মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৯

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৯
সাদিয়া জাহান উম্মি

মির্জা বাড়িতে সকালের নাস্তা করতে বসেছে একত্রে সবাই।আতিক মাহাবুব বার বার তাকাচ্ছেন গম্ভীর মুখে বসে নাস্তা করতে থাকা রুদ্রিকের দিকে।বেশ অনেকক্ষন যাবত চেষ্টা করছেন রুদ্রিকের সাথে কথা বলার জন্যে কিন্তু পারছেন নাহ।
‘ দাদু?আপনাকে আর একটা রুটি দেব?’

রোজার কথায় নড়েচড়ে বসেন আতিক মাহাবুব।রোজার প্রশ্নের উত্তর দিলেন,
‘ নাহ, লাগবে না।আর তাছাড়া তুমি বোসে নাস্তা করতে পারো নাহ?যার যেটা লাগবে সে সেটা নিয়েই খেতে পারবে। ‘
রোজা হেসে বোসে পরল।আতিক মাহাবুব এইবার রুদ্রিকের দিকে তাকিয়ে গলা খাকারি দিয়ে বলেন,
‘ রুদ্রিক? তোর সাথে কথা আছে।’
রুদ্রিকের গম্ভীর স্বরের জবাব,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ বলো।আমি শুনছি।’
‘ ইম্পোর্ট্যান্ট কথা।’
রুদ্রিক এইবার সোজাসুজিভাবে তাকালো আতিক মাহাবুবের দিক।বলল,
‘ বলো।’
আতিক মাহাবুব জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলেন,
‘ তুমি বলেছিলে তুমি ফ্রি হলে আমার সাথে যাবে মেয়ে দেখতে।সেই কথা কি ভুলে গিয়েছ?’
রুদ্রিক শান্ত কণ্ঠে বলে,

‘ না,ভুলেনি।’
‘ তাহলে তুমি কবে যাবে?কতোদিন তো হয়ে গেল।’
‘ আমি তো বললাম আমি ফ্রি হলে জানাবো।’
‘ কি এমন কাজ আছে তোমার?যে একেবারে ফ্রি হওয়ার সময়টুকু তুমি পাচ্ছো নাহ।’
রুদ্রিক ত্যারা জবাব দিল,

‘ তাহলে তুমি এমন আমার পিছনে হাত ধুয়ে পরেছ কেন?আমার এখনো স্টাডি কম্পলিট হয়নি।’
আতিক মাহাবুব ভ্রু-কুচকালেন নাতির কথায়।বললেন,
‘ সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।তুমি শুধু আমাকে একটা নাতবউ এনে দেও।তারপর তোমাকে আর লাগবে না।আমার নাতবউকে আমি আমার কাছেই রাখবে।’
রুদ্রিক জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে কপাল কুচকে বলল,

‘ বিয়ে যেহেতু আমাকে তুমি করাবেই।তাহলে আমার বিয়ে করা বউকে আমি তোমার কাছে কেন রাখতে যাবো?আর এতোই যেহেতু শখ। তাহলে নিজেই তো বিয়ে করে নিতে পারো।’
রোজা ফিক করে হেসে দিল।আরিয়ানও হাসছে।আর আরহাম সাহেব মুখ লুকিয়ে হাসছেন।তার বাবাকে শুধুমাত্র রুদ্রিকই পারে বশে আনতে।আতিক মাহাবুব রেগে বলেন,

‘ চরম অসভ্য হয়েছিস তুই।’
‘ সেটা আমি জানি।নতুন কিছু বলো।’
আতিক মাহাবুব না পেরে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করলেন রুদ্রিককে।
‘ আমার সাথে এইভাবে কথা বলছিস।আজ তোর মা আর দাদি থাকলে তাদের তো ফিরিয়ে দিতি নাহ।আর আমি বুড়ো হয়ে গিয়েছি দেখে তোর কাছে আমার কথার কোনো দাম নেই।’

রুদ্রিক জানে এটা তার দাদু তাকে ব্লাকমেইল করার জন্যে অভিনয় করছেন।রুদ্রিকের খাওয়া শেষ।ও টেবিল থেকে উঠে যেতে যেতে বলে,
‘ ওকে ফাইন কাল যাবো আমি।হ্যাপি?’
আতিক মাহাবুবের ঠোঁটের কোণে চওড়া হাসি ফুটে উঠল।উনিও খাবার শেষ করে নিজের রুমে চলে গেলেন।রুমে গিয়ে নিজের পিএ সিয়ামকে ফোন দিলেন।ফোন রিসিভ করতেই সিয়াম সালাম দিলো।আতিক মাহাবুব সালামের উত্তর দিয়ে বলেন,

‘ সিয়াম?ওদিকের কি খবর?আমার নাতবউ আর রুদ্রিক কতোদূর এগিয়েছে।দু দিনের খবর তো আমায় দিলে নাহ।’
সিয়াম দাঁত দিয়ে নখ কাটতে লাগল।দুদিনের খবর সে ইচ্ছে করেই দেয়নি।কিভাবে বলবে ও এই কথা যে তার নাতবউ প্রথম কথাতেই সোজা রুদ্রিকের কলার ধরার সাহস করেছে।যদি ওকে টু’স করে গুলি করে উড়িয়ে দেয়?যদি বলে আমার নাতির কলার ধরল আর তুমি চুপচাপ দেখছিলে গর্দ’ভ।সিয়ামের কোনো সারাশব্দ না পেয়ে আতিক মাহাবুব বলে উঠলেন,

‘ কথা বলছ না কেন?’
‘ আসলে স্যার..’
‘ আসলে নকলে বাদ দেও।সোজা কথা বলো।’
সিয়াম লম্বা শ্বাস ফেলল।উপায় না পেয়ে সবটা বলল আতিক মাহাবুবকে।

‘ স্যার রুদ্রিক বাবাকে একটা মেয়ে প্রপোজ করেছিল। এইজন্যে রুদ্রিক বাবা রেগে গিয়ে ওই মেয়েকে একটু ভয় দেখিয়েছিল।যাতে পরবর্তীতে এমন কাজ করার সাহস ওই মেয়ে না পায়।মেয়েটা ওর বান্ধবীদের কাছে গিয়ে কাঁদতেছিল।আর অথৈ মামনি সেটা দেখে ফেলে।আর জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে।ওই মেয়ের বান্ধবীরা আসল ঘটনা না বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব দোষ রুদ্রিক বাবার দিয়ে দেয়।

ব্যস অথৈ মামনি রেগে একদম রণ’চন্ডী হয়ে যায়।মামনির বন্ধুরাও তাকে থামাতে পারছিল না।সোজা গিয়ে রুদ্রিক বাবার কাছে যান।রুদ্রিক বাবাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করে তার উত্তর দিতেই সে সোজা রুদ্রিক বাবার কলার টেনে ধরে।অথৈ মামনিকে থামাতে না পেরে ইহান তাকে জোড়ে থাপ্পড় মারে।তারপর আসল ঘটনা বুঝিয়ে বলে।সব বলায় অথৈ মামনি নিজের দোষ বুঝতে পারে হয়তো।তাই এর পরের দিন রুদ্রিক বাবার কাছে মাফ চাইতে চলে যায়।

রুদ্রিক বাবা তাকে এক শর্তে ক্ষমা করবেন বলেছে তা হলো আগামী এক সপ্তাহ রুদ্রিক বাবা যা বলবেন অথৈ মামনীর তাই করতে হবে।আর অথৈ মামনি রাজিও হয়ে যান।কারন উনা বিনা দোষে রুদ্রিক বাবার সাথে মিসবিহেইব করেছে তাই।’
সিয়াম গরগর সব কথা বলে দেন আতিক মাহাবুবকে।সিয়াম ভাবল এই বুঝি জোড়সে একটা রামধমক খাবে।আর হলোও তাই।তবে যে কারনে ভয় পাচ্ছিল সে কারনে নাহ।তার ঠিক উল্টোটা হলো।

‘ হতচ্ছা’রা তুমি সেটা আজ আমায় বলছ।এতো ইন্ট্রেস্টিং একটা ঘটনা।’
‘ এ্যাঁ?’
‘ এ্যাঁ না হ্যা।’
তারপর খুশিতে গদগদ হয়ে বলেন,
‘ আগামী এক সপ্তাহ রুদ্রিক আর অথৈ একসাথে থাকবে।সিয়াম সকল ব্যবস্থা করো। যে করেই হোক এই এক সপ্তাহে ওদের কাছাকাছি আসতেই হবে।আর খেয়াল রাখবে তাদের একান্ত সময়ে যাতে অন্য কেউ ঢুকে ওদের ডিস্টার্ব করতে না পারে।’

সিয়াম অবাক হয়েই বলে,
‘ ওকে স্যার।আমি খেয়াল রাখব।’
আতিক মাহাবুব ফোন কেটে দিলেন।সিয়াম অবাকের রেশ ধরেই বলল,
‘স্যারের মাথা নিশ্চ’য়ই খারাপ হয়ে গিয়েছে।’

রিধি তারাহুরো করে ভার্সিটিতে ঢুকছিল।খেয়াল করেনি যে সামনে ইহান আসছে।ও যেতে নিতেই ইহানের সাথে জোড়েসোড়ে একটা ধাক্কা খায়।ইহানের শক্তপোক বুকের সাথে রিধির মুখটা গিয়ে জোড়ে বারি খায়।ফলে ও নাকে অনেকটা ব্যথা পায়।রিধি ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে,
‘ উহুহু! উফ নাকটা বুঝি আমার শেষ।ও আল্লাহ্। ‘

ইহান নিজেও বুকে ব্যথা পেয়েছে।তবে রিধির ব্যথাতুর কণ্ঠ শুনে ওর দিকে তাকাল।রিধি দুহাতে ওর নাক চেপে ধরে রেখেছে দেখে ইহান আলতো স্পর্শ করে রিধির হাতটা সরিয়ে দিল।দেখতে লাগল রিধি কোনো গুরুতর আঘাত পেয়েছে না কি।এদিকে রিধি ইহানের স্পর্শে পুরো বরফের মতো জমে গিয়েছে।ওর হৃৎপিন্ডটা অসম্ভবভাবে জোড়ে জোড়ে বিট করছে।ইহানের হাতের একেকটা স্পর্শ ওর বুকের ভীতর তীব্রভাবে তোলপাড় সৃষ্টি করছে।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে ওর।ইহান দেখল রিধির নাকটা লাল হয়ে গিয়েছে।তাই ইহান বলল,

‘ বেশি ব্যথা লেগেছে?’
রিধি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে ইহানের দিকে।সেইভাবেই বলল,
‘ হ্যা অনেক ব্যথা।’
ইহানের ভ্রু-কুচকে আসে।কপালে চিন্তার রেখা পরে।বলল,
‘ কোথায় ব্যথা করছে?বলো আমাকে।ডক্টরের কাছে যাবে?’
‘ বুকে ব্যথা করে।খুব ব্যথা করে।এই ব্যথা কোনো ডাক্তার ভালো করতে পারবে না।’
ইহান অবাক হয়ে বলে,

‘ আরে কি বলছ এসব?কি এমন হয়েছে?যে ব্যথা ডাক্তার সারাতে পারবে নাহ।’
এতোক্ষনে হুশ আসে রিধির।ও এতোক্ষন কি বলছিল নিজের অজান্তে।রিধি সজ্ঞানে আসতেই নিজের কর্মকান্ডে মন চাচ্ছে লজ্জায় ম’রে যেতে। লজ্জা শরম ত্যাগ করে কি বলে যাচ্ছিলো ও এগুলো।লজ্জায় রিধি হাশফাশ করে বলে,

‘ কোন ব্যথা? কিসের ব্যথা?আমার কোনো ব্যথা নেই।আসছি আমি হ্যা?অথৈ অপেক্ষা করছে।’
কোনোরকম উল্টাপাল্টা বলে রিধি একদৌড়ে চলে গেল।ইহান ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বিরবির করল,
‘ কি হলো মেয়েটার?কিসব উল্টাপাল্টা বলে গেল?বেশি কি ব্যথা পেয়েছে?’
ইহানের চেহারায় চিন্তার ছাপ পরে রইল।

রিধি অথৈদের কাছে এসে হাটুতে ভর দিয়ে হাপাতে লাগল।ওকে এমনভাবে দৌড়ে আসতে দেখে প্রিয়ান বলল,
‘ কিরে?তোরে কি কুত্তায় দৌড়ানি দিছে নাকি?এমনে দৌড়াইয়া কইত্তে আইলি?’
পিহু নাক মুখ কুচকে বলে,
‘ এইগুলো কি ধরনের কথা?তোর ভাষা শুনে আমার গা গুলাচ্ছে।’
প্রিয়ান রাগি গলায় বলল,

‘ তো?তোরে কেউ কইছে আমার কথা শুনতে?তুই কানে তুলা দিয়া থাক।’
আহিদ বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
‘ তোরা কি একটা দিন শান্তিতে থাকতে পারিস নাহ?’
পিহু আর প্রিয়ান একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি মেরে উল্টোদিকে তাকিয়ে থাকে।
অথৈ রিধিকে পানির বোতল দেয়।রিধি সেটা পান করে নিতেই অথৈ বলল,

‘ এখন বল।এমন হুরমুর করে কোথা থেকে আসলি?’
‘ আর বলিস না।আজ তো আমি শেষ হয়ে গিয়েছিলাম।তোর ভাই আমাকে কাঁচা চি’বিয়ে খেতো।’
আহিদ ভ্রু-কুচকে বলল,
‘ সোজাভাবে বলতে পারিস নাহ একটা কথা?’
প্রিয়ান চুলে ব্যাক ব্রাশ করতে করতে বলে,

‘ আরে ভাই এই মেয়েদের স্বভাবই এমন।কথারে শুধু ত্যানা প্যাঁচাতে থাকে।’
পিহু কটমট করে তাকায় প্রিয়ানের দিকে।তা দেখে প্রিয়ান ধমকে উঠে,
‘ ওই একদম এমনে তাকাবি নাহ।তোরে কি আমি কিছু বলছি?’
‘ তোর একটা কথাও আমার সহ্য হয় না।’
‘ আর আমার তোরে সহ্য হয় না।’

‘ তো আমি মনে হয় তোর কোলে গিয়ে বসে থাকি?’
‘ চুউউউউউপ।’ অথৈ চিৎকার করে উঠল।পিহু আর প্রিয়ান থেমে যায়।
অথৈ দাঁত কিরমির করে আহিদকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ আহিদ এই দুটোকে চুপ থাকতে বল।এমনিতেই আমি চিন্তায় বাঁচি না।আর এই দুটোর জ্বালা আরোও একশো ডিগ্রি চিন্তা বারিয়ে দেয়।আমি কিন্তু সত্যি এদের খু’ন করে ফেলব।’

পিহু প্রিয়ান ঠোঁটে আঙুল চেপে একসাথে বলে,
‘ আর একবারও ঝগড়া করব না।সত্যি এইযে চুপ করলাম।’
পিহু রেগে প্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ এই তুই আমার কথা নকল করলি ক্যান?’
প্রিয়ানও একই সুরে বলে,

‘ তুই করেছিস নকল আমি নাহ।’
আবার শুরু হয়ে যায় এদের টম এন্ড জেরির ঝগড়া।অথৈ আর রিধি কপাল চাপড়াতে লাগল।আহিদ হাসতে হাসতে বলে,
‘ এরা কোনোদিন সুধরাবে না।শুধু ওদের উপর চিল্লিয়ে এনার্জি লস করিস তোরা।’
রিধি রেগেমেগে বলে,

‘ তোরা থামবি?আমাকে বলতি দিবি কিছু?’
পিহু আর প্রিয়ান সাময়িকের জন্যে থেমে যায়।কারন রিধি রেগে গিয়েছে।আর রিধি রাগ মানেই পিঠের উপর ধামধুম ঘুষি খাওয়া।আর তারা সেটা খেতে চায় না।পিহু আর প্রিয়ানকে থামতে দেখে অথৈ,রিধি আর আহিদ সস্তির নিশ্বাস ফেলল।তারপর রিধি একটু আগের ঘটনা সবটা বলল ওদের।

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৮

রিধি এমন পাগলামো কথা শুনে ওর হাসতে হাসতে শেষ।আর রিধি মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।কিন্তু এতো হাস্যার মাঝে অথৈর চিন্তার শেষ নেই।আজ থেকে রুদ্রিক ওকে যা বলবে ওর তাই করতে হবে।না জানি লোকটা ওকে দিয়ে কি কি করায়।ভেবেই গলা শুকিয়ে আসছে ওর।

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ১০