প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২০

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২০
Writer Mahfuza Akter

সকালের পর সুজাতা ঘরের ভেতর ঘাপটি মে*রে বসেছে। বাইরে একবারের জন্যও পা রাখেনি। রান্নাঘরে সবকিছু একা হাতে মালিহাকে সামলাতে দেখে আফনা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“তুমি একলা সব কাম করতাসো, ছোটবউ? বড়বউ কই গেছে?”
মালিহা মলিন মুখে হেসে বললো,

“আমি একাই সব সামলে নেবো, মা। আপার মন-মেজাজ এখন ঠিক নেই। তাই আমিও আর ডাকিনি।”
আফনা বেগম অতিষ্ঠ হয়ে মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“সংসারে এক মুহুর্তও শান্তি সহ্য হয় না কারো! আমার-ই কিছু একটা করতে হইবো। বুঝছি!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আফনা বেগম মালিহার দিকে তাকিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মালিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নার কাজে হাত দিলো। সবটা গুছিয়ে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই সুজাতাকে অরুণীর ঘরের দিকে যেতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল মালিহার। সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো সুজাতার সচেতন ভাবভঙ্গির দিকে। সুজাতা অরুণীর ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো। মালিহা হতাশ হয়ে সেখান থেকে চলে গেল। তার বুঝতে বাকি নেই সুজাতা কেন অরুণীর কাছে এসেছে!

অরুণী জানালার পাশে বসে উদাস চোখে আকাশ দেখছে। হঠাৎ কারো আগমন টের পেয়ে পেছনে তাকালো সে। সুজাতা জোরপূর্বক হেসে এগিয়ে এলো অরুণীর দিকে। অরুণীর মাথায় হাত রেখে বললো,
“কিছু খেয়েছিস দুপুরের পর?”
অরুণী অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো সুজাতার দিকে। এই প্রথম সুজাতার এমন স্নেহপূর্ণ কোনো কথা শুনছে সে। বিস্মিত মুখে-ই উত্তর দিলো,

“হ্যাঁ, খেয়েছি। তুমি হঠাৎ এখানে?”
সুজাতা নিজের মাথার ঘোমটা ফেলে বিছানায় বসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“এলাম নিজের দুঃখের গল্প শোনাতে। এই বাড়িতে তো আমার দুঃখের প্রতি কারোই কোনো নজর নেই!”
অরুণী ভ্রু কুঁচকে বললো,

“তোমার আবার কিসের দুঃখ?”
“তোকে আর কী বলবো নতুন করে? সবকিছু তো তোর চোখের সামনে-ই ঘটলো! কত স্বপ্ন ছিল আমার একমাত্র ছেলেটাকে নিয়ে! সব শেষ।”
অরুণী ম্লান মুখে হেসে বললো,
“সব শেষ হওয়ার কী আছে? সৌহার্দ্য স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে তরীকে। আর তরীও তো অনেক সুন্দরী! পড়াশোনা করে সেও ভালো কিছু করবে। দুজনকে মানাবে ভালোই!”

সুজাতা বিরক্ত হলো অরুণীর কথায়। ক্ষিপ্ত গলায় বললো,
“কিসের ভালো মানাবে? তরী আর আমার ছেলের বয়সের পার্থক্য দেখেছিস? আমার ছেলের পাশে তো তোর মতো একটা মেয়েকেই মানাবে।”
অরুণী চকিত দৃষ্টিতে তাকালো সুজাতার দিকে। এগিয়ে এসে সুজাতার পাশে বসলো। হতভম্ব হয়ে বললো,
“মানে?”
সুজাতা হাত বাড়িয়ে অরুণীর গালে হাত রাখলো। হেসে কোমল গলায় প্রশ্ন করলো,
“আমার ছেলেকে ভালোবাসিস? বিয়ে করবি আমার ছেলেকে?”

সৌহার্দ্য বাড়ি ফিরেছে বিকেলের পর। ঘরে এসে তরীকে গুটিশুটি হয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো সে। মনে মনে বিড়বিড় করে বললো, “এই অসময়ে ঘুমাচ্ছে কেন? শরীর ঠিক আছে তো?”
এগিয়ে গিয়ে তরীর কপালে হাত রাখলো সৌহার্দ্য। পরখ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই তরী হালকা নড়ে উঠলো। সৌহার্দ্য দ্রুত সরে দাড়িয়ে নিজের হাতের ঘড়ি খোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তরী ধীরগতিতে চোখ মেলে শোয়া থেকে উঠে বসলো। সৌহার্দ্যকে দেখে বারকয়েক পলক ফেলে বললো,

“আপনি কখন এলেন?”
সৌহার্দ্য হাসার চেষ্টা করে বললো,
“কিছুক্ষণ আগে।”
তরী প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। সৌহার্দ্য প্রশ্ন করলো,
“সারাদিন ঘরে ঘুমিয়ে-ই কাটিয়েছো?”
তরী সৌহার্দ্যের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“আসলে দুপুরের পর চোখ লেগে গিয়েছিল একটু।”

“তুমি তো দিনে তেমন ঘুমাও না। এখন হঠাৎ বারবার ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণ হলো, তুমি কাল সারারাত জেগে ছিলে। তাই আজ থেকে রাতে ভালোমতো নিশ্চিন্তে ঘুমিও। নয়তো তুমি এভাবে রোজ দিনে ঘুমানো কন্টিনিউ করলে বাড়ির সবাই মনে আমাকে দোষারোপ করবে!”
তরী অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
“আপনাকে কেন দোষারোপ করবে?”
সৌহার্দ্য বিরস মুখে বললো,

“কারণ তখন সবাই মনে করবে আমি এতোটাই পাষণ্ড পুরুষ, যে নিজের বউকে সারারাত ঘুমাতে দেয় না। এজন্য বউ সারাদিন ঘরে ঘুমায়। কিন্তু কেউ তো আর জানে না যে, এই সৌহার্দ্য রায়হানের চেয়ে বড় দুর্ভাগ্যবান পুরুষ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই।”
বলেই সৌহার্দ্য নিজের কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। তরী ফ্যালফ্যাল করে নির্বোধের মতো তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে। একদমে এতোগুলো কীসব কথা বলে সৌহার্দ্য চলে গেল?
তরী তেমন মাথা না ঘামিয়ে মালিহার ঘরে চলে গেল।

মালিহা বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। দৃশ্যপটে ভাসছে সেদিন ডক্টর সামিয়ার বলা কথাগুলো। সেদিন মালিহা ডক্টর সামিয়াকে নিয়ে গিয়ে তার চেম্বারেই দরজা আঁটকে দিয়েছিলো ডক্টর সামিয়ার কাছ থেকে আসল সত্যিটা জানার জন্য। সে বুঝতে পেরেছিল, ডক্টর সামিয়া কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। তাই ডক্টর সামিয়াকে শক্ত গলায় প্রশ্ন করেছিল মালিহা,

“কী হয়েছে তরীর? আপনি আসল ঘটনা কাউকে বলতে চাইছেন না কেন, ডাক্তার?”
ডক্টর সামিয়া ভড়কে গিয়ে বলেছিলেন,
“আ…আপনি এভাবে আমায় আঁটকে ধরেছেন কেন? ছাড়ুন আমায়! আমি কিছুই জানি না।”
“আপনি সব জানেন। এজন্যই এতক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কীসব কথা বলছিলেন! কিন্তু আমার তো সোজাসাপ্টা উত্তর চাই! আপনি যা যা জানেন, এখনি বলে ফেলুন আমায়। নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। কী হয়েছে তরীর?”
ডক্টর সামিয়া হতবিহ্বল হয়ে গেলেন। এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন তার ডাক্তারি জীবনে প্রথম হয়েছেন হয়তো। তাই উপায়ান্তর না পেয়ে হতাশ গলায় বললেন,

“দেখুন! আমি নিশ্চিত কিছু-ই বলতে পারবো না। সবটাই আমার অনুমান। পেশেন্টের প্রচুর ব্লি*ডিং হয়েছে যার কারণে আমার ধারণা, ওর সাথে খা*রা*প কিছু-ই হয়েছে। ব্লি*ডিং না হলে তো কোনো সমস্যা-ই ছিল না। তাছাড়া ওর হাতে, পায়ে আর মাথায় যেই আঘাত দেখলাম, ওকে মে*রে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। এখন আসল সত্যিটা কী, সেটা তো আপনারা পেশেন্টের কাছ থেকেই জানতে পারবেন। তরী ছাড়া আসল ঘটনা আমরা কেউ-ই জানি না।”
মালিহা ফট করে চোখ মেলে শোয়া থেকে উঠে বসলো। কপাল ঘেমে উঠেছে তার। আঁচল দিয়ে নিজের মুখ মুছতেই তরীকে ঘরে ঢুকতে দেখলো। তরী মলিন মুখে হেসে এগিয়ে এলো মালিহার কাছে। মালিহার পাশে বসে উদাস গলায় বললো,

“ছোট মা! একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?”
“বল!”
“আমাকে দেখে তোমার কী মনে হয়? ভাগ্যবতী? নাকি অ*ভা*গী?”
মালিহা তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
“অন্তত আমার মতো দুর্ভাগ্য যেন তোর না হয়!”
তরী অবাক হয়ে বললো,

“তোমার সাথে কী এমন হয়েছে, ছোট মা? তুমি নিজেকে এভাবে কেন বলো?”
মালিহা হাসলো। কিন্তু তার টলমলে চোখ দুটো তরীর নজর এড়ালো না। মালিহা মুখে হাসি ঝুলিয়েই বললো,
“আমার গল্প শুনবি?”
তরী আগ্রহী গলায় বললো, “হ্যাঁ! বলো না!!”
“আজ না, অন্য একদিন! যেদিন তোকে সব কথা খুলে বলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না, সেদিন বলবো তোকে।”

চারদিক এখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। ঘড়ির কা’টা দশটারও ওপারে। আফনাদ হক রাতের খাবার শেষে উঠানে হাটাহাটি করছেন। মোহনা রান্নাঘরেই কাজ করছে। আফনাদ হক বললেন,
“আজ তরীর সাথে একবার দেখা করতে গেলাম না। তুমি অন্তত যেতে পারতে, মোহনা।”
মোহনা বিরস মুখে বিড়বিড় করে বললো,
“ঐ মেয়েকে বহু সাধনা করে নিজের ঘাড় থেকে নামিয়েছি। এখন আবার দেখা করতে যাবে কে?”
আফনাদ হক মোহনার সাড়াশব্দ না পেয়ে বললেন,
“কিছু বলেছি তোমায়! নাকি?”

মোহনা বিরক্তি নিয়ে বললো, “ঐ বাড়ির কেউ আমায় তরীর ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেবে না। অযথা গিয়ে কী লাভ?”
আফনাদ হক হতাশার নিঃশ্বাস ফেললেন। হঠাৎ মূল ফটকে কড়া নাড়ার শব্দে চমকে উঠলেন তিনি। মোহনাও বেরিয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। “এতো রাতে কে এলো?” বিড়বিড় করতে করতে আফনাদ হক এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলেন। দরজার ওপাশে অর্ণবকে দেখে অবিশ্বাস্য চোখে ঘনঘন পলক ফেললেন আফনাদ হক। বলে উঠলেন,

“তুমি?”
মোহনাও এগিয়ে এসে অর্ণবকে দেখে হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। অর্ণব অশান্ত গলায় বললো,
“খালামনি, আমি… আমি তরীর কাছে এসেছি। আমি ওকে বলেছিলাম না যে আমি আসবো ওর কাছে? এই দেখো! আমি এসেছি।”
আফনাদ হক বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললেন,
“যেভাবে এসেছিলে, সেভাবেই চলে যাও। তোমার মুখ দেখারও ইচ্ছে নেই আমার। তোমার মতো মানুষ আমার মেয়েকে ডিজার্ভ করে না।”

অর্ণব আহত চোখে তাকালো। সে জানত এমনটাই হবে। এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক! সবার রাগ করার মতো কাজই তো সে করেছে। তাই আফনাদের কথা গায়ে না মেখে বললো,
“আমি জানি আপনারা রেগে আছেন। কিন্তু আমার কথাটাও আপনারা একটু শুনুন।”
“কী শুনবো তোমার কথা? কী বলার বাকি আছে তোমার? তোমার কোনো কথা…. ”
আফনাদ হকের কথা শেষ হওয়ার আগেই অর্ণব বললো,
“আগে আমি তরীর সাথে দেখা করবো।”

আফনাদ হক রাগী কন্ঠে বললেন, “তরী এই বাড়িতে নেই। আর তোমার মুখে দ্বিতীয় বার ওর নাম আনবে না। তরী এখন সৌহার্দ্যের স্ত্রী। তুমি যেই সম্মান শেষ করে গিয়েছো, সেই সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য-ই সৌহার্দ্য তরীকে বিয়ে করেছে।”
অর্ণব অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। সৌহার্দ্য তরীকে বিয়ে করেছে – কথাটা যেন তার বিশ্বাস-ই হচ্ছে না। আফনাদ হক অর্ণবের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিলেন। অর্ণব আহত চোখে তাকিয়ে এক পা, দু পা করে পিছিয়ে এলো সেখান থেকে।
গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে অর্ণব পুকুরপাড়ে এসে দাঁড়ালো।

এই পুকুরপাড়ে কতই না স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার আর তরীর! সে এসব স্মৃতি কীভাবে ভুলবে? তাহলে কি সেদিন তরীর হাত ছেড়ে দেওয়াটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল? তরীকে কি সারাজীবনের মতো হারিয়ে ফেলেছিল সেদিন? এতো বড় শাস্তি তো সে মেনে নিতে পারছে না!

অর্ণব চোখ ভরে এলো অশ্রুতে। দু’হাতে নিজের চোখ ঘষলো সে। রাস্তার কিনারায় নতুন নিয়নের আলো জ্ব*লছে আজ। সেই আলোয় সবটাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তরীর নামটা জীবনের অপ্রাপ্তির তালিকায় বসাতে পারছে না সে। একবার তরীর সাথে দেখা করা উচিত। কিন্তু এতরাতে সেটাও সম্ভব না। তাই হতাশ হয়ে পেছন ঘুরে দাড়ালো অর্ণব। সামনে এগোনোর আগেই চোখ পড়লো তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা এক অদ্ভুত অবয়বের দিকে। অর্ণবের থেকে ঠিক কয়েকহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে সে। সারা শরীর একটা চকচকে কালো চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে সে। চোখ দুটো হয়তো উন্মুক্ত, কিন্তু রাতের আধারে তা দেখতে পারছে না অর্ণর। নিয়নের আলোয় তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে। অবাক গলায় বললো, “কে?”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ১৯

ব্যক্তিটি নিজের ডান হাত চাদরের আড়াল থেকে বের করলো। হাতে সাথে বেরিয়ে এলো বৃহদাকৃতির রা*ম দা*, যার ঔজ্জ্বল্যে অর্ণব চোখ বড় বড় করে ফেললো। ব্যক্তিটি সেই বিশাল রা*ম দা* সুদক্ষ হাতে ঘুরিয়ে ধরে ভ*য়ং*ক*র গলায় বললো,
“তোর মৃত্যু!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২১