকে লজ্জা পেতে দেখে প্রিয়ান দুষ্টু হাসলো।তারপর পিহুকে চোখ মেরে সরে আসল।সোজা হয়ে বসে চুলে দুহাত দিয়ে ব্যাকব্রাশ করে আবারও তাকালো পিহুর দিকে। ওকে এখনও একইভাবে বসে থাকতে দেখে হাত বাড়িয়ে পিহুর হা করা মুখটা বন্ধ করে দিলো।

এতে যেন সম্বিৎ ফিরে পেলো পিহু।দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো।কটমট করে তাকালো প্রিয়ানের দিকে।তারপর সবার অগোচরেই হাত এগিয়ে প্রিয়ানের পিঠে সজোড়ে চিপটি কাটলো।ব্যথা পেলেও কিছু বলল না প্রিয়ান।সে হাসছে পিহুর কান্ডে।ওকে হাসতে দেখে যেন পিহু আরও ক্ষ্যাপে গেলো। দাঁতে দাঁত চিপে বলে,’ তোকে তো আমি পরে দেখে নিবো।’
প্রিয়ান মৃদ্যু গলায় বলে,’ প্লিজ,আম ওল ইউরস!’

‘ অসভ্য!’
এদিকে ভ্রু-কুচকে পিহু আর প্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে।ওর এইভাবে তাকানো দেখে রুদ্রিক বলে উঠে,’ কি হলো?ওমনভাবে তাকিয়ে কি দেখো?’
অথৈ ধীর স্বরে বলে,’ ওরা দুটো এমন ফুসুরফাসুর করছে কেন? কি বলছে?’
রুদ্রিক বলল,’ তা শুনে তুমি কি করবে?’
‘ ওমা আমি শুনবো না।আমি তো ওদের বেষ্টফ্রেন্ড।’
‘ সবকিছু সবাইকে বলা যায় না।’
‘ কেন? কেন বলা যাবে নাহ?’
রুদ্রিক খানিকটা নিচু হয়ে কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলে,’ আমি যদি তোমাকে চুমু খাই।তাহলে সেই কথা কি তুমি সবাইকে বলবে?’

অথৈয়ের চোখজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে আসল রুদ্রিকের কথায়।লজ্জা পেলো রুদ্রিকের কথায়।হঠাৎ সেদিন রুদ্রিকের ব্যালকনিতে ওদের চুম্বনের কথা মনে পরে গেলো।শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেলো অথৈয়ের।মাথা নিচু করে নিলো অথৈ। মিনমিন করে বলে,’ কিসব বলছেন?ওদের মধ্যে কি সেই সম্পর্ক আছে?আমরা তো স্বামী স্ত্রী।’
রুদ্রিক অকপটে বলে ফেলল,’ ওরা স্বামী স্ত্রী না সেটা ঠিক আছে।তবে এটাই সত্যি যে প্রিয়ান পিহুকে ভালোবাসে।’
অথৈ চমকে গেলো রুদ্রিকের কথায়।অবাক হয়ে বলে,’ মানে?’

‘ আস্তে চেচ্চাচ্ছ কেন?ওরা শুনে ফেলবে।’
অথৈ শুকনো ঢোক গিলল। নিজেনে সামলে বলে,’ আপনি এসব কি বলছেন?’
‘ ঠিকই বলছি।’
‘ কিন্তু এটা কিভাবে?মানে আমরা কেন বুঝতে পারলাম নাহ?’ অথৈয়ের বোকা বোকা কথা শুনে হাসল রুদ্রিক।বলে,’ তুমি আসলেই বোকা।বেষ্টফ্রেন্ডরা একে-অপরের প্রেমে পরতে পারে এটা অসম্ভব কিছু না।আমাদের নীল, মারিয়া আর অনিক, সিয়াকেই দেখো।ওরাও তো বেষ্টফ্রেন্ড ছিলো।ভালোবাসা বলে কয়ে আসে না।ভালোবাসা হয়ে যায়।যেমন আমি তোমাকে ভালোবাসি।বুঝেছ?’

রুদ্রিকের মুখে ‘ ভালোবাসি!’ কথাটা শুনে অথৈয়ের মনের আনাচে-কানাচেতে অদৃশ্য রঙিন প্রজাপতিরা উড়াউড়ি করতে লাগলো।লোকটা কিভাবে বিনা সংকোচে ভালোবাসি বলে দিলো।তবে ও কেন পারে না বলতে?কেন বুক কাঁপে এতো।লজ্জারা যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে অথৈকে।অথৈ কিছুনা বলে মুচঁকি হাসলো।চোখ সরিয়ে জানালার বাহিরে তাকালো।ট্রেন শব্দ তুলে নিজের গতিতে চলে যাচ্ছে।গাছ-পালা,ঘড়-বাড়ি,মাঠ-খাট,খোলা প্রান্তর সব পিছনে ফেলে সামনে এগোচ্ছে।

অথৈ সেই দৃশ্য মন ভড়ে অবলোকন করছে।জানালার বাহিরে এতো সুন্দর দৃশ্য,দেহ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো হিমেল হাওয়া আর পাশে প্রিয় মানুষটা।এর থেকে বেশি আর কি চাই?হঠাৎ অথৈ অনুভব করল রুদ্রিকের হাতটা ওর কোমড় পেচিয়ে ধরেছে।রুদ্রিকের স্পর্শে কেঁপে উঠলো অথৈ।লোকটার প্রতিটা স্পর্শে যেন ভালোলাগা ছেঁয়ে যায়।লোকটার সান্নিধ্যে আরও গভীরভাবে মিশে থাকতে ইচ্ছে করে।অথৈ মুচঁকি হেসে শরীরটা এলিয়ে দিলো রুদ্রিকের দিকে।রুদ্রিক অথৈকে আরো ভালোভাবে নিজের সাথে আকঁড়ে ধরে।অথৈ চোখ বন্ধ করে বলে,’ এই জার্ণিটা কোনোদিন শেষ না হোক।আপনি আমি এইভাবেই সারাজীবন একসাথে থাকি।’

রুদ্রিক হাত বাড়িয়ে বাতাসের তোরে এলোমেলো হয়ে যাওয়া অথৈয়ের চুলগুলো গুছিয়ে দিলো।তারপর বলল,’ সাধ্য থাকলে সময়টা আমি এখানেই থামিয়ে দিতাম।কিন্তু তা যে হবার নয়।’
রুদ্রিক ঘাড় ঘুরিয়ে রুদ্রিকের দিকে তাকালো।হেসে বলে,’ আপনি অনেক ভালো রুদ্রিক।এতো ভালো কেন আপনি?’
রুদ্রিক অথৈয়ের নাকটা হালকা টেনে দিয়ে বলে,’ আমি সবার জন্যে ভালো না অথৈ। তবে তোমার কাছে আসলেই আমি নিজের গাম্ভীর্যতা ধরে রাখতে পারি না।তোমার কোমলতা আমাকেও তোমার প্রতি কোমল হতে বাধ্য করে।আমার মস্তিষ্ক আমার মনের কাছে হেরে যায়।কারন আমার পুরো মনটা জুড়েই তো শুধু তুমি আছ।আর এখন তো আমার সবটা শুধু তুমি ঘিরেই। তুমিই আমার সব অথৈ। ‘

রুদ্রিকের প্রতিটা কথা যেন অথৈয়ের হৃদয়ে ঝংকার তুলে দিলো।লোকটার ভালোবাসা দেখে অথৈ বরাবরই অবাক হয়।কেউ কাউকে এতোটা কিভাবে ভালোবাসতে পারে?ঠিক কিভাবে?অথৈ নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে করে। রুদ্রিককে স্বামীরূপে সে নিজের করে পেয়েছে।আল্লাহ্ তায়ালা তাকে না চাইতেও সবকিছু দিয়েছেন।সে সারাজীবন ভড় শুকরিয়া আদায় করলেও তা কম হয়ে যাবে।

এদিকে সাফাত একদৃষ্টিতে রুদ্রিক আর অথৈয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।দুজনকে একসাথে দেখতে কতোটা ভালোলাগছে।অথৈয়ের ঠোঁটে বিস্তৃস্ত মিষ্টি হাসিটার একমাত্র কারন তো রুদ্রিকই তাই নাহ? রুদ্রিকের কাছে থাকলে অথৈ যেভাবে হাসিখুশি থাকে। অথৈ যদি ওর হতো তবে কি অথৈ ঠিক এইভাবেই হাসতো?না অথৈকে সে বোধহয় এতো খুশি রাখতে পারতো না।কিন্তু সে ওর সবটা দিয়ে চেষ্টা করতো।কিন্তু এখন এটা ভাবলে তো হবে না।অথৈ ওর কাছে সুখে থাকতো না বোধহয়।তাইতো উপরওয়ালা তার ভাগ্যে অথৈকে লিখেনি।

অথৈ যদি ওর ভাগ্যে লিখা থাকতো তাহলে শতো কোটি বাধার পরেও হলেও অথৈ ওর হতো।সাফাত চোখ সরিয়ে নিলো।বুকের বা পাশটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে।হাজার হোক সে তো অথৈকে ভালোবাসে।ভালোবাসার মানুষটিকে অন্যকারো সাথে দেখলে কষ্ট হবেই।এটা যে কারো হাতে থাকে না।সাফাতের চোখজোড়া ছলছল করছে।ও অতি সন্তর্পণে চোখের জলটুকু মুছে নিলো।চোখ বন্ধ করর সিটে গা এলিয়ে দিলো।

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৩৭

সৃষ্টিকর্তার কাছে মনেপ্রাণে এটাই চাইলো যে ও জীবনেও তিনি এমন কাউকে পাঠাক যে ওকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসবে।সেই মানুষটার ভালোবাসায় যেন সাফাত সব ভুলে ওই মানুষটাকে নতুনভাবে ভালোবাসতে পারে।তাকে ঘিরেই যেন বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পায়।এমন কাউকে তার জীবনে যেন খুব দ্রুত আসে।তার সব কষ্ট গ্লানিটুকু যেন নিঃশেষ করে দেয়।মনে প্রাণে এটাই চায় সাফাত।আর তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় বন্ধু সাফাত আর ওর ভালোবাসার মানুষ অথৈ যেন সারাজীবন একে-অপরের সাথে সুখে শান্তিতে থাকে।

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৩৯