মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৫৩

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৫৩
সাদিয়া জাহান উম্মি

আরহার চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝরে যাচ্ছে।সে সহজে কারো সামনে কাঁদে না।নিজের এই দূর্বল সত্তাটাকে কঠিনভাবে আবৃত করে রাখে মনের সুপ্তকোণে।যাতে কেউ তার এই দূর্বলতা উপলব্ধি করতে না পারে।ও সদা প্রাণজ্জ্বল থাকে।কিন্তু আজ ওর সেই শক্ত খোলশটা যেন সাফাতের সামনে ভেঙ্গে গুড়িয়ে গিয়েছে।কিছুতেই ওর কান্না থামাতে পারেনি ও।

সাফাতকে ভালোবাসে তাই বলেই কি এমনটা হয়েছে?ভালোবাসার মানুষটার সামনেই কি নিজের আসল সত্ত্বাটা আপনা-আপনিই বেরিয়ে আসে?হবে হয়তো।নাহলে আরহা কেন সাফাতের সামনে কাঁদছে।এদিকে সাফাত আরহা জীবনের তিক্ত অতীতগুলো জেনে ঠিক কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।বুকের বা-পাশটায় কেমন একটা অদ্ভূত যন্ত্রণা হচ্ছে।আরহার কান্নাটা যেন সহ্য হচ্ছে না ওর।মেয়েটা কান্না করলে একটুও মানায় না।একটুও না।আরহাকে সদা হাসিখুশিই মানায়।ও সদা হাসুক।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এইভাবে যেন কোনোদিন না কাঁদুক।সাফাতের কি হলো কে জানে?হাত বাড়িয়ে আরহার কান্না ভেজা গালগুলো মুছে দিলো।এটা করে নিজের কাজেই নিজেই থতমত খেয়ে গেলো সাফাত।এটা কি করল ও? কেনই বা করল?এদিকে সাফাতের এমন করায়।আরহার কান্না আপনা-আপনিই থেমে গেলো।অবাক হয়ে ড্যাবড্যাব করে সাফাতের দিকে তাকিয়ে রইলো ও।আরহার এমন দৃষ্টিতে অসস্থিতে পরে গেলো সাফাত।হালকা নড়েচড়ে গলা খাকারি দিলো।এতে যেন হুশ ফিরল আরহার।সাফাত পকেট থেকে রুমাল বের করে আরহার দিকে বাড়িয়ে দিলো।বলল,

‘ কান্নাগুলো মুছে নেও।এভাবে আর কোনোদিন কাঁদবে না।তোমাকে কান্না করায় মানায় না।তুমি সর্বদা হাসিখুশি থাকবে।তোমার হাসিখুশি মুখটাই দেখতে ভালোলাগে।’
সাফাতের মুখনিশ্রিত প্রতিটি বাক্য যেন প্রশান্তির বর্ষণ হয়ে আরহার উত্তপ্ত হৃদয়াটা ভিজিয়ে দিলো।অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকল।ওই গম্ভীর হয়ে থাকা মানুষটার দিকে।যাকে সে খুব ভালোবাসে।একান্তভাবে,বুকের গভীরে যেই ভালোবাসা অতি যতনে লুকিয়ে রেখেছে।আরহা ভেজা চোখেই হাসল।

‘ হাসিখুশি?সে তো আমি আমার দুঃখগুলো লুকানোর জন্যে হাসি হাসি মুখ করে থাকতাম।আমি যে আমার দূর্বলতা কাউকে দেখাতে চাই না।শুধু আমার খুব কাছের মানুষ ছাড়া।’
সাফাত মৃদ্যু স্বরে বলে,
‘ তবে আমায় যে বললে?তবে কি আমি তোমার কাছের মানুষ?’

আরহা থতমত খেয়ে গেলো।সাফাত যে এমন একটা প্রশ্ন এভাবে করবে ভাবতে পারেনি।আরহার কেমন যেম একটু লজ্জা লজ্জা লাগছে।হ্যা,এই মানুষটাকেই তো ও একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ ভাবে।যাকে সে নিজের মনের কথা অকপটে বলে দিতে পারবে।যাকে সে অনেক ভরসা করে।মেঘালয় থাকতে ওর জ্বর এসেছিলো।মানুষটা ওর জন্যে যা যা করেছে।সব শুনেছিলো মারিয়া আর সিয়ার থেকে।সেই থেকে যেন ওর ভালোলাগাটা আরও বেড়ে গিয়েছিলো।এখানে আসার পর মানুষটার অনুপস্থিতি যে ওকে কতোটা পোড়াচ্ছিলো তা কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না।প্রতিমুহূর্তে সাফাতকে দেখার জন্যে ছটফট করত ওর মন।আস্তে আস্তে বুঝতে পারে এই মানুষটাকে ও ভালোবেসে ফেলেছে।অনেক অনেক ভালোবেসে ফেলেছে।
আরহা হালকা হেসে জবাব দেয়,

‘ হয়তোবা!’
সাফাতের বুকটা ধ্বক করে উঠে।মেয়েটা কি ওকে ভালোটালো বাসে নাকি আবার?এমন হলে তো অনেক খারাপ হবে ব্যাপারটা।মেয়েটা কষ্ট পাবে ওকে ভালোবেসে।কারন ওর মনে যে আগে থেকেই একজন আছে।যাকে একতরফাভাবে ভালোবাসে ও।এই এই তরফা ভালোবাসায় যেই যন্ত্রণা।সেই যন্ত্রণা অন্য কেউ অনুভব করুক তা সাফাত চায় নাহ।অন্তত ওকে ভালোবেসে যেন কেউ কষ্ট না পাক।সাফাত শুকনো ঢোক গিলে নিলো।ধীর স্বরে বলল,

‘ এমনটা হবে না কোনোদিন।আর তুমিও এসব চিন্তা করো না।’
সাফাতের থেকে এমন একটা উত্তর আশা করেনি আরহা।ওর মুখটায় অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়।এটা কেন বলল লোকটা?কেন হবে না।কি এমন কমতি আছে আরহার মাঝে?
আরহার রাগ লাগল।কণ্ঠে হালকা তেজ ঢেলে বলে,
‘ কেন? কেন হবে না?আর কাউকে ভালোবাসা কি খারাপ?’

সাফাত শান্ত চোখে আরহার চোখের দিকে তাকালো।আরহার চোখজোড়ায় সাফাত স্পষ্ট বুঝতে পেলো।আরহার মনে ওকে নিয়ে অনুভূতি আছে।সাফাতের হৃদয় কেঁপে উঠল।মেয়েটা সারাটাজীবন কষ্ট পেয়ে এসেছে।এখন আবার ওকে ভালোবেসে কষ্ট পাবে।কারো কষ্টের কারন তো সাফাত হতে চায়নি।
সাফাত গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

‘কাউকে ভালোবাসা অপরাধ না।কিন্তু আমাকে ভালোবাসা অপরাধ হবে।আমাকে ভালোবাসলে যে কোনোদিন কেউ পূর্ণতা পাবে না।বরং তার পূর্ণতার খাতায় অপূর্ণতার গল্প’রা ঠাই পাবে।শূণ্যহাতে ফিরতে হবে তাকে।’
আরহা অবাক নয়নে তাকালো সাফাতের দিকে।তবে কি লোকটা বুঝতে পারল আরহা লোকটাকে কতোটা ভালোবাসে?লোকটা কি তার অনুভূতি বুঝতে পেরেছে?আরহা মলিন স্বরে বলে,

‘ ভালোবাসালে পূর্ণতা,অপূর্ণতা পাবো কি না।এটা ভেবে তো ভালোবাসা হয় না।ভালোবাসা হয়ে যায় মনের অজান্তেই।মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রন করা গেলেও।মনকে কিন্তু কিছুতেই নিয়ন্ত্রন করা যায় না।মানুষ চাইলেও পারে না।’
সাফাত চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়লো।আবার লম্বা নিশ্বাস নিয়ে আরহার দিকে তাকালো।
‘ আমায় নিয়ে আশা করো না আরহা।এই জীবনে আমায় নিয়ে আশা করলে যে কষ্ট ছাড়া কিছু পাবে না।’

আরহা বুকে ঝড় উঠে গিয়েছে।সাফাতের প্রতিটি কথায় যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে ওর অন্তরটা।আরহা কাতর স্বরে বলে,
‘ কেন? কেন আপনাকে ভালোবাসা যাবে না সাফাত?আমার ভালোবাসার গভীরতাটা অনুভব করে দেখুন একবার।একবার আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা আঁকড়ে ধরে দেখুন।আপনার দেওয়া কষ্টকেও যে আমি সুখ ভেবে সযত্নে গ্রহণ করে নিবো।’
সাফাত মলিন স্বরে বলে,

‘ এক মনে কি দুজনকে ঠাই দেওয়া যায় আরহা?তুমিই ভেবে দেখো একবার।মানুষ তো একটা।তার হৃদয়টাও যে একটা।’
আরহা থম মেরে গেলে সাফাতের কথায়।সাফাতের কথাগুলো কানে বাজতে লাগল তীক্ষ্ণভাবে।তার মানে সাফাতের মনে আগে থেকেই একজন আছে।লোকটা অন্য কাউকে ভালোবাসে।তার হৃদয়ে অন্য একজনের বসবাস।
তাকে সাফাত ভালোবাসবে না। কোনোদিন বাসবে না।

এ কোন ভাগ্য নিয়ে জন্মালো ও?কেন ওর সাথেই এমন হয়?যাদেরকেই ও ভালোবাসে তারাই কেন ওর থেকে দূরে চলে যায়?মা, বাবাকে ভালোবাসত আরহা।প্রচন্ড ভালোবাসার বাবাকে হঠাৎ পরিবর্তন হওয়া মেনে নিতে পারেনি।এই এক আঘাত পেলো।সেই বাবা নামক নর’পিশাচের কারনে ওর মা এই দুনিয়া থেকে চিরকালের জন্যে চলে গেলো।ওদের দু ভাই বোনকে একা রেখে।দুনিয়াতে এখন ভাই,ভাবি ছাড়া আর কেউ নেই।

এর পর হুট করে সাফাতকে দেখা।প্রথম দেখাতেই ভালোলেগে যায় সেই ভালোলাগা ভালোবাসায় রূপ নেয়।আর আজ হলো কি?ভালোবাসা প্রকাশ না হওয়ার আগেই প্রত্যাখান হয়ে গেলো।ওর জীবনে ও পূর্ণতা বলতে কিচ্ছু মিলবে না?এই জীবনে কি শুধু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাবে ও?পূর্ণতা কি কোনোদিন মিলবে না।আরহার অনুভব করল ওর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।বুকের মাঝে তীব্র দহন হচ্ছে।এই দহন যে সহ্য করা যাবে না।আরহা জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলো।

সাফাত আরহা কষ্ট জর্জড়িত মুখটা দেখছে।ওর নিজেরও যে কষ্ট লাগছে আরহার জন্যে।কিন্তু ওর নিজেরও যে কিছু করার নেই।ও তো অথৈকে ভালোবাসে।সেখানে আরহাকে কিভাবে মেনে নিবে?এটা পারবে না সাফাত। কিছুতেই পারবে না।
আরহা অস্থির হলো।এলোমেলো হলো ওর দৃষ্টি।কি থেকে কি করবে কোনো কিছু ভাবতে পারছে না।ঠিক তখনই ওর ফোনে কল আসে।আরহা সেদিকে স্থির নয়নে চায়। তার ড্রাইভার ফোন দিচ্ছে।আরহা কাঁপা কাঁপা হাতে কলটা রিসিভ করবে।ড্রাইভার জানায় তার দেওয়া ঠিকানায় ড্রাইভার এসে পরেছে।আরহা থমথমে কণ্ঠে বলে,

‘ আসছি।’
এরপর ফোন রেখে সাফাতের দিকে তাকায়।সাফাত ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো।আরহা তাকাতেই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।কেন যেন মেয়েটার ওই উদাস চাহনী সহ্য হচ্ছে না সাফাতের। আরহা অদ্ভূতভাবে হাসল।সাফাতের উদ্দেশ্যে অনুভূতিহীন কণ্ঠে বলে উঠল,

‘ একটা কথা কি জানেন?
ভালোবাসাই হোক বা অন্য যে কোন কিছু, জোর করে আদায় করার চেয়ে বরং না পাওয়াই ভালো।’
উঠে দাঁড়ালো আরহা।বেদনামিশ্রিত হাসি সাফাতকে উপহার সরূপ দিয়ে বলে,
‘ নিজেকে দোষারোপ করবেন না।আপনার যেটা সঠিক মনে হয়েছে।আপনি তাই করেছেন।
ভুলটা শুধু আমারই ছিল,

কারণ স্বপ্নটা যে আমি একাই দেখে ছিলাম, তাই আজ না পাওয়ার বেদনাটাও শুধুই আমার।’
এই বলে আরহা আর এমমিনিটও দাঁড়ালো না।সোজা হেটে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেলো।আজ আবারও প্রাপ্তির খাতায় বিশাল আকাড় শূন্যতা যোগ হলো আরহার।এই হাহাকার,এই যন্ত্রনা কাকে দেখাবে আরহা?কিভাবে সহ্য করবে।আরহা বিরবির করল,

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৫২

‘ আপনার নামের অনুভূতিগুলো,থাক না জমা না পাওয়ার খাতায়।কেননা, মন বোঝে কিছু প্রেমের হয় না স্থান মিলনের পাতায়।’

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৫৪