প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৯

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৯
Writer Mahfuza Akter

সৌহার্দ্যের মোহনীয় দৃষ্টি তরীর ঘুমন্ত মুখে নিবদ্ধ। সারাটা রাত এক মুহুর্তের জন্য দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। তরী বেশ কিছুক্ষণ জেগে ছিল, ছটফট করছিল। কিন্তু ভোরের দিকে ঘুমে তলিয়ে গেছে সে। কিন্তু সৌহার্দ্যের ঘুম যেন চোখ থেকে উড়ে গেছে, যখন তার চোখ পড়েছে তরীর ঘুমন্ত মুখটার দিকে।

এই রকম একটা সকালের স্বপ্ন সে কতকাল ধরে মনে অতি যত্নে পুষে রেখেছে! সকাল হবে, ভোরের আলো ফুটবে আর সৌহার্দ্যের ঘুম ভাঙবে তার চাঁদের সান্নিধ্যে থেকে। চোখ মেলতেই সে দেখবে তার প্রিয় মানবীটিকে। কিছুদিন আগেও নিজের এই স্বপ্নটাকে নিতান্তই অবাস্তব ও অবান্তর কল্পনা ভেবে হতাশ হতো সৌহার্দ্য। সে ভেবেছিল, স্বপ্নটা আজীবন স্বপ্ন-ই থেকে যাবে! কিন্তু নিয়তির খেলা বোঝা বড়-ই দায়!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সকালের তীক্ষ্ণ আলোয় তরী চোখ কুঁচকে নিতেই সৌহার্দ্য নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ক্ষণিকের জন্য। ঘুমের ভান করে নিজের জায়গায় শুয়ে রইলো সে। তরী নড়েচড়ে উঠে চোখ মেললো ধীর গতিতে। অবসন্ন দৃষ্টি নিয়ে পাশে তাকাতেই সৌহার্দ্যকে দেখে আর বেশি সময় শুয়ে রইলো না তরী। উঠে বেরিয়ে গেল মালিহার ঘরের উদ্দেশ্যে।

মালিহা প্রহর আর মুগ্ধকে খাবারের জন্য ডেকে রান্নাঘরে ঢুকলো আবার। আজ সকাল থেকে সুজাতার থমথমে মুখটা বেশ ভালো করেই চোখে পড়েছে মালিহার। সবসময় হাসতে থাকা মানুষটার হঠাৎ এমন চুপচাপ ভাব মালিহার একদমই ভালো লাগছে না। তাই নিজেই যেচে গিয়ে সুজাতার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

“কী কী বানাবো আজকে, আপা? নাস্তা আজকে আমি-ই বানাই না-হয়! তুমি টেবিলে সাজিও।”
সুজাতা কাটকাট গলায় বললো,
“তুমি তোমার কাজ করো, আর আমাকে আমার কাজ করতে দাও। আমার ভালো লাগছে না এখন তোমার কথা শুনতে।”
মালিহা কিছুক্ষণ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো সুজাতার দিকে। সুজাতা এই প্রথম তার সাথে এমন কঠোর গলায় কথা বললো। কিন্তু এর পেছনে কারণ কী?

একে একে সবাই খাবার ঘরে উপস্থিত হলো। তবে তরী আর অরুণীকে দেখা যাচ্ছে না। আফনা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“সবাই আইলো! আমাগো চাঁদ কই? আর অরুণী?”
সৌহার্দ্যও অবাক হলো তরীকে না দেখে। মালিহার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো, তরী কোথায়? মালিহার অসহায় চোখ দেখা বোঝা যাচ্ছে, সে কিছুই জানে না। রায়হান সাহেব থমথমে গলায় সৌহার্দ্যকে বললেন,

“এসব কী, সৌহার্দ্য? তুমি জানো না তোমার স্ত্রী কোথায়? ওকে সাথে নিয়ে আসা উচিত ছিল তোমার!”
সুজাতা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, সেই! দিন বদলেছে এখন। বউয়েরা বরদের খোঁজখবর কী রাখবে? উল্টো বাড়ির বউ-ই নিজের ঘরে ঘাপটি মে’রে বসে থাকবে। আর আমরা? আমরা তো গুরুজন নই! আমরা হলাম কাজের লোক। খাবার-দাবার সব বউকে ঘরে আসন পেতে পাঠাতে হবে। নতুন বউ বলে কথা!”

মালিহা হতভম্ব হয়ে গেল সুজাতার কথায়। আফনা বেগম হতবিহ্বল দৃষ্টি মেলে বললেন,
“এগুলা কী কইতাসো, বড় বউ? তরীরে নিয়া তুমি এসব কথা মুখে আনলা কেমনে?”
রায়হান সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে সুজাতাকে বললেন,
“খাবার সময় আজেবাজে কথা বলিও না, সুজাতা। এই মুহুর্তে কোনো অশান্তি চাচ্ছি না আমি।”
সুজাতা তিক্ত গলায় বললো,

“অশান্তি? কিসের অশান্তি? আমি তো তোমাকে কাল রাতেই বলে দিয়েছি ঐ মেয়েকে আমি নিজের ছেলের বউ হিসেবে কোনো দিন মেনে নেবো না।”
তরী খাবার ঘরে মাত্রই প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো। সুজাতার মুখে এমন কথা শুনে দরজার আড়ালে লুকিয়ে গেল সে।
মালিহা দাঁতে দাঁত চেপে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। সৌহার্দ্য চুপচাপ বসে আছে নিজের চেয়ারে। বাড়ির সবার সামনে সকাল সকাল এইসব তামাশা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ প্রহর বলে উঠলো,

“আন্টি, আমি জানি আপনাদের ফ্যামিলি ম্যাটারে আমার কথা বলাটা সাজে না। কিন্তু তরীকে তো আপনি ছোট থেকে বড় হতে দেখেছেন! ও তো খুব ভালো মেয়ে! এই বাড়ির বউ হওয়ার জন্য যথেষ্ট যোগ্য বলেই ওকে মনে করি আমি।”
সুজাতা পুনরায় তিক্ত সুরে বললো,

“হ্যাঁ! বেশ যোগ্য সে! এই আহমেদ ভবনের মানুষেরা পুরো গ্রামের আদর্শ। আর এই আদর্শ পরিবারের বউ হলো এমন একটা মেয়ে, যার চরিত্রহীনতার কাহিনী এই গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।”
সৌহার্দ্য রাগী চোখে তাকালো সুজাতার দিকে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
“ইনাফ, মা। অনেক বলেছো! কাল রাতে এত কথা শোনানোর পর আজ সকাল হতে না হতেই আবার শুরু করেছো। আমার বউকে যাচ্ছেতাই বলার অধিকার আমি কাউকে দেইনি। তোমাকেও না!”
সুজাতা হতভম্ব কন্ঠে বললো,

“বউ এসেছে একদিনও হয়নি। আর এখনি মায়ের সাথে এইভাবে কথা বলছো? বউ মায়ের থেকে বড় হয়ে গেল!”
সৌহার্দ্য বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সুজাতার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তার দু’কাধে হাত রেখে শান্ত গলায় বললো,
“মা মায়ের জায়গায়, আর বউ বউয়ের জায়গায়। কেউ যেমন কারো থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়,ঠিক তেমনি একজনের জায়গায় আরেকজনকে বসানোও সম্ভব নয়।

মা হিসেবে তোমার যেমন আমার ওপর অধিকার আছে, ঠিক তেমনি বউ হিসেবে ওর-ও অধিকার আছে আমার ওপর। এই বাড়ির বউ হওয়ার আগে তরী আমার বউ। ওকে কথা শোনাতে হলে, আমি শোনাবো। এই অধিকারটা শুধুই আমার। ওর মা-বাবারও সেই অধিকারটা আর নেই। তাই আমার স্ত্রীর অপমান আমি সহ্য করবো না। এখন সেটা তুমি করো, বা অন্য কেউ।”

বলেই সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুজাতাকে ছেড়ে দিলো। সুজাতা বিস্ময়পূর্ণ চোখে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। সৌহার্দ্য সেদিকে পরোয়া না করে বললো,
“আজকে হসপিটালে জয়েন করছি আবার। তরীকে আরেকবার যদি এইসব অপমানজনক কথা বললে, আমি বাধ্য হবো এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। নিজের চোখের সামনে নিজের বউকে এইভাবে অপমানিত হতে দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

সৌহার্দ্য বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। একবারও পেছন ফিরে তাকালো না। আফনা বেগম পেছন থেকে ডাকলেন অনেকবার। কিন্তু সৌহার্দ্য না খেয়েই চলে গেল। তরী সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে ঝাপসা চোখে তাকালো। চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে। কিন্তু পানি গড়িয়ে পড়তে বাধা দিচ্ছে সে। কোনোমতে নাক টেনে সেও সৌহার্দ্যের ঘরে চলে গেল। এই মুহুর্তে খাওয়ার কোনো ইচ্ছে-ই তার নেই।

সুজাতা রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেল। সবার খাওয়া শেষে মালিহাও খাবার নিয়ে তরীর ঘরে গেল। তরী বিষন্ন মনে বসে আছে বিছানায়। মালিহা জোরপূর্বক ওকে খাইয়ে দিলো। তরীর নীরবতা যেন মালিহাকে সব বলে দিচ্ছে, বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, এই মুহুর্তে তরীর মনের ভেতর কী চলছে!
খাওয়া শেষে মালিহা তরীর দিকে তাকিয়ে বললো,

“সেই রাতে কী হয়েছিল, চাঁদ?”
তরী চমকে তাকালো মালিহার দিকে। ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“কোন রাতের কথা বলছো?”
“তুই তো ভালো করেই জানিস, কোন রাতের কথা আমি তোকে জিজ্ঞেস করতে পারি!”
তরীর ভীত চোখ দুটো অনবরত আশেপাশে ঘুরতে লাগলো। মালিহা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তরীর দিকে। তরী সময় নিয়ে বললো,

“আ…আমি জানি না। আমার কিছু মনে নেই।”
মালিহা কিছুক্ষণ তরীর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে গেল। তরী আপনমনে ব্যথিতচিত্তে বললো,
“অর্ণব ভাই! আজ তোমার জন্য! শুধুমাত্র তোমার জন্য আমার জীবন এই অদ্ভুত সমীকরণে দাঁড়িয়েছে, যার কোনো সমাধান-ই নেই।”

বাড়ির সবাই ভোরে ঘুম থেকে উঠলেও, মধু ঘুম থেকে ওঠে দুপুরের দিকে। তাই সে রোজ একা একাই নাস্তা খায়। আজও নিজে কোনো রকম দুটো রুটি খেয়ে তরীর কাছে দৌড় লাগালো মধু। কিন্তু তরীকে বিছানায় ঘুমাতে দেখে হতাশ হলো সে। তরীর মলিন মুখটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মেয়েটা প্রচন্ড ক্লান্ত। কী যাচ্ছে ওর ওপর দিয়ে কে জানে! তাই তরীর ঘুমটা আর ভাঙালো না মধু।

সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই প্রহরের ঘর থেকে কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে পা থেমে গেল মধুর। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দরজায় আড়ি পেতে দাঁড়ালো সে। ভেতর থেকে প্রহর আর মুগ্ধর গলা ভেসে আসছে। মুগ্ধ বলছে,
“অরুণীকে আজ ওর ঘর থেকেই বের হতে দেখলাম না। আমার বেশ টেনশন হচ্ছে।”
প্রহর বললো, “এতো টেনশন করার দরকার নেই। চল, আমরা ফিরে যাই এবার। এখানে থেকে আর কী লাভ?”

“আমি অরুণীকে ফেলে যাচ্ছি না। এমনিতেই মেয়েটা প্রচন্ড ডিপ্রেসড্!”
“তাহলে তুই-ই থাক! আমি চলে যাই। ভার্সিটি থেকে কোনো ছুটি নেইনি আমি। আর দু’দিন পরপর ছুটি নেওয়াটা ভালো দেখায় না।”
মুগ্ধ নাক ফুলিয়ে বললো,
“প্রেমে তো পড়োনি কোনোদিন! তাই ভাইয়ের কষ্টটা বুঝতে পারছো না।”
প্রহর হেসে বললো,
“এই অভীক শাহরিয়ার কোনোদিন প্রেমে পড়বেও না। তোমায় আর সৌহার্দ্যকে এমন নাকানিচুবানি খেতে দেখে শিক্ষা হয়ে গেছে আমার।”

বলেই হুট করে দরজা খুলে বের হতে গিয়ে মধুর সাথে জোরেশোরে একটা ধাক্কা খেলো প্রহর। মধু পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিলো। প্রহর হতভম্ব হয়ে বললো,
“হোয়াট? তুমি এখানে?”
মধু বিস্ফোরিত চোখে নিজের বাহু ঘষতে ঘষতে বললো,
“এভাবে না বলে না কয়ে হুট করে দরজা খোলে কেউ? এখন যদি পড়ে গিয়ে নাকমুখ ভেঙে যেত আমার, তাহলে আমাকে কে বিয়ে করতো, হ্যা?”
প্রহর কিটকিটিয়ে হেসে বললো,

“হ্যাঁ, তোমাকে এমনিতেও কেউ বিয়ে করবে না! কে তোমার মতো উটকো ঝামেলা ঘাড়ে চাপাবে? পড়াশোনার তো কোনো ঠিকঠিকানা নেই! শুধু সারাক্ষণ মানুষের দরজায় উঁকি-ঝুকি দিয়ে বেড়ানো!”
মধু রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
“কী বললেন? আমি মানুষের ঘরে উঁকি ঝুঁকি দেই?”
“না। লেট মি কারেক্ট! তুমি উঁকি দেও না। তুমি আসলে আড়ি পাতো। স্টুপিড গার্ল!”

বলেই প্রহর মধুকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। মধু রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে প্রহরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
“তোমাকে যদি নাকানিচুবানি না খাওয়াই, তাহলে আমার নামও মধু না!”

বিকেলে ড্রয়িং রুমে বসে বসে টিভি দেখছিলেন আসমা বেগম। তার পাশে বসে ম্যাগাজিন পড়ছেন রাশেদ সাহেব। হঠাৎ লাগেজ নিয়ে অর্ণবকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে বিমূঢ় চোখে তাকালেন রাশেদ সাহেব। ম্যাগাজিন রেখে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললেন,
“তুমি? এখন এখানে কীভাবে?”
আসমা বেগম রাশেদ সাহেবের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজেও চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন। অর্ণবকে দেখে চমকে উঠে বললেন,
“তুই?”
অর্ণব বিরক্ত হয়ে বললো,

“হ্যাঁ, আমি। ভর্তিসহ সকল ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে এসেছি। দুই-তিনদিন পর চলে যাবো।”
রাশেদ সাহেব থমথমে গলায় বললেন,
“এসেছো, ভালো কথা। কিন্তু গ্রামে যাওয়ার কথা আর ভেবো না।”
অর্ণব ম্লানমুখে হেসে বললো,

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৮

“গ্রামে তো আমাকে যেতেই হবে, বাবা! আমি তোমার কথা মেনে সেদিন তরীর হাত ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন তোমায় আমার কথা মানতেই হবে। তরীকে বলেছিলাম, আমি ওর কাছে ফিরবো। আমি ফিরে এসেছি। এই দুই সপ্তাহে আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি, তরীকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২০