মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৪

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৪
ফাবিয়াহ্ মমো

বলিষ্ঠ হাতদুটো শক্ত করে জড়িয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে ঘন-ঘন নিশ্বাসগুলো স্পষ্ট অনুভব করছে। একটু নড়তে চাইলো মেহনূর, কিন্তু হাতদুটোর জন্য পারলো না। নিদ্রালু মুখটা দেখে খুব মায়া লাগলো। এই মায়ার কোনো ব্যাখ্যা নেই। দেখলেই মনেহয় একটু ছুঁয়ে দেই। একটু বিশেষ ভাবে আদর করি। একটু কাছে টেনে তাকে উষ্ণতার চাদরে ঢেকে দেই।

ওই মুখটায় যেন বিশেষ কিছু আছে। একবার তাকালে চোখদুটো চুম্বকের মতো আঁটকে যায়, বুকের ভেতরটা শীতল হয়; নরম অনুভূতিতে প্রাণটা শিরশির করে। মানুষটা আজও বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। কি শান্তি, কি নির্ভার, কি দুঃখহীন নিশ্চিন্তের ঘুম! ঘুমন্ত চেহারায় ছেয়ে আছে পবিত্রতার লালিমা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সে যে পাষাণ নয়, সে যে মুক্ত পাখির মতো নিষ্পাপ। চুলের ফাঁকে-ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে মাথাটা বুলিয়ে দিলো মেহনূর। সমস্ত শরীর যেন উদ্বেলিত হলো ওর। ঠোঁটদুটোর পানে দৃষ্টি দিয়ে মনটা কেমন চনমন করে উঠলো। বালিশ থেকে মাথাটা কিন্ঞ্চিত তুলে ঠোঁটে টুপ করে চুমু খেলো।

ঠোঁটে উষ্ণ পরশ পেয়ে তন্দ্রার ঘোরটা সামান্য পাতলা হলো মাহতিমের, নিভু-নিভু চোখে মেহনূরের দিকে তাকালো। প্রচণ্ড ঘুমের হাতছানিতে নেত্রপল্লব বুজে আসছে, তবুও মাথা উঠিয়ে ঘুমঘুম কন্ঠে বললো, ‘ তুমি আবারও ঘুমের মধ্যে চুমু — ‘। শব্দটা আর বলতে পারেনি সে। সেই মূহুর্ত্তেই মেহনূর ঠোঁটের উপর আঙ্গুল চাপা দেয়।

চট করে দুহাতে মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে। মেহনূর চোখ বন্ধ করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘ আমি বুঝতে পারিনি গো। আর করবো না। আমি ভুলে গেছিলাম। এবারের মতো ক্ষমা চাই ‘। ঘুমের মধ্যে আদর পাওয়াটা মাহতিমের ঘোরতর অপছন্দ। সে বলেই দিয়েছে, কখনো আদর দিলে জ্ঞানে-সজ্ঞানে দিও। বিছানার চারিদিকে ফিনফিনে পর্দা দেওয়া।

জানালার গরাদ দিয়ে পাতলা হাওয়া ঢুকছে। বাইরে এখন বৃষ্টি নেই। ছাদ ধুয়ে পানি পরার শব্দটা ঝর্ণার মতো হচ্ছে। প্রকৃতির মায়ায় কোথায় যেন বিষণ্ণ কন্ঠে কোকিল ডেকে উঠলো। সেই সুরে তাল মেলালো কান্নারত কুকুর। চমকে তাকালো মেহনূর! এমন লাগছে কেন? কেমন যেন অস্থির-অস্থির ভাব!

এ সময় কোকিল ডাকে?সাঁঝের বেলায় কুকুর কাঁদে? নাতো, কিছুই ঠিক লাগছে না। প্রচণ্ড অদ্ভুত লাগছে। এ কেমন অনুভূতি? ইচ্ছে করছে মাহতিমকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু এমন অনুভূতি হবার কারণ কি? মস্তিষ্কটা এমন উদ্ভট-উদ্ভট ভাবছে কেন? কেন তাকে চিন্তার প্রতিযোগিতায় ছেড়ে দিচ্ছে? এটা কি আগাম কিছুর ভয়, নাকি সাধারণ কোনো চিন্তা?

– হার্টবিট ফার্স্ট। পালস রেট ওয়ান ফোর্টি। নিশ্বাস স্বাভাবিক না।
মেহনূর চরমভাবে হতবাক! হকচকিয়ে ঘুমন্ত মুখের দিকে বিষ্ময় দৃষ্টিতে তাকালো। ঘুমুঘুমু কন্ঠে কথাগুলো উচ্চারণ করেছে মাহতিম। কি সাংঘাতিক কারবার! এখনো তার চোখের পাতা তন্দ্রার ঘোরে বন্ধ, অথচ ঠাস-ঠাস করে উর্বরমস্তিষ্কে কিসব কথা বললো! মেহনূর নিজের ব্যতিব্যস্ত অবস্থাকে শান্ত করে উজবুক সুরে বললো,

– আপনি ঘুমাননি?
মাহতিম ঘুমন্তাবস্থার ভেতর ক্ষুদ্র কন্ঠে বললো,
– ভেঙেছে।

মেহনূর ভীতুর মতো সিলিংয়ের দিকে তাকালো। একটা ঘুমন্ত ব্যক্তি কিনা হার্টবিট গুণে-গুণে সবটা আঁচ করেছে। এমন উদ্ভট কৌশল দেখে মেহনূর কিংকর্তব্যবিমূঢ়। গোয়েন্দার মতো আশ্চর্যজনক ব্যবহার দেখে মেহনূর চোরের ভঙ্গিতে ঢোক গিললো। এই লোকের কাছে যতবার কিছু লুকোতে চেষ্টা করেছে, ততবারই বাজেভাবে ধরা খেয়েছে। তাই বলে এবারও? এবারও যে এরকম কিছুর মুখোমুখি হবে, তা যে চিন্তাই করা যায়নি। মেহনূর সরল চোখে প্রশ্নাত্মক কন্ঠে শুধালো,

– আপনার কি গোয়েন্দার শিক্ষাও গুলে খাওয়া শেষ? সুস্থ মানুষের মতো ঘুমাতে দেখলাম, আর এখন কিনা তাগড়া ব্যক্তির মতো জেরা করছেন?
মাহতিম সেই প্রসঙ্গে গেলোই না। নিজের অনুমান করা থিসিসের উপর স্থির থেকে বললো,

– তোমার কোন্ জায়গাটায় ঘুমাচ্ছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারার কথা। যেখানে কান রেখে শুয়ে আছি, সেখানে স্টেথোস্কোপ ছাড়াই হার্টবিট বলতে পারবো। তোমার বুকের একেকটা হিংস্র ধুকপুকনি আমার শরীরে তাল ঠুকছে মেহনূর। এখানে একটু আদর দিলে কি তোমার ছোট্ট হার্টটা শান্ত হবে?

এমন কথা শুনে মেহনূর চাপা উত্তেজনায় কুণ্ঠিত হলো, মুখে কিছুই বললো না। কম্বলটা টেনে মাহতিমের মাথাটা ঢেকে দিলো। বাইরে থেকে কনকনে শীতের মতো হাওয়া আসছে। সেটা ফ্যানের বাতাসে একীভূত হয়ে হিম অবস্থা ছড়িয়ে দিলো। মেহনূর আরো শক্ত ভাবে, আরো আড়ষ্ট হয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। কন্ঠস্বর নরম করে বললো,

– কিছুই করতে হবে না। আজ তো আমার কাছে আছেন, কাল যখন ঢাকা যাবেন তখন কিভাবে থাকবো? প্রতিদিন আপনার জন্য ভোর পাঁচটায় উঠাটা অভ্যেস হয়ে গেছে। আপনার জিনিসগুলো হাতের কাছে রাখা, আপনার জন্য চটপট নাস্তা বানানো, দরজায় দাঁড়িয়ে আপনাকে বিদায় দেওয়া, এসব যে আমার রুটিন হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় ফিরে আপনার ঘামার্ক্ত শার্টটা খুলে নেওয়াটা আমার এমন কর্তব্য হয়ে গেছে যে, একদিন যদি এটা থেকে বন্ঞ্চিত হই, মনেহয় ‘ কি যেন করিনি, কি যেন করিনি ‘।

মাহতিম নড়েচড়ে উঠতেই মাথা থেকে কম্বলটা সরে গেলো। আবারও মুখ তুলে আধো-আধো নজরে মেহনূরের দিকে তাকালো। একটু হাসি দিয়ে গাঢ় হয়ে বললো,

– তুমি না-থাকলে আমার অবস্থাটা অন্ধকার হতো মেহনূর। যে দুটো বছর দূরে ছিলাম, আমার কি যে কষ্ট হয়েছে। না-ছিলো আমার খাওয়া-দাওয়ার প্রতি নজর, না-ছিলো শরীরের প্রতি মনোযোগ। যেদিন থেকে তুমি এলে, আমার সবকিছু দুহাতে সাজিয়ে-গুছিয়ে দিলে।
মেহনূর শুকনো মুখে হাসলো। ডানহাত বাড়িয়ে মাহতিমের গালে-কপালে হাত বুলিয়ে দিলো। দ্বিধাহীন চোখে সরল ভঙ্গিতে বললো,

– আমার সবটুকু ঐশ্বর্য যেদিন আপনার দরবারে তুলে দিলাম, সেদিনই আপনার সত্তাটা নিজের করে নিয়েছি। আজ কাজের উছিলায় দূরে যাচ্ছেন, দয়াকরে আমার সুস্থ মানুষটাকে ফিরিয়ে দিবেন। আমি আর কিছুই চাইবো না, আর কোনোকিছুর জন্য অনুরোধ করবো না। ভেবে নিন, আপনার কাছে এটাই আমার জীবনের সর্বশেষ আবদার। আমার আবদারের ঝুলি আজীবনের জন্য তুলে নিলাম। আর কোনোদিন এই মুখে কিছু চাইবো না।

মেহনূর চোখ সরিয়ে ডানদিকের জানালায় তাকালো। এইটুকু কথা বলতে-বলতে কেন চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ছুটলো, সে কিছুই জানে না। শুধু অনুভব করলো তার বুকের ভেতর এই সামান্য কথাটা গভীরভাবে দাগ কেটেছে। বারে-বারে মুখ দিয়ে এমন কথা বেরুচ্ছে যেটা অশনি দিকের সূত্র। সন্ধ্যার আধো-আধো অন্ধকারে রুমটা আলোহীন। শান্ত আকাশটার দিকে তাকিয়ে বালিশটা নিরবে-নিরবে ভিজে যাচ্ছে। হঠাৎ মৌনভাবে গলা ও ঘাড়ের মাঝে মুখ নামালো মাহতিম। ঠোঁটটা ওর কানের কাছে রেখে শ্রাব্য-সীমায় বললো,

– তুমি আমার কাছে চাইবে, আমি দেবো। এভাবে আবদারের ঝুলি তুলে নিলে তো কষ্ট পাবো। মনে করবো, তোমার আবদার শোনার জন্য বোধহয় আর বাঁচবোই না।

মেহনূর দু’চোখ খিঁচে ফুপিয়ে উঠলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁটটা এমন ভাবে কামড়ে ধরলো, দাগ বসে যাচ্ছে নিচের ঠোঁটে। নাকটা দমকে-দমকে ফুলে উঠছে তখন। চোখের পাপড়ি ভিজে স্রোতের মতো দু’প্রান্ত দিয়ে ঝরছে। গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না, তবুও আঁটকে-আঁটকে বহু চেষ্টায় বললো,

– আমি আবারও বলছি, আপনি নোমানকে নিয়ে যান। যদি তাও সম্ভব না-হয়, আমার কোনো সিকিউরিটি গার্ড লাগবে না, আপনি তাদের নিয়ে যান; তাও যদি ব্যর্থ হয়, আপনি পরিচিত কাউকে সঙ্গে রাখুন। আপনার শত্রুর চেয়ে আমি আপনাকেই বেশি ভয় পাই। আপনি কারোর কথা শুনেন না।

এইযে আমি গাধার মতো চেঁচিয়ে যাচ্ছি, আপনি তবুও —
মাহতিম ঠোঁটে ‘ শ ‘ জাতীয় শব্দ করে থামিয়ে দিলো। আস্তে করে ওর পিঠের নিচে ডান হাত, মাথার নিচে বাঁ-হাতটা গলিয়ে দিলো। বিছানা ও বালিশ থেকে সন্তপর্ণে নিজের দুহাতের মধ্যে রুদ্ধ করলো। ভেজা গালটায় নিজের সুক্ষ্ম সূঁচালো গাল চেপে বললো,

– কেঁদো না, চুপ কর। যদি তোমার মনেহয় আমার সঙ্গে কেউ থাকলে তুমি নিশ্চিন্তে থাকবে, তাহলে আমি মানুষ নিচ্ছি। টেনশন কোরো না। আমার জুনিয়র কাউকে বলে দিচ্ছি, ও এসে যাবে। তুমি ঠান্ডা হও লক্ষ্মী। আমিতো বেশি দিনের জন্য যাচ্ছি না। এইতো তিনদিন, তারপর ঠিক এসে পরবো।

‘ মালিবাগ ‘, ঢাকার ব্যস্ততম জায়গা। অসংখ্য মানুষের কিলবিল উপস্থিতি। অগণ্য গাড়িতে ঘিন্ঞ্জি এক এলাকা। সেখানে নিশ্বাস নিলে দম যেন আঁটকে আসে, ঠিক এতোটাই বিষাক্ত বাতাস। ধূলোয়-ধূলোয় পথঘাট অন্ধকার। মানুষের হৈচৈয়ে সদাসর্বদা সরব। এমনই একটি জায়গায় দিনক্ষণ স্থির করেছে।

সেখানে দেখা করবে দুই প্রান্তের দুই মানুষ। আজ কেউই জানে না, সামনে কি অপেক্ষা করছে। কারোর জ্ঞাতব্যে নেই, কি ধরনের উ/গ্র পরিকল্পনার শি/কার হবে। নৃ;শং/সভাবে কিছু করার জন্য ওত পেতেছে একদল। ক:লু-ষিত চিন্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে তারা। কখন শি!কারের জালে পা ফেলবে জলজ্যান্ত শিকার।

এতোটাই নি/ষ্ঠুর পরিচয় দেবে যে, মানুষের কলিজা শুদ্ধ কেঁপে উঠবে। দেহের প্রতিটি অঙ্গ এমনই ভাবে ক্ষ/তবী/ক্ষ;ত করবে যে, নূন্যতম চেনার অবশিষ্টটুকু রাখবে না। খবরের পাতায়-পাতায় উঠবে লোমহর্ষক শিরোনাম। এই ক্রু/রতা মানুষের সুস্থ চিন্তাকে দুলিয়ে দিবে। ভয় ধরাবে মনে-মনে। তাদের ভাবতে বাধ্য করবে, হিং/স্র পশুর চেয়ে হিং/স্র মানুষ বিপ-দজ্জ/নক।

ভোরের আলো ফুটে দিক-দিগন্তে ছড়ালো। জেগে উঠলো মফস্বলবাসী। সর্বপ্রথম জাগ্রত হলো পাখ-পাখালি। চক্ষু কপাট মেললো মেহনূর আফরিন। পুরো রুমটায় আলোয়-আলোয় ঝিকিমিকি করছে। সূর্যের তেজালো রশ্মি দেয়ালে-দেয়ালে ছেয়ে আছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এখনো পর্দা ঘেরা শয্যায় শুয়ে আছে মেহনূর। আলস্যপরায়ণ দেহটা যেন আরেকটু ঘুম চাচ্ছে।

দুটো মিনিটের জন্য চোখজোড়া বন্ধ করলো। সুন্দর মূহুর্তগুলো স্বচ্ছ হাসিতে রোমন্থন হচ্ছে। বৃষ্টিস্নাত কাণ্ডটার কথা চিন্তা করলেই কান গরম হয়ে যায়। অথচ, কাল একটুও লজ্জা করেনি। মনে হয়েছে, আরেকটু যদি স্নেহাদর দেওয়ার সৌভাগ্য থাকতো, সবটুকুই বিলিয়ে দিতো মেহনূর। পুরো একটা বিকেল, পুরো একটা রাত, দুটো প্রাণ মিলেমিশে এক ছিলো। যাকে এতোদিন হাসিখুশিরূপে সচ্ছল ভঙ্গিতে দেখেছে, তার এই প্রণয়ী আচরণ ছিলো রোমান্ঞ্চকর।

মেহনূর চোখ খুলে ডানপাশে তাকালো, দেখলো সে নেই। আজ বিচলিত হলো না; বরন্ঞ্চ,এই সময় মুখোমুখি হবার লজ্জায় প্রাণপণে লুকাতে চাইলো। বিছানা থেকে নেমে শাড়ি হাতে বাথরুমে গেলো। শাড়িটা পরে গামছায় চুল ঝারতে-ঝারতে বেরিয়ে এলো মেহনূর; কিন্তু একি! এখনো রুম খালি? হঠাৎ কি যেন ভাবনায় চুল ঝারার হাতটা থেমে গেলো। কপালে ঈষৎ কিছু ভাঁজ ফেলে ওভাবেই দৌঁড় লাগালো!

গামছাটা ফ্লোরে ফেলে চটজলদি বিছানার বালিশ উঠালো, আলমারির দ্বার খুললো, খাটের তলায় নজর দিলো। ট্রাভেল ব্যাগটা নেই!ণ থমথমে দৃষ্টিতে চোয়াল ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো মেহনূর। হতভম্বের মতো ড্রেসিং টেবিলের সামনে গেলো সে। আয়নায় দেখা যাচ্ছে, স্বচ্ছ গ্লাসটার নিচে কাগজ চাপা। মেহনূর চোয়াল ঝুলানো অবস্থায় কাগজটা হাতে নিলো। ওখানে পরিচিত অক্ষরে লেখা,

‘ মন খারাপ কোরো না। কল এসেছে, চলে যেতে হলো। সারারাত তো অত্যাচার করলাম, তাই ঘুম ভাঙ্গালাম না। থাকো তাহলে, আসি।
আনসারী . ‘
কাগজটা রেখে দিলো মেহনূর। উনি চলে গেছেন। মুখ ভার করে নিচে নামলো সে, দেখতে পেলো বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে। তিনি এসে নাস্তার জন্য ডাকলে মেহনূর গেলো না। সোজাসুজি প্রথম বাক্যে বললো,

– উনি কখন বেরিয়েছেন?
বৃদ্ধা অকপটে বললো,
– মেলা দেরি হয় নাই, ইট্টু আগে বাইর হইছে। বেশি হইলে আধা ঘন্টা হইবো।
ইশ! আধঘন্টা? কেন এমন হলো? মেহনূর হাপিত্যেশের সুরে বললো,
– আমি খাবো না, আমি বাসায় যাবো।

কথাটা বলেই মেহনূর বিদায় নিলো। এখানে একবিন্দু থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাইরে আগে থেকেই গাড়ির ব্যবস্থা করা ছিলো, তাতে চুপচাপ উঠে পরলো মেহনূর। গাড়িটা স্থিরতা ভেঙ্গে চলতে শুরু করলে মেহনূর মুখ ফিরিয়ে বাড়িটা দেখতে লাগলো। বিষাদের অনলে বুকটা দুমড়ে-মোচড়ে আসছে।

একবার যদি ডেকে দিতো? কানের কাছে শুধু একবার ‘ ও মেহনূর ‘ বলতো? দেয়নি। মেহনূর চোখ বন্ধ করে মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকালো। হঠাৎ সামনের সিট থেকে অনবরত ফোন বাজছে। ড্রাইভ করছে নোমান। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ কম মেহনূরের, তবুও ফাঁকে-ফাঁকে শুনলো, ‘ জ্বী, জ্যাম? আচ্ছা, ঠিকআছে ‘। ফোনটা রাখতে দেরি, হঠাৎ গাড়িটা এমন স্পিডে হাঁকালো, মেহনূর ভয়ে-উত্তেজনায় কপাল কুঁচকে বললো,

– নোমান ভাই, স্পিড বাড়ালেন কেন? এক্ষুণি স্পিড কমান। কি শুরু করলেন আপনি? কথা শুনতে পাচ্ছেন না? আপনাকে স্পিড কমাতে বলেছি না?
প্রচণ্ড স্পিডে গাড়ি ছুটছে। নোমান শুনেনি। এক্সিলেটর দুর্দান্তগতিতে বাড়ছে। দুপাশের জানালা দিয়ে শাঁ শাঁ ধ্বনিতে বাতাস হানছে। মেহনূর আবার চেঁচালো, ফলাফল শূন্য।

নোমানের এই আমূল পরিবর্তন দেখে মেহনূর নির্বাক! ওই কলটা কার ছিলো? খারাপ চিন্তাটা বদ্ধমূলভাবে জেঁকে ধরছে। মানুষের উপর তিল পরিমাণ ভরসা করা যায় না। মেহনূর হাত মুঠো করে শক্তভাবে বসলো। ড্রাইভ করতে-করতেই আরেকদফা কল আসলো। এরপর যে কাণ্ডটা হলো, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। নোমান একহাতে ড্রাইভ করতে-করতে ফোনটা পিছু বাড়িয়ে দিলো। তাড়াহুড়ো কন্ঠে বললো,

– ম্যাম, ধরুন। কলটা আপনার।
মেহনূর ভয় বিদীর্ণ করে ফোনটা হাতে নিলো। কৌতুহল চোখে আশেপাশে দেখতে পেলো, আচানক স্পিড কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে স্ক্রিনে লেখা ‘ M.A.B. ‘. মেহনূর ঢোক গিলে ফোনটা কানে চেপে বললো,
– হ্যা-হ্যালো,

আমতা-আমতা সুরটা সিগন্যাল দিতেই কর্তৃত্বপূর্ণ গলাটা ভেসে এলো,
– দেখোতো আশেপাশে আছি নাকি।
মেহনূর চরমভাবে ছটফট করে উঠলো। ডানে-বামে পাগলের মতো তাকাতে লাগলো। কোথাও দেখতে না-পেয়ে ফোন ধরা অবস্থায় বললো,

– কোথায়? দেখছি না, একটু হাত বের করুন।
বলতে-বলতে মেহনূর পিছু ফিরে তাকালো। তাদের গাড়ির পিছু-পিছু অসংখ্য গাড়ি আসছে। কিন্তু কোনটা সেই আকাঙ্ক্ষী গাড়ি? মেহনূর হন্যে হয়ে নিরুপায় গলায় বললো,
– এখনো দেখছি না। আপনি কি মজা করছেন? কোথায় আছেন? কোন গাড়ি?
একটু থেমে মাহতিম বললো,
– ওহহো, এখনো দেখোনি? দাঁড়াও।

বুকটা প্রচণ্ডরূপে ধুক-ধুক করছে! কানে এখনো ফোনটা ধরা। কখন-কোনদিক ছুটে আসে মেহনূর জানে না। হতবিহ্বল হয়ে অস্থিরচিত্তে নিশ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ হর্ণ বাজাতে-বাজাতে ছুটে এলো গাড়ি। মেহনূর ধড়ফড় করে ডানদিকে তাকালো! এক মূহুর্ত্তের জন্য সবকিছু স্থির! শুধু ধুকপুক-ধুকপুক হৃদ ছন্দটা শোনা যাচ্ছে। চোখের পলক নিশ্চলভাবে জানালার বাইরে গেঁথে গেছে।চলন্ত গাড়ির ড্রাইভিং সিটে স্বয়ং মাহতিম আনসারী বসে। গায়ে আজ নেভি শার্টটা ফর্মাল গেটআপে পরা। বুকের উপর তেরছা ভাবে সিটবেল্ট লাগানো। মাথার চুল আজও জেল দিয়ে সেট।কানে কালো ব্লু-টুথ। মেহনূর মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে ধীর গলায় বললো,

– পাশের শূন্য সিটে চলে আসি?
দৃষ্টি ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালো মাহতিম। স্টিয়ারিং ধরা অবস্থায় দুষ্টু হাসিতে বললো,
– আসেন, আবার ফিরে যাই?
মেহনূর পালটা হাসিতে নিশ্বাস ছাড়লো শুধু। দূর থেকে মাহতিম বাঁ-হাত উঁচিয়ে কিছু একটা দেখালো। তার কবজির কাছে গোল হয়ে রক্ত জমে আছে। চোখে-মুখে দুষ্টু হাসি টেনে নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,

– ট/র্চার,
রাতের ঘটনা স্মরণ করতেই চোখ নামালো মেহনূর। ইশ! এই কাজটা কখন করলো? এখন যে এটা নিয়ে প্রচুর খোঁটা শোনাবে। হঠাৎ ফোনের ওপাশ থেকে ঠান্ডা সুরে বললো, ‘ আসি, নিজের খেয়াল রেখো ‘। চট করে দৃষ্টি তুললো মেহনূর, তাদের গাড়িদুটো আর পাশাপাশি নেই। রাস্তাটা দু’দিকের দুই সড়কে ভাগ হয়ে গেছে। মেহনূর সিটে গা হেলিয়ে ফোনটা কোলে নামিয়ে ফেললো। হৃদয়ঙ্গম অনুভূতিতে চক্ষুজোড়া মুদিত করে বললো,

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৩ শেষ অংশ

তোমারই বিহনে ফেঁসেছি আমি। রেখেছি তোমায় নয়নে। হৃদয়মৃণালে রেখেছি তোমায়, ছুঁয়ে দিয়েছি ক্ষণেক্ষণে। ভুলে গিয়েছি নিজের দুঃখ কথা, তুলে দিয়েছি আমার হাসি। মাঝে-মাঝে তোমায় কাছে পেলে, ভুলে যাই দিগ্বিদিক।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৬