মন বিনিময় পর্ব ৩৭

মন বিনিময় পর্ব ৩৭
তাসফিয়া হাসান তুরফা

দিলারা বেগম ও সামিরা চলে এসেছেন বাসায়। তার আগের দুটো দিন ছিলো স্বপ্নিল ও রাহিতার ছোট্ট বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে একান্ত ও মধুর সময়। কথায় আছে সুখের দ্রুত চলে যায়। হলোও তাই। আগামীকাল স্বপ্নিল চলে যাবে মালেশিয়া। যার দরুন এ ক’দিনে অফিসের কাজে বেশ ব্যস্ত থেকেছে সে।

রাহিতারও ভার্সিটি খুলেছে। সে-ও পড়াশুনা ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ সবমিলিয়ে সে রাতের পর স্বপ্নিল-রাহিতার খুব একটা একাকী সময় কাটেনি। তবু স্বপ্নিলের যাওয়ার দিন যত ঘনিয়ে এসেছে দুজনের মন খারাপ ততই প্রখর হয়েছে। একিসাথে দুজনের মাঝে দৃশ্যমানরুপে একে-অপরের প্রতি টান বেড়েছে৷

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দূরত্বের আগে কাছে আসা যাকে বলে। কাল চলে যাবে বলে আজ তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছে স্বপ্নিল। আসার পথে কি মনে করে যেন রাহিতার জন্য সাদা গোলাপ নিয়ে এসেছে৷ সেদিন কথায় কথায় রাহিতা বলেছিলো ওর ফুল ভীষণ পছন্দ। বলাবাহুল্য, কথাটা মাথায় রেখেই স্বপ্নিলের এ কাজ। কেননা আজকাল রাহিতার ছোট ছোট খুশির কারণ হতে পারলেও যেন অদ্ভুত প্রশান্তিতে মেতে উঠে তার অন্তর!

স্বপ্নিল রুমে, অফিস থেকে এসে গোসল করছে। এদিকে নিচে ওর জন্য চা করতে এসেছিলো রাহিতা। রহিমা খালা বানিয়ে দিতে চাইলেও রাহিতা নিজেই স্বপ্নিলের জন্য এসব করতে ভালোবাসে। তা দেখে কেউ আর দ্বিমত করেনা। চায়ের পানি চুলোয় বসে দিয়ে শাশুড়ির কাছে ড্রয়িংরুমে আসে রাহিতা। দিলারা বেগম পারতপক্ষে টিভি দেখলেও ছেলের তাড়াতাড়ি বাসায় আসা, পকেটে লুকিয়ে রাখা গোলাপ এসব ঠিকি নজরে পড়েছে তার।

দুজনের সম্পর্কে এমন উন্নতি দেখে মনে মনে অত্যন্ত খুশি হয়ে বারকয়েক “মাশাল্লাহ” বল্লেও মুখ ফুটে কাউকে বুঝতে দেননি কিছু! মা হয়ে তিনি বুঝেন তার ছেলে কতটা চেস্টা করছে রাহিতার সাথে ভালো থাকার, ওকে ভালোবাসার। তাই এ মুহুর্তে কোনোকিছু বলে স্বপ্নিলকে বিব্রত করতে চাননি তিনি। তবে রাহিতা এবং ওর অনুভূতি সম্পর্কে আগে থেকে অবগত হওয়ায় ওকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করাই যায় বলে উচিত মনে করলেন তিনি। তাইতো পাশে বসা রাহিতার উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,

—কি ব্যাপার বউমা, আমার ছেলেকে পুরোপুরি পটিয়ে নিয়েছো বুঝি?
শাশুড়ির এমন কথায় চমকে উঠে রাহিতা। লজ্জা পেয়ে বলে,
—কিসব বলছেন, মা!
—ঠিকি তো বলছি। তোরা দুটো বুঝিস আর না-ই বুঝিস আমার যা বুঝার সব কিন্তু ঠিকি বুঝে ফেলেছি। তারপর বল, দাদি কবে হচ্ছি?

এবার উনার কথায় লজ্জায় কুকড়ে যায় রাহিতা। পরক্ষণেই অজানা বিষাদে ছেয়ে যায় ওর অন্তর। স্বপ্নিলের সাথে যে এখনো ওর সম্পর্ক ততটা গভীর হয়নি এটা কি মুখে বলা যায়? দ্বিধান্বিত সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভাবে শাশুড়িকে কি বলবে। উনি হয়তো ভাবছেন ওদের মধ্যে স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য শুধু দিলারা বেগম কেন, এখন ওদের দুজনকে বাহিরে থেকে দেখলে যেকেউ-ই ভাববে ওরা একটা সুখী স্বাভাবিক দম্পতি। কিন্তু দুজনের ভেতরে যে এখনো জড়তার দেয়াল পুরোটা ভাঙেনি সেটা স্বপ্নিল-রাহিতা ছাড়া আর কেউ জানেনা! তবুও রাহিতা আশা হারায়না এবং রাহিতার এ আশার প্রদীপ জ্ব’লে থাকার কারণ স্বপ্নিল নিজেই!

কেননা আজকাল স্বপ্নিলের হুটহাট ওর জন্য বাসায় জলদি চলে আসা, মাঝেমধ্যে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, রাহিতার পছন্দ বলে মাঝেমধ্যে ফুল নিয়ে আসা এসব কিসের লক্ষণ রাহিতার বুঝতে অসুবিধে হয়না। স্বপ্নিল যে এতদিনে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে, রাহিতা সেটা এখন বুঝে ঠিকি। কিন্তু ওর মুখ থেকে কি করে স্বীকার করাবে তা ভেবে পায়না। যে নিজে ভালোবাসে সে-ই যদি স্বীকার না করতে চায় তবে তাকে কিভাবে বলানো যায়? স্বপ্নিলের মতো ত্যাড়া ছেলেকে কিভাবে লাইনে আনা যাবে ভেবে রাহিতা হয়রান! এসব ভাবনার মাঝেই পুনরায় শাশুড়ির কথায় ভ্যান ভাঙ্গে তার।

—কি রে, কই হারিয়ে গেলি?
—কোথাও না, মা। আমি একটু আসছি, উনার চা হয়ে গেছে। দিয়ে আসি!
কথাটা বলেই রাহিতা উঠে চলে যায়। ওর এভাবে লজ্জা পেয়ে উঠে চলে যাওয়া দেখে মনে মনে হাসেন দিলারা বেগম। কিন্তু একিসাথে তিনি অদেখা করতে পারেন না, তার প্রশ্ন শুনে রাহিতার মুখটা কিভাবে মেঘে ঢেকে গিয়েছিলো।

আর এতেই উনার মনে খানিকটা খটকা লাগে! আসলেই ওদের দুজনের মাঝে সবকিছু ঠিক আছে তো? নাকি তিনি যা দেখছেন তার সবটাই মরিচিকা? যদি এমনটাই হয় তবে তো এটা হতে দেওয়া যাবেনা। আর কতদিন ওরা এভাবে অনিশ্চিত সম্পর্কে ঝু’লে থাকবে? স্বপ্নিল কাল চলে গেলে পুনরায় রাহিতার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবেন তিনি। এরপর শীঘ্রই কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে। কঠিন মনে ভাবেন দিলারা বেগম।

আজ রাতে বেশ জলদিই খেতে বসেছে সবাই। ডাইনিং টেবিলে পরিবারের সাথে খাওয়াদাওয়া ও গল্পগুজবের আসর জমেছে। আগামী দু’সপ্তাহ কাছের মানুষদের দেখবেনা তাই আজ একটু বেশিই সময় নিয়ে ডিনার করে স্বপ্নিল। আসল উদ্দেশ্য পরিবারের সাথে বেশিক্ষণ সময় কাটানো, কেননা খাবার পরেই যে যার রুমে চলে যাবে সকলে।
এরই এক ফাকে ছেলের উদ্দেশ্যে দিলারা বেগম বলেন,

—বাবা, তোর ফ্লাইট যেন কয়টায় কাল?
—ভোর ৬.৩০ টায়, মা।
—আচ্ছা। রহিমা, ফজরের নামাজের আগে আগেই উঠে যেয়ো কাল। আমি ডেকে দিবোনি। রুটি বানিয়ো…
—শুধু শুধু খালাকে কস্ট দিচ্ছো কেন, মা? আমি নাস্তা করবোনা এত সকালে। প্লেনেই খাবার দিবে তখন খেয়ে নিবোনি।
মায়ের কথা থামিয়ে জবাব দেয় স্বপ্নিল। ওর উত্তরে সন্তুষ্ট হন না দিলারা বেগম। ছেলেকে থামিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন,

—তোর থেকে আমি শুনতে চেয়েছি? আমি যা বলেছি সেটাই হবে। তুই খেয়েই যাবি কাল।
—কিন্তু মা, তুমি..
—একবার বলেছিনা স্বপ্নিল? আমি তর্ক করতে চাইনা আর এ ব্যাপারে।
মায়ের শক্ত কথায় স্বপ্নিলের মেজাজ বি’গ’ড়ে যায়। হুট করে রেগে যাওয়া তার পুরনো স্বভাব, আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। গজগজ করতে করতে মুখ ফস্কে সে বলে,

—হ্যাঁ, তোমার কথা শুনা ছাড়া আর উপায় আছেও নাকি আমার কাছে। সারাজীবন তো তোমার ইচ্ছামতোই চলেছি। নিজের ইচ্ছের কি আদৌ দাম আছে আমার? তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী চলতেই তো আমার জীবন কেটে গেলো!
হুট করে বলে ফেলা স্বপ্নিলের এ কথায় পরিবেশ নিরব হয়ে যায়। চুপচাপ খেতে থাকা রাহিতাও হঠাৎ করে খাবার মুখে রেখেই থেমে যায়।

দিলারা বেগম আগের ন্যায় একিভাবে চেয়ে আছেন ছেলের দিকে, নিজের ছেলের এ স্বভাব সম্পর্কে তিনি চির অবগত। তাই স্বপ্নিলের রাগকে বিশেষভাবে গায়ে না মাখলেও ওর বলা শেষের কথাটা আচমকা উনাকে ভাবিয়ে তুলে। তবে কি স্বপ্নিল তার বিয়ে নিয়ে ইনডাইরেক্টলি এভাবে বললো? সে কি এখনো খুশি নয়? একদিকে সকালে রাহিতার আধারঘন মুখ, অপরদিকে স্বপ্নিলের মুখের এমন কথা না চাইতেও তার মনের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিলো।

জোর করে একটা সম্পর্ককে কখনোই টিকে রাখা যায়না এটা দিলারা বেগম জানেন এবং তিনি এটার পক্ষেও নন। তবুও তিনি রিস্ক নিয়ে পরিস্থিতির খাতিরে স্বপ্নিলের সাথে রাহিতার বিয়ে করে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এতদিনে দুজনের মাঝে সব ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু আজ তার মনে হলো তিনি ভুল ভেবেছিলেন। এসব ভেবেই চিন্তার পারদ ভারী হয় তার।
এদিকে হঠাৎ এভাবে সবাইকে চুপ থাকতে দেখে স্বপ্নিল বুঝে সে মায়ের সাথে এভাবে রিয়েক্ট করে ভুল করে ফেলেছে। তাই পরিস্থিতি সামলাতে সামিরার উদ্দেশ্যে বলে,

—কিরে বাদর, তোর জন্য কি নিয়ে আসবো মালেশিয়া থেকে? এখনো বললিনা যে?
স্বপ্নিলের কথায় চকচক করে উঠে সামিরার চোখ। যেন ভাইয়ের মুখ থেকে এতক্ষণ এ কথাটাই শোনার অপেক্ষায় ছিলো সেভাবে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে,
—আরে ভাই, এতক্ষণে একটা কাজের কথা বললে তুমি। আমি তো সেই সন্ধ্যা থেকে লিস্ট করে বসে আছি কি কি নিবে। তোমার দিবো খাওয়া শেষে।

—তোর লিস্টের সব আনতে আমার বয়েই গেছে! যেটা যেটা পছন্দ হবে শুধু সেটাই আনবো। লিস্ট তোর কিন্তু ইচ্ছা আমার।
স্বপ্নিলের কথায় বিরক্ত সহিত চোখমুখ কুচকায় সামিরা। মুখ বাকিয়ে বলে,
—তুমি সবসময় আমার সাথে এরকম করো, ভাই। তুমি কি কোনোদিন ভালো হবেনা?
—হবোনা। মা, তোমার জন্য কি নিয়ে আসবো?
—তুই সহি-সালামতে ফিরে আয়। তাহলেই হবে আমার। আমার কিছু লাগবেনা।

স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দেন দিলারা বেগম। মায়ের এত শান্ত স্বর শুনে খানিকটা অবাক হয় স্বপ্নিল, সে ভেবেছিল ওর কথায় মা রাগ করবেন নয়তো কস্ট পাবেন। কিন্তু তার কণ্ঠ এত স্বাভাবিক শুনে সে অবাক না হয়ে পারেনা। তবু বিষয়টা আর ঘাটতে মন চায়না ওর। যাওয়ার আগে মায়ের মন খারাপ করানোর কোনো ইচ্ছেই নেই স্বপ্নিলের। তাই হাসি মুখে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,

—জানতাম তুমি এটাই বলবে। আচ্ছা যাও তোমার বলা লাগবেনা। আমি আমার ইচ্ছেমতোন কিছু নিয়ে আসবো। ঠিক আছে?
স্বপ্নিলের কথার আর প্রত্যুত্তর করেন না দিলারা বেগম। মাথা নাড়িয়ে সায় দেন শুধু। অতঃপর আরও টুকটাক কথাবার্তা শেষে যে যার মতো রুমে চলে যায় খাওয়া শেষে।

রাত ১২টা। নির্ঘুম চোখে বিছানার দু-প্রান্তে শুয়ে আছে স্বপ্নিল রাহিতা। পাশ ফিরে স্বপ্নিলের দিক তাকাতেই রাহিতা চমকায়। স্বপ্নিলের নিষ্পলক দৃষ্টি ওর দিকেই তাক করা। সে বিস্মিত সুরে বলে,
—আপনি এখনো ঘুমান নি কেন? আমি তো ভেবেছি আপনি ঘুমিয়ে গেছেন!
—তুমিও তো জেগে আছো!
স্বপ্নিলের ত্যাড়া উত্তর। রাহিতা বিরক্ত হয়। চোখ পাকিয়ে বলে,

—ভোরের ফ্লাইট আমার নয়, এ জার্নিটা আপনার। তাই এখন কথা না বলে ঘুমিয়ে পড়ুন! আমার চেয়ে বেশি ঘুম আপনার প্রয়োজন।
কথাটা বলেই রাহিতা চোখ সরায়। ভাবে স্বপ্নিল এবারো ত্যাড়া কথা বলবে কোন নয়তো ঘুমিয়ে যাবে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে স্বপ্নিল নরম কণ্ঠে বলে ওঠে,

মন বিনিময় পর্ব ৩৬

—ঘুম আসছেনা, রাহি!
—কেন?
—হয়তো ঘুমের চেয়েও বেশি আমার তোমায় প্রয়োজন তাই!

মন বিনিময় পর্ব ৩৭ শেষ অংশ