প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২১

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২১
Writer Mahfuza Akter

“পুকুরপাড়ে ঝোপের পাশে একজনের গ*লা**কা*টা লা**শ পাওয়া গেছে”- কথাটা রাতের মধ্য প্রহরেই যেন বাতাসের বেগে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পৌঁছে গেছে। রাতের সুনশান নীরবতা ভেঙে জনসমাগম ও কোলাহলে মুখরিত হয়ে গেছে গ্রাম।
রায়হান সাহেব ক্লান্ত ভঙ্গিতে সেই ঘটনাস্থল থেকে ফিরলেন মাত্র। আফনা বেগম আর সৌহার্দ্য তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল বৈঠক ঘরে বসে। রায়হান সাহেবের আগমন দেখে সৌহার্দ্য বলে উঠলো,

” বাবা চলে এসেছে!”
আফনা বেগম বসে বসে ঝিমচ্ছিলেন। সৌহার্দ্যের কথায় যেন চমকে উঠলেন। রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কী খবর ঐ দিকের? কে খু*ন হইলো?”
রায়হান সাহেব অবসন্ন পায়ে এগিয়ে এসে আফনা বেগমের পাশে বসলেন। বললেন,
“আমি দেখিনি, মা। পুলিশ এসেছে। আমি পুলিশের সাথে কথা বলে এসেছি।”
আফনা বেগম মাথা নাড়িয়ে বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ঠিকই করছো না দেইখা। এইসব দেখার মতো মনের শক্তি তোমার নাই। আমি শুধু ভাবি, মানুষ এতো পাষণ্ড হয় কেমনে? মানুষের গায়ের ওপর এইভাবে ছু**রি চালানো কেমনে সম্ভব?”
রায়হান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“সেটা তো মাঝেমধ্যে আমিও ভাবি! এইরকম খু**ন তো আর আজকে নতুন না! এর আগেও এমন মধ্য রাতে কয়েকটা খু**ন হয়েছে। আমার তো মনে হচ্ছে, খু**নী একজন-ই, যে এভাবে এক এক করে মানুষের জীবন নিচ্ছে!”
মালিহা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে রায়হান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো,

“আপনার জন্য শরবত বানিয়েছি, ভাই। এখানে এনে দিবো, নাকি আপনার ঘরে রেখে আসবো?”
“আমার ঘরেই রেখে এসো।”
বলেই রায়হান সাহেব সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার সাথে আমার ঘরে এসো। কথা আছে আমার, তোমার সাথে।”

রায়হান সাহেব নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। সৌহার্দ্যও গেল রায়হান সাহেবের পিছু পিছু। আফনা বেগম মালিহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “বাড়ির বউ হইবো এমন! সবার দিকে খেয়াল রাখবো। আর সুজাতারে দেখো! ঘরের ভেতর পইড়া পইড়া ঘুমাইতাছে! যত্তসব!”

অর্ণব ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। গ্রাম ছেড়ে শহরে হাইওয়েতে চলে এসেছে সে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। কিন্তু কয়েকঘন্টা আগের সেই দৃশ্যটা মাথা থেকে সরছে না কোনোমতেই। সারা শরীর দরদর করে ঘামছে তার। হাত-পা কাঁপছে অনবরত। ভাগ্যের কারণেই আজ বেঁচে ফিরতে পারছে সে সম্ভবত। নয়তো আজকে তার মৃত্যু অবধারিত ছিল।

তখন সেই চাদরাবৃত আগন্তুকের মুখে “তোর মৃত্যু!” কথাটা শুনে গলা শুকিয়ে গিয়েছিল অর্ণবের। হতবিহ্বল দৃষ্টি মেলে সে তাকিয়েছিল আগন্তুকের হাতে থাকা রা*ম দা*টির দিকে। সেটা চালানোতে এই ব্যক্তি যে বেশ দক্ষ বুঝতে বাকি নেই অর্ণবের। তাহলে কি আজই তার জীবনের শেষ রাত? ভাবনার মাঝেই অর্ণব অনুভব করলো ব্যক্তিটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। শুকনো ঢোক গিলে অর্ণব পিছিয়ে যাচ্ছে। পাড়ের একদম কিনারায় দাঁড়িয়ে অর্ণব বুঝতে পারলো, আর পিছিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ পেছনে পানি। এদিকে সেই ব্যক্তি এবার এগোনোর গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। উপায় না পেয়ে অর্ণব সশব্দে পুকুরের পানিতে ঝাপ দিলো। সাঁতারে বেশ দক্ষ হওয়ায় পানির মধ্য দিয়ে ডুবন্ত অবস্থায়-ই সাঁতরে একটু দূরে গিয়ে মাথা তুলে তাকালো।

পুকুরের একপাশে মাছ চাষ করা হয়। রাতের আঁধারেই সেখানে মাছ ধরতে আসে মাছের ব্যবসায়ীরা। এমনই একজন হাতে জাল নিয়ে মাছ ধরতে এসে পাড়ে কালো চাদরে আবৃত কাউকে দেখে অবাক গলায় বললো, “কে রে? মাছ চুরি করতে আসছোস?”
ব্যক্তিটা জ্ব*ল*ন্ত চোখে পেছন ফিরে তাকালো। এই মুহুর্তে অর্ণব হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ায় ভীষণ ক্ষিপ্ত সে। সে হয়তো ভাবতেই পারেনি, অর্ণব এভাবে পালিয়ে যাবে! কিন্তু সামনের লোকটাকে দেখে তার রাগ কয়েকগুন বেড়ে গেল। হাত দু’টো পেছনে লুকিয়ে এগিয়ে এলো সে কয়েক পা। ক্রোধান্বিত কন্ঠে বললো,

“তোকে অনেকদিন ধরে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু সুযোগ-ই পাচ্ছি না। আজ তো দেখি নিজে এসে ফাঁদে পা দিয়েছিস! তাই তোর জন্য আমার পক্ষ থেকে সহজ মৃত্যু!”
বলেই আর একমুহূর্তও দেরি করলো না সে। ঝড়ের গতিতে দা*টি লোকটার গলায় বসিয়ে দিলো। ফিনকি দিয়ে র**ক্তের ছিঁটে এসে পড়লো ব্যক্তিটার চোখে, মুখে ও চাদরে। সে হাত দিয়ে নিজের মুখ উন্মুক্ত করে লেগে থাকা র*ক্ত*কণা মুছে আবার মুখ ঢেকে ফেললো। ঘাড় ঘুরিয়ে পুকুরের মধ্য খানে পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ণবে দিকে বিস্ফোরিত চোখে একবার তাকিয়ে দ্রুত গতিতে স্থান ত্যাগ করলো।

অর্ণব হতবাক হয়ে এতক্ষণ নিজের চোখের সামনে ঘটে চলা হ*ত্যা*কা*ন্ডটা দেখলো। সামনের দিকে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না সে৷ পাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়া র*ক্ত*স্রোত পুকুরের পানিতে এসে মিশছে। অর্ণবের গা হিম হয়ে এলো। সে দ্রুত পুকুরের পাশে ঝোপের দিকে গিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রাস্তার কিনারায় থাকা নিজের গাড়িটায় বসে ঝড়ের গতিতে গ্রামের বাইরের দিকে এগিয়ে চললো। কিছু সময়ের মধ্যেই লোকজন জড়ো হয়ে যাবে। রাস্তার কিনারায় এই গাড়ি দেখলে, খু*নী হিসেবে এই গাড়ির মালিককেই সন্দেহ করবে। তাই গাড়িসহ যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই অর্ণবের।
সবটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই বুক কেঁপে উঠছে অর্ণবের। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, আর কখনোই গ্রামে যাবে না সে।

সৌহার্দ্য রায়হান সাহেবের মুখোমুখি বসেছে। রায়হান সাহেব নিজের ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসেছেন। সুজাতা পাশের ঘরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সেদিকে আপাতত কোনো নজর নেই রায়হান সাহেবের। সৌহার্দ্যের সাথে তার ঠান্ডা মাথায় কথা বলাটা বেশ জরুরি। পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার নিয়ে সৌহার্দ্যের দিকে গম্ভীর চোখে তাকালেন রায়হান সাহেব। হাতের সিগারেটটা দেখিয়ে বললেন,

“অভ্যাস আছে?”
সৌহার্দ্য অকপটে মাথা নেড়ে বললো,
“কলেজ লাইফে ছিল। এখন নেই।”
“ভালো।” বলেই রায়হান সাহেব সিগারেটটা জ্বা*লি*য়ে ঠোঁটের ভাজে গুঁজে নিলেন। সৌহার্দ্য সেটা দেখতে দেখতে বললো,
“আমায় ডেকেছো কেন, বাবা?”

রায়হান সাহেব সিগারেটে একটা টান দিয়ে নাকমুখ ভর্তি ধোঁয়া ছাড়লেন। এরপর বললেন,
“দিনেই ডাকতে চেয়েছিলাম।। কিন্তু তুমি যে বিয়ের পরদিনই হসপিটালে ডিউটি দিতে চলে যাবে, সেটা বুঝতে পারিনি।”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “ইমার্জেন্সি ছিল, বাবা। এজন্য!”
“তোমার আর তরীর বিয়ের ব্যাপারে আমার কিছু কথা তোমায় বলার ছিল।”

সৌহার্দ্য অবাক হয়ে তাকালো। বললো, “বিয়ের ব্যাপারে?”
“হুম। তোমার আর আমার মধ্যে একটা কমিটমেন্ট হয়েছিল।”
রায়হান সাহেবের ঠান্ডা গলায় বলা কথাটা শুনে সৌহার্দ্যের গলা শুকিয়ে এলো যেন। সে ভাবেনি, তার বাবা এখনো সেই কমিটমেন্টের কথা মনে রাখবে। সৌহার্দ্যের হতভম্ব চোখ দুটো একবার দেখে নিয়ে রায়হান সাহেব প্রশ্ন করলো, “মনে আছে?”

“সেসব কথার এখন কোনো মানে নেই, বাবা! এখন পরিস্থিতির শিকার হয়ে সকল কমিটমেন্ট ভেঙে বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছি আমি।”
“কথা ছিল, তরী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে আমি ওর বিয়ের কোনো পদক্ষেপ নেবো না। কিন্তু তোমার আর তরীর বয়সের পার্থক্য বেশী হওয়ায় আমি নিজের শর্ত শিথিল করেছি। অন্তত তরীর অনার্স পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করলেই তোমার সাথে তরীর বিয়ের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এখন ভাবনাচিন্তার বাইরে। আমি চেয়েছিলাম তরীকে এই মুহুর্তে শহরে পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু তার আগেই তুমি ওকে বিয়ে করে ফেললে!”

“আমার মনে হয়, আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
সৌহার্দ্য কাটকাট জবাব শুনে রায়হান সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। ছেলেটা এতো একগুঁয়ে কেন? বাবার সিদ্ধান্ত না শুনেই নিজে নিজে বিয়ে সেরে ফেললো। এটা কি সৌহার্দ্যের উচিত হয়েছে? রায়হান সাহেবের মতে, এটা বেশ অনুচিত কাজ। অথচ নিজের ভুল মেনে নিতে একেবারেই নারাজ। রায়হান সাহেব ভোঁতা মুখে বললেন,
“বিয়েটা তরীর অমতে জোর করে করোনি তো?”

সৌহার্দ্য প্রচন্ড বিরক্ত হলো। এসব কোনো কথা হলো? সৌহার্দ্যকে তিনি এতোটা নিচু মনের কীভাবে ভাবছেন? সৌহার্দ্য বিরক্তি নিয়ে বললো,
“বাবা! বিয়ের মতো সেনসিটিভ একটা ব্যাপারে জোরজবরদস্তি খাটানোর মতো কাজ আমি করবো? তুমি এটা কীভাবে বলছো?”
রায়হান সাহেব থমথমে গলায় বললেন, “তোমার ওপর বিশ্বাস নেই।”
সৌহার্দ্য হতাশ হলো। দু’হাতের আঙ্গুল একত্রিত করে রায়হান সাহেবের দিকে তাকালো। রায়হান সাহেব শান্ত গলায় বললেন,

“তোমার মা কিন্তু তরীকে তোমার থেকে আলাদা করেই ছাড়বে! তার ভাবভঙ্গি আমি বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি যদি তোমার মায়ের কারণে অথবা অন্য কোনো কারণে তরীকে ছেড়ে দাও, তাহলে আমি তোমার মুখ কোনোদিন দেখবো না।”
সৌহার্দ্য শক্ত গলায় বললো, “আমি ম*রে গেলেও ওকে ছাড়বো না, বাবা। ওর ওপর সারাজীবন ছায়া হয়ে থাকবো। কোনো বিপদ ওকে ছুঁয়েও দেখতে পারবে না।”

“এগুলো বলা অনেক সহজ। কিন্তু বাস্তবে তুমি তরীর কতটা পাশে থাকতে পারো সেটাই, দেখবো আমি।”
“ঠিক আছে। দেখে নিও।”
সৌহার্দ্য উঠে দাঁড়ালো। রায়হান সাহেব বাঁধা দিয়ে বললেন,
“তরীকে নিয়ে শহরে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নাও। এ বাড়িতে থাকতে হবে না।”
সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বললো, “চলে যাবো?”
“হ্যাঁ। এই গ্রামের মানুষ আর তোমার মা, কেউই তোমাদের শান্তি দেবে না। আশা করি, আমার কথা বুঝতে পারছো। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও।”

সৌহার্দ্য মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। রায়হান সাহেব চোখ কুঁচকে চেয়ারে হলান দিয়ে বসলেন। তার মনে হচ্ছে, গ্রামের চেয়ে শহর তরীর জন্য বেশি অনিরাপদ।
সৌহার্দ্য ঘরে এসে দেখলো, তরী জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য চিন্তিত ভঙ্গিতে দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসলো। তরী হঠাৎ বলে উঠলো,
“এতো দেরী করে এলেন যে?”
“বাবা ডেকেছিল?”

তরী ফট করে ফিরে তাকালো। ঈষৎ চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, “আজকের খু*নটা নিয়ে বড়আব্বু কি কাউকে সন্দেহ করছে?”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“না তো! বাবা আমাদের বিয়ে নিয়েই কথা বলতে ডেকেছে।”
তরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “ওহ!”
সৌহার্দ্য উঠে দাঁড়িয়ে বিছানা গোছাতে গোছাতে বললো,

“অনেক রাত হয়েছে। এসে শুয়ে পড়ো। নয়তো কাল সারাদিন আবার ঘুমে ঢুলবে।”
তরী সৌহার্দ্যের কথা শুনলো না যেন! উদাস গলায় বললো,
“আচ্ছা, প্রিয়মানুষেরা কোনো অপরাধ করলে কেমন অনুভব হয়?”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “অপরাধ করলে তো শাস্তি পেতেই হবে। এখন সেটা প্রিয়মানুষ করুক, বা অন্য কেউ! আইন সবার জন্যই সমান।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২০

তরী নিস্তেজ চোখে তাকিয়ে বললো,
“যদি কোনোদিন জানতে পারেন, আমি আপনার অজান্তে কোনো অপরাধ করেছি, তাহলে কি আপনার কাঠগড়ায় আমার জন্য ক্ষমা থাকবে না?”
সৌহার্দ্য সহাস্যে উত্তর দিলো,
“তোমার অপরাধেরও সঙ্গী হতে রাজি আমি।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২২