প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৮

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৮
Writer Mahfuza Akter

আজ ভরা পূর্ণিমায় চাঁদ যেন তার সমস্ত আলো ঢেলে দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে। মুগ্ধ আহমেদ ভবনের বাগানে ঘাসের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে আর ভাবছে কখন প্রহর ওর ফোনে কল দিয়ে ওকে ভেতরে যেতে বলবে। প্রহরের সাথে সাথেই ভেতরে ঢোকেনি সে দু’টো কারণে। প্রথমত, এসব পারিবারিক ব্যাপারে উপস্থিত থাকতে একদম অভ্যস্ত নয় মুগ্ধ। আর দ্বিতীয়ত, অরুণী তাকে দেখে নিশ্চিত কোনো সিনক্রিয়েট করতো। সৌহার্দ্য আর তরীর বিয়েটা যেহেতু হয়েই গেছে, এতেই মুগ্ধ বেশ খুশি।

মনে মনে আনন্দ বিলাস করার মাঝেই প্রহরের কল এলো। মুগ্ধ ফোন কানে গুঁজে বিরক্তির সুরে বললো,
“এতক্ষণ লাগে? এদিকে মশার কামড়ে নাজেহাল অবস্থা আমার!”
“আজাদ চাচাকে বলে দিয়েছি তোকে যেন ভেতরে ঢুকতে দেয়। চলে আয়!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ওকে।” মুগ্ধ ফোন পকেটে পুরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। শিস বাজাতে বাজাতে এগিয়ে গেল বড় দরজাটার দিকে। কয়েক ধাপ এগোতেই দরজা পেরিয়ে কাউকে বেরিয়ে আসতে দেখলো সে। বাগানে লাগানো নিয়নের হলদেটে আলোয় সবটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুগ্ধ এগিয়ে কাছাকাছি আসতেই খেয়াল করলো যে, এটা অরুণী।
অরুণীর কোনো হেলদোল নেই। ঝাপসা চোখে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে সে। মুগ্ধকে পাশ কাটিয়ে যেতেই মুগ্ধ সচকিত হয়ে অরুণীর সামনে দাড়িয়ে বললো,

“এ কি! কোথায় যাচ্ছেন আপনি এতো রাতে?”
অরুণী অদ্ভুত চোখে তাকালো। সেই র*ক্তি*ম জলভরা চোখ দুটো দেখে মুগ্ধ ভেতরে অদ্ভুত অশান্তি অনুভব করলো। কেমন একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাময় অনুভূতি! এই প্রথম সে অরুণীকে কাঁদতে দেখছে। অরুণী মুগ্ধকে আবার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। মুগ্ধ পুনরায় তার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“দেখুন! আমি জানি আপনার মনের অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু তার মানে এই না যে, এভাবে এই অসময়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন!”

অরুণী মুগ্ধর কথা শুনেও কোনো পরোয়া করলো না। বিরস কন্ঠে বললো,
“সরে দাঁড়াও আমার পথের সামনে থেকে।”
মুগ্ধ ভরাট কন্ঠে বললো, “আমি আপনাকে কোথাও যেতে দেবো না!”
অরুণী যেন সহ্যের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো মুগ্ধর দিকে। দুই হাত দিয়ে মুগ্ধর বুক বরাবর সজোরে ধাক্কা দিয়ে বললো,
“কেন যেতে দেবে না তুমি? হাও ডেয়ার ইউ? আমার পথ আগলে দাঁড়ানোর সাহস কী করে হলো তোমার? কোন সাহসে আমার ওপর অধিকার খাটাচ্ছো তুমি? এই মুহুর্তে তোমাকে অসহ্যকর লাগছে আমার কাছে। তোমার মুখও আমি দেখতে চাই না!”

বলেই অরুণী ছুটে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। মুগ্ধ আহত চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অরুণীর প্রত্যেকটা কথা তার হৃদয়ে তীরের মতো আঘাত করেছে, এটা কি অরুণী জানে? চোখের কোণে জমে ওঠা জলকণা মুছলো মুগ্ধ। এটাকেই হয়তো প্রণয়ের দহন বলে! পরমুহূর্তেই মলিন মুখে হেসে নিজেও বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো।

বৈঠক ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেতর থেকে কথোপকথনের আওয়াজ ভেসে এলো মুগ্ধর কানে। নিতান্তই পারিবারিক ব্যাপার ভেবে মুগ্ধ আর সেদিকে কান দিলো না। প্রহরের কথা অনুযায়ী এগিয়ে গেল তাদের ঘরের দিকে।
এদিকে সৌহার্দ্যের হতবিহ্বল দৃষ্টি সুজাতার ওপর নিবদ্ধ। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে, তার মা এমন কথা বলতে পারে। সৌহার্দ্যের সাথে সাথে রায়হান সাহেবও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সুজাতার দিকে। সুজাতার বলা কথাটা তারও পছন্দ হয়নি হয়তো!

তাদের এমন দৃষ্টি দেখে সুজাতা বললো,
“এমন ভাবে তাকিয়ে আছো কেন তোমরা?”
সৌহার্দ্য অবাকতা কাটিয়ে উঠতে না পেরে বললো,
“তুমি কী বললে একটু আগে, মা? তরীকে তুমি এমন একটা কথা কীভাবে বললে?”
সুজাতা নীরস গলায় বললো,

“ঠিকই তো বলেছি! তুমি কেন বিয়ে করলে ওকে? ওর গায়ে যে ক*ল*ঙ্কের দাগ লেগে গেছে, সেটা কি তুমি জানো না?”
রায়হান সাহেব চাপা স্বরে ধমকে উঠলেন,
“কিসের ক*ল*ঙ্ক? কীসব বলছো তুমি? তরীকে নিয়ে এমন কথা বলার আগে মুখে বাঁধছে না তোমার?”
সুজাতাও রাগী কন্ঠে বললো,
“না, বাঁধছে না। সত্যিটা যখন সবাই বলাবলি করছে, তখন আমি বলতে দোষ কোথায়? আমার ছেলে লাখে একটা! বিদেশ থেকে ডাক্তার হয়ে এসেছে এই রকম একটা মেয়েকে বিয়ে করার জন্য? কী যোগ্যতা আছে ঐ মেয়ের আমার ছেলের বউ হওয়ার?”

রায়হান সাহেব আবারো ধমকে উঠলেন,
“চুপ করো! তুমি ভালো মতোই জানো যে, তরীর আসল পরিচয়টা কী? ওর ব্যাপারে একটা বাজে কথাও আমি সহ্য করবো না। এখন সে এই বাড়ির বউ। সৌহার্দ্য একদম ঠিক করেছে তরীকে বিয়ে করে। আর এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। তরীর শৈশব থেকেই ওকে নিজের ছেলের বউ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি আর মা। তোমারও সেটা জানা কথা। এমনকি আফনাদ আর সৌহার্দ্যও সেটা জানে। তুমিও তো সবসময় তরীকে নিজের মেয়ের মতোই দেখে এসেছো! তরীকে নিজের ছেলের বউ করার স্বপ্ন তোমারও ছিল। তাহলে এখন এসব কথার মানে কী?”

“তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। আমি মানি যে, তরীর মতো সুন্দরী মেয়ে আশেপাশের পাঁচ গ্রামেও নেই। কিন্তু ওর চরিত্রে যে ক*ল*ঙ্ক লেগেছে, সেটা মানতে পারবো না আমি।”
“বারবার ক*ল*ঙ্কের কথা কেন তুলছো তুমি? কিসের ক*ল*ঙ্ক? তুমি কি সত্যিটা জানো যে, তরীর সাথে ঐদিন কী ঘটেছিল? কোনো প্রমাণ আছে যে, তোমার ধারণা-ই ঠিক? শুধু মানুষের কথার ওপর ভিত্তি করে একটা নিষ্পাপ মেয়ের ওপর কীভাবে এমন নোং*রা অপবাদ দিচ্ছো তুমি?”

সুজাতা তিক্ত গলায় বললো,
“এটা কোনো অপবাদ নয়! তুমি নিজে জানো, সেদিন তরীর সাথে কী হয়েছিল? আমরা কেউই জানি না! পুরো গ্রামের প্রতিটা মানুষ তরীকে ন*ষ্টা বলছে। আশেপাশের গ্রামেও সবটা ছড়িয়ে গেছে। এসব সত্যি না হলে তরী এখনও মুখ বুজে সবটা সহ্য করছে কেন? এসব যদি মিথ্যা-ই হয়, তাহলে আসল সত্যিটা তরী কাউকে বলছে না কেন? কারণ তরীর সাথে সেই রাতে নিশ্চয়ই খারাপ……”
সৌহার্দ্য এবার অতিষ্ঠ হয়ে মুখ খুললো,

“স্টপ ইট, মা! তুমি এসব কী বলছো? যার ব্যাপারে এসব বলছো, ভুলে যেও না সে এখন আমার স্ত্রী। আর আমার স্ত্রীর ব্যাপারে কোনো বাজে কথা বলতে পারো না তুমি।”
সুজাতা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
“ওর কোনো যোগ্যতা নেই তোমার বউ হওয়ার! আমার অমতে ওর সাথে সংসার করতে পারবে না তুমি। ছেড়ে দাও ওকে!”
সৌহার্দ্য শান্ত গলায় বললো,

“তরীর যোগ্যতা না থাকলে যোগ্য হয়ে দেখাবে তোমায়! আর রইলো ছাড়ার কথা! ছেড়ে দেওয়ার জন্য ওর হাত ধরিনি আমি। তরী বলেনি আমায় ওর হাত ধরতে, আমি স্বেচ্ছায় ওকে নিজের সাথে জুড়েছি। এখন তো ওকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়, মা। তুমি ওকে যত তাড়াতাড়ি মন থেকে মেনে নেবে, ততই ভালো।”
বলেই সৌহার্দ্য দ্রুত পায়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। সুজাতা রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো। রায়হান সাহেব সেটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলেন বৈঠক ঘর থেকে।

সৌহার্দ্য ঘরে প্রবেশ করতেই দেখলো, তরী মালিহার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। সৌহার্দ্যকে দেখেই উঠে বসলো তরী। মালিহাও উঠে দাঁড়িয়ে সৌহার্দ্যের দিকে এগিয়ে এলো। সৌহার্দ্যের মাথায় হাত রেখে মিষ্টি হেসে বললো,
“বুকে আগলে রাখবি তো আমার মেয়েকে সবসময়?”
সৌহার্দ্য প্রশস্ত হেসে বললো,
“একবার আগলে নিলে আর ছাড়ার মানুষ ড. সৌহার্দ্য রায়হান নয়।”
মালিহা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই সৌহার্দ্য বললো,

“আমাদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিও, ছোট মা। আর প্রহরের ঘরেও পাঠিয়ে দিও। আমরা কেউই রাতে কিছু খাইনি।”
“হ্যাঁ, মনে আছে আমার। ব্যবস্থা করছি আমি।”
মালিহা বেরিয়ে যেতেই সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিছানায় বসা তরীর দিকে তাকাতেই দেখলো, তরী একদৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“কী দেখছো?”
তরী শান্ত ও ভরাট গলায় বললো,
“আপনাকে!”

সৌহার্দ্য এগিয়ে এসে তরীর মুখোমুখি বসলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
“সাহস বেড়েছে তাহলে! কয়েকদিন আগে তো আমার দিকে তাকাতেও ভয় পেতে।”
“তখন তো আপনি আমার টিচারের মতো ছিলেন!”
সৌহার্দ্য হেসে বললো,
“হ্যাঁ, এখন বর হয়েছি। সাহস তো বাড়া-ই স্বাভাবিক!”

তরী পূর্ণ দৃষ্টিতে সৌহার্দ্যের হাসিমুখের দিকে তাকালো। ভারী কন্ঠে বললো,
“আমাকে বিয়ে করাটা আপনার উচিত হয়নি। সবাই এতোদিন আমার দিকে আঙুল তুলতো। এখন সবাই আপনাকেও নানা কথা শোনাবে। আজ তো অরুণী-ই কত কথা শুনিয়ে দিলো!”
সৌহার্দ্যের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল মুহুর্তেই। সে থমথমে মুখে বললো,
“অরুণীর মুখ বন্ধ করে দিয়েছি আমি।”

তরী মলিন হেসে বললো,
“আজ অরুণীর মুখ বন্ধ করেছেন। কাল তো হাজারো মুখের অসহনীয় কথা শুনতে হবে। কয়জনের মুখ বন্ধ করবেন আপনি?”
সৌহার্দ্য বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত গলায় বললো,
“তোমার জন্য সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়তেও রাজি আমি। শুধু তুমি পাশে থেকো আজীবন!”

বলেই সৌহার্দ্য আলমারি থেকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল। তরী বিস্ময়পূর্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো সেই অদ্ভুত মানবটির যাওয়ার দিকে।
মালিহা খাবার নিয়ে এসে তরীকে খাইয়ে দিয়ে গেল। খাওয়া শেষে সৌহার্দ্য পানি খেতে খেতে তরীর দিকে তাকাতেই দেখলো, তরী কেমন আড়ষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে বললো,
“হোয়াট? কোনো প্রবলেম?”
তরী ইতস্ততপূর্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,

“আপনি তো বিছানায় ঘুমাবেন! আমি কোথায় ঘুমাবো? আপনার ঘরে তো সোফা-ও নেই! আমি কি মেঝেতে ঘুমাবো?”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো তরীর দিকে। তার চোখে মুখে বিরক্তি স্পষ্ট। সময় নিয়ে বিরস মুখে সে বললো,
“মুভি-সিনেমায় সবসময় মানুষের ঘরে সোফা উপস্থিত থাকলেও, বাস্তব জীবনে সবার ঘরে সোফা থাকে না। তাই বিছানায় আমার পাশেই ঘুমাতে হবে তোমায়। মেঝে শোয়ার কথা চিন্তা করলে বিছানায় বেঁধে রাখবো কিন্তু!”

শেষোক্ত কথাটা অনেকটা হুমকি দিয়েই বললো সৌহার্দ্য। তরী আর উপায়ান্তর না পেয়ে বিছানার এক কোণায় শুয়ে পড়লো। সৌহার্দ্যের পাশে শোয়ার কথা ভাবতেই তরীর গা শিউরে উঠছে। সৌহার্দ্য ঘরের আলো নিভিয়ে তরী আর নিজের মাঝে একটা কোলবালিশ রেখে শুয়ে পড়লো। তরী অবাক চোখে তাকালো কোলবালিশটার দিকে। সাথে সাথেই সৌহার্দ্যের ক্লান্ত স্বর ভেসে এলো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৭

“তোমার-আমার মাঝের বাঁধা সেদিনই দূর হবে, যেদিন তুমি নিজ হাতে এই কোলবালিশটা আমাদের মাঝখান থেকে সরিয়ে দেবে। তার আগে নয়!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৯