প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২২ শেষ অংশ

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২২ শেষ অংশ
Writer Mahfuza Akter

তরী সৌহার্দ্যের উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ। সৌহার্দ্যের ভ্রু-দ্বয়ের মাঝে গভীর ভাজ, কিন্তু ঠোঁটের প্রান্তভাগে প্রসারিত হাসির রেখা। চোখ দুটো তরীর মুখের ওপর নিবদ্ধ। সেটা খেয়াল করতেই তরী হকচকিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। সৌহার্দ্য সেটা দেখে সহাস্যে বলে উঠলো,

“আমার বন্ধন থেকে ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা তো এ জনমে নেই তোমার, চাঁদ! কেন বৃথা শক্তির অপচয় করছো?”
তরী সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
“উত্তর চেয়েছিলেন! দিয়ে দিয়েছি তো! তাহলে আমায় ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন? আপনি বললেন আপনার প্রশ্নের উত্তর দিলে আপনি ছেড়ে দিবেন আমায়?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ইচ্ছে তো করছে না! কিন্তু বলেছিলাম যেহেতু, তাই ছেড়ে দিচ্ছি। ড. সৌহার্দ্য রায়হান আবার কথার নড়চড় করে না! তবে আপাতত ছাড়ছি, ভেবো না পার্মানেন্টলি।”
বলেই তরীর পিঠ থেকে হাত সরিয়ে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো সৌহার্দ্য। তরী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো! সৌহার্দ্য পূর্ণ দৃষ্টিতে তরীর দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা নজরে আসতেই তরী ভ্রু কুঁচকে বললো,
“ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

সৌহার্দ্য দৃষ্টি না সরিয়ে একই ভাবে তাকিয়ে থেকেই উত্তর দিলো,
“নিজের জিনিসে তাকিয়ে থাকতে ট্যাক্স দিতে হয় না। যাই হোক! কোনো প্রকার ন্যাকামো না করে সরাসরি আমাকে নিজের বর বলে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা। এতোক্ষণ অনেক রোম্যান্স হয়েছে। এখন আসল কথায় আসি। আমার বউ তুমি। ড. সৌহার্দ্য রায়হানের বউ। আমার এজুকেশনাল এন্ড প্রফেশনাল লাইফ সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে নিশ্চয়ই! এখন আমার মতো একটা মানুষের বউ হয়ে তুমি নিজের গায়ে অশিক্ষিতের তকমা লাগাবে, এটা তো আমি মেনে নেব না! আমার ভবিষ্যৎ বাচ্চাকাচ্চার মা অশিক্ষিত হলে বাচ্চাদের কীভাবে মানুষ করবে?”

তরী নাক ফুলিয়ে তাকালো। এক ধাপ অগ্রসর হয়ে ফুঁসে উঠে বললো,
“আমি অশিক্ষিত নই। এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি, বুঝেছেন?”
“হ্যাঁ, ঢেএএএর পড়াশোনা করে ফেলেছো! এখন তোমার এই পড়াশোনা দিয়ে কেরানীর চাকরীও পায় না কেউ।”
তরী বিরক্ত হয়ে বললো,

“এখানে আবার চাকরীর বিষয় কোথা থেকে এলো? আমি চাকরী করতে যাবো কেন? আশ্চর্য!”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নাহ্! এই মেয়েকে বোঝাতে বোঝাতে সে পাগল হয়ে যাবে। কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে সৌহার্দ্য তরীর হাত ধরলো। তরী কিছুটা চমকালো। কিন্তু কিছু বললো না। সৌহার্দ্য তরীকে বিছানায় বসিয়ে নিজে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসলো। তরীর হাত দু’টো নিজের দু’হাতে পুরে তরীর দিকে শীতল দৃষ্টি মেলে দিলো সৌহার্দ্য। তরী হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। এভাবে তার সামনে তার হাত আগলে এমন আদুরে চোখে তাকিয়ে কেউ কখনো বসেনি। সৌহার্দ্যের এই আচরণ তরীর ভীষণ ভালো লাগলো। সৌহার্দ্য তরীর হাত ধরে শান্ত গলায় বললো,

“আমি তোমায় চাকরি করতে বলিনি। কখনো বলবোও না। বিষয়টা চাকরির না। আমি তোমাকে তোমার ক্যারিয়ার গড়ে নিতে বলছি; একটা সাকসেসফুল এন্ড এস্টেবলিশড্ ক্যারিয়ার। আমাদের জীবনের প্রতিটা সেকেন্ড অনিশ্চয়তায় মোড়ানো। কখন পরিস্থিতি আমাদের কোন জায়গায় নিয়ে দাঁড় করায়, আমরা কেউ বুঝতেও পারি না। অসহায়ত্ব বলে-কয়ে আসে না- এটা তোমার চেয়ে ভালো আর কে-ই বা বুঝবে, বলো? তোমার দায়িত্ব আমি নিয়েছি।

এখন ধরো, কোনোভাবে আমার কোনো ক্ষতি হলো! তখন তুমি কী করবে? মানুষের অসহায় মুহুর্তে কেউ আসতে চায় না। এই যে আমার মাকে-ই দেখো। আগে তোমায় চোখে হারাতেন, আর এখন সহ্য-ই করতে পারে না। আমার কিছু হয়ে গেলে তোমায় সেই অসহায় পরিস্থিতিতে কেউ এগিয়ে আসবে না। তাই তোমায় নিজেকে এরকম ভাবে প্রিপেয়ার করতে হবে যেন যেকোনো পরিস্থিতিতে তোমায় কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে না হয়! এমনকি আমার ওপরও নির্ভর করতে না হয়! তোমার ভরসার জায়গা হবে তুমি নিজে। আর নিজেকে গড়ে তোলার সময় এখন-ই। বুঝেছো, চাঁদ?”

তরী মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। এইভাবে তো সে কখনো ভেবে দেখেনি। সত্যি-ই নিজের নির্ভরতার জায়গা নিজের মধ্যে ধারণ করার বিকল্প নেই। তরী একদৃষ্টিতে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি যা বলবেন, তা-ই শুনবো আমি। বুঝতে পারছি না কেন আজ আপনাকে বিশ্বাস করতে ভীষণ ইচ্ছে করছে! মনে হচ্ছে আমার বিশ্বাসের একমাত্র ধারক আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। আপনাকে বিশ্বাস করে আমি আবার ঠকবো না তো?”
সৌহার্দ্য তরীর হাত মুঠোয় ভরে অনবরত ঠোঁট ছুঁইয়ে হাসিমুখে বললো,

“তোমার বিশ্বাস আমার দ্বারা ভঙ্গ হলে নিজ হাতে মরণ দিও আমায়। সহাস্যে নিজের প্রাণটা তোমার হাতে তুলে দিতে দ্বিতীয় বার ভাববো না।”
তরী বিস্ময়, বিমূঢ় ও নির্বাক হয়ে রইলো। সৌহার্দ্য বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ঘড়িতে একবার চোখ বুলালো। হসপিটালে যাওয়ার সময় হয়ে আসছে প্রায়। সৌহার্দ্য কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। একপলক তরীর দিকে তাকিয়ে দেখলো, মেয়েটা এখনো বিস্মিত চোখে ওকেই দেখছে। সৌহার্দ্য হাসলো। অদ্ভুত সে হাসি মুখে ঝুলিয়ে-ই বললো,
“তোমায় হুট করে এভাবে বিয়ে করে ফেলার মূল কারণ ছিল তোমার জীবনটাকে গুছিয়ে দেওয়া। আমার চাঁদ অসহায়ের মতো মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরবে, অপমানিত হবে, অসম্মানিত হবে; সেটা সহ্য হবে না আমার।”

সৌহার্দ্য হসপিটালে যাওয়ার জন্য একেবারে প্রস্তুত হয়ে নিচে এসেছে। সৌহার্দ্যের পেছনে পেছনে তরীও ধীরেসুস্থে আসছে। খাবারের ঘরে গিয়ে দেখলো মালিহা আর সুজাতা পাশাপাশি কাজ করছে। তবে আগে যেমন কাজের সময় তাদের মুখ আর হাসি অনবরত চলতে থাকতো, আজ আর সেরকম দেখা যাচ্ছে না। দুজনেই নীরবে নিজ নিজ দায়িত্ব সামলাচ্ছে। সাথে যুক্ত হয়েছে দু’জন কাজের মহিলা। সৌহার্দ্যকে দেখেই মালিহা বললো,

“হাসপাতালে যাচ্ছো এখন? দুপুরের খাবার খেয়ে যাও।”
সৌহার্দ্য উজ্জ্বল হাসি দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, খেয়ে-ই যাবো ছোটমা। চাঁদও এসেছে আমার সাথে। আসলে দেরী করে হলেও তোমাদের আদরের মেয়ে বুঝতে পেরেঋে যে, বরকে নিজ হাতে না খাওয়ালে বউ বউ ফিল আসে না। আর বউয়ের হাতে না খেলে নিজেকে অবিবাহিত, কুমার পুরুষ মানুষ মনে হয়।”

সৌহার্দ্যের কথা শুনে তরীর মুখ হা হয়ে গেল। সে কখন বললো যে, সে সৌহার্দ্যকে নিজে খাওয়ানোর জন্য এখানে এসেছে? এই ছেলে বানিয়ে বানিয়ে এসব কী বলছে? তরীর বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে সৌহার্দ্য ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমি না নিজে দায়িত্ব নিয়ে আমাকে আজ খাওয়াবে বললে? তো খাবার সার্ভ করো!”
তরী ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করলো, “মিথ্যুক কোথাকার!!”

মালিহা ওদের কার্যকলাপ দেখে নিঃশব্দে হাসছে। ওদের যতই দেখছে, ততই যেন চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে মালিহার।
সুজাতা সবকিছুই নীরবে শুনছে। মনে মনে বেশ বিরক্ত হচ্ছে সুজাতা। কাজের মহিলা দু’টো আড়চোখে বারবার তরীর দিকে তাকাচ্ছে আর মিটমিট করে হাসছে। সৌহার্দ্য সবেমাত্র খাওয়া শুরু করেছে এমনসময় কাজের মহিলাদের মধ্যে একজন সুজাতার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“আপনারা আসলেই বড় উদার মানুষ গো! নয়তো নিজের বিদেশফেরত এই হীরার টুকরা ডাক্তার পোলার জন্য এই মাইয়ারে বউ বানাইয়া আনে কেউ? এর কেচ্ছা তো দশগ্রামে ছড়াইয়া গেছে!”
সুজাতা দাঁত কটমট করে তাকালো। আজ কাজের লোকদের কাছের হাসির পাত্র হতে হচ্ছে তাদের। মালিহা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য খাওয়া বাদ দিয়ে তাদের দিকে চোখ তুলে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে গেছে তার। সৌহার্দ্য কিছু বলার প্রস্তুতি নিতেই হঠাৎ তরীর শান্ত গলা শোনা গেল,

“আসলে কী বলুন তো? বানিয়ে বানিয়ে কেচ্ছা রটানোর মজা-ই আলাদা। তাই সুযোগ পেলে কেউ সেটা হাতছাড়া করতে চায় না। হোক সেটা সত্য বা মিথ্যা, মজা নেওয়াটা-ই আসল। আমার সাথেও আপনারা সেটা-ই করেছেন। এতোদিন দেখেছি আর চুপচাপ সহ্য করেছি। নরম ছিলাম। কিন্তু এই নরম আমিটাকে আপনারা পি*ষে এতোটা-ই শক্ত করেছেন, যার আঘাত এখন কতটা বেদনাদায়ক হয় সেটাই বোঝাবো আমি!”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২২

তরী কথাগুলো বলেই সেখান থেকে চলে গেল। সৌহার্দ্য তরীর কথাগুলো চুপচাপ শুনেছে। কিছু বলেনি, একবার ওর দিকে তাকায়ও নি। মনে একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে সৌহার্দ্য আবার খাওয়া শুরু করলো। তার চাঁদ নিজের জন্য স্ট্যান্ড নেওয়া শিখে গেছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী-ই বা আছে? হাসিমুখে খেতে লাগলো সৌহার্দ্য। ইশ! মাছের কোরমা-টা আজ দারুন হয়েছে!!

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ২৩