মন বিনিময় পর্ব ৩৭ শেষ অংশ

মন বিনিময় পর্ব ৩৭ শেষ অংশ
তাসফিয়া হাসান তুরফা

গোল গোল চোখে স্বপ্নিলের দিক চেয়ে আছে রাহিতা। নিজের কানকে একবার জিজ্ঞেস করে স্বপ্নিল কি সত্যিই এটা বলেছে নাকি সে ভুল শুনলো? কিন্তু ঘড়ির কাটা শব্দ করে ডেকে উঠার সাথে সাথেই ওর ভাবনায় ছেদ পড়ে। অনুভব করে যা শুনলো সবটাই সত্যি। প্রায় সাথে সাথেই ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। কম্পিত কণ্ঠে সুধালো,

—ম,মানে?
স্বপ্নিল সাথে সাথে জবাব দিলোনা। বরং নিজ জায়গা থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে এলো। রাহিতার নিকটে এসে ওর পানে চেয়ে বললো,
—তুমি আমায় মিস করবে, রাহি?
রাহিতা হাসলো। দুস্টু বুদ্ধি চাপলো মাথায়। স্বপ্নিলকে একটু রাগাতে মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—উহু। আপনাকে মিস করতে যাবো কোন দুঃখে?
রাহিতার এমন গা-ছাড়া উত্তরে স্বপ্নিল বেজায় চটে গেল। ভ্রু যুগলের মাঝে গাঢ় ভাজ ফেলে বললো,
—কেন? আমি এতদিন কাছে থাকবোনা, তোমার সাথে দেখা হবেন কতগুলো দিন আর তুমি আমায় একটুও মিস করবেনা? মনে পড়বেনা বুঝি আমায়?

—আপনি মিস করবেন আমায়?
স্বপ্নিলকে রাগতে দেখে রাহিতা কথা ঘুরায়। প্রশ্নের জবাবে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে ওর দিকে। স্বপ্নিল কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। রাহিতার মতো সে-ও মুখ বাকিয়ে উত্তর দেয়,
—মোটেও নাহ। যে আমায় মিস করেনা আমিও তাকে মিস করিনা। বুঝেছো?

ওর কথা শুনে শব্দ করে হেসে ফেলে রাহিতা। ওর হাসির শব্দে চোখ পাকিয়ে ওর দিক তাকায় স্বপ্নিল। মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে। রাহিতা উঠে বসে। স্বপ্নিলের দিক ঝুকে বেশ কিছুক্ষণ ডাকে ওকে।
—এই যে শুনছেন? উঠুন না। আমি তো মজা করছিলাম। শুনছেন?

রাহিতার এতবার ডাকার পরেও স্বপ্নিল আগেকার ন্যায় ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে অপরদিক হয়ে। এক পর্যায়ে ক্লান্ত রাহিতা হাল ছেড়ে দেয়। খেয়াল করে দেখে স্বপ্নিল শান্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। সে ভাবে ও হয়তো ঘুমিয়ে গেছে তাই জবাব দিচ্ছেনা। বভাবা, স্বপ্নিল বেশ দ্রুত ঘুমিয়ে যেতে পারে, এ ব্যাপারে ওর আগেকার রেকর্ড আছে। বিয়ের পর থেকেই বিষয়টা দেখে আসছে রাহিতা। যতই দুঃখ হোক আর যতই কিছু হোক স্বপ্নিল বেশিক্ষণ না ঘুমিয়ে থাকতেই পারেনা! ওর ঘুম লাগবেই! তাই রাহিতাও এ ব্যাপারে বিশেষ মাথা ঘামালোনা, ঘুমন্ত স্বপ্নিলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আলতোভাবে ওর হাত ধরে রাখলো বেশ কিছুক্ষণ। স্বপ্নিলের গালে হাত ছুয়ে ধীর স্বরে বললো,

—আমি জানিনা আপনাকে কখনো সরাসরি বলার সুযোগ পাবো কিনা। কিন্তু আপনি হয়তো জানেনও না আমি আপনাকে ঠিক কতটা মিস করবো। জলদি ফিরে আসবেন আমার কাছে।
কথাগুলো বলেই ধীরেসুস্থে স্বপ্নিলের হাত ছেড়ে দেয় রাহিতা। চুপচাপ নিজের স্থানে ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়ে আগের ন্যায়।

এদিকে রাহিতা চোখ বুজতেই অপরপাশে হুট করে চোখ মেলে তাকায় স্বপ্নিল। এতক্ষণ সে জেগেই ছিলো, মূলত ইচ্ছা করেই রাহিতার রিয়েকশন দেখার জন্য সে ঘুমের ভান করে পড়ে ছিলো। এবার রাহিতার এমন ইতিবাচক রিয়েকশন দেখে মনে মনে যারপরনাই খুশি হয় স্বপ্নিল, হৃদয়রাজ্যে সুখের প্রজাপতিরা ডানা মেলে উড়তে থাকে! ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে প্রশস্ত হাসি। রাহিতার দিক চেয়ে সন্তুষ্ট অন্তরে শুয়ে পড়ে সে নিজেও! যাক অন্তত চলে যাওয়ার আগে মনে শান্তি নিয়ে যেতে পারবে সে!

ভোর ৫টার মতোন বাজে। এয়ারপোর্টের সামনে গাড়ি থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নিল-রাহিতা। বাসার সবার থেকে বিদায় নিয়ে এসেছে স্বপ্নিল। দিলারা বেগম আসতে চেয়েছিলেন প্রথমে, কিন্তু পরে ভাবলেন স্বপ্নিলের সাথে এর আগেও এয়ারপোর্টে এসেছেন তিনি। কিন্তু বিয়ের পর এ প্রথম বউকে রেখে কোথাও যাচ্ছে ছেলে। তাই পরবর্তীতে দুজনের প্রাইভেসির ব্যাপারটা মাথায় রেখে তিনি আর আসেননি।

আশেপাশের সবাই ভীষণ ব্যস্ত, খুব সকালে ফ্লাইট হওয়ায় যাদের ফ্লাইট তারা ছাড়া তেমন একটা মানুষ নেই। সবাই যে যার মতোন ছুটছে। আশেপাশের কাউকে দেখার যেন সময়ই নেই তাদের। সেভাবেই এক কোণায় দাড়িয়ে আছে স্বপ্নিল-রাহিতা। একটু পরেই স্বপ্নিল ভেতরে চলে যাবে। তবে রাহিতা বেশ কিছুক্ষণ থেকে খেয়াল করছে স্বপ্নিল কেমন যেন উশখুশ করছে কখন থেকে। যেন কিছু বলবে কিন্তু ইতস্ততায় বলতে পারছেনা। রাহিতা ভাবলো জিজ্ঞেস করবে, এমন সময় স্বপ্নিল ধরা গলায় বলে,

—রাহি, একটা কথা বলি?
—বলুন না। কখন থেকেই তো দেখছি আপনি কিছু বলার জন্য উশখুশ করছেন কিন্তু বলতে পারছেন না। কি হয়েছে আমায় নির্দ্বিধায় বলে ফেলুন, স্বপ্নিল।
ওর কাধে হাত রেখে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে রাহিতা। যেন খানিকটা আশ্বাস দেয় নির্ভরতার, যাতে স্বপ্নিল দ্বিধাহীনভাবে নিজের অনুভুতি প্রকাশ করতে পারে ওর সামনে। রাহিতার আশ্বাসে কাজ হলো। স্বপ্নিলের এতক্ষণের অস্থির ভাব বেশ খানিকটা কমে গেলো। কিছুক্ষণ অবিচলভাবে রাহিতার দিক চেয়ে অবশেষে মনের কথা মুখে এনে সে বললো,

—আমাদের মাঝে সবকিছু আগেকার মতোই থাকবেনা, রাহি? আমাদের সম্পর্ক আমি ফিরে আসার পরও ঠিক এমনই থাকবে, বলো?
স্বপ্নিলের হঠাৎ এমন প্রশ্নে আকাশ থেকে পড়ে রাহিতা। চমকে উঠে সে প্রশ্ন করে,
—মানে? এসব কি বলছেন? আমাদের সম্পর্কের আবার পরিবর্তন হবে কেন?
—আমি জানিনা। আমার যা মনে হলো তাই বললাম। কথা দাও, আমাদের সম্পর্ক ঠিক এমনই থাকবে। এ সাময়িক দূরত্ব আমাদের মধ্যকার সম্পর্কে কোনোরুপ প্রভাব ফেলতে পারবেনা। কথা দাও আমায়।

রাহিতার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে স্বপ্নিল। বিস্মিত বিমূঢ় রাহিতা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে স্বপ্নিলের পানে। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবে। হঠাৎ কিছু মাথায় আসতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় রাহিতার কাছে। সে বুঝে স্বপ্নিল আচমকা কেন এ প্রশ্ন করছে। হয়তো অতীতের কথা মনে হয়ে তার এ দ্বিধা। বিচলিত স্বপ্নিলকে আশ্বাস দিতে রাহিতা হেসে বলে,

—আপনি কি আমাদের সম্পর্ক নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছেন? ভাবছেন আমরা আলাদা থাকলে আমি আপনাকে ভুলে যাবো?
ধরা পড়ে যাওয়ায় স্বপ্নিল খানিকটা লজ্জাবোধ করে। ইতস্ততভাবে এদিক-সেদিক তাকায়। ওকে লক্ষ্য করেই রাহিতা বলে,
—দেখুন স্বপ্নিল, আমি জানিনা আপনার মাথায় এমন চিন্তা কেন এসেছে। হয়তো আপনি এখনো অতীত নিয়ে চিন্তা করেন বলে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমায় নিয়ে আপনার ইনসিকিউর হওয়ার কোনো কারণ নেই।

আপনার আমার সম্পর্কটা কোনো ঠুনকো সম্পর্ক নয় যে সামান্য বিচ্ছেদেই আমাদের সম্পর্ক বা একে-অপরের প্রতি অনুভূতি পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমাদের সম্পর্ক সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে উপরে। আল্লাহ স্বয়ং আমাদের একে-অপরের জন্য নির্বাচন করেছেন সেখানে এসব অনর্থক চিন্তা মাথাতেও আনবেন না। আপনি যতদূরেই থাকেন না কেন, আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা ও সম্মান ঠিক আগের মতোই থাকবে।

যদি কোন পরিবর্তন হতেই হয়, তবে সম্পর্কটা সময়ের সাথে সাথে আরও জোরালো হবে। কেননা, যেখানে মনের টান থাকে সেখানে তো অনেক বছরের দূরত্বও কিছু নয়, আমরা তো কিছুদিনের জন্য আলাদা থাকছি মাত্র। তাই আমায় ও আমাদের সম্পর্ক নিয়ে একদমই চিন্তা করবেন না। যা করতে যাচ্ছেন ভালোভাবে সেটা করে ফিরে আসুন আমার কাছে। আমি অপেক্ষায় থাকবো।

রাহিতার কথায় ও চিন্তাধারায় স্বপ্নিলের গর্ববোধ হয়। মনে মনে আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া আদায় করে তার জীবনে এমন জীবনসঙ্গী পাঠানোর জন্য। রাহিতা কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর দু’বাহু ধরে টেনে নেয় নিজের দিকে। বলিষ্ঠ হাতের দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় প্রেয়সীকে। রাহিতাও সহাস্যে জড়িয়ে ধরে স্বপ্নিলকে। কিছুক্ষণ সেভাবেই কেটে যায় একে-অপরের সান্নিধ্যে। এরপর স্বপ্নিল রাহিতাকে ছেড়ে দিয়ে ওর দু’হাত মুঠোয় নিয়ে বলে,

—আম সরি রাহি, এমন অবিবেচক কথাবার্তা মাথায় আনার জন্য। আমি আর কখনো আমাদের সম্পর্ক নিয়ে এমন চিন্তাভাবনা করবোনা। আই প্রমিস।
—ইটস ওকে। আমি কিছু মনে করিনি। আপনার ফ্লাইটের জন্য লেট হয়ে যাবে। এখন যান।
—হ্যাঁ, যাচ্ছি। ভালো থেকো, সাবধানে থেকো। আল্লাহ হাফেজ।

রাহিতাও হাত নেড়ে বিদায় জানায় স্বপ্নিলকে। বেশ কিছুদূর হেটে যায় স্বপ্নিল। রাহিতাও পেছন ফিরে গাড়ির কাছে যাওয়ার জন্য হাটতে আরম্ভ করবে। ঠিক এমন সময় হাতে টান পড়ায় পেছন ফিরে তাকায় সে। স্বপ্নিলকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দুজনের মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে রাহিতার মুখ আজলায় ভরিয়ে অতিদ্রুত এক প্রগাঢ় চুম্বন করে স্বপ্নিল। বিস্মিত রাহিতাকে অবাক করে দিয়ে হাসিমুখে ফেরত যেতে যেতে বলে,

মন বিনিময় পর্ব ৩৭ 

—আমি তোমায় অনেক মিস করবো, রাহি। সব কাজ সেরে খুব জলদিই তোমার কাছে ফিরে আসবো, আমার বউ।

মন বিনিময় পর্ব ৩৮