মন বিনিময় পর্ব ৩৮

মন বিনিময় পর্ব ৩৮
তাসফিয়া হাসান তুরফা

স্বপ্নিল চলে গেছে বহুক্ষণ। অথচ রাহিতা আগের জায়গায় ঠাই দাঁড়িয়ে, যেভাবে ছিলো ঠিক সেভাবেই। যেন একটু আগে কি হলো বুঝে উঠতে পারছেনা সে! স্বপ্নিল কি সত্যিই এত ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো নাকি সে সাত সকালে এমন আকাশকুসুম কল্পনা করেছে? বিষয়টা উপলব্ধি করতে ডান হাতে নিজের বড়সড় নখ দ্বারা চিমটি কাটলো রাহিতা।

সূচালো ব্যথা অনুভব হতেই এটা যে বাস্তব তা পরিষ্কার হলো! নিমিষেই চোখ দুটো বৃহদাকার ধারণ করলো। হুট করে কি থেকে কি হয়ে গেলো রাহিতা ভেবে পায়না! অথচ এ প্রথম স্বপ্নিলের এত কাছে আসার অনুভূতি এখনো গ্রাস করে রেখেছে ওকে। মিশ্র অনুভূতিতে স্তব্ধ রাহিতা ঠোঁটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় ড্রাইভার ফোন দেওয়ায় হুশ ফিরে আসে ওর! ফোন রিসিভ করে দ্রুতপায়ে হেটে গাড়ির কাছে চলে যায় সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

স্বপ্নিল পৌঁছে ফোন করেছে মায়ের কাছে। ও রাহিতাকেও ফোন দিয়েছিলো কিন্তু সে ইচ্ছে করেই ফোন রিসিভ করেনি। কেন করেনি তা স্বপ্নিল মনে মনে ঠিকই বুঝেছে! এয়ারপোর্টে চলে আসার আগে ও যা করেছে, তাতে নির্ঘাত ভীষণ লজ্জা পেয়েছে রাহিতা। যে লাজুক মেয়েটা! এখন তো আরও বাহানা পেয়েছে পালিয়ে বেড়ানোর, তাই ইচ্ছে করেই ওকে জ্বা’লাচ্ছে। সামনে থাকলে তো আর এটা করতে পারতোনা! স্বপ্নিল সুযোগই দিতোনা!

মনে মনে ভাবে স্বপ্নিল।
এখন ক’দিন যে রাহিতা এমন করবে কে জানে?
এভাবেই কেটে গেলো তিনদিন৷ এ ক’দিনে রাহিতা ইচ্ছে করেই স্বপ্নিলের ফোন/মেসেজ অদেখা করছে। মনে মনে সে দেখতে চাইছে স্বপ্নিল ওর জন্য ছটফট করে কিনা, সে-ও ঠিক একিভাবে ওর জন্য অস্থির হয় কিনা! অপরদিকে রাহিতার এ কাজে ভীষণ বিরক্ত স্বপ্নিল।

কোথায় সারাদিন ক্লায়েন্টদের সাথে ব্যস্ততা শেষে হোটেলে ফিরে যে একটু বউয়ের সাথে একান্তে কথা বলে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করবে, অথচ ওর বউ ওকে পাত্তাই দিচ্ছেনা। এতবার ফোন দিলো মেসেজ দিলো তবুও রাহিতা একটারও জবাব দিলোনা, এটা কি বেশি বেশি হচ্ছেনা? কেন এমন করছে সে স্বপ্নিলের সাথে? মনে মনে রাহিতার প্রতি বেশ রাগ হয় স্বপ্নিলের। যে রাগের চোটে সে আর ইচ্ছে করেই রাহিতাকে ফোন-মেসেজ দেয়না। স্বপ্নিলও দেখতে চায় রাহিতার ক’দিন ওকে এভাবে ইগ্নোর করতে পারে! দু-সপ্তাহ পর তো এমনিতেই দেশে যাচ্ছে সে। তখন একেবারে সুদে-আসলে সব ফেরত নিবে রাহিতার থেকে!

পরক্ষণেই আবার স্বপ্নিল ভাবে, একটা সামান্য কিস করাতেই যদি রাহিতা এমন করে তবে সে সামনে এগোবে কি করে? এ তো বড্ড ভাবনার বিষয়! এই লজ্জাবতীকে নিয়ে সে কি করবে? এমনই সব অদ্ভুত সব চিন্তাভাবনা করে দিন কাটে স্বপ্নিলের।

একদিকে স্বপ্নিল-রাহিতার এই লুকোচুরি প্রেম, অন্যদিকে দুজনেই একে-অপরের খোজ নিতে থাকলো দিলারা বেগমের থেকে। যা পারতপক্ষে উনার দুশ্চিন্তার পারদ আরও বাড়িয়ে দিলো। স্বামী প্রথমবার বিদেশ গেলো অথচ বউ ওর সাথে ফোনে কথা বলছেনা, আবার স্বপ্নিলও মায়ের থেকেই রাহিতার খোজ নিচ্ছে যার অর্থ দাঁড়ায় ওর নিজেরও এ ব্যাপারে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। দুজনে এভাবেই বেশ আছে। তবে কি এ দূরত্ব ওদের মধ্যকার দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে দিলো? এমন হলে তো মুশকিল! এভাবে চললে কি করে হয়? দিলারা বেগম ভেবে পাননা।

সপ্তাহখানেক পেরোনোর এক ফাঁকে দিলারা বেগম কথা বলার সুযোগ খুজছিলেন রাহিতার সাথে। আজ সুযোগ পেয়ে কাজেও লাগালেন। রাত ৮.৩০টার মতোন হবে। সামিরা পড়ছে আর রাহিতা পড়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছিলো। এমন সময় তেলের বাটি নিয়ে রুমে চলে এলেন দিলারা বেগম। শাশুড়িকে আসতে দেখে উঠে বসে রাহিতা। উনার হাতে তেলের বাটি দেখে বলে,

—মাথায় তেল দিবেন, মা? দিয়ে দেবো?
—না রে। রহিমা ঘুমানোর আগে দিয়ে দেবে আমায়। আমি তো এখন তোর মাথায় দিয়ে দেবো বলেই তেল গরম করে আনলাম।
উনার কথায় রাহিতা হাসে। হাসিমুখেই নম্র সুরে বলে,

—কেন এত কস্ট করতে গেলেন, মা? আমি একাই দিতাম পরে।
—এটাতে আবার কিসের কস্ট? তুই আমার একমাত্র ছেলের বউ। তোর জন্য এটুক করতেই পারি নাকি? আয় বোস এখন। আমি খাটে বসছি।

এবার আর না করতে পারেনা রাহিতা। বলাবাহুল্য, শাশুড়িকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে সে। তার এত মায়াময় কথায় সে কখনোই মানা করতে পারবেনা! তাইতো চুপচাপ বসে পড়ে পেছন ফিরে, দিলারা বেগমের সামনে। তেল দেওয়ার ফাকে ফাকেই টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছিলো দুজনের। এমন সময় প্রসঙ্গ বুঝে হঠাৎ দিলারা বেগম বলেন,
—আচ্ছা রাহি, একটা কথা বল তো!
—হ্যাঁ, বলুন না মা।

—তোর লাস্ট কবে স্বপ্নিলের সাথে কথা হয়েছিলো রে? না মানে আমি কাল রাতে কথা বলেছি তো। ছেলেটা আজ ফোন দিলোনা সারাদিন একবারও। কি করছে কে জানে? তোর সাথে কথা হয়েছে রে?
শাশুড়ির কথায় শুষ্ক ঢোক গিলে রাহিতা। মনে মনে ভাবে সে কি করে বলবে তার সাথে স্বপ্নিলের শেষ কথা হয়েছিলো যেদিন স্বপ্নিল দেশ ছেড়েছে সেদিনই। আর ওইদিন ওদের মাঝে যা হয়েছে তারপর থেকেই যে সে ইচ্ছে করে স্বপ্নিলের সাথে কথা বলছেনা, ওকে জ্বা’লাচ্ছে এটা তো আর শাশুড়িকে মুখে বলা যাবেনা তাইনা! রাহিতা পড়লো দোটানায়। একদিকে শাশুড়িকে মিথ্যে বলতে সায় দিলোনা মন, অপরদিকে সত্যটা বলার মতো ঠোঁটকাটা সে নয়। তাই কথা পাল্টাতে কোনোমতে সে বললো,

—আজকে ফোন দিয়েছিলাম উনাকে। ধরেননি ফোন। হয়তো খুব ব্যস্ত। আপনি চিন্তা করবেন না, মা। ফ্রি হলে তিনি ঠিকই ফোন দিবেন।
—ওহ। এটা হতে পারে৷ এখন এক কাজ কর তো। ফোন দে স্বপ্নিলকে। দেখি এখন ধরে কিনা। আমার ফোন তো রুমে রেখে এসেছি। তোরটা থেকেই দে তো।

দিলারা বেগমের কথায় রাহিতা পড়ে বিপাকে। এই যে সে খুব সন্তপর্ণে সপ্তাহখানেক ধরে স্বপ্নিলকে এড়িয়ে চললো, এরপর এখন হঠাৎ করে কিভাবে ফোন দিবে? কিন্তু রাহিতার ভাবনা ওর মনের মাঝেই চাপা পড়ে গেলো, কেননা দিলারা বেগম বারবার তাগিদ দিতে লাগলেন ওকে ফোন দেওয়ার। শেষমেশ রাহিতা একপ্রকার বাধ্য হয়েই ফোন হাতে নিলো। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে ভাবলো, স্বপ্নিল যে রেগে আছে ওর উপর! ফোন তো ধরবেনা নিশ্চিত। তাই এ রিস্ক নেওয়াই যায়। এরপর কল কেটে গেলে শাশুড়িকে বলে দেবে ফ্রি আছে তাই ধরছেনা ফোন।

মনে মনে নিজের নির্বোধ ভাবনায় হেসে রাহিতা মেসেঞ্জারে কল দিলো স্বপ্নিলকে। কিছুক্ষণ টুংটুং করে রিং হলো, বুঝা গেলো স্বপ্নিল অনলাইনে আছে। শ্বাসরোধ করে স্বপ্নিলের ফোন না ধরার অপেক্ষায় রইলো রাহিতা এবং খানিকবাদে ওর ধারণাই সঠিক প্রমাণ হলো। স্বপ্নিল ফোন ধরেনি। ফোস করে এক শ্বাস ফেলে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে রাহিতা বললো,
—উনি তো ফোন ধরলেন না, মা। হয়তো বাইরে আছেন। আপনি টেনশন করেন না। পরে কথা হবে।

দিলারা বেগম রাহিতার সামনে মাথা নাড়লেও মনে মনে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন। নির্ঘাত বড়সড় কোনো ঝামেলা হয়েছে স্বপ্নিল-রাহিতার মাঝে। নয়তো দুজন এভাবে দুজনকে ইগ্নোর করতোনা। এই যে রাহিতা প্রথমে ফোন দিতে চাইছিলোনা, পরে আবার স্বপ্নিল ইচ্ছে করেই ওর ফোন ধরলোনা এটাও তিনি ঠিকি বুঝলেন। অতএব তার ধারণা ঠিক। অতঃপর কি করবেন ভাবতে লাগলেন! এভাবেই এক মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তা নিয়ে রুম ত্যাগ করলেন তিনি। হাফ ছেড়ে বাচলো রাহিতা নিজেও!

গভীর রাত। নিভৃতে ঘুমোচ্ছে রাহিতা। এরই মাঝে কর্কশ শব্দে ফোন বেজে উঠে। চমকে উঠে ঘুম থেকে জাগে রাহিতা। ফোন হাতে নিতেই দেখে স্বপ্নিল ফোন করছে। তা দেখে একপলক ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে নেয় রাহিতা। এতদিন মনের বিরুদ্ধে যেয়ে স্বপ্নিলকে ইগ্নোর করলেও আজ এ মাঝরাতে স্বপ্নিলের ফোন আর উপেক্ষা করতে পারলোনা সে! বুকের মাঝে ছলাৎ করে উঠলো রক্ত, একরাশ বাজে চিন্তা ভর করলো মাথায়। সেদিনের পর থেকে তো স্বপ্নিল আর ফোন দেয়নি ওকে একবারো। তবে আজ এ সময় ফোন দিলো কেন? স্বপ্নিল ঠিক আছে তো? ওর কিছু হলোনা তো! ব্যস্ত হাতে দ্রুতভংগিতে রাহিতা ফোন রিসিভ করে। অস্থির কণ্ঠে বলে,

—হ্যালো?
কিছুক্ষণ অতিক্রম হয়। ওপাশ থেকে স্বপ্নিলের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়না। মাঝেমাঝে গাড়ির আওয়াজ আসে শুধু। এবার রাহিতার বুক কাপে। একরাশ বাজে চিন্তায় ঘেমে যায় সে। স্বপ্নিল কথা বলছেনা কেন? সে ঠিক আছে তো? মনে মনে নিজেকে হাজারো গালি দিতে থাকে এতদিন স্বপ্নিলকে ইগ্নোর করার জন্য। বুকে ভয়, চোখে পানি নিয়ে কম্পিত কণ্ঠে পুনরায় শুধায়,

—হ্যালো, আপনি কথা বলছেন না কেন? শুনতে পারছেন? স্বপ্নিল, আপনি ঠিক আছেন?
রাহিতার ক্রন্দনরত কণ্ঠে কাজ হয়। এবার ফোনের ওপাশ থেকে স্বপ্নিলের আওয়াজ ভেসে আসে কানে,
—ঠিক রেখেছো যে থাকবো?

স্বপ্নিলের কণ্ঠ শুনে রাহিতার ভয় কাটে। এতক্ষণের চিন্তাভাবনা সব জানালা দিয়ে পালায়। এতদিন পর প্রিয়তমের কণ্ঠ শুনে কলিজা ঠান্ডা হয় রাহিতার। আবেগে ভাসে সে, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না থামায়। দু-একবার ওর নাক টানার আওয়াজ শুনা যায় শুধু। স্বপ্নিল এখনো নিশ্চুপ। রাহিতা ভাবলো স্বপ্নিল হয়তো আর কথা বলবেনা ওর সাথে, ঠিক সে সময় স্বপ্নিলের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ওর হৃদয় এফোড় ওফোঁড় করে দেয়।

—খুব সাহস বেড়েছে তোমার তাইনা? বড্ড বেশি বেশি করেছো এ কয়দিন! আমায় ইগ্নোর করেছো, তাইনা? শুধু দেশের বাইরে জরুরি কাজে আটকে আছি বলে কিছু বলছিনা। একবার শুধু দেশে ফিরতে দাও আমায়, আই স্যোয়ার রাহি, সব সাহস বের করে দিবো তোমার। জাস্ট একবার হাতের নাগালে পাই তোমায়, তারপর…
স্বপ্নিল থামে। ওর কথার তেজে রাহিতা বিষম খায়। নিজেকে সামলে কোনোভাবে শুধায়,

মন বিনিময় পর্ব ৩৭ শেষ অংশ

—তারপর?
—খে’য়ে ফে’লবো তোমায়!

মন বিনিময় পর্ব ৩৯