মন বিনিময় পর্ব ২২

মন বিনিময় পর্ব ২২
তাসফিয়া হাসান তুরফা

ভার্সিটি বন্ধ হয়েছে একদিন হলো মাত্র অথচ গতকাল জন্মদিনের পার্টি হতে আসার পর থেকে যেন রাহিতার সময় কাটছেই না বলা চলে! এদিকে হাতে পড়ে আছে সপ্তাহখানেক সময়ের ছুটি। পরদিন বিকেলে শাশুড়ির সাথে সোফায় বসে ঝালমুড়ি খেতে খেতে টিভি দেখছিলো সে। কি করে ছুটির ক’দিন কাটানো এ বিষয়েই ভাবছিলো মূলত। ঠিক সে সময় ড্রয়িংরুমের সেন্টার টেবিলে রাখা দিলারা বেগমের ফোন বেজে উঠে৷ রাহিতা উঠে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে শাশুড়িকে হস্তান্তর করে।

—কে ফোন দিয়েছে, রাহি?
—আম্মা লেখা আছে, মা।
—ওহ, আমার মা ফোন দিয়েছে। দে কথা বলি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফোন কানে ধরতেই মায়ের সাথে কথা হয় দিলারা বেগমের এবং কিছুক্ষণের মাঝেই তার চেহারায় একপ্রকার হাসিখুশি ভাব দেখা যায়। কি কথা হচ্ছে পাশে বসে বুঝার চেস্টা করছিলো রাহিতা। এরই এক পর্যায়ে স্বপ্নিলের নানি রাহিতার সাথে কথা বলতে চাইলেন। উনার সাথে কথা বলার এক ফাঁকে সে জানতে পারে স্বপ্নিলের মামাতো বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। সেটার দাওয়াত দেওয়া উপলক্ষেই ফোন দিয়েছেন তিনি, একিসাথে খানিকবাদে স্বপ্নিলের মামির সাথেও তার কথা হয়।

এরপর উনারা সবাই মিলে দিলারা বেগমকে জোর করেন অবশ্যই নতুন বউকে সাথে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে। বাপের বাড়ির চাপে পড়ে দিলারা বেগম রাজি হয়ে গেলেন। এদিকে এ বিয়ের ব্যাপারটায় যে সবচেয়ে বেশি খুশি, সে হলো রাহিতা। যার খুশির ছাপ স্পষ্ট ভেসে তার চোখেমুখে। এভাবেই অনেকদিন বিয়ের দাওয়াত খাওয়া হয়নি তার, নিজের বিয়ে হয়েছে শুধু মাসখানেক আগে। কিন্তু নিজের বিয়েতে কি আর ওভাবে মজা করা যায়? অবসর কাটানোর এক দুর্দান্ত সুযোগ পেয়েছে সে। তাইতো খুশিমনে রাহিতা সিদ্ধান্ত নিলো এ বিয়েতে সে মনখুলে আনন্দ করবে! ওর হাসিমুখের দিক চেয়ে স্মিত হেসে দিলারা বেগম বললেন,

—এবার খুশি তুই? সকাল থেকে তো ভাবছিলি কিভাবে সময় কাটাবি, এখন তো মোক্ষম উপায় পেয়ে গেলি একটা!
—হ্যাঁ, মা। আমি ভীষণ খুশি! কত্তদিন পর বিয়ে খাবো একটা! সামিরা কোচিং থেকে আসুক বাসায়। তারপর দুজন মিলে প্ল্যান করবো বিয়েতে কি পড়বো, কি কি করবো এসবের। আই এম সো এক্সাইটেড!

—আচ্ছা বাবা সব করিস। তোদেরই তো দিন! নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে, আমার ছেলেটার সাথেও একটু প্ল্যান করিস।
উনার শেষ কথায় চাঞ্চল্য মিইয়ে যায় রাহিতার, দুই গালে ছেয়ে যায় ইষৎ রক্তিম আভা। রাহিতার লাজুকতায় হেসে ফেললেন দিলারা বেগম। একিসাথে মেয়েটার চঞ্চলতা দেখে খুশি হন। পুত্রবধূর এ হাসিমুখ যেন সর্বদা বজায় থাকে মনে মনে সে দোয়া করতে ভুললেন না।

সন্ধ্যায় বাসায় চলে এসেছে স্বপ্নিল। তবে আজ ভীষণ ব্যস্ত সে। যেহেতু হুট করে অফিস থেকে ছুটি নিচ্ছে সপ্তাহখানেকের জন্য তাই স্টাফদের কাজ ভালোভাবে বুঝে দিতে হবে, ম্যানেজারকে দায়িত্ব দিয়ে এসেছে সে। পাশাপাশি নিজেও ফোনে টুকিটাকি কথাবার্তা বলছে বাসায় আসার পর থেকে। এরই মাঝে রাহিতা শাড়িটারি বের করে ফেলেছে গুছানোর জন্য। কি কি নেবে না নেবে সব এখন থেকেই ঠিক করছে, কাল সকালেই বেরোবে তারা। বিয়েতে কি পড়বে না পড়বে ভাবতে ভাবতেই বহুক্ষণ পেরিয়ে গেছে তার। এদিকে স্বপ্নিলের এসব বিষয়ে যেন কোনো হেলদোল নেই, রাহিতা দু একবার জিজ্ঞেস করলো ওর জন্য কোন শার্ট নিবে না নিবে কিন্তু স্বপ্নিল সেসবে পাত্তাই দিলোনা একপ্রকার। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে রাহিতা বলেই ফেললো,

—এমন করছেন কেন বলেন তো? কি পড়বেন বিয়েতে সেটা এটলিস্ট বলেন। পাঞ্জাবি নিবো নাকি শার্ট? কোনটা নিবো সেটাও তো বলছেন না। এভাবে করলে আমি ব্যাগ কিভাবে গুছাবো?
রাহিতার কথায় ফোন রেখে সোফা থেকে উঠে স্বপ্নিল। বিছানায় ব্যাগপত্র নিয়ে বসে থাকা রাহিতার দিক এগিয়ে গিয়ে বলে,
—তোমার এসব করতে হবেনা, রাহি। আমার ব্যাগ আমি গুছিয়ে নেবো। তোমার কস্ট করতে হবেনা, তুমি নিজের ব্যাগ গোছাও তাহলেই হবে।

—আরে কোনো কস্টই হবেনা। আমি নিজের ব্যাগ গোছাচ্ছি তো, সাথে আপনারটাও গুছিয়ে দেবো। বলুন না?
—আমার নিজের ব্যাগ নিজে গোছানোর অভ্যাস আছে, রাহি। বলছি তো। তুমি তোমারটা গোছাও তো! বললাম না?
এবার স্বপ্নিলের কথায় খানিকটা দমে যায় রাহিতা। সে তো স্ত্রীর অধিকারেই ওর ব্যাগ গোছাতে চাইছিলো। এটাতে স্বপ্নিলের কি সমস্যা হতে পারে? সে ভেবে পায়না। পরক্ষণেই ভাবে হয়তো স্বপ্নিলের সত্যিই নিজের ব্যাগ নিজে গোছানোর অভ্যাস, তাই এমন করে বলছে। কেননা বিয়ের পর থেকে স্বপ্নিলকে নিজের বেশিরভাগ কাজ নিজেই করতে দেখেছে সে। তাই আর বেশি মাথা ঘামায়না এ ব্যাপারে। মনের আক্ষেপ মনের ভেতরেই চাপা রাখে!

রাহিতাকে চুপ থাকতে দেখে স্বপ্নিল নিজেও পুনরায় ফিরে যেতে ধরে। হঠাৎ কি মনে করে যেন আবার তাকায় রাহিতার দিকে। আর তৎক্ষণাৎ তার নজরে আসে রাহিতার উদাস মুখ, চুপচাপ একধ্যানে কাপড় ভাজ করতে থাকা রাহিতার দিক তাকিয়ে স্বপ্নিল কি যেন ভাবে। তারপর নিঃশব্দে আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণের মাঝেই নিজের পরিধেয় শার্ট-প্যান্ট বের করে নিয়ে ফেরত যায় রাহিতার কাছে। স্বপ্নিলের ডাকে চোখ তুলে তাকায় রাহিতা। ওর হাতে কাপড়চোপড় দেখে কিছু ভেবে উঠার আগেই সেগুলো ওর হাতে ধরিয়ে দেয় স্বপ্নিল। রাহিতা কিছু বলার আগে নিজেই বলে উঠে,

—নেও ধরো। আমার গুলোও তুমিই গুছিয়ে দাও।
—কিন্তু আপনি যে বললেন…
—উফফ! এত কথা বলো কেন, রাহি? নিজেই তো চাইলে আমারগুলোর জন্য আবার এখন নিজেই প্রশ্ন করছো?
স্বপ্নিলের আচরণে মনে মনে খুশি হলেও তা মুখে প্রকাশ করেনা রাহিতা। চাপা হাসির আড়ালে নিজের খুশিটুকু সযত্নে লুকিয়ে রাখে। স্বপ্নিলের হাত থেকে শার্ট-প্যান্ট নিয়ে সেগুলো একবার দেখতে দেখতে বলে,
—আচ্ছা ঠিকাছে। আমিই গুছিয়ে রাখছি। তবে পাঞ্জাবি বের করলেন না যে? আমি তো ভেবেছিলাম বিয়ে পড়ানোর দিন পাঞ্জাবি পড়বেন। তাহলে?

—হুম, তা তো পড়তে চেয়েছিলামই কিন্তু আপাতত চোখের সামনের কোনো পাঞ্জাবি পছন্দ হলোনা। এক কাজ করো, তুমি সবকিছু গোছানো হয়ে গেলে আমার কাবার্ড ঘেটে ভালো দেখে একটা পাঞ্জাবি পছন্দ বের করে নিও।
স্বপ্নিলের শেষের কথায় আরেকদফা খুশি হয় রাহিতা। শেষমেশ স্বপ্নিল কিনা ওর পছন্দমতো পাঞ্জাবি পড়বে? ঠোঁটের কোণে সরু হাসির রেখে টেনে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় রাহিতা।
মিহি সুরে বলে,

—আচ্ছা, আপনি ব্যস্ত না খুব? কাজ করুন। আমি সব ঠিক করে রাখবো।
—হ্যাঁ, বেশ ব্যস্ত আজ। কাল সকালেই বেরোতে হবে তো, সময়ও নেই বেশি। এখন আরেকটা ফোন করা লাগবে। আমি বারান্দায় যাই৷

ঘণ্টাখানেকের মাঝেই নিজেদের ব্যাগপত্র সব গুছিয়ে ফেলে রাহিতা। অতঃপর স্বপ্নিলের জন্য পাঞ্জাবি বাছাই করতে আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ এদিক সেদিক খুজে নিজের শাড়ির সাথে মিলিয়ে মেরুন রঙের এক পাঞ্জাবি বের করে সে। বিয়ের পর এই প্রথম কোনো অনুষ্ঠান একত্রে করা! তার মধ্যে স্বপ্নিলের দিকের অনুষ্ঠান, বউ হিসেবে রাহিতার প্রথম দাওয়াত।

মন বিনিময় পর্ব ২১

সে হিসেবে নব-দম্পতি দুজন বিয়েতে এক রঙের পোশাক পড়লে বেশ মানানসই লাগবে দেখতে! মনে মনে একদফা নিজেদের কল্পনাও করে ফেলে রাহিতা। নতুন সুখের প্রজাপতিরা উড়ে বেড়ায় মন জুড়ে!
রাহিতার মন বলছে গ্রামে থাকা এই এক সপ্তাহ বেশ সুন্দর সময় কাটবে তার। স্বপ্নিলের সাথে ওর সম্পর্কের আরও উন্নতি হবে। দুরুদুরু বুকে আগামীকাল সকালের অপেক্ষা করে রাহিতা, মনে মনে প্রস্তুতি নেয় স্বপ্নিলের সাথে এক সুন্দর যাত্রার!

মন বিনিময় পর্ব ২৩