মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৫

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৫
ফাবিয়াহ্ মমো

অস্থিরতা কাজ করছে। মনে-মনে ভয় হচ্ছে। বারবার পিছু তাকাচ্ছে মেহনূর! কেন এমন হচ্ছে? কেন মনেহচ্ছে খারাপ কিছু হবে? চোখদুটো একটা সেকেন্ডের জন্যও বন্ধ হচ্ছে না। মাহতিমকে বিদায় দেওয়ার পর থেকে স্বস্তি পাচ্ছে না। নোমান এখন ড্রাইভে, গন্তব্য এখন কোয়ার্টারে।

কেন জানি মনেহচ্ছে কিছুই ঠিক নেই। কেন এটা মনেহচ্ছে তা অবশ্য জানা নেই। কিছু হারানোর ভয়, কিছু ফেলে আসার চিন্তা, কিছু না-পাওয়ার হিসাব সবকিছু চুরমার করে দিচ্ছে। কিছু খুইয়ে ফেলার উৎকন্ঠায় মন-প্রাণ ছটফট-ছটফট করছে। গাড়িটা যত ফুল স্পিডে এগুচ্ছে, ততই মনেহচ্ছে খারাপ কিছু হবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দুশ্চিন্তায় আর টেকা যাচ্ছে না, তৎক্ষণাৎ নিরুত্তেজ হয়ে চোখ বন্ধ করলো মেহনূর। লম্বা-লম্বা গভীর দম নিয়ে বুক ফুলিয়ে ছাড়লো। আজ কি চরম কিছু হবে? গাড়িটা ঘুরাতে বলবে? সেই মফস্বলের দিকে যেতে বলবে? মেহনূরকে দুশ্চিন্তায় দেখে প্রশ্ন করলো নোমান,

– ম্যাম কিছু হয়েছে? আপনাকে সুস্থ লাগছে না। আপনি কি ঠিক আছেন?
সিটে গা হেলিয়ে সব শুনলো মেহনূর। চোখের পাতা তখনও বন্ধ, নিশ্বাসের গতি তখনও উত্থাল। চোখের কালো পর্দার কাছে দৃশ্যমান হলো সৌম্য পুরুষটা। চলমান গাড়িটার ভেতর রোমন্থন করলো একেকটি স্মৃতি। ওই ফিনফিনে পর্দা ঘেরা রাজকীয় শয্যায় ছিলো ওই ব্যক্তি। পুরোটা দিন, পুরোটা বিকেল, পুরোটা রাতজুড়ে ছিলো পাশে।

একটা মূহুর্ত্তের জন্যও কাছ ছাড়া করেনি ওকে। যেন একেকটি ন্যানো সেকেন্ড খুব দামী, খুব মহামূল্যবান। এই সময়গুলো হারাতে চায়নি মাহতিম। ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে যখন বললো, ‘ আই লাভ ইউ ‘, তখনই ওর ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে কেঁপে উঠে। যখন হাতের-ভাঁজে-হাত রেখে শক্ত করে ধরলো, তখন একটুও ভয় লাগেনি মনে। মানুষটার প্রতি বিশ্বাসের-সম্মানের-ভালোবাসার ডোরটা এতো অটুট ছিলো যে, একটা পলকের জন্যও চিন্তা লাগেনি।

তবে আজ কেন তাঁর প্রতি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে? আকস্মিকভাবে চিন্তার দুনিয়ায় বাধা পরলো। হঠাৎ কানে ব্রেক কষার চরম শব্দ হলো! সামান্য ঝাকুঁনি খেয়ে গাড়িটা থামতেই তৎক্ষণাৎ চোখ খুললো মেহনূর। যতটা স্বাভাবিকভাবে চোখ মেলে তাকিয়েছিলো, ততটাই অস্বাভাবিক হারে চোখদুটো বড়-বড় করে তাকালো। বিষ্ময়ের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছে মেহনূর চিৎকার দিলো,

– ইয়া আল্লাহ্!
গেটের কাছে সচল এ্যাম্বুলেন্স। একটা স্ট্র‍্যাচারটা ধরাধরি করে তিনজন ওয়ার্ড বয় কাকে যেন নিয়ে যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে এ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে ঢুকিয়ে হা করা দরজাটা ঠাস করে লাগালো। সাইরেনের গা ছমছম করা শব্দে মেহনূর কাঠ-কাঠ চোখে ঢোক গিললো।

এখনো বুঝতে পারেনি কোয়ার্টারের কাছে কি হচ্ছে। এ্যাম্বুলেন্সটা একবিন্দু দেরি না-করে দ্রুতগতিতে চলে গেলো। তখনই আসল দৃশ্যটা দেখতে পেলো সে, কোয়ার্টার থেকে পরপর দুটো গাড়ি বেরুচ্ছে। একটা গাড়ির জানালা তখন খোলা ছিলো, সেখান দিয়ে নীতির কান্নারত মুখটা দেখতে পেলো। এবার নোমানও ভয় জড়িত কন্ঠে অস্থিরভাবে বললো,

– ম্যাম, মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হয়েছে। সিচুয়েশন ভালো না, কি করবো?
মেহনূর এতোক্ষন যাবৎ পুরোপুরি স্থির ছিলো। চোখের সামনে অপ্রত্যাশিত কিছু দেখতে পেয়ে হতবাক! নোমানের কথায় সংবিৎ পেয়ে স্বাভাবিক হলো মেহনূর, তাড়াতাড়ি গাড়ি চালাতে বলে নোমানের ফোনটা হাতে নিলো। অতিদ্রুত কন্টাক্ট লিস্ট থেকে খুঁজে-খুঁজে তৌফের নাম্বারে ডায়াল করলো। গাড়িটা তখন ভয়ানক স্পিডে ছুটতেই বাজতে থাকা কলটা রিসিভ হলো,

– হ্যালো, হ্যালো তৌফ ভাইয়া? আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? আমি মেহনূর বলছি। আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? আমি, আমি আপনাদের পেছনে আছি। ব্যাপারটা কি হয়েছে? বাইরে এ্যাম্বুলেন্স কেন?
গাড়িটা সিয়াম চালাচ্ছিলো। সিয়ামের পাশে তৌফ বসে ছিলো। মেহনূরের কথা শুনতে পেয়ে ওমনেই হড়বড় করে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালো। সত্যি-সত্যিই মেহনূরের গাড়িটা আসছে দেখে তৌফ আশ্চর্য হয়ে বললো,

– হায়হায় রে সর্বনাশ! এইটা কি! ভাবী আপনার গাড়িতে এতো স্পিড ক্যান? গাড়ির স্পিড কমাতে বলেন। মাহতিম দেখলে নোমানরে গলা টিপে ধরবো। তাড়াতাড়ি কমাতে বলেন।
মেহনূর কথাটা পরোয়া না-করে বললো,

– আসল কথাটা বলুন। কে অসুস্থ হয়েছে? আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে তৌফ ভাই। দয়াকরে ঘটনাটা বলুন।
চুপ রইলো না তৌফ। মেহনূরের তাগাদা দেখে বলতে বাধ্য হলো। শানাজ সকালের দিকে কোয়ার্টারে আসে। ইচ্ছে ছিলো মেহনূরকে সারপ্রাইজ দিবে, কিন্তু এসে দেখে মেহনূর নেই। সকালের নাস্তাটা কোনোরকমে খেয়ে শুতে যায়।

কিন্তু ঘন্টাখানেক পরে এমন যন্ত্রণা শুরু হয়, সহ্য করতে না-পেরে সবাইকে ডাকতে থাকে সে। এদিকে সবাই কোয়ার্টারের পেছন সাইডে আড্ডা দিচ্ছে। শানাজের হাঁক-ডাক শুনতে পায়নি কেউ। পাশের ঘর থেকে মারজা তখন চিৎকার শুনতে পান। বিছানা থেকে তাড়াহুড়ো করে নামতে যেয়ে শাড়িতে পা আঁটকে মারাত্মকভাবে জখম হন।

ফ্লোরের শক্ত পাটাতনে আঘাত লেগে মাথা থেকে অনর্গল রক্তের ফোয়ারা ছুটে। ওইসময় জুসের ক্যান আনার জন্য ফারিন তখন ঢুকছিলো, ওমন মর্মান্তিক শোরগোল শুনে আতঙ্কিত হয়ে ছুটে যায় সে। দৃষ্টিজোড়া তরমুজের মতো গোল-গোল করে থমকে যায়, প্রচণ্ড ভয় পেয়ে হা করা মুখে হাতচাপা দেয়। একদিকে মারজার রক্তাক্ত অবস্থা, অন্যদিকে শানাজের প্রসববেদনা। এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হয়।

তাড়াতাড়ি ইমার্জেন্সী কলে এ্যাম্বুলেন্স আসে, দুজনকেই হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পুরো ঘটনা শোনার পর মেহনূর। ফোন কেটে দেয়। মাথাটা মৌমাছির মতো ভোঁ-ভোঁ করছে। একি বিপদ হলো! একি হলো মাবুদ! কন্ঠরোধ হয়ে আসছে! দৃষ্টি ঘোলা যাচ্ছে। মেহনূর ঠোঁট কামড়ে শক্ত হয়ে গেলো। যতটা শক্ত হলে কান্না চাপা যায়, ততটা কসরত করলো সে।

রাস্তায় জ্যাম চলছে। তার উপর সাংঘাতিক গরম। মাথার উপর অরুণ চাকাটা উত্তপ্ত। গাড়ির এসিটা আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। স্টিয়ারিংয়ে ডানহাত রেখে তবলার মতো আঙ্গুল নাড়াচ্ছে সে। অপেক্ষা করছে কখন জ্যাম ছুটবে। আশেপাশের গাড়িগুলো পিপীলিকার মতো ঠেকছে।

এই শহুরে যানজট কখন ছুটবে, তার হদিশ নেই। ডানপাশের জানালা দিয়ে ডানে তাকালো মাহতিম। থেমে থাকা প্রাইভেট গাড়ি দেখতে-দেখতে হঠাৎ এক জায়গায় দৃষ্টি আঁটকে গেলো। সাথে-সাথে চোখজোড়া ছোট করে তাকালো। সতর্ক হলো মাহতিম।

স্টিয়ারিংয়ে তবলা বাজানো হাতটা তখনও চলছে, এমন একটা অভিনয় করছে, যেন কিছুই দেখেনি, কিছুই বোঝেনি। লোকটার চাহনি স্বাভাবিক না, যেন পৈশাচিক ক্রুরকর্মের জন্য মুখিয়ে আছে। কিছু দূর আগেই মাইক্রোবাসটা থেমে আছে। খোলা জানালা দিয়ে যেই মাস্তান মুখটা দেখা যাচ্ছে, সেই লোকটা চোরাদৃষ্টিতে এদিকেই তাকাচ্ছে, দু’আঙ্গুলের ফাঁকে নিকোটিন চেপে সেও নাটক করছে।

ওই লোকটা হয়তো ভাবতেও পারেনি, ইতিমধ্যে সে ধরা খেয়েছে। কালো সানগ্লাসের নিচে একজোড়া তীক্ষ্মদৃষ্টি তাকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছে। লোকটা কালো কুচকুচে ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট চেপে ধরলো, একটান নেওয়ার সুযোগে আবার কাঙ্ক্ষিত গাড়িটায় চাইলো। বিড়বিড় করে পাশের জনকে শোনালো,

– অহন কিছু করতে যাইস না, ধৈইর্য্য ধর। আlকাম একটা ঘটায়া কাiইট্টা পlরোন যাইতো না। হাlলাlরে ধইরা আচ্ছামতো মlলlম লাগামু, হেরপর ওস্তাদের কাছে সাlপ্লাlয় দিমু, ঠিকাছে?
পাশেরজন চ্যাপ্টা কাঁচের বোতলে দেlশি পlদাlর্থ খেতে-খেতে বললো,

– হুন ব্যাডা, মাথা কইলাম গরম করিস না। আগে ওস্তাদের কাছে নিমু। ওস্তাদে যদি হুকুম দেয়, তখনই কlরাতের কাম করমু। তার আগে কেউ টাlচও করমু না।
সিগারেট ফুঁকা লোকটা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো,

– হাlলাlর পো হাlলা প্যাঁlচ লাগাইতে যাlস ক্যা? ভালা কতা হজম হয় না? এই হাlলাlয় নাটের গুরু জানোস না? পুরা একলাই একশো! লগে কেউ আহে নাই কইলাম। যদি আমগোর কপাল খারাপ হইয়া থাহে, তাইলে মনে কর জিiন্দা থাlকোনের উপায় নাই। ধlরা পরলে আজীবনের লাইগা লাlশ মুইছা দিবো।

দূরদৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে মাহতিম। লোকটা পাশের জনকে ধমকের সুরে বলছে। বাঁ-কানের ব্লুটুথে তর্জনী চেপে স্টিয়ারিংটা দুহাতে ধরলো। জ্যাম ছুটে যাচ্ছে। যেই দেখলো, রাস্তা রেডি হচ্ছে, ওমনেই চতুরতার সাথে গাড়ি টানলো মাহতিম। বাস-ট্রাক-সিএনজিকে টেক্কা দিয়ে কৌশলের সাথে ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে ছুটাতে লাগলো।

ডানদিকের সাইড মিররে দৃষ্টি দিলো সে, ওই মাইক্রো গাড়িটা হন্য হয়ে ধরাশায়ী করতে চাইছে। দৃশ্যটা দেখে আবারও সামনে তাকালো মাহতিম। মাথাটা একদম ঠান্ডা করে ক্রমে-ক্রমে স্পিড বাড়াতে লাগলো। ব্লুটুথের সংযোগটা পেয়ে যেতেই প্রথম বাক্য বললো সে, বেশ কর্তৃত্বের সাথে কাট-কাট ভঙ্গিতে বললো,

– ফলো করছে।
তথ্যটা জানালো সে । ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি চুপচাপ শুনলো। ভদ্রলোকের নাম অশোক সেন। হেড অফিসের বিশেষ একজন কর্মকর্তা। ভদ্রলোক কথাটা শোনার পর কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। কালক্ষেপণ সেরে প্রশস্ত গলায় বললেন,
– আনসারী, এখনো সময় আছে। আমি তোমাকে হারাতে চাই না।

গুরুতুল্য ব্যক্তির কাছে এরকম কথা শুনে হালকা হাসলো মাহতিম। অশোক সেন প্রচণ্ড রাগী একজন মানুষ। ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকটা সদস্য তাঁর কাছে মিনমিন করে। হেড অফিসের একজন গণমান্য লোক হিসেবে তাঁর সম্মানটা প্রচুর। তাঁর সামনে প্রত্যেকটা সোলজার ক্লিন-কাট ডিসিপ্লিন মানতে বাধ্য। সামান্য ভুলচুক হলে একদম ছাড় দেন না।

এমনই একজন কঠিনীভূত লোকের কাছে মাহতিম বেশ প্রিয়। প্রথম-প্রথম মাহতিমকে এতো অপমান করতো, যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আজ সেই মাহতিমের জন্য কিনা ভদ্রলোক টেনশন করছে। মাহতিম নির্ঝঞ্ঝাট কন্ঠে হাসি দিয়ে বললো,

– কিছু পাওয়ার জন্য কিছু হারাতে হয়। মিথ্যাকে সামনে আনার জন্য যদি আমাকে সরতে হয়, আমি রাজি। বহু বছর ধরে চলতে থাকা নৈiরাজ্য আমি মানবো না। এই সত্য উদঘাটন করতে গিয়ে অনেকেই পিছিয়ে গেছে, অনেকেই কালের গর্ভে আজ মৃjত। আমার দেlশেlর মানুষ ভালো নেই। তাদের চোখে আর ধূlলো লাগাতে দিবো না। আজ আমার জন্য যদি দেlশেlর একধাপ উন্নতি হয়, তাও হোক! কিন্তু ওlদের আlসল চেহারা আমি বেlর করেই ছাlড়বো।

সত্যের ক্ষlমতা হাতে নিয়েছি, এর জন্য যদি নিজেকেই বlলিlদান দিতে হয়, তাও দেবো, কিন্তু দূtর্নীতিবাtজদের মুtখে কাiলি বসিয়ে যাবো। আমি ওয়াসিফ পূর্বের মতো পরাজয় স্বীiকার করবো না। আমি উনার মতো মহৎ নই। একবার যেহেতু কাlদায় হাlত ডুবিয়েছি, সেখান থেকে একটা-একটা করে সবগুলোকে টেlনে আনবো। আমি ওlদের কাউকেই ভlয় পাই না।

মাহতিমের অন্তর্মুখী জেদটা প্রবল। একবার যখন রোখে চাপে, তখন কার্যসিদ্ধির আগ পযর্ন্ত থামে না। অশোক সেন তেমনই কিছুর আভাস পেলেন। তিনি বুঝে গেছেন, থামাবার কোনো পথ নেই। আনসারী এখন দুর্বার-দুর্জয়-দুমর্দ চিন্তায় আছে, এ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া অসম্ভব। অশোক সেন ভারী গলায় তেজঃপূর্ণ স্বরে বললেন,
– লাইফটা রিlস্কে রেখে যে কাজে নেমেছো, আই হোপ তাতে তুমি সফল হবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তুমি যেন আমাদের কাছে ফিরে এসো।

মাহতিম এর পরিপ্রেক্ষিতে বাঁকা হাসি দিলো। ঠিক কেমন শুকনো একটা হাসি, আজ সেই হাসিতে দাম্ভিকতার রোষ নেই। স্টিয়ারিং ধরা বাঁ-হাতটায় চোখ রাখলো সে। কবজির রক্তিম গোল চিহ্নটায় হাসি ছুঁড়ে তাকালো। মলিন দৃষ্টিতে মনে-মনে বললো,

– ইতিহাস পুনরাবৃত্তি ভালোবাসে। সেদিন দুঃখের অনলে দগ্ধ ছিলো মন। আজ বlদlলার আlগুlনে বিlক্ষিlপ্ত আমার চেতনা। তুমি রাগ কোরো না মেহনূর। আমাকে ভুল বুঝো না।

একটানা পাঁচটা ঘন্টা কেটে গেলো। এই পাঁচটা ঘন্টা যেন শূলের মতো বিঁধছিলো। কোনো শান্তি নেই, কোনো ভরসা নেই, কোনো আশ্বাস নেই; ছিলো শুধুই ভয়। হাসপাতালের দোরগোড়ায় প্রতিটা মানুষ ছিলো চিন্তায়। অবশেষে চিন্তার দুয়ারে প্রবেশ করলো ডাক্তার।

তিনি ডেলিভারি রুম থেকে সমস্ত কার্যক্রম সমাপ্ত করে বেরুলেন। ঠোঁটে সন্তুষ্টির হাসি এঁটে নার্সের দিকে ইশারা করলেন। সবার বুকে তখন ধ্বক-ধ্বক শব্দ হচ্ছিলো, একইসাথে অসংখ্য তাল ঠুকছিলো। সবাই উন্মুখ হয়ে নার্সের দিকে তাকালো। নার্সের কোলে সাদা কাপড়ে প্যাঁচানো ছোট্ট পুত্তলি। সেই পুত্তলির মতো জিনিসটা থেকে একটুখানি মুখটা বেরিয়ে আছে।

সৌভিক দূর থেকে ওই মুখের দিকে তাকিয়ে বাক্য ভুলে গেছে। নার্সের কাছে গিয়ে দুহাত বাড়ানোর সাহস নেই। মেহনূর স্তব্ধ চাহনির মতো একপা করে এগিয়ে গেলো, নার্সের কোল থেকে দু’হাত বাড়িয়ে ছোট্ট পুত্তলির মতো মানুষটাকে কোলে নিলো। সদ্য জন্মানো অতিথির মুখটা দেখে চাপা উচ্ছাসে হাসলো মেহনূর। তার চোখ থেকে অঝোরে পানি পরছে। আহা, শানাজ বুবুর ছেলে! মেহনূর খুশিতে-আনন্দে পাগলপ্রায় হয়ে কপালে আলতো চুমু খেলো।

মেহনূরকে আমেজের ন্যায় হাসিখুশি দেখে তৌফরা সবাই হুড়মুড় করে ছুটে এলো। কয়েকটা সেকেন্ড অসংখ্য চোখ ঘুরঘুর করে ছোট্ট অতিথিকে দেখলো। এরপরই এমন উল্লাসে মেতে উঠলো যে, এতোক্ষন যাবৎ যেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা ছিলো, তা প্রায় ভুলেই গেলো।

মেহনূরের কোল থেকে নীতির কোলে, নীতির থেকে সিয়ামের, সিয়ামের থেকে ফারিনের, এমন করে সবার কোলে-কোলে ঘুরতে গিয়ে নবাগত অতিথি কেঁদেই দিলো। এবার তেলে-বেগুনে ক্ষেপে উঠলো সৌভিক। এতোক্ষন রোবটের ভূমিকায় স্থির ছিলো ঠিকই, কিন্তু ছেলের কান্না শুনে আচমকাই রেগে গেলো। তড়িঘড়ি করে সবকিছু ভুল বাবার ভূমিকায় আসীন হলো। ছেলেকে কোলে নিয়ে চুপ করালো সৌভিক। কান্না থামা ছেলের দিকে হাসতে-হাসতে কথা শুরু করলো।

শানাজ এখন সুস্থ। ডেলিভারিটা নরমালে হয়নি। বাংলাদেশের তথাকথিত নিয়মের মতো হয়েছে। এজন্য একটু রক্ত সংকটে পরেছিলো। অন্যদিকে মারজার অবস্থাও ভালো। আশঙ্কামুক্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। মাথার ডানপাশে বারি লেগে তিন ইন্ঞ্চির মতো ফেটে যায়, সেখানে অবশ্য সেলাই দেওয়া হয়েছে।

মাসখানেকের ভেতর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবেন। হাসপাতালে দেখভালের জন্য শুধু নীতি-সিয়াম-সাবির থাকলো। বাকিরা সবাই তল্পি-তল্পা গুটিয়ে কোয়ার্টার মুখো হলো। রাতে অবশ্য শানাজের পাশে সৌভিকের কাকীমা থাকবেন, তাই নবাগত বাচ্চাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। নয়টার ভেতর পৌঁছে গেলো সবাই। বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে যার-যার রুমে ফিরে গেলো। সদর দরজায় লক লাগিয়ে নিজের রুমে ফিরলো মেহনূর।

সুইচ টিপে বাতি জ্বালাতেই একরাশ নিরবতা আঁকড়ে ধরলো। প্রতিটি দেয়াল যেন জানান দিচ্ছে, ‘ মাহতিম ঘরে নেই, মাহতিম ঘরে নেই ‘। দরজাটা চাপিয়ে নিজেকে পরিচ্ছন্ন করলো মেহনূর। শাড়িটা পালটে চুলটা মুছতে-মুছতে সোফায় বসলো। টি-টেবিলের উপর থেকে রেখে যাওয়া ফোনটা তুললো, ফোন বন্ধ, চার্জ নেই।

টেবিলের কাছে চার্জার সেটিংসে ফোন ঢুকালো মেহনূর। ঘড়িতে তখন পৌণে দশটা বাজে। ফোনটা বাংলা বইয়ের উপর রাখতেই হঠাৎ ডায়েরির দিকে নজর পরলো। কি ব্যাপার? ডায়েরিটা ফুলে আছে কেন? ডায়েরিটা টেনে দেখলো, সেখানে একটা কলম ঢুকানো। তার চেয়ে অবাক করা বিষয়, সেখানে মাহতিমের লেখা। মেহনূর চটপট ভঙ্গিতে ডায়েরি তুলে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোলের উপর ডায়েরি মেলে পড়তে লাগলো,

রাগ কোরো না লক্ষ্মী। তোমার ডায়েরিতে এজন্য লিখেছি, কারণ আমার কোনো ডায়েরি নেই। তোমার সুন্দর-সুন্দর লেখাগুলোর পাশে আমার লেখাটা খুবই বেমানান লাগছে। কিন্তু কথাগুলো না-জানিয়ে গেলে ভেতরে-ভেতরে চাপ ফিল করবো। তুমি কথাগুলো পড়ার পর পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে দিও।

মেহনূর, আজ দুটো কথা জানাতে তোমার ডায়েরিতে কলম ঘুরাচ্ছি। প্রথমেই তোমার কাছে ক্ষমা চাই। হয়তো ভাবছো কেন ক্ষমা চাচ্ছি। তুমি আমাকে যেভাবে বিশ্বাস করো, তোমার অন্ধ বিশ্বাসকে আমি ভালোবাসি। আজ আমি এমন পর্যায়ে আছি, যেখান থেকে তোমার প্রতি ভিড়তে পারবো না।

আমার ভালোবাসার প্রতি অক্ষুন্ন বিশ্বাস, তুমি আমাকে বুঝবে, তুমি আমার কথাগুলো উপলব্ধি করতে পারবে। আজ যেই কথাগুলো এই পৃষ্ঠায় লিখে যাচ্ছি, সেগুলো অশ্রু না-ফেলে শান্ত মেয়ের মতো পড়বে। তুমি আমার জন্য ওই মেহনূর হয়ে যাও, যখন তুমি কলেজ থেকে বেরিয়ে প্রতিবাlদী আচরণ করেছিলে। তুমি সেদিনের মতো শক্ত হও, যখন তোমার দিকে এ্যাপ্রোচ করা সত্ত্বেও তুমি নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ করোনি।

আমি হাতে একটা কেস নিয়েছি। এটার সুরাহা আমাকেই করতে হবে। কেউ যেচে এসে নিজের বিlপlত্তি ডাকে না, কিন্তু আমি ডেকেছি। আমি যখন কথাগুলো লিখছি, তখন তুমি আমার সামনে গুটি পাকিয়ে ঘুমাচ্ছো। আর যখন এটা পড়ছো, আমি পাশে নেই। পরীক্ষাগুলো ঠিকমতো দিও।

আমার চিন্তায়-চিন্তায় বিভোর থেকো না। মায়ের দিকে একটু খেয়াল রেখো। গিঁটে ব্যথা উঠলে আমার মা-টা খুব কষ্ট পায়। পায়ে একটু তেল মালিশ করে ঘুম পাড়ালে মন্দ হয় না। ফারিনটা পাটিশাপটা পিঠা খুব পছন্দ করে। একদিন আমার কাছে তোমার গুণের কথা শুনে খেতে চেয়েছে। কতদিন থাকবে তা তো জানি না।

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৪

তুমি এর মধ্যে একদিন সময় করে ইচ্ছাটা পূরণ করে দিও। আমার কোয়ার্টারটা তোমার জন্য বরাদ্দ থাকবে। যদি মনেহয় আমার মতো স্বার্থপরের জন্য এখানে থাকবে না, তাহলে কোয়ার্টারটা ছেড়ে দিও, আমি কষ্ট পাবো না। নিজের দিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করো। তোমাকে অসুস্থ দেখতে পারি না। বেডরুমটা শূন্য খাঁ খাঁ করছে, তাই না? (ক্ষমা চাই)

মন বাড়িয়ে ছুঁই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৬