প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২২

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২২
Writer Mahfuza Akter

সকাল থেকে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে ঘুরছেন রায়হান সাহেব। সৌহার্দ্যকে চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখে রাগের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। এমন অবাধ্য ছেলে তিনি নিজের জীবনে দেখেননি। ছেলেটা কি আজ হসপিটালেও যাবে না? রায়হান সাহেব রাগ প্রকাশও করতে পারছে না, আবার রাগটা বেশিক্ষণ দমিয়ে রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বাড় মাথায় তুলতে। কিন্তু এমন গোপন বিষয় নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করাও সম্ভব নয়।

সৌহার্দ্য রায়হান সাহেবের থমথমে ভাবভঙ্গি দেখে ওনার ভেতর চলা ঘুর্ণিঝড় বেশ টের পাচ্ছে। তবে বরাবরের মতোই সে এব্যাপারে ভাবলেশহীন। বৈঠক ঘরে রায়হান সাহেবের পাশে বসে বসে বাবা-ছেলের কার্যকলাপ সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করছেন আফনা বেগম। সৌহার্দ্য চলে যেতেই আফনা বেগম আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। এই মুহুর্তে এই দিকটায় কেউ-ই নেই। তাই সুযোগ বুঝে রায়হান সাহেবকে প্রশ্নটা করে বসলেন তিনি,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তোর আর আমার নাতির মইধ্যে কী হইসে রে? তুই ওরে দেইখা এমন রাগে ফোঁস ফোঁস করছিলি ক্যান?”
রায়হান সাহেব তিক্ত গলায় বললেন,
“তোমার নাতি আমার কোনো কথা কানে তুললে আর আমার এমন ফোঁস ফোঁস করতে হয় না! সে তো সারাজীবন আমার বিরুদ্ধে চলার প্রতিজ্ঞা করেছে! এমন অবাধ্য ছেলে আমি আমার জীবনে দেখিনি।”

আফনা বেগম আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রায়হান সাহেব গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গেলেন। আফনা বেগম অবুঝের মতো তাঁর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে শুধালেন, “আমার নাতি আবার কী করলো?”
রায়হান সাহেব নিজের ঘরে না গিয়ে সৌহার্দ্যের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। খোলা দরজার সামনে দাঁড়াতেই ভেতরে স্পষ্ট দেখতে পেলেন সৌহার্দ্য জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা একটা ফাইলের দিকে মনযোগী ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। তরী এখন ঘরে নেই। রায়হান সাহেব দরজায় কড়া নাড়তেই সৌহার্দ্য ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো,

“বাবা, কিছু বলবে?”
রায়হান সাহেব বিরস মুখে বললেন,
“বললেই বা কী? আমার কোন কথাটা শোনো তুমি? এ জীবনে আমার কোন কথাটা শুনেছো তুমি?”
সৌহার্দ্য পুনরায় নিজের চোখ ফাইলে নিবদ্ধ করে বললো,
“আপাতত মনে পড়ছে না।”
সৌহার্দ্যের এমন প্রতিক্রিয়াহীন ভাবভঙ্গি দেখে রায়হান সাহেব ভীষণ বিরক্ত হলেন। এগিয়ে এসে টেবিলের পাশে রাখা চেয়াটায় বসে বললেন,

“আমার কথা না শোনার কারণ কী? কেন তরীকে নিয়ে শহরে চলে যেতে চাইছো না? তোমার আর তরীর সম্পর্কটা ভাঙার জন্য তোমার মা উঠেপড়ে লেগেছে, আর তোমার কোনো হেলদোল-ই নেই! আশ্চর্য!”
“আমি তরীকে না ছাড়লে কেউ আমাদের সম্পর্ক ভাঙতে পারবে না। আর তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। তরীকে আমি এ জীবনে ছাড়ছি না!”

সৌহার্দ্যের কাটকাট জবাবে রায়হান সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। ছেলেটার এতো আত্মবিশ্বাস কেন? পুনরায় প্রশ্ন করলেন,
“যদি তোমাকে বাধ্য করা হয় তরীকে ডিভোর্স দিতে? তখন?”
সৌহার্দ্য হাতের ফাইলটা টেবিলে রেখে আরেকটা ফাইল হাতে নিলো। সেটার পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বললো, “বাধ্য হবো না আমি।”
“যদি তরী সত্যি-ই কোনো দিন তোমায় ধোঁকা দেয়, তোমার বিশ্বাস ভাঙে কিংবা তোমাদের সম্পর্কের অমর্যাদা করে, তখন কী করবে?”

সৌহার্দ্য শান্ত চোখে রায়হান সাহেবের দিকে তাকালো। হাতের ফাইলটা বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দৃষ্টি মেলে দিলো জানালার বাইরে। রায়হান সাহেব জহুরি চোখে পরখ করছে সৌহার্দ্যকে। সৌহার্দ্যকে বেশ চিন্তিত লাগছে। কয়েক মুহূর্ত পর সৌহার্দ্য ঠান্ডা গলায় বললো,
“তরী এমনটা কখনো করবে না।”
“যদি কখনো করে?”

“তাহলে আমার নিষ্ঠুরতম রূপটা দেখবে ও। আমি কখনোই ওকে ছাড়তে পারবো না, বাবা। ওকে ছাড়ার কথা ভাবলে আমার দম আটকে আসে। ডিভোর্স দিলে তো নিঃশ্বাস-ই বন্ধ হয়ে যাবে আমার। আর যদি তরী কখনো আমায় ধোঁকা দেয়, তাহলে আমি ওকে ছাড়তেও পারবো না, নিজের হাত থেকে বাঁচাতেও পারবো না।”
রায়হান সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন, “মানে?”
সৌহার্দ্য নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,

“কিছু না। তুমি শুধু এটাই জেনে রাখো যে, আপাতত আমি এই বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি না।”
রায়হান সাহেব ভীষণ বিরক্ত হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তিক্ত গলায় বললেন,
“অবাধ্য ছেলে কোথাকার!”
সৌহার্দ্য কথাটা শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা ফাইলগুলো একত্রিত করে গুছিয়ে রাখলো। রায়হান সাহেব বিরক্ত মুখে ঘর থেকে বের হওয়ার সময়ই তরীর সাথে দেখা হলো। তরী রায়হান সাহেবকে দেখে বললো,

“কিছু লাগবে তোমার, বড়আব্বু? এখানে কষ্ট করে এলে যে?”
রায়হান সাহেব তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে হতাশ গলায় বললেন,
“এই বাড়িতে আমার কথা চিন্তা করার জন্য তুই ছাড়া আর কেউ-ই নেই দেখছি!”
বলেই রায়হান সাহেব তরীকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। তরী অবুঝের মতো রায়হান সাহেবের যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। হতভম্ব হয়ে বললো,

“কী হয়েছে বড়আব্বুর? এখানে কেন এসেছিলেন উনি?”
সৌহার্দ্য হালকা হেসে বললো,
“সকাল থেকেই বাবার মাথা গরম হয়ে আছে। কাল রাতে আমায় বলেছিলেন, তোমাকে নিয়ে যেন শহরে চলে যাই। ওনার সেই আদেশ আমি মানিনি। সেজন্য-ই এতো রেগে আছেন।”
তরী অবাক হয়ে বললো,

“বাবার কথা শোনেন না কেন আপনি? নিশ্চয়ই আপনার ভালোর জন্য-ই বলছে!”
সৌহার্দ্য এগিয়ে এসে তরীর মুখোমুখি দাঁড়ালো। ভ্রু নাচিয়ে বললো, “তুমিও চাও এই বাড়ি থেকে চলে যেতে?”
তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি কেন এমনটা চাইতে যাবো? বড়আব্বু বলছিলেন, তাই বললাম! বাকিটা আপনার ইচ্ছা।”
“বাবার ধারণা আমরা এখানে থাকলে আমাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাবে। তুমি তো জানো-ই মা তোমাকে এখন অপছন্দ করেন।”

তরী সৌহার্দ্যের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললো,
“আপনি আমায় কখনো ছেড়ে দিলে আমায় এই গ্রাম থেকে অনেক দূরে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দিবেন? এখানে থাকলে আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করবে না।”
সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে বললো,

“আমি তোমাকে কেন ছাড়বো? তোমাকে আমার বউ হয়েই বাঁচতে হবে আর আমার বউ হয়েই ম*রতে হবে। আমি ছাড়া তোমার সামনে আর কোনো অপশন নেই। বুঝেছো?”
তরী অবাক চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বড়মা তো আমায় পছন্দ করে না! বড়আব্বুও ভয় পাচ্ছে আমাদের জন্য। আপনার কোনো ভয় লাগছে না?”
সৌহার্দ্য তরীর দু’কাধে হাত রেখে বললো,

“ভয় পেয়ে পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে যাওয়াটা কোনো সমাধান নয়, চাঁদ! তোমার দুঃসময়ে তোমার চলার পথে হাজারো বাঁধা আসবে। সেগুলো ওভারকাম করার জন্য সাহসী হতে হবে। তুমি শুধু আমার সামনেই চাঁদ হয়ে থাকবে। কিন্তু পুরো পৃথিবীর সামনে তোমার এই চাঁদের ন্যায় কোমলীয়তার কোনো মূল্য নেই। নরম নাটিতে সবাই আঘাত করতে পছন্দ করে। কিন্তু শক্ত মাটিতে আঘাত করতে কেউ সাহস করে না। কারণ শক্ত মাটিতে আঘাত করলে নিজেকেই আঘাত পেতে হয়।

তোমাকে শক্ত হতে হবে। মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলা শিখতে হবে। চুপচাপ সহ্য করার মতো বোকামি করবে না। মানুষকে মুখের ওপর উত্তর দিতে শেখো। কেউ যেন তোমায় মিথ্যে অপবাদ দেওয়ার সাহস না পায়! নিজের অধিকারটা নিজে আদায় করে নেওয়া শুরু করো। এই এডভার্স সিচুয়েশানে স্ট্রাগেল করতে হবে তোমায়।”
তরী মন্ত্রমুগ্ধের মতো সৌহার্দ্যের কথা শুনছিল। সৌহার্দ্য ওকে ছেড়ে দিয়ে বললো,

“তোমার এডমিশনের পর এখান থেকে এমনিতেও চলে যেতে হবে আমাদের। দেখি কোথায় চান্স হয়! সেই হিসেবেই ব্যবস্থা নিতে হবে।”
তরীর ভ্রু কুঁচকে গেল। হতবিহ্বল দৃষ্টি মেলে বললো,
“এডমিশন? কিসের এডমিশন?”
“কিসের আবার? তোমার মেডিক্যাল কলেজের এডমিশন?”
তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসতে বসতে বললো,
“দরকার নেই। আমার আর ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে নেই।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

“কার সামনে দাঁড়িয়ে কী বলছো একবার ভেবে দেখেছো? তুমি কি নিজের পরিচয়ও ভুলে গেছো?”
তরী হতভম্ব হয়ে বললো,
“নাহ্! আমার পরিচয় ভুলবো কেন? আমি অরিত্রী আফনাদ। ডাকনাম তরী।”
“আমি কে বলো তো?”
তরী অবাক হয়ে তাকালো। রেগে গেল নাকি লোকটা? তরী নির্বোধের মতো তাকিয়ে বললো, “আপনি ডক্টর সৌহার্দ্য রায়হান।”

“আমার নাম জিজ্ঞেস করিনি। আমি কে হই তোমার সেটা বলো!”
তরী চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। এটা আবার কী ধরনের প্রশ্ন? এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলা উচিত তার? তরী চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘনঘন পলক ফেলছে। সৌহার্দ্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই চোখের দিকে তাকাতেই তরীর গলা শুকিয়ে গেল। কী করবে সে এখন? কী বলবে? মুখের ওপর বলে দেবে যে, ‘আপনি আমার বর হন!’ বিব্রতকর লাগছে ব্যাপারটা। তাই তরী বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

“আমার কাজ আছে। ছোটমায়ের কাছে যাচ্ছি!”
বলেই তরী দরজার দিকে পা বাড়াতেই সৌহার্দ্য পেছন থেকে তরীর হাত ধরে সজোরে টান দিলো। এমনটার জন্য তরী একদমই প্রস্তুত ছিল না। আকস্মিক ঘটনায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সে সৌহার্দ্যের প্রশস্ত বুকের ওপর আছড়ে পড়লো। সৌহার্দ্য একচুলও পেছালো না। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে তরীর পিঠের নিম্নাংশ ডান হাতে পেঁচিয়ে ধরলো। কল্পনাতীত এই ঘটনায় তরী অবিশ্বাস্য চোখে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্য কপালে গভীর ভাজ ফেলে তরীর হতভম্ব মুখটার দিকে তাকিয়ে বললো,

“আমার থেকে পালানোর চেষ্টা কোরো না, চাঁদ! দিনশেষে আমার নীড়ে-ই ফিরতে হবে তোমায়। আমার কাছে ফিরতে বাধ্য তুমি।”
তরী শুকনো ঢোক গিললো। সৌহার্দ্যের বুকে লে*প্টে থাকতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। একমাত্র মালিহা ছাড়া কারো এতোটা কাছাকাছি সে কখনো দাঁড়ায়নি। তাই কম্পিত কণ্ঠে বললো, “ছাড়ুন!”

“আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। আমি তো দিনে শ’খানেক বার বলি যে, তুমি আমার বউ। সবার সামনেও নির্দ্বিধায় স্বীকার করি যে, তুমি আমার স্ত্রী। তুমি কেন বলতে পারছো না? নাকি আমায় মেনে নিতে কষ্ট হয় তোমার?”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২১

তরী ঘনঘন পলক ফেলে সৌহার্দ্যের দিকে তাকালো। সৌহার্দ্যের চোখে মুখে কেমন অদ্ভুত একটা মলিনতা। তরীর কী হলো সে নিজেও বুঝতে পারলো না! নির্দ্বিধায় বলে ফেললো,
“আপনি আমার বর, আমার অর্ধাঙ্গী। আপনাকে মানি আমি। নিজের স্বামী হিসেবে মনেপ্রাণে মানি।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২২ শেষ অংশ