মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৫১

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৫১
সাদিয়া জাহান উম্মি

সিয়া অনিকের সাথেই আছে।আজ পাঁচদিন যাবত অনিক হাসপাতালে ভর্তি।এর মাঝে রিধি,প্রিয়ান,পিহু,আহিদ আর অথৈ সবাই একসাথে এসে দেখা করে যায়।ওরা প্রায় প্রতিদিনই এসেছে।আর বাকিদের কথা নাহয় নাই বলা যায়।তারা তো পারলে এক মিনিটের জন্যেও হাসপাতাল থেকে নড়েনি।অনিকের বাবা মা ছেলের কাছে থাকতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু তারা বয়স্ক মানুষ।এভাবে দিনের পর দিন হাসপাতালে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবেন।তাই তাদের থাকতে দেয়নি কেউ।উনাদের আস্বস্ত করেছে ওরা সবাই।তবে প্রতিদিন আসেন ছেলের সাথে দেখা করতে।এদিকে সিয়ার বাবা মা প্রথম দিন কিছু বলেনি সিয়াকে হাসপাতালে থাকার কারনে।রুদ্রিক ম্যানেজ করে নিয়েছিলো।কিন্তু তারা আর অনুমতি দেননি সিয়াকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাই বাধ্য হয়ে সিয়াকে রাতে বাসায় চলে যেতে হয়।কিন্তু সকাল হলেই আবারও সিয়া চলে আসে।অনিকের মন চাইতেও না সিয়াকে যেতে দিতে।কিন্তু কিছু করার নেই।কোনো বাবা মা-ই চাইবে না।তাদের এমন প্রাপ্তবয়স্ক একটা মেয়ে রাতের বেলা বাড়ির বাহিরে থাকুক।তাই অনিকও আর জোড়াজুড়ি করেনি।আজ অনিককে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে।তাই সিয়া অনিকের যাবতীয় সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে।কাজ শেষ হতেই সিয়া অনিকের পাশে এসে দাঁড়ায়।

‘ তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে?যদি পুরোপুরি সুস্থ ফিল না করো।তবে আর কয়েকটা দিন থাকতে পারো হাসপাতালে।’
অনিক সিয়ার কথায় আস্তে আস্তে বলে,
‘ আমি ঠিক আছি।তুই চিন্তা করিস না।’
‘ তাহলে আমি বাকিদের ডাকছি।ওরা তোমাকে হাটতে হ্যাল্প করবে।’
এই বলে সিয়া চলে যাবার জন্যে পা বাড়ালে অনিক সিয়াকে ডেকে উঠে।থেমে যায় সিয়া।ঘুরে এসে ফের অনিকের সামনে দাঁড়ায়।প্রশ্ন করে,
‘ কিছু লাগবে তোমার?’
অনিক করুন কণ্ঠে বলে,

‘ আমায় মাফ করেছিস সিয়া মন থেকে?আমি চাই না জোড়পূর্বক তুই আমার সাথে কোনো সম্পর্কে জড়াস।আমি তোর বিরহে যেটুকুই বা বাঁচি কিন্তু তোর করুনা আমি সহ্য করতে পারব না সিয়া।আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো।’
অনিকের প্রতিটা কথা মন দিয়ে শুনল সিয়া।দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও।আরেকটু এগিয়ে গিয়ে অনিকের দুহালে নরম হাতে স্পর্শ করল।অনিক আবেশে চোখ বন্ধ করে নিয়ে আবারও চোখ মেলে তাকায় সিয়ার দিকে।সিয়া নরম গলায় বলে,

‘ আমার চোখের দিকে তাকাও অনিক।আমার চোখের দিকে তাকালেই তুমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।’
অনিক অপলক তাকিয়ে থাকল সিয়ার চোখের দিক।এইতো,এইতো সেই চোখ।যেই চোখে অনিক অসীম ভালোবাসা দেখতে পেতো।কিন্তু ওর ভুলের নাহ,ভুল না ওর অন্যায়ের কারনে সেই ভালোবাসা সিয়ার হৃদয়ের এককোণে চাপা পরে গিয়েছিলো।আজ ফের সেই ভালোবাসাময় চোখজোড়া দেখে স্নিগ্ধ অনুভূতিতে তলিয়ে যাচ্ছে অনিক।ওর অজান্তেই ওর দুচোখ ভিজে গেলো।সিয়া হালকা হেসে অনিকের সেই ভেজা চোখজোড়া মুছে দিলো।সিয়া বলে,’ কাঁদছ কেনো?’
অনিক ধরা গলায় বলে,’ আমার ভালোবাসাকে ফিরে পেয়ে।’

‘ তোমার ভালোবাসা তো তোমারই ছিলো অনিক।কিন্তু তুমি তো বুঝতে পারোনি।যখন বুঝলে অনেক দেরি করে ফেলেছিলে।তবুও আমি তোমায় ফেলে যায়নি অনিক।আমি যদি তোমার নাও হতাম তবে অন্যকারও কোনোদিন হতাম না।একজীবনে একজনকেই আমি ভালোবেসেছি অনিক।একজনকেই ঠাই দিয়েছি।চাইলেও সেই স্থান আমি কাউকে কোনোদিন দিতে পারতাম না।তার আগেই যে আমার মরন হতো অনিক।’
অনিক সাথে সাথে সিয়ার ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল।

‘ শশশ!বাঁজে কথা বলবে না তো সিয়া।সহ্য হয় না।আমি তোমাকে প্রমিস করলাম সিয়া।আর কোনোদিন তোমাকে কষ্টে কাঁদতে দিবো না সিয়া।তুমি কাঁদবে আর তা হবে তোমার সুখের কান্না।তুমি সুখে কাঁদবে সিয়া।আমি তোমাকে এতোটাই ভালোবাসব যে আমার দেওয়া আগের আঘাতগুলো তুমি সব ভুলে যাবে।আমার ভালোবাসা তীব্রতায় তুমি হারিয়ে যাবে।’
সিয়ার চোখেই জল জমেছে।ও চোখ মুছে বলে,

‘ আমি তো কাঁদতে চাই অনিক।খুব করে কাঁদতে চাই সুখের কান্না।’
অনিক সিয়ার হাতটা টেনে পরম আদরে চুমু খেলো।বলল,
‘ তুমি আমার হও সিয়া।এই জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই আমার। বিয়ে করবে আমায় তুমি সিয়া?আমার হয়ে তুমি আমাররাজ্যের রানি হবে?’
‘ হবো অনিক।তোমার রাজ্যের রানি হবো।’

চোখে জল, ঠোঁটের কোণে হাসি অনিক আর সিয়ার দুজনের।দুজন অপলক তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে।হঠাৎ চারপাশ থেকে করতালির আওয়াজে হুঁশ ফিরে ওদের।সিয়া দ্রুত সরে যায় অনিকের কাছ থেকে।ওরা তাকিয়ে দেখে রুদ্রিক,ইহান,সাফাত,নীল,মারিয়া,অথৈ,পিহু,রিধি,প্রিয়ান,আহিদ ওরা সবাই উপস্থিত অনিকের কেভিনে।মারিয়ার হাতে মোবাইল ছিলো।যা দিয়ে ও অনিক আর সিয়ার ওই মুহূর্তগুলো রেকর্ড করছিলো।মারিয়া হেসে বলে,
‘ ওয়াও।হোয়াট অ্যা প্রোপোজাল।’

নীল মারিয়ার কানে কানে বলে,’ আমি কিন্তু আরও রোমান্টিকভাবে প্রোপোজাল করতে পারি।গভীরভাবে ভালোবেসে।’
মারিয়া লজ্জা পেয়ে যায়।লজ্জামিশ্রিত হাসি নীলকে উপহার দিয়ে বলে,’ নির্লজ্জ কোথাকার।আশেপাশে কতো মানুষ আছে দেখছ না?’

নীল হালকা হেসে বলে,’ প্যেয়ার কিয়া তো ডারনা ক্যেয়া?যাব প্যেয়ার কিয়া তো ডারনা ক্যেয়া?’
গানের এই লাইনটুক খেয়ে নীল মারিয়া নীলকে চোখ মেরে দিলো।মারিয়া হেসে দিলো।
এদিকে সিয়াআকস্মিক সবাইকে দেখে লজ্জা পেলো।আর অনিক মুগ্ধ চোখে সিয়ার ওই লজ্জামাখা মুখটা মন ভরে দেখছে।এই মুখটা আজ কতোদিন পর অনিক উপভোগ করতে পারছে।তাই এই মুহূর্তে এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইছে না।
ইহান হাসতে হাসতে বলে,

‘ অনিক তোর মুখে সিয়াকে তুমি বলে সম্বোধন করা শুনে আমার কেন জানি হাসি পাচ্ছে।’
রিধি নাক মুখ কুচকে বলে,’ আপনার তো শুধু অযথাই হাসি পায়।কতো সুন্দর করে অনিক ভাইয়া সিয়া আপুকে প্রোপোজ করল।আপনি তো খারুস আপনি এসব বুঝবেন না।বেআক্কল লোক কোথাকার।’
ইহান চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায় রিধির দিকে।
‘ আমাকে বেআক্কল বলা হচ্ছে।তোমাকে তো পরে দেখে নিচ্ছি।জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।’

ইহানের হুমকিতে শুকনো ঢোক গিলল রিধি।বেশি বলে ফেলল না-কি?এখন আবার এই লোক তাকে কি করবে?রিধি সরে গিয়ে আহিদের পিছনে লুকিয়ে পরল।রিধির ভীতু মুখটা বেশ উপভোগ করছে ইহান।ঠোঁট কামড়ে মৃদ্যু হাসল ও।
প্রিয়ান পিহুর হাতটা আঁকড়ে ধরল।হঠাৎ কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে সেদিকে তাকায় পিহু।প্রিয়ানের কাজ এটা বুঝতে পেরেই পিহু চোখের ইশারায় বুঝালো এমন করতে না।এখানে সবাই আছে।কে শুনে কার কথা।প্রিয়ান ওর হাতটা আরও শক্ত করে ধরে বলে,’ আমরা কবে বিয়ে করব পিউ?শীঘ্রই মনে হয় অনিক ভাই আর সিয়া আপুর বিয়ে হবে।’

প্রিয়ানের কথা শুনে পিহু বলে,’ অনেক দেরি।আমাদের গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগে তো একদম না।’
প্রিয়ান মুখটা ফুলিয়ে ফেলল।
‘ কোথায় একটু আমাকে শান্তনা দিবি।তা না করে উলটো আমার হৃদয়ের দহন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিস।বেয়াদপ কোথাকার।’
পিহু রেগে গেলো প্রিয়ানের ওকে ‘বেয়াদপ’ বলায়।ও প্রিয়ানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগি স্বরে বলে,’ আমাকে বেয়াদপ বলা।আবার আসিস আমার কাছে।লাথি মেরে তোর মেইন পার্টস উড়িয়ে দেবো একদম।’

পিহু হনহন করে কেভিন থেকে বেড়িয়ে গেলো।প্রিয়ান ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল।এইজন্যেই বলে বেষ্টফ্রেন্ডকে বিয়ে করা মানে স্বয়ং নিজেই নেচে-কুঁদে সিংহের গুহায় চলে যাওয়া।অথৈ হেসে দিলো প্রিয়ানের মুখের এক্সপ্রেশন দেখে।ওকে হাসতে দেখে প্রিয়ান মুখ ফুলিয়ে বলে,’ হাসিস না তো।আমি বাঁচিনা আমার জ্বালায়।আর তুই রাক্ষসীগো মতো বত্রিশপাটি দাঁত বাহির কইরা ভ্যা’টকাইতেছস।’

অথৈ ধরাম করে কিল বসিয়ে দিলো প্রিয়ানের পিঠে।রেগে বলে,’ তুই কাকে রাক্ষসী বলছ।ঘুষিয়ে তোর চাপা ভেঙে ফেলব।’
প্রিয়ান পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে কাঁদো স্বরে বলে,’ সারাজীবনটা আমার মাইয়াগো হাতে মাইর খাইতে খাইতে শেষ হইবো।ইয়া মাবুদ এ কই এনে ফাঁসায় দিলা আমারে।’
কেভিনে উপস্থিত সবাই হেসে দিলো প্রিয়ানের কথায়।রিধি হাসতে হাসতে বলে,’ সারাজীবনের কথা জানিনা।কিন্তু তুই যদি এখন পিহুর রাগ না ভাঙাস।তবে পিহু তোকে ওর ক্রোধের আগুনে জ্বা’লিয়ে দিবে।’

রিধির কথা শেষ হতে দেরি। প্রিয়ানের পিহুর পিছনে ছুটতে দেরি নেই।সবাই আরেকদফা হাসল।
মেঘালয় থেকে আসার দুদিন পরেই প্রিয়ান আর পিহু সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সবাইকে ওদের সম্পর্কের কথা জানিয়ে দেয়।সবাই বেশ খুশি হয়। সাথে আশ্চর্যও হয়।কারন যারা সারাদিন টম এন্ড জেরির মতো ঝগড়াঝাটি করতেই থাকে তারা একে-অপরকে ভালোবাসে।ব্যাপারটা হজম করতে বেশ সময় লেগেছে।এদিকে আহিদও কোনো বিরোধীতা করে না।প্রিয়ান ভালো ছেলে।পরিবারও ওর ভালো।ছোটো থেকে ওরা একসাথে বড়ো হয়েছে।আর পিহুও যেহেতু প্রিয়ানকে ভালোবাসে তাহলে এখানে আর নাকচ করার কিছু নেই।

অনিকের চোখে সত্যিকারের ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে রুদ্রিক।ও জানে অনিক এখন সিয়াকে ভালোবাসে।রুদ্রিক প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজে দাঁড়ালো।গম্ভীর কন্ঠে অনিকের উদ্দেশ্যে বলে,
‘ যেই যেই প্রমিস করলি সিয়াকে তুই।তা যেন অক্ষরে অক্ষরে করা হয় মনে রাখিস।যদি সিয়ার চোখ থেকে কোনোদিন তোর কারনে অশ্রু ঝরে তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।’
অনিক সিয়ার হাতটা নিজের হাতের মাঝে আগলে নিয়ে বলে,
‘ নিজের জীবন দিয়ে হলেও ওকে আগলে রাখব।আর কোনোদিন ওকে কষ্ট দিবো না।এক ভুল আমি আবারও করতে রাজি নই।’

সাফাত বলে,’ কথাটা মনে রাখলেই হলো।’
‘ অবশ্যই।’
ইহান বলে উঠে,’ এখন চল যাওয়া যাক।নিচে গাড়ি ওয়েট করছে।’
‘ হুম চল।’
অনিককে নিয়ে ওরা হাসপাতাল থেকে চলে যায়।সবাই যার যার বাড়িতে চলে যায়।যেহেতু এক্সামের আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি রুদ্রিকদের।তাই প্রিপারেশন নিতে হবে।

পরেরদিন সকাল সকাল ভার্সিটি এসে হাজির হয় আহিদ।মেঘালয় থেকে আসার পর থেকে মাইশার সাথে দেখা হয়নি ওর।মাইশাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছিলো না।ভার্সিটিতে এসে মাইশাকে খুঁজেছিলো পায়নি।না পেয়ে মাইশার বাসায়ও গিয়েছিলো। ওর রুমমেট থেকে জানতে পারে মাইশা নাকি গ্রামের বাড়ি গিয়েছে।এই কয়দিনে পাগলপ্রায় আহিদ দিশেহারা হয়ে পরেছিলো।আজ ওর এক ক্লাসমেট ওকে কল করে জানায় মাইশা নাকি আজ ভার্সিটিতে এসেছে।আর সে লাইব্রেরিতে আছে।খবরটা পেয়ে তৎক্ষনাত ছুটে এসেছে আহিদ।সোজা চলে যায় লাইব্রেরিতে।লাইব্রেরিতে গিয়ে কাক্ষিত মানুষটিকে দেখতে পেয়ে স্থির হয়ে যায় আহিদ।সেইদিকেই একধ্যানে তাকিয়ে থাকে।এতোদিনে খরা হয়ে থাকা হৃদয় জমিনে যেন এক পশলা প্রশান্তির বারিধারার বর্ষণ হলো।বুকে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল আহিদ।

মাইশা লাইব্রেরিতে বসে বসে কিছু নোটস তৈরি করছিলো।হঠাৎ ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিতে লাগল ওকে কেউ দেখছে গভীরভাবে দেখছে।মাইশা ব্যক্তিটিকে খোঁজার জন্যে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল।হঠাৎ লাইব্রেরির দরজার দিকে চোখ যেতেই মাইশার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেলো।ভূমিকম্পের ন্যায় হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল যেন।মাইশা দাঁড়িয়ে যায়।চোখ ভিজে উঠল মাইশার।ঠিক কতোদিন পর মানুষটাকে দেখল মাইশা।

এই মানুষটা যে ওর দেহ,মন সবটা জুড়ে আছে।আহিদ মেঘালয় চলে যাবার পরেরদিনই খবর আসে ওর মা অনেক অসুস্থ।ওই খবর শুনে তৎক্ষনাত গ্রামে ফিরে যায় মাইশা।ফোনে যে যোগাযোগ করবে তারও উপায় ছিলো না।ওর ছোটো ভাই বুঝেনি।খেলার ছলে ওর মোবাইলটা নিয়ে দোতলা থেকে ফেলে দেয়।ফলে মোবাইলটা নষ্ট হয়ে যায়। সিমটা ওর বাবা রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে যে তিনি কোথায় রেখেছেন তা আর বলতে পারেননি।

সিমটাও হারিয়ে যায়। গ্রামের বাড়ি ভালো মোবাইল কি আর সেখানে কিনতে পাওয়া যায়?তাই মাইশার বাবা বলেন যে শহরে ফিরে গিয়েই নাহয় নতুন মোবাইল কিনতে।উপায় না পেয়ে বাবার কথাই মেনে নেয়।কিন্তু মনকে কি মানানো যায়।এই মন তো সেই কবেই সে আহিদের কাছে হারিয়ে ফেলেছিলো।লোকটাকে যে কখন নিজের মনের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলে নিজেই বুঝতে পারেনি মাইশা।

যখন গ্রামে গেলো।আহিদের অনুপস্থিতি ওকে হারে হারে উপলব্ধি করিয়ে দেয়।যে ও ঠিক কতোটা ভালোবেসে ফেলেছে আহিদকে।যে কয়টাদিন গ্রামে ছিলো প্রতিটা দিন ছটফট করে কেটেছে মাইশার।ছুটে চলে আসতে মন চাইতো শহরে।শুধু আহিদকে দেখার জন্যে।কিন্তু চাইলেও আসতে পারছিলো না ওর মা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত।এইতো কাল সন্ধ্যায় ফিরেছে ও গ্রাম থেকে।আর আজই ভার্সিটিতে চলে এসেছে।কিন্তু ভার্সিটিতে এসে দেখে তেমন কেউ আসেনি। মাইশা আহিদকে দেখার জন্যে এতোটাই বিভোর ছিলো যে।অনেক জলদি চলে এসেছে ভার্সিটিতে।তাই উপায় না পেয়ে ভাবল লাইব্রেরিতে বসে কিছু নোটস বানানো যাক।সময় হলে নাহয় আহিদের সাথে গিয়ে দেখা করবে।

কিন্তু হঠাৎ এভাবে আহিদকে লাইব্রেরিতে দেখবে ভাবেনি মাইশা।চোখে জল, ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে মাইশার।একপা একপা করে মাইশা এগিয়ে যায় আহিদের কাছে।একেবারে আহিদের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়।মিষ্টি কণ্ঠে বলে, ‘ কেমন আছেন আহিদ?’

আহিদ তখনও এক দৃষ্টিতে মাইশার দিকে তাকিয়ে আছে।মাইশার কথায় নড়েচড়ে উঠে আহিদ।সাথে সাথে এতোদিনের মাইশার এইভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে নেওয়ার ব্যাপারটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।রাগে আহিদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।হাত বাড়িয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মাইশার দুবাহু।আকস্মিক আহিদের এমন কান্ডে অবাক হয় মাইশা। সাথে বাহুতে ব্যথা অনুভব করায় হালকা আওয়াজে ব্যথাতুর শব্দ করে উঠে।আহিদের সেদিকে ধ্যান নেই।ও রাগে অগ্নিঝরা হয়ে বলে,’ আজ এতোদিন পর এসে জানতে চাইছ কেমন আছি আমি?দেখো আমাকে। ভালোভাবে দেখো।দেখে বলো আমি কেমন আছি।’

কথাগুলো শেষ করে ঝটকা মেরে আহিদ মাইশার বাহু ছেড়ে দেয়।রাগি গলায় বলে,’ আমাকে মানুষ বলে মনে হয় না তোমার?আরে তুমি কি এতোটাই অবুঝ?একটা ছেলে কেন তোমার কাছে বার বার আসে।তোমার সাথে টাইম স্পেন্ড করতে চায়।ভার্সিটিতে এতো এতো মেয়ে থাকতে শুধু তোমার কাছেই যেন ছুটে আসে।কেন তোমাকে দিনে দুই তিনবার কল দিয়ে তোমার ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে? তুমি কি কিছুই বুঝো না?তুমি হুট করে গায়েব হয়ে গেলে।’

মাইশা ভয়ে কাঁপছে।আহিদকে এতোটা রেগে যেতে কোনোদিন দেখেনি ও।লোকটাকে সবসময় শান্ত আর হাসিখুশি মেজাজই সর্বদা দেখেছে।মানুষটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। তাই তো এতোটা রেগে গিয়েছে।মাইশা শুকনো ঢোক গিলল।কাঁপা গলায় বলে উঠে,’ আমি গ্রামে আমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম।’

আহিদ চিৎকার করে উঠে,’ হ্যা মানলাম তুমি গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলে।কিন্তু সেটে একটাবার আমাকে বলতে পারতে।না-কি আমাকে তেমন কোনো কিছু মনেই করো ন তুমি?হ্যা মনে করোই তো না।করলে তো একটাবার আমাকে কল করে জানাতে পারতে।আমিই ছ্যাছড়া।তুমি আমাকে নিয়ে কিছুই ভাবোইনা। সেখানে আমি অযথাই তোমার পিছনে ঘুরেছি এতোদিন।’
আহিদের তিক্ত বাক্যগুলো সহ্য হলো না মাইশার আর।ও ডুকরে কেঁদে উঠে। আহিদ ওকে কাঁদতে দেখে মলিন হেসে বলে,’ ভয় পেয়েছ মাইশা?ভয় পেয়েও না আমাকে।আমার কারনে তুমি ভয় পাচ্ছ এটা আমি মানতে পারছি না মাইশা।আমি চলে যাচ্ছি।তুমি শান্তিতে পড়ো মাইশা।আমি আর কোনোদিন তোমাকে জ্বালাতন করব না।ভালো থেকো তুমি।’

এই বলে আহিদ পা বাড়ালো চলে যাবার জন্যে।মাইশার যেন সহ্য কতে পারল না আহিদের এই তিক্ত বাক্যগুলো।আহিদ ওকে ভুল বুঝে চলে যাবে।এটা মানতে পারলো না কিছুতেই।ভেজা কণ্ঠে ডেকে উঠল মাইশা,’ আহিদ?’
আহিদ একপললের জন্যে থমকে গেলো মাইশার ওই ভেজা কণ্ঠের আকুলতা ভড়পুর ডাক শুনে।পরক্ষনে আবার পা বাড়ালো।তাকে থামলে চলবে না।আর পিছনে ঘুরবে না ও।মাইশা তো ওকে ভালোবাসে না।

তাহলে ও কেন মাইশার ডাকে থামবে।এই ডাকে সারা দিতে গেলে ও নিজেই ভালোবাসার দহনে জ্বলেপুড়ে যাবে।মাইশা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।আহিদ চলে যাচ্ছে।মাইশা আর নিজেকে আটকালো না।মন যা চাইলো। তাই করল।ছুটে চলে গেলো আহিদের কাছে।আহিদকে পিছন থেকে ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরল।কাঁদতে কাঁদতে বলে,’ আমি ইচ্ছে করে যোগাযোগ বন্ধ করেনি আহিদ।আমি আপনাকে অনেক মিস করেছি।কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম।চাইলেও আপনাকে কল করতে পারেনি। আপনি আমাকে ভুল বুঝে এভাবে চলে যাবেন না।প্লিজ যাবেন না।’

আহিদ যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো মাইশার এহেন কান্ডে।ও কখনও ভাবেইনি মাইশা ওকে এইভাবে জড়িয়ে ধরবে।মাইশার ওই নরম দেহের স্পর্শ পেয়ে যেন আহিদের সারা শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে যাচ্ছে। নিশ্বাস আটকে আসছে।আহিদ কাঁপা কাঁপা হাতে ওর বুকের কাছের শার্ট খামছে ধরা মাইশার হাতজোড়ার উপর রাখল।শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। আহিদের এইটুকু স্পর্শে যেন আরও কান্না বেড়ে গেলো মাইশার। একে একে ওর সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলল আহিদকে।

সব শুনে অবাক হয়ে গেলো আহিদ।মেয়েটার সাথে এসব ঘটে গেলো আর ও কিনা একবার জানতেও চাইলও না মাইশার কাছে কিছু।উলটো কিনা মেয়েটাকে কতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলো।অপরাধবোধে আহিদের মনটা একটুখামি হয়ে উঠল।মাইশার হাতদুটো ওর বুকের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে।পিছনে ঘুরে গেলো। আহিদকে ছেড়ে দিলো মাইশা।মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল।আহিদ হাত বাড়িয়ে মাইশার চিবুক স্পর্শ করল।মুখটা উঁচু করল ওর।আহিদ অপরাধী স্বরে বলে,’ আই এম সরি মাইশা।আমি না জেনে বুঝে তোমাকে এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিলাম।আমাকে মাফ করে দেও।’

আহিদ মাইশার চোখের পানি মুছে দিলো।মাইশা ভেজা কণ্ঠে বলে,’ উহু, সরি বলছেন কেন?আপনার জায়গায় আপনি ঠিক আছেন।আমি জানি কাছের মানুষটার সাথে যোগাযোগ না করতে পারলে কতোটা খারাপ লাগে।আপনার সাথে যোগাযোগ না করতে পেরে আমিও কষ্ট পেয়েছি।’

মাইশার মুখে নিজেকে ‘ কাছের মানুষ’ বলে সম্বোধন করতে শুনে হৃদয়ে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো।পরক্ষণে দুষ্টু হেসে বলে,’ তার মানে তুমি বলতে চাইছ আমি তোমার কাছের মানুষ?’
আহিদের দুষ্টু স্বরের বলা কথাগুলো শুনে লজ্জা পেয়ে যায়।হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে কি বলে ফেলেছে।খেয়ালই করেনি।এখন লজ্জায় তাকাতে পারছে না আহিদের দিকে।
আহিদ ঘোরলাগা দৃষ্টিতে মাইশার লজ্জামিশ্রিত মুখটা দেখছে।হঠাৎ আবেগি স্বরে বলে উঠে,’ আই লাভ ইউ মাইশা।আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।আমার বউ হবে মাইশা?’

মাইশার বুকটা কেঁপে উঠল আহিদের বুকে ভালোবাসার কথা শুনে।নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারল না।ঝাপিয়ে পরল আহিদের বুকে।কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলে, ‘ আমিও আপনাকে ভালোবাসি আহিদ।আগে বুঝতে পারেনি।কিন্তু যখন গ্রামে গেলাম।তখন হারে হারে টের পেয়েছি আপনি আমার কতোটা জুড়ে আছেন।আমি আপনার বউ হবো আহিদ।বউ হবো।’

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৫০

আহিদ দুহাতে বুকের মাঝে আগলে নিলো মাইশাকে।এতোদিম তো এটারই অপেক্ষা করছিলো আহিদ। অবশেষে ওদের ভালোবাসাও পূর্ণতা পেলো।মাইশা ওর মন ছুঁয়ে দেখেছে।বুঝতে পেরেছে আহিদ ওকে কতোটা ভালোবাসে।আর কিছু চায়না আহিদ।শুধু আজীবন মাইশাকে এইভাবে নিজের বক্ষস্থলের মাঝে আগলে রাখতে চায়।

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৫২