মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৫২

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৫২
সাদিয়া জাহান উম্মি

গরমে অতিষ্ঠ হয়ে আছে ধরনী।তীব্র রোদের আলোতে যেন চারপাশ ঝলসে যাচ্ছে।এমকই এক পরিবেশে গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরহা।চোখে মুখে তার বিরক্তির আভাস।আরহার ত্যক্ত কণ্ঠস্বর,
‘ উফ, এই গাড়িটা এখনই নষ্ট হতে হলো।এমনিতেই পাকনামি করে ড্রাইভার আনিনি।ভাইয়া কতো করে বলল।আমি শুনলাম না।এখন যদি শুনে গাড়ি নষ্ট হয়ে আমি মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি।তাহলে আর নিস্তার নেই।’
আরহা রুমাল বের করে কপালের ঘামটুকু মুছে দিলো।গাড়ি থেকে পানির বোতল বের করে এক ঢোক খেতেই নাক মুখ কুচকে ফেলল।বলল,

‘ এটা কি পানি?নাকি লাভা?এতো গরম ক্যান?উফ,ভাল্লাগে না কিছু।’
আরহা মোবাইল বের করল।বিরবির করল,
‘ ড্রাইভার কাকাকে এখানের ঠিকানা দিয়ে আসতে বলে দেই।তিনি এসে নাহয় গাড়িটা নিয়ে যাবেন।সে আসলে আমি নাহয় রিকশা বা সিএনজি নিয়ে চলে যাবো।’
আর‍হা ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে আসতে বলে দিলো।সাথে এটাও বলল এই খবর যেন ওর ভাইয়ের কাছে না যায়।ড্রাইভার জানালো তার ঘন্টাখানিক সময় লাগবে আসতে।আরহা বিরক্তি নিয়ে ফোন রাখল। কি আর করবে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এদিকে দূর থেকে আরহাকে এতোক্ষণ যাবত দেখছিলো সাফাত।সে অনিককে দেখতে গিয়েছিলো ওর বাড়িতে।সেখান থেকে আসার পথেই সে আরহাকে রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।সাথে সাথেই বাইক থামিয়ে ফেলে।ঠিক কি কারনে বাইকটা যে ও থামিয়েছে ও জানে না।কিন্তু আরহাকে দেখার সাথে সাথে হাতটা আপনাআপনিই যেন ব্রেকে চলে গেছে।আজ ঠিক কতোদিন পর মেয়েটাকে দেখল।সেইযে মেঘালয় থেকে আসার পর মেয়েটার ভাই এসে ওকে নিয়ে গেলো।এরপর আর দেখা হয়নি মেয়েটার সাথে।তবে সাফাতের প্রতিদিন আরহার কথা মনে পরত।

ওকে নিয়ে আরহার করা পাগলামিগুলো মনে পরত।সাফাত এটা অনেক আগেই বুঝেছিল আরহা ওকে পছন্দ করে।তাই তো মেয়েটার থেকে দূরে দূরে থাকত।ও চায়না ওর মতো কেউ কষ্ট পাক এক তরফা ভালোবেসে।কিন্তু আজ কেন যেন নিজের মনটাকে থামাতে পারেনি।আরহাকে দেখার সাথে সাথেই ওকে থেমে যেতে হয়েছিলো।অনেকক্ষন যাবতই আরহাকে দেখছিলো।আরহাকে বিনা এইভাবে একা একা রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।

কেন যেন ওর ভালো লাগল না।তাই বাইকটা একটু সাইডে পার্ক করে এগিয়ে যায় আরহার কাছে।একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আরহার।এদিকে আরহা ক্রমাগত পায়চারি করছিলো।পায়চারি করতে করতে পিছনে ফিরে আচমকা সাফাতকে দেখে ভড়কে যায়। দুকদম পিছাতে গিয়ে পরে যেত্র নেয় পিছনে।সাফাত নিজেও ঘাবড়ে যায়।দ্রুত হাত বাড়িয়ে আরহার কোমড় জড়িয়ে ধরে।সাফাতের নিরেট হাতের স্পর্শ কোমড়ে পেতেই আরহার সারা শরীর ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠে।চোখ বন্ধ করে নেয় খিঁচে।সাফাত তাকিয়ে রয় আরহার মুখশ্রীর দিকে।

কোমড় অব্দি চুলগুলো পনিটেইল করে বাধা।মুখে হালকা মেক-আপের ছোয়া।চোখগুলোতে আইলাইনারের রেখা টানায় আর মাশকারা দেওয়ায় আরও সুন্দর দেখাচ্ছে।গালগুলোতে হাইলাইটার দেওয়ায় রোদের আলোতে আরও জ্বলজ্বল করছে।ঠোঁটে লিপগ্লোস দেওয়া।গায়ে জড়ানো কালো কামিজ।মেয়েটাকে ভয়ানক সুন্দর দেখাচ্ছে।ঠোঁটের দিকে তাকাতেই সাফাত শুকনো ঢোক গিলল।পরক্ষনে আরহা এতো সেজেছে কোনো কারনে।এটা ভাবতেই বিরক্ত লাগল।মেয়েটা এমন সেজেগুজে যাচ্ছে কোথায়?সাফাত দ্রুত আরহাকে সোজাভাবে দাঁড় করিয়ে দিলো।সাফাত গলা খাকারি দিতেই আরহা চোখ মেলে তাকায়।সাফাতের দিকে চোখ যেতেই আরহা নড়েচড়ে ভালোভাবে দাঁড়ালো।সাফাত গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,

‘ এতো সেজেগুজে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?’
আরহা চোখ পিটপিট করে বলে,
‘ কোথায় দেখলেন এতো সেজেগুজে?এর থেকেও বেশি সাজে মেয়েরা।’
সাফাত চোখ ছোটো ছোটো করে তাকালো।
‘ মেয়েরা সাজলেই তোমাকেও সাজতে হবে?’
‘ কেনো আমি কি মেয়ে না?’

আরহার প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় সাফাত।আমতা আমতা করে বলে,
‘ হ্যা তুমি মেয়ে।কিন্তু এতো সাজুগুজু করা ভালো না ত্বকের জন্যে।’
আরহা চওড়া হাসল।
‘ এতো প্যাচাপ্যাচি না করে সোজাসাপ্টাভাবে বলে দিলেই তো পারেন।আমাকে ন্যাচারালভাবে দেখতেই আপনার ভালো লাগে।’

সাফাত খুক খুক করে কেঁশে উঠল।তা দেখে আরহা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।সাফাত আঁড়চোখে সেই হাসিটা দেখে নেয়।কি হচ্ছে ওর সাথে?কেন হচ্ছে?কোনো কিছুই বুঝতে পারছে না সাফাত।সাফাত মাথা ঝারা দিয়ে চিন্তাটুক বাদ দিলো।আরহাকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
‘ কোথাও যাচ্ছিলে?’
আরহা মাথা দুলালো।
‘ হ্যা,নিজের সাথে একা একটু টাইম স্পেন্ড করতে যাচ্ছিলাম।’
‘ একা কিভাবে টাইম স্পেন্ড করে?’
‘ তো কি করব বলুন?আপনার মতো তো আমার কোনো ফ্রেন্ড নেই।যে বসে বসে আমার বকবাকানি শুনবে।ভাইয়া তো হসপিটালে ব্যস্ত সময় পার করে।ডক্টর মানুষ।বুঝেনই তো?তবুও আমাকে যথেষ্ঠ সময় দেওয়ার চেষ্টা করে।আর বাবা?তার কথা বাদই দিন।’

সাফাতের খাবার লাগল অনেক আরহার জন্যে।মেয়েটা আসলেই বড্ড একা।সাফাত প্রশ্ন করল,
‘ তোমার ওই ফ্রেন্ডগুলোর কি খবর?’
আরহা হেসে দিলো ফিক করে।
‘ ভাইয়া এমন টাইট দিয়েছে না একেকটাকে।সবগুলো স্বার্থপর।দেশে আসার পর আমার সাথে আবারও প্যাচ আপ করতে এসেছিলো।আমিই পাত্তা দেয়নি।’
‘ এই একটা ভালো করেছ।’

আরহা মুচঁকি হাসল।সাফাতও বিনিময়ে হাসি দিলো।এরপর কি বলবে ভেবে পেলো না সাফাত।পরক্ষনে কিছু একটা ভাবল।অনেকটা সময় নিয়ে আস্তে করে বলে,
‘ তুমি চাইলে আমার সাথে এককাফ কফি খেতে পারো।যাবে?’
আরহা হা করে তাকালো সাফাতের দিকে।এই লোক সেধে সেধে ওকে কফি খাওয়ার অফার দিচ্ছে।বিষয়টা হজম করতে বেশ সময় লাগল।নিজেকে সামলে নিয়ে আরহা ঠোঁটে প্রসারিত করে হাসল।

‘ হ্যা অবশ্যই যাবো। যদি আপনার না সমস্যা হয়।’
‘ আমার সমস্যা হবে না। তাই তো তোমাকে বললাম।’
‘ তাহলে চলুন যাওয়া যাক।’
যাবার জন্যে পা বাড়াবে এরপর গাড়ির দিকে নজর যায় আরহার।ঠোঁট উলটে বলে,
‘ কিন্তু এই গাড়িকে কি করব?’

সাফাত বলে,’ তুমি গাড়িটা লক করে রেখে দেও।আমরা বেশি দূরে যাবো না।এই তো কাছেই একটা ক্যাফে আছে।সেখানেই যাচ্ছি।তোমার ড্রাইভারকে টেক্সট করে দেও এখানে এসে পৌছালে তোমাকে একটা কল করতে।তাহলেই তো হবে।’
আরহার বেশ লাগল সাফাতের বুদ্ধিটা।চমৎকার হাসি দিয়ে বলে,
‘ আপনি তো বেশ ভালো বুদ্ধি দিলেন। ইন্ট্যিলিজেন্ট ম্যান।থ্যাংক ইউ সো মাচ।’
‘ ইউর ওয়েলকাম।’

আরহা সাফাতের কথা মতো গাড়ি লক করে দিলো।তারপর সাফাত আর আরহা কাছেই একটা ক্যাফে আছে সেখানে গিয়ে বসল।সাফাত ওয়েটারকে ডেকে নিজের জন্যে একটা হটকফি অর্ডার করল।আর আরহা নাকি কোল্ড কফি পছন্দ করে।অর্ডার করা শেষ হতেই সাফাত এইবার আরহার দিকে তাকালো।মেয়েটা ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো।সাফাত তাকাতেই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে।সাফাত গলা খাকারি দিয়ে বলে,
‘ তো তোমার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলো।এতোদিন তো টুকরো টুকরোভাবে বলেছ।তাই ভালোভাবে বুঝতে পারেনি।’
আরহা ভ্রু নাচালো।

‘ কি জনাব?আজ হঠাৎ আমার প্রতি আপনি এতো আগ্রহ দেখাচ্ছেন কেন?’
সাফাত হালকা কেশে এদিক সেদিক তাকালো।মিন মিন করে বলে,
‘ এখানে আগ্রহের কি পেলে?আমরা তো ধরতে গেলে পরিচিত।আর পরিচিত মানুষদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা ভালো।এইযে আমিও আমার সম্পর্কে তোমায় বলতাম।অবশ্য তুমি বলতে না চাইলে সমস্যা নেই।’
আরহা মাথা দোলালো।লম্বা শ্বাস ফেলে বলতে লাগল।

‘ আমি বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান।আমার বাবার নাম ফাহিম হোসেন মায়ের নাম রূহানি রহমান।আমার একজন বড়ো ভাই আছে।যার নাম আয়াজ হোসেন।তাকে তো চিনেনই।যেহেতু আমার সম্পর্কে জানতে চাইছেন।তাই আপনাকে আজ সব জানাবো।যা আমি আজও কাউকে বলিনি।নিজের মধ্যে চাপা দিয়ে রেখেছি।’

আরহা মলিন হাসল।ওর মন আজ চাইছে এতোদিনের ওর বুকের মাঝে দামাচাপা দেওয়া ওর কষ্টগুলো সাফাতের কাছে সেয়ার করার।তাহলে যেন ও নিস্তার পাবে।একা একা এই কষ্টগুলো বয়ে বেড়াতে বেড়াতে যে ও ক্লান্ত হয়ে পরেছে।এমন একটা মানুষ কোনোদিন পায়নি।যে দুদন্ড ওর পাশে বসে ওর মনের কথাগুলো বলবে।আজ যেহেতু সাফাত ওর সম্পর্কে জানতে চাইছে। আবার ও তো সাফাতকে ভালোবাসে।তাই ওর কাছে মনের কথাগুলো সব উজাড় করে দিবে।আরহা বলতে শুরু করবে,

‘ আমার যখন সাত বছর বয়স।ভাইয়ার তখন সতেরো বছর বয়স।আমরা দু ভাই বোন পড়ছিলাম।মা আমাকে পড়াচ্ছিলেন।হঠাৎ বাবা ডিপার্টমেন্ট থেকে ফিরলেন।ও বলতে ভুলে গিয়েছি আমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন তখন।এখন অবশ্য পুলিশ কমিশনার। তো বাবা আসল।আর এসেই মাকে টেনে রুমে নিয়ে গেলেন।এর কিছুক্ষণ পরেই মায়ের বিভৎস চিৎকারে যেন আমাদের পুরো বাড়ি শুদ্ধ কেঁপে উঠেছিলো।

বাবা মাকে অনেক মেরেছিলেন।মেরে ধরে সে আবার চলে গিয়েছিলো।আমি ভয়ে ভাইয়াকে ঝাপ্টে ধরেছিলাম।আর ভাইয়া অনবরত দরজা ধাক্কে মা আর বাবাকে ডাকছিলো।কিন্তু তাদের কোনো জবাব পাচ্ছিলাম না।শুধু বাবার বিশ্রি ভাষার গালিগালাজ আর মায়ের কান্না শুনছিলাম।বাবা মাকে মেরে চলে যাওয়ার পর আমরা দু ভাই বোন ছুটে গিয়েছিলাম মায়ের কাছে।মা’কে নিস্তেজভাবে ফ্লোরে পরে থাকতে দেখেছিলাম।আমরা দু ভাই বোন অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন।ভাইয়া আর আমি মাকে ধরে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে ডাক্তারকে ফোন করে আসতে বলি।

ডাক্তার মাকে দেখে চলে যান।মায়ের সারা শরীরটা না কালসিটে দাগ পরে গিয়েছিলো।এরপর থেকে প্রতিনিয়ত বাবাকে দেখতাম মা’কে এইভাবে অত্যাচার করতে।একদিন আমি সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে বাবার হাত ধরে আটকে দিয়েছিলাম।বারবার বলতাম বাবা মাকে মেরো না।বাবা রেগে আমাকে ধাক্কা দিলেন।ভাইয়া আমাকে ধরতে গিয়ে নিজে দেয়ালে আঘাত পায়।তার মাথা ফেটে যায়।ভাইয়া আবার বাবার অনেক প্রিয় ছিলো।ঠিক তার উলটো ছিলাম আমি।আমাকে দেখতেই পারতেন না।ভাইয়া ব্যথা পাওয়ায়।

সে রেগে আমাকে অনেক মারল।আমার কারনে নাকি ভাইয়া ব্যথা পেয়েছে।সেই মারার কারনে আমি পনেরো দিন পর্যন্ত জ্বরে ভুগেছিলাম।ভাইয়াও অসুস্থ।মা নিজে অসুস্থ হয়ে আমাদের দু সন্তানের যত্ন নিলেন।এভাবেই চলছিলো দিনকাল।বাবার অত্যাচারে দিনদিন আমাদের দিনগুলো দূর্বিষহ হয়ে উঠছিল।যখন আমার নয় বছর।হঠাৎ একদিন বাবা এক মহিলাকে নিয়ে বাড়িতে হাজির হয়ে যায়।আমাদের বলে এটা নাকি আমাদের নতুন মা।আমি মানিনি।মহিলার গায়ে ফুলদানি ছুড়ে মেরেছিলাম।কিভাবে মারব বলুন?আমার তো মা আছে।

ওই মহিলা আমার মা হবে কেন?সেই ফুলদানি মারার কারনে আমাকে আবার মারল বাবা।দুদিন যাবত ঘরে আটকে রাখল।ভাইয়া প্রতিবাদ করায় তাকেও আটকে রেখে দেয়।আর মা?মা কেমন যেন পাথর হয়ে গিয়েছিলো।সেদিনের পর থেকে মা আর কোনোদিন কথা বলেনি আমাদের কারো সাথে।কেমন যেন একটা জড়বস্তুর মতো ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছিলো।আমি ছোটো ছিলাম তাও চেষ্টা করতাম মায়ের যত্ন নিতে।নিজে নিজে রান্না করতে গিয়ে,একদিন হাত পুড়ে যায়।তা দেখে মা একটু স্বাভাবিক হয়।

কিন্তু একদিন মা আমায় ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলো হঠাৎ বাবা ওই মহিলার সাথে এসে মা’কে জোড় করে নিজের সাথে নিয়ে যায়।তারপর রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়।ভাইয়া তখন ভার্সিটিতে ছিল।ঘন্টাখানিক পর বাবা আর ওই মহিলা বের হয়ে যায়।আমি দৌড়ে গিয়ে যেই অবস্থায় দেখলাম।তা আর আপনাকে বলে বোঝাতে হবে না আশা করি।আমি যেতেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কেঁদে দেয়।আমিও কান্না করেছিলাম।ভাইয়া আসার সময় হয়ে যাওয়ায়।মা ঠিকঠাক হয়ে নেয়। আমাকেও বলে যাতে ভাইয়াকে এসব না বলতে।আমিও মায়ের কথা মেনে নেই।কিন্তু পরদিন সকাল যে আমাদের জন্যে এতো বিভৎস হবে ভাবিনি।ঘুম থেকে মা’কে কোথায় পাচ্ছিলাম না।খুঁজতে খুঁজতে গার্ডেনে যাই আমি আর ভাইয়া।গিয়ে দেখলাম বাগানে লাগানো আমগাছটার সাথে আমার মায়ের লা’শ ঝুলে আছে।’

এইটুকু বলে আরহা আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারল না।দু হাতে মুখ ঢেকে ধুকড়ে কেঁদে উঠল।তার জীবনের এই ভয়ংকর অতীতটুকু তাকে আজও শান্তিতে নিশ্বাস নিতে দেয়না।প্রতিমুহূর্তে ওর মন চায় ম’রে যেতে।এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।আরহা নিজেকে থামানোর অনেক চেষ্টা চালালো।ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতে শুরু করল,

‘ আমার মা আমার বাবার করা অত্যাচার সয্য করতে না পেরে আত্ম’হত্যা করে।সেদিন যেন আমরা দু ভাই বোন দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম।পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু কি করার বলেন?একবার যে চলে যায় তাকে কি আর কোনোদিন ফিরে পাওয়া যায়?যায় না।আর আমরা চেয়েও কিছু করতে পারলাম না।বাবা যেহেতু পুলিশ ছিলেন তাই আমার মায়ের এই ঘটনাটা দামাচাপা দিয়ে দিলেন।কেউ কোনো প্রশ্ন করল না আমার মায়ের মৃত্যু নিয়ে।আমাদেরও ভয় দেখিয়ে রাখল।আমরা তো ছোটো ছিলাম বলেন?তাই ভয়ে কাউকে কিছু বলিনি।

কিন্তু ভাইয়া প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলো।বাবা আমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে তাকেও চুপ করিয়ে রাখে।আমার মায়ের মৃত্যুটা সবাইকে স্বাভাবিক মৃত্যুর মতো দেখানো হলো।কিন্তু আমরা তো জানি বলেন?আমার মাকে হত্যা করা হয়েছে।আমার মাকে জীবিত লা’শ বানিয়ে দিয়েছিলো সে।সে শুধু নিশ্বাস নিচ্ছিলো।তাদের অত্যাচারে সেটাও ত্যাগ করে আমার মা।মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ওই মহিলাকে বাড়িতে নিয়ে আসে।শুরু হয় আরেক অত্যাচার।একদিন আমার নানাভাই আমাদের ব্যাপারে জানতে পারেন সব।

ও আমার বাবা মায়ের লাভ ম্যারেজ ছিলো।তারা পালিয়ে বিয়ে করেছিলো।তাই তিনি মেনে নিননি তাদের।তো হঠাৎ নানাভাই খবর পান তার আদরের মেয়ে আর নেই।তাই সব রাগ অভিমান ছেড়ে দৌড়ে চলে এসেছিলেন। কিন্তু তখন তো অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো।মা তো আমার কবরে ঘুমিয়েছিলো শান্তিতে বলেন।নানাভাইকে আমরা চিনতাম।মায়ের কাছে একটা এলবাম ছিলো।সেখানে আমার নানুবাড়ির সবার ছবি আছে।তো নানাভাইকে এক দেখাতেই চিনে ফেলেছিলাম।নানাভাইকে আমি আর ভাইয়া সব বলে দিয়েছিলাম।নানা ভাই আমাদের সাথে নিয়ে যান।

কিন্তু আমাকে নিয়ে যেতে দিলেও ভাইয়াকে তিনি নিয়ে যেতে দিবেন না।পরে ভাইয়া নিজেই রাগারাগি করে।সে নানাভাইয়ের সাথে যেতে চায়।তাই আর আটকাতে পারেননি।আর এই বিষয়ে কেস করলেও তিনি হেরে যেতেন।কারন আমরা তো নামাভাইয়ের সাথেই যেতাম।নানাভাইদের বাড়ি মাদারিপুর ছিলো।সেখানে আমরা চলে গেলাম।কিছুদিন পর নানাভাই ভাইয়াকে হোস্টেলে দিয়ে আসেন।যেহেতু ভাইয়া ঢাকা মেডিকেলে পরে।তার পড়েলেখায় সমস্যা হচ্ছিলো।আর আমি একা নানুবাড়িতে রয়ে গেলাম।এরপর নানাভাই বাবার নামে মামলা করল।

অনেকদিন চলল মামলা।বাবা যেহেতু পুলিশ অফিসার ছিলেন।ভালো পজিশনে।তাই তার কিছুই করতে পারলাম না আমরা।নানাভাইও হার ছেড়ে দেন।উপর ওয়ালার হাতে সব ছেড়ে দেন।আল্লাহ্ ছাড় যেন কিন্তু ছেড়ে দেননা।সেই আশায় রইলাম।দেখতে দেখতে আমি বড়ো হয়ে যাই।কিন্তু এতো সহজ ছিলো না।আমার মামিরা আমায় সহ্য করতে পারতো না।প্রতিনিয়ত আমাকে অত্যাচার করত।আমি তাও কিছু বলতাম না কাউকে।কাকে বলব বলেন?নানাভাই যে তখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে ছিলেন।

আর ভাইয়া তখন পড়ালেখা করত।তাকে এসব বলে তাকে চিন্তায় ফেলতে চাইতাম না।এরপর ভাইয়া ডক্টর হয়ে যায়।সেদিন আমার থেকে খুশি যেন কেউ ছিলো না।কি যে খুশি ছিলাম।ভাইয়া আমার জন্যে অনেক অনেক গিফট এনেছিলো। এভাবেই চলছিলো।ভাইয়া হসপিটাল জয়েন করে।কিন্তু হঠাৎ নানাভাই মারা যান। আমি যেন এটা মানতেই পারলাম না।মানুষটা যে আমার বড্ড আপন ছিলো।আমি ডিপ্রেশনে চলে যাই।এর মধ্যে মামিদের অত্যচার তো আছেই।একদিন ভাইয়া সব জেনে যায়।ভাইয়া যেহেতু এখন নিজে ইনকাম করতে পারে।

তাই ঢাকায় একটা ফ্লাট কিনে নেয়।আর আমাকে সেখান থেকে নিয়ে যায়।এরপর একবছর লেগেছিলো আমার ঠিক হতে।এতে আমি লেখাপড়াতেও পিছিয়ে পরি। ভাইয়া আমার অনেক যত্ন নিয়েছে।ভাইয়ার কারনে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি।এরপর ভাইয়া আমাকে আবার কলেজে ভর্তি করে দেয়। এর মধ্যে আমার বাবা ফের আসেন আমাদের কাছে।তার ওই বউয়ের ভাইয়ের মেয়েকে ভাইয়ার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠেপড়ে লেগে যায়।

কিন্তু ভাইয়া আমার ভাবি মানে ইসরাত ভাবিকে ভালোবাসত।বাবার জোড়াজুড়িতে ভাইয়া তৎক্ষনাত ভাবিকে বিয়ে করে নেয় ঘরোয়াভাবে।ভাবির ফ্যামিলি আগে থেকে সব জানত তাই সমস্যা হয়নি।এতে বাবা অনেক রেগে যায়।কিন্তু ভাইয়াকে কিছুই বলতে পারেননি।তবে তিনি থেমে থাকেননি।এখন তিনি পরেছেন আমার পিছনে।তার বউয়ের ভাইয়ের ছেলেও আছে।এখন সেই ছেলেকে আমায় বিয়ে করতে বলছে।

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৫১

মানে তারা অনেক বড়োলোক তো তাই।শুধু মাত্র আপনাকে আমার সম্পর্কে বলার জন্যে ওই জঘন্য লোকটাকে বাবা বলে সম্বোধন করলাম।যাতে আপনার বুঝতে সমস্যা না হয়। নাহলে তাকে বাবা বলে আমি কোনোদিন মানি না।সে বাবা নামের কলঙ্ক।জা’নোয়ার সে।তার মতো লোক কখনও মানুষের কাতারে পরে না।সে আমার মায়ে’র খুনি। তাকে আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি।আমার সাধ্য থাকলে এই দুহাতে তাকে কু’পিয়ে কু’পিয়ে খু’ন করতাম আমি।’
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে আরহার চেহারায় হিংশ্রতা ফুটে উঠে।

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৫৩