শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪১

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪১
তানিয়া মাহি

বাহিরে তাকাতেই কাকে দেখলো শুভ্রতা? ইমতিয়াজ! ইমতিয়াজ কেন এখানে এসেছে?
শুভ্রতা রেস্টুরেন্টে চেয়ারটায় বসে আছে। নিহান খাবার অর্ডার দিতে গিয়েছে। শুভ্রতা বসে ফোনে কিছু একটা করছিল হঠাৎ বাহিরের দিকে তাকাতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়ার যোগাড় হয়ে যায়। বাহিরে কে দাঁড়িয়ে, ইমতিয়াজ! ইমতিয়াজ কেন তার পিছু কিরছে, কি চায় সে? শুভ্রতা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস টেনে নিহানের দিকে এগিয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর দুজন মিলে খাবার নিয়ে নিজেদের টেবিলে চলে আসে। যদিও শুভ্রতা ইমতিয়াজের চোখ থেকে বাঁচতেই নিহানের কাছে গিয়েছিল কিন্তু ওখান থেকে ফিরে সে নিজেই বাহিরের দিকটায় তাকিয়ে ইমতিয়াজকে খুঁজতে থাকে।
” আমি খাবার নিয়েই আসছিলাম তোমার আবার যেতে হবে কেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শুভ্রতা আশেপাশে তাকিয়ে ইমতিয়াজকে খুঁজছিল এমন সময় নিহান কথাটা বলে উঠলে চমকে উঠার ন্যায় নিহানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। নিহানের পুরো কথায় মনোযোগ না থাকলেও কিছুটা কানে গিয়েছে তার। সে অনুযায়ী বলে,” দেরি হচ্ছিল তাই গেলাম। একটা সাহায্য করাও হয়ে গেল।”

নিহান হালকা হাসির রেখা টেনে শুভ্রতার উদ্দেশ্যে বলে, ” বিকেলে কি ভয় পেয়ে গিয়েছিলি?”
” আপনি এমনভাবে ডাক পাঠিয়েছিলেন, ভয় পাব ন? আরাম করে পায়েস খাচ্ছিলাম তখন।”
শুভ্রতার কথায় নিহানের ওষ্ঠ আরেকটু প্রশস্ত হয়। চোখগুলো ছোট হয়ে যায়। নিহান হাসলেই তার চোখগুলো দারুণভাবে ছোট হয়ে যায়।

” হাসছেন কেন? আমি কি কোন জোকস শুনিয়েছি নাকি?”
যদিও বা নিহানের হাসি থেমে যাওয়ার পথেই ছিল শুভ্রতার এই কথায় আবার হেসে ফেলে সে। আশ্চর্য এই কথায় কি কেউ হাসে? নিহান কেন হাসছে? অবাক করা বিষয় শুভ্রতার কথায় আজ অযৌক্তিকভাবে হাসি পাচ্ছে নিহানের। এভাবে হাসলে কি শুভ্রতা রেগে যাবে? আসলেই রেগে যাবে? খুব বেশি রেগে যাবে কি? নাহ, কথায় কথায় এভাবে হাসা ঠিক না, আর যার কথায় হাসবে সে যদি কোন আবেদনময়ী নারী হয়, চোখে যার প্রজ্জ্বলিত শিখা তাহলে তার কথায় হাসা দন্ড**নীয় অপরাধ।

বিকেলে আবিরা ডেকে দেওয়ার সাথে সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিহানের কাছে যায় সে। রুমে পা রেখেই ইন্দ্রিয় বুঝিয়ে দেয় নিহান ঘরে নেই, সে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কারো সাথে আলাপ করছে। সেটা কি প্রেমালাপ? ছি, প্রেমালাপ কেন হতে যাবে? সব আলাপ প্রেমালাপ হয় না, পৃথিবীর সব মধুর আলাপকেও প্রেমালাপের ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না।
শুভ্রতা ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায়। কিছুটা এগিয়ে যেতেই শুনতে পায়, ” জি স্যার আমি খুব তাড়াতাড়ি রওয়ানা দিব ইন শা আল্লাহ। যে ব্যক্তিকে সন্দেহ হয়েছিল তাকে আটকে রাখা হয়েছে খুব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নিব। গতকাল ব্যস্ত থাকায় আমি কিছুই করতে পারি নি। ইন শা আল্লাহ আমি খুব তাড়াতাড়ি কাজে এক্টিভ হব।”

শুভ্রতা কথা বলতে শুনে ব্যালকনির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাতাস বইছে। ঠান্ডা বাতাস। এক মুহুর্তের মধ্যে কি সুন্দর অনুভব হচ্ছে শুভ্রতার! নিহান কথা শেষ করতেই শুভ্রতার উপস্থিতি বুঝতে পেরে পিছনের দিকে তাকায়, শুভ্রতা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের ছোট চুলগুলো উড়ে পিছনের দিকে যাচ্ছে। সংগোপনে পা ফেলে শুভ্রতার দিকে এগিয়ে আসে সে। কোমরে হাত দিতেই শুভ্রতা চমকে ওঠে। সামনে তাকিয়ে দেখে নিহান,স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

” আপনিও না! ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। ছাড়ুন, ডেকেছেন কেন?”
” বউ আদর করতে।”
নিহানের অস্পষ্ট কথা শুভ্রতা এতকাছে থেকেও ঠিক বুঝতে পারে না। তাই পুনরায় সেই কথা শুনতে জিজ্ঞেস করে, ” কি?”
” কিছু না চুপ করে থাকো একটু।”
” কিন্তু ডেকে….”

শুভ্রতার কথা শেষ করতে দেয় না নিহান। ঠোঁটে আঙুল রাখতেই বৈদ্যুতিক শ*ক খাওয়ার মতো এক ঝটকায় চুপচাপ স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে যায় সে। নিহানের নেশা**ক্ত চোখ শুভ্রতার পুরো মুখ একবার পর্যবেক্ষণ করে ঠোঁটের ওপর নজর ফেলে। শুভ্রতার ঠোঁট কাঁপছে। অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। শুভ্রতা মাথানিচু করে নেয়, ভেতরটা খুব হাসফাস করছে তার। নিহানকে এত কাছে দেখে শরীরটা কেমন একটা লাগছে। নিহানের ঠোঁট শুভ্রতার গাল স্পর্শ করল। শুভ্রতা সাথেসাথে চোখ বন্ধ করে নেয়।

দরজায় কেউ নক করতেই শুভ্রতা নিজেকে নিহানের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। নিহান কপালে হাত দিয়ে চোখমুখ খিঁচে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। শুভ্রতা দরজার দিকে গিয়ে দেখে ইরা দাঁড়িয়ে।
” আরে ইরা! আয় ভেতরে আয়, বাহিরে দাঁড়িয়ে কেন?”
” এমনিই আসলাম। তুমি ঘামছো কেন ফ্যান দাও নি?”
” এমনিইইই, ও কিছু না। আয় ভেতরে আয়। ”

” শুভ্রা রেডি হয়ে নাও, বাহিরে যাব। হাতে সময় নেই, আবার ফিরতে হবে তো।”
ইরার উপস্থিতি বুঝতে পেরে ব্যালকনি থেকেই শুভ্রতাকে ডেকে কথাটা বলে নিহান। শুভ্রতা নিহানের দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে বলে, ” বের হবেন, একথা বলেন নি তো?”
” বের হব এটা জানাতেই আবিরাকে পাঠিয়েছিলাম।”
” আচ্ছা আপু তোমরা যাও আমি বরং অন্যসময় আসব।”

শুভ্রতাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ইরা চলে যায়। শুভ্রতাও নিহানের কথামতো রেডি হতে চলে যায়। দশ মিনিটের মাঝে নিহানের রেডি হওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। সে বসে বসে শুভ্রতার জন্য অপেক্ষা করছে। বেচারি শাড়ি পরেছে কিন্তু কুচি ঠিক করতে পারছে না। সব মেয়ের এই অবস্থাই হয়, ঘরে স্বামী থাকলে তারা কুচি ঠিক করতে পারে না। কুচি ঠিক দেবার দায়িত্ব প্রতিটা স্বামীর। নিহানও সেই দায়িত্বটা যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে পালন করে। শাড়ির কুচি ঠিক করে দাঁড়িয়েই নিহানের মনে হলো শুভ্রতাকে একটা চুমু খাওয়া দরকার। দরকার যেহেতু তাই এমন দরকারি কাজে দেরি করতে নেই। চুমুর বিষয়টা মনে হলেই দিয়ে দিতে হয়৷ নিহানও দেরি করল না। শুভ্রতার মুখের দুইপাশে হাত দিয়ে ধরে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।

” কি হলো?”
শুভ্রতার প্রশ্নের উত্তরে বেশ স্বাভাবিকভাবে নিহান জবাব দেয়, ” চুমু খাওয়া হলো।”
” এত চুমু খাওয়া আসে কোত্থেকে আপনার? এভাবে অপ্রস্তুত করে দিবেন না একদম।”
” কোথায় এত চুমু দেখলি? এটা তো কিছু না। বউকে তো সারাদিন চুমুর ওপর রাখতে হয় নইলে বউ বুঝবে কী করে যে তার বর অত্যাধিক রোমান্টিক?”

শুভ্রতা আর কথা বাড়ায় না। কারণ সে বুঝে গেছে এখন নিহানের কথার বিপরীতে কথা বললে নিহান আবার কিছু বলবে, তারপর সে কিছু বলবে এভাবে কথা বাড়তেই থাকবে। তার চেয়ে ভালো কথার সমাপ্তি এখানেই ঘটুক।
শুভ্রতাকে চুপ থাকতে দেখে নিহান শুভ্রতার কপালে আরেকটা চুমু খেয়ে বাহিরের দিকে চলে যেতে যেতে বলে, ” আমি নিচে অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি চলে আয় জান।”

” মুখ খুলুন।”
নিহান খাবার নাড়াচাড়া করছিল। শুভ্রতা চামচে খাবার নিয়ে নিহানের মুখের সামনে ধরে। নিহান মুচকি হেসে খাবারটা খেয়ে নেয়। নিজের খাবারের প্লেটে চামচ রেখে নড়ে চড়ে বসে সে। খাবার চিবিয়ে নিয়ে বলে, ” আমি এখন নিজে হাতে খাব না। তুই খাইয়ে দিবি।”
” লোভ হয়ে গেল তাই না? আচ্ছা দিচ্ছি।”

শুভ্রতা নিজেও খাচ্ছে আর একমনে নিহানকেও খাইয়ে দিচ্ছে। নিহানের পিছনের টেবিলেই ইমতিয়াজ বসে আসে। নিহানের বিপরীতে থাকায় নিহান তাকে দেখতে পারছে না। শুভ্রতার চোখ মাঝেমাঝে সেদিকে যাচ্ছে। দুই একবার চোখে চোখ পড়তেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছে শুভ্রতা। যে মানুষটা সবকিছু ছেড়েছুড়ে তার কাছে ছিল তাকে কতগুলো মাস শান্তিতে ঘুমোতে দেয় নি, কান্না ছাড়া যার দিন কাটেনি, কথার আঘা**তে ক্ষ*তবিক্ষ*ত করতে ছাড়ে নি তার ওপর এখন এত নজর রাখা কেন? কি চাইছে ইমতিয়াজ? তার নতুন সংসারে কোন ঝামেলা বাধাবে না তো! ভয় লাগছে শুভ্রতার। নিহানকে কি সবকিছু জানিয়ে দেয়া উচিৎ? কী জানাবে সে? প্রাক্তন স্বামী তাকে অনুসরণ করছে?

নিহানকে খুশি খুশি মুখে খাইয়ে দেওয়া দেখে ইমতিয়াজ তার হাতের কাটাচামচটা দিয়ে টেবিলে শক্ত করে বসিয়ে ঘুরিয়ে যাচ্ছে। কিচ্ছুক্ষণ এভাবে ঘুরালে টেবিলে দাগ বসে যেতে পারে।
খেতে খেতে নিহান শুভ্রতার হাত ধরতেই ইমতিয়াজ উঠে দাঁড়ায়, শুভ্রতা ভয়ে কেঁপে ওঠে। ইমতিয়াজ তাদের দিকে রাগা*ন্বিত চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের দিকে পা বাড়ায়, শুভ্রতা মাথা নিচু করে নেয়। সে নিহানকে বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। ইমতিয়াজ কি বড় কোন ঝামেলা বাধাবে? শুভ্রতার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে। তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ।

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪০

শুভ্রতা আবার নিহানের পিছনের দিকে তাকাতেই দেখে ইমতিয়াজ সেখানে নেই। শুভ্রতার চোখ এদিক ওদিক ঘুরছে। নাহ, ভেতরে আর দেখা যাচ্ছে না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গেল ইমতিয়াজ!

শুভ্ররাঙা ভালোবাসা পর্ব ৪২