মন বিনিময় পর্ব ৭

মন বিনিময় পর্ব ৭
তাসফিয়া হাসান তুরফা

সময় ও স্রোত কারও জন্য থেমে থাকেনা, কেটে যায় চোখের পলকে। হলোও ঠিক তাই! দেখতে দেখতেই স্বপ্নিল ও রাহিতার জীবন থেকে চলে গেলো আরও সপ্তাহ কয়েক সময়। বিয়ের প্রায় মাসখানিক হতে চলার পরেও স্বপ্নিল এখনো রাহিতার সাথে খুব বেশি সহজ হতে পারেনি। একটু একটু হয়েছে। তবে সে যে চেস্টা করেনি, তা নয়।

স্বপ্নিল চেস্টা করেছে, অনেক চেস্টা করেছে কিন্তু কেন যেন কোনোভাবেই মানিয়ে নিতে পারছেনা রাহিতার সাথে৷ বারবার মেয়েটার দিক তাকালে ওর মনে এক অদ্ভুত মায়ার জোয়ার সৃষ্টি হয় কিন্তু এক অজানা বাধায় সে জোয়ারে ভাসতে পারেনা সে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

যার ফলশ্রুতিতে অপরাধবোধ আরও মাথা চেপে বসে এবং নিজের প্রতি জন্মানো ক্ষোভ মনের অজান্তে মাঝেমধ্যেই সে রাহিতার উপর ঝাড়ে! রাহিতাও কম যায়না, কখনো ধৈর্য ধরে তো কখনো ওকে ঠিকই উচিত জবাব দিয়ে ছাড়ে। তবে এতদিন তাদের কক্ষের চার দেয়ালের মাঝে এসব ঝগড়াঝাঁটি হলেও গতকাল ঘটে গেছে এক ভিন্ন ঘটনা।

অফিস থেকে বাসায় আসছিলো স্বপ্নিল, বাসায় আসার আগে থেকেই কোনো এক কারণে সে অন্যমনস্ক ছিলো। যার ফলে এক প্রকার ছন্নছাড়ার মতো ঘরে প্রবেশ করে সে কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত বাড়ি এসে ওই রাগ সে ঝেড়ে ফেলে রাহিতার উপর! সে তো ভালোমনে এসেছিলো ক্লান্ত স্বপ্নিলকে চা দিতে কিন্তু উল্টো তাকেই যে এভাবে স্বপ্নিলের রাগের শিকার হতে হবে তা মোটেও ভাবতে পারেনি মেয়েটা।

বলাবাহুল্য, আজ স্বপ্নিলের রাগটা একটু বেশিই ছিলো যার কারণে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার আগেই এক ঝটকায় রাহিতার হাত সরিয়ে দেয় সে এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই কাপ উল্টে চা পড়ে যায় রাহিতার হাতে! হঠাৎ এমন আক্রমণে ব্যথায় কুকড়ে উঠে মেয়েটা, মুখ ফসকে বের হয় আর্তনাদ! কিন্তু স্বপ্নিল যেন আজ নিজের হুশে নেই, কি করছে না করছে কিছুই জানেনা! সেভাবেই ইগ্নোর করে উঠে চলে গেলো সেখান থেকে। যেন কোনোদিকেই কোনো ধ্যানজ্ঞান নেই তার আজ!
স্তম্ভিত রাহিতা কিছু বলার ভাষাও খুজে পেলোনা! এতদিন তো কখনো স্বপ্নিল এমন আচরণ করেনি ওর সাথে!

কোনোভাবেই আঘাত করেনি তাকে তবে কেন আজ তাকে ভুলবশত ব্যথা দিয়ে সেটা না দেখেই এভাবে অদেখা করে চলে গেলো? ওর ভালো থাকা না থাকায় কি তবে কোনো যায় আসেনা তার? দুর্বিষহ মনে ভাবতে থাকে রাহিতা! বেচারির এমনিতেই আজ ভীষণ মন খারাপ ছিলো সকাল থেকে, তার মধ্যে হুট করে কোনো কারণ ছাড়াই স্বপ্নিলের এমন আচরণ ওর কিছুতেই বোধগম্য হলোনা।

মনের কস্টগুলো আর মনে লুকিয়ে রাখার ইচ্ছেও হলোনা। হাতে কোনোপ্রকার মলম বা কিছু না লাগিয়েই নির্জন কক্ষের মেঝেতে বসে হঠাৎই হুহু করে কেদে উঠলো সে! আজ চোখের পানিগুলো যেন কিছুতেই বাধা মানছেনা তার! ঠিক এমন সময় ওকে অবাক হয়ে দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সামিরা। হাস্যোজ্জ্বল সে দরজা খোলা পেয়ে হেলেদুলে রুমে ঢুকে রাহিতাকে এভাবে কাদতে দেখে বিস্ময়ের চুড়ায় পৌঁছে গেলো! এক ছুটে এগিয়ে এসে পাশে বসে পড়লো রাহিতার। আঁজলায় মুখ তুলে নিয়ে চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

—ভাবী, কি হয়েছে তোমার? কাদছো কেন এভাবে?
আচমকা ননদকে এসময় রুমে দেখে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ রাহিতা কাদতে ভুলে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। বহুকস্টে নিজেকে থামিয়ে আমতা আমতা করে বললো,

— তু-তুমি এখানে? আসলে হাতে চা পড়েছে তো তাই কাদছিলাম ব্যথায়।
হাতের ব্যথাকে অজুহাত করে বোনের সামনে ভাইয়ের খারাপ আচরণের কথা লুকোলো সে। কিন্তু এতেও কাজ হলোনা। বরাবর চঞ্চল সামিরাকে অত্যন্ত শান্ত দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ ওর লালচে হওয়া হাতের দিক তাকিয়ে সে নিশ্চুপ কণ্ঠে বললো,
—ভাইয়া করেছে এটা, তাই না?
চমকে উঠে ওর দিক তাকায় রাহিতা। সামিরা ধরে ফেলেছে তবে! এ সত্যকে এখন কিভাবে ধামাচাপা দেবে ভাবার আগেই সামিরা আবারো বললো,

—কি হলো, ভাবী? চুপ করে আছো কেন? স্বপ্নিল ভাইয়াই করেছেনা? ঠিক বলছি তো আমি?
—সামিরা, আসলে আ-আমি…
—আমার থেকে কিছু লুকোনোর প্রয়োজন নেই, ভাবী। আমি তোমাদের রুমে আসার আগে ভাইয়ার চিল্লানোর আওয়াজ পেয়েছিলাম বাইরে থেকে।

একান্তই তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে চুপচাপ কেটে পড়ছিলাম। এরপর তোমার চিল্লানোর আওয়াজ শুনে আর ভাইয়াকে বের হতে দেখে ভেবেছি তুমি ভাইয়াকে চুপ করিয়েছো। তাইতো হেসে হেসে আসছিলাম এখানে। কিন্তু তোমায় এভাবে কাদতে দেখে আর তোমার হাত দেখে এখন যা বুঝার সব বুঝা হয়ে গেছে আমার! তাই বলছি আমার থেকে এখন অন্তত কিছু লুকিয়োনা প্লিজ।

হতাশ মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম সুরে করুণ চোখে রাহিতার গালে হাত রেখে বললো সামিরা। এতক্ষণ চুপ থাকলেও বোন সমতুল্য ননদের এমন নরম কথায় ও তার সব জেনে যাওয়ায় নিজের অবাধ্য অনুভূতিগুলো আর দমিয়ে রাখলোনা রাহিতা। এতদিন যা সে কারও সামনে করেনি, নিজের কাছাকাছি বয়সী সামিরার সাথে অনায়েসেই তা করে ফেললো।

ওকে জড়িয়ে ধরে প্রকাশ করলো নিজের মনের লুকায়িত সব দুঃখ! খুলে বললো এতদিন মনের মাঝে জমে থাকা সব কস্টের ঝুলি, নিজের মনকে হালকা করতে এটুকু যে আজ তার করতেই হতো! এতদিন রাহিতার প্রতি স্বপ্নিলের ঠান্ডা আচরণ টুকটাক লক্ষ্য করলেও তার আজকের আচরণ দেখে অবাক না হয়ে পারলোনা সামিরা নিজেও! নিজ ভাইয়ের প্রতি রাগে ও রাহিতার সাথে তার করা এসব আচরণ শুনে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেলো তার!

মেয়েটাকে কিভাবে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পেলোনা সে! রাহিতা বয়সে যে খুব বড় তাও না, ওর চেয়ে বছর দুয়েক বড় হবে হয়তো৷ কিন্তু এরই মাঝে মেয়েটার জীবনে কেমন সব ঝড়-ঝঞ্ঝা চলছে তা বেশ ভাবিয়ে তুলে সামিরাকে! ফলশ্রুতিতে রাহিতাকে সান্ত্বনা দিতে যেয়ে কখন যে তার নিজের চোখের কোণে জল জমেছে সেটাও বোধগম্য হয়না সামিরার! নিজেকে প্রস্তুত করে কোনোমতে কান্নারত রাহিতার উদ্দেশ্যে বললো,

—কাদেনা, ভাবী। শান্ত হও প্লিজ। জানিনা তোমায় কি বলে সান্ত্বনা দেওয়া উচিত কিন্তু আমি সত্যিই ভাবতে পারছিনা ভাইয়া এরকম কিছু করবে। আমি..
আর কিছু বলার আগেই কোনো একদিক চেয়ে থেমে গেলো সামিরা। হঠাৎ ওর থেমে যাওয়ায় ওর দিক চোখ ঘুরাতেই তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো রাহিতা নিজেও! দরজার কাছে ওর শাশুড়ি দাঁড়িয়ে আছেন। আর উনি যে এতক্ষণ তাদের দুজনের কথা শুনেছেন তা উনার লালচে হয়ে যাওয়া ফর্সা চেহারায় স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে।

রাহিতা-সামিরার দৃষ্টি বিনিময়ের মাঝেই রুমে প্রবেশ করলেন দিলারা বেগম। রাগের আভা ঠিকরে বের হচ্ছে তার মুখ থেকে। ছলছল নয়নে তার দিক তাকিয়ে ইতস্ততভাবে রাহিতা কিছু বলতে যাবে তখনি হুট করে এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেন দিলারা বেগম।

মাতৃতুল্যার স্নেহের পরশ পেয়ে যেন এতক্ষণের সব কস্ট-অভিমান পুনরায় জেগে উঠে রাহিতার! নিজেকে আর থামিয়ে না রেখে কস্টগুলোকে ঝড়তে দিলো মায়ের আঁচলে! কিছুক্ষণ কাদার পর সে খানিকটা শান্ত হতেই চোখের ইশারায় মেয়েকে পানি এগিয়ে দিতে বললেন দিলারা বেগম। সামিরা পানি এগিয়ে দিতেই রাহিতাকে খাটে বসিয়ে পানি খেতে দিলেন তিনি। ঢক ঢক করে পানি খেয়ে খানিকটা শান্ত হয়ে গেলো মেয়েটা। অতঃপর শাশুড়ির দিক তাকিয়ে নত মস্তকে বললো,

—মা, আমি বুঝতে পারছিনা উনার কি হয়েছে। হঠাৎ করে আজ তার কি হলো? এ কয়দিনে তো খানিকটা সহজ হচ্ছিলেন কিন্তু আজ কেন যে এভাবে…
—কাদিস না, মা। তুই শান্ত হ। আমায় কিচ্ছু বুঝাতে হবেনা তোর। যা বুঝার আমি বুঝে গেছি।
—মানে?

—মানে আর কি? স্বপ্নিল যে এখনো তোকে মেনে নিতে চাচ্ছেনা তা বেশ বুঝতে পারছি। আমি তো ভেবেছিলাম হয়তো একটু একটু করে তোকে মেনে নেওয়া শুরু করেছে স্বপ্নিল, কিন্তু এখন তো দেখছি আমার গর্দভ ছেলের চাকা ওই এক জায়গাতেই আটকে আছে! তবে ওর আজকের আচরণ আমি একদমই আশা করিনি স্বপ্নিলের থেকে! আমি তো কখনো ওকে এমন শিক্ষা দেইনি, তবে ও কি করে পারলো নিজের বউকে আঘাত করতে? রাগের বশে যা ইচ্ছা তাই করবে নাকি? তোকে বিয়ে করেছে বলে আঘাত করার অধিকারও পেয়েছে নাকি ও?

রাগের চোটে ফুসে উঠে বললেন দিলারা বেগম। রাহিতা চুপচাপ বসে থেকে দেখলো তাকে। নিজের ছেলের আচরণে তিনি কতটা অনুতপ্ত তাকে দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু স্বপ্নিল যে এটা ইচ্ছা করে করেনি, অন্যমনস্কভাবে করেছে তা বুঝতে পারছেন না দিলারা বেগম। তাই ধীর স্বরে রাহিতা বলে উঠে,

—মা, উনি ইচ্ছা করে আমার হাতে চা ফেলে দেন নি। রাগের বশে হাত সরাতে গিয়ে ধাক্কা লেগে চা পড়েছে..
—তুই চুপ কর! তোকে কথা বলতে বলেছি আমি? বললামই তো স্বপ্নিলের পক্ষে আর একটাও কথা বলা লাগবেনা তোর৷ নির্লজ্জটা যে এসব কাণ্ড ঘটিয়ে কোথায় চলে গেছে আল্লাহই জানে। আর এতকিছুর পরেও তুই ওর পক্ষে সাফাই গাইছিস? ভাগ্য করে তোর মতো পেয়েছে অসভ্যটা। কিন্তু দাত থাকতে দাতের মর্যাদা বুঝতে পারছেনা!
আফসোসের সুরে বললেন দিলারা বেগম। তাদের দুজনের দিক চেয়ে সামিরা ধীর স্বরে বলে উঠলো,

—ভাইয়া কোথায় গেলো? এখন তাহলে কি হবে, মা? তুমি কথা বলবে ওর সাথে?
—বলবোনা মানে? একশবার বলবো। ওর সাহস কি করে হয় রাহিতার সাথে এমন করার! বাসায় আসতে দে ওকে, আমি দেখছি হতচ্ছাড়াটাকে! আর রাহি, তুইও আর বসে থেকে হাতের ব্যথা লুকিয়ে সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো ওর জন্য না কেদে চুপচাপ হাতে মলম লাগিয়ে নে। সামি ওকে লাগিয়ে দিস তো মলম। আমি একটু আসছি!
কথাগুলো বলেই গটগট করে রুম থেকে বের হয়ে গেলেন দিলারা বেগম। কাঠপুতুলের ন্যায় সেদিক চেয়ে রইলো রাহিতা ও সামিরা দুজনই!

রাত করে স্বপ্নিল চলে এলো বাসায়। এ সময় সবার খাওয়াদাওয়া করে ঘুমানোর কথা। অথচ এ সময় ড্রয়িংরুমের সোফায় মা কে বসে থাকতে দেখে খানিকটা অবাক হলো সে। একিসাথে কড়াচোখে ওর দিক তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা বিব্রতও হলো বটে! মায়ের গম্ভীর গলায় তার দিক তাকায় সে।

—এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
—একটু বাহিরে ছিলাম, মা।
—ঘরে বউকে রেখে বাহিরে অযথা সময় কাটাতে খুব ভালো লাগে তোর, তাই না?
মায়ের এহেন কথায় চোখ তুলে তার দিক একবার তাকিয়ে পুনরায় মাথা নামিয়ে ফেললো স্বপ্নিল। রেগে উঠে দিলারা বেগম পুনরায় বললেন,

—এসবই যদি করার ইচ্ছে ছিলো তবে বিয়ের আগে আমায় বলিসনি কেন? বউকে কখনো মেনে নিবিনা, বউয়ের সাথে থাকতে চাইবিনা, অযথাই ওকে আঘাত করবি এসব আমায় বললেই হতো। তাহলেই তো বিয়ের জন্য জোর করতাম না তোকে, অযথা তোর জন্য একটা মেয়ের জীবনটাও এভাবে নস্ট হতোনা!
—মা…

মায়ের কঠিন স্বরের বিপরীতে আহত কণ্ঠে ডেকে উঠলো স্বপ্নিল। তার মা সচারাচর তার সাথে এভাবে কথা বলেননি কখনো, এমনকি বিয়ের আগে যখন সে আনিকার জন্য সু’ইসাই’ড করতে যাচ্ছিলো তখনো প্রচণ্ড রেগে গেলেও এভাবে ধমকিয়ে কথা বলেননি দিলারা বেগম তার সাথে। স্বপ্নিল বুঝে গেলো তখন রাহিতাকে ও অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যেয়ে সে ঠিক করেনি, এটা হয়তো কোনোভাবে তার মায়ের চোখে পড়েছে৷ যার কারণেই প্রচন্ড রেগে আছেন তিনি! নয়তো রাহিতা এসব কথা বাহিরে বলার মতো মেয়ে না, এতদিনে বেশ ভালোভাবেই তাকে চিনে গেছে স্বপ্নিল!

—এখন মা বলছিস কেন? তোর মা কি তোকে এমন শিক্ষা দিয়েছে? জানিস মেয়েটার চোখে জল ছিলো তোর জন্য, তবুও মুখ ফুটে একবারো তোর বিরুদ্ধে কোনো নালিশ করেনি সে। অথচ তুই? তুই তো দিব্যি ওর কথা ভুলে রাত-বিরেতে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! লজ্জা করলোনা তোর একটাবার?
—আমি তখন ইচ্ছে করে ওমন করিনি, মা। ওটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিলো, আমার হাত লেগে রাহিতার হাতে চা পড়েছিলো কিন্তু তুমি এটার জন্য আমায় ভুল বুঝলে।

—যদি ইচ্ছাকৃতভাবে না-ই করিস তবে কেন ওকে ফেলে রেখে গেলি তখন? ওর কি কস্ট হয়না? তুই দেখিস না?
—এটাই তো প্রব্লেম, মা। তুমি শুধু ওর কস্টটাই দেখো। আমার কস্ট? সেটা কি একটাবারও ভেবে দেখেছো, মা? আমি কিভাবে আছি সেটা দেখার প্রয়োজন মনে করোনা একবারও? আমাকে কি মানুষ মনে হয়না, মা? আমার অনুভুতিগুলোর কি? আমি আর নিতে পারছিনা এসব। না পারছি সব ছেড়ে চলে যেতে আর না পারছি ধরে রাখতে! আমাকে মুক্তি দেও এসব থেকে…

পুনরায় স্বপ্নিলের মুখে মুক্তির কথা শুনে এবার নিজের উপর থেকে কাবু হারিয়ে ফেললেন দিলারা বেগম। আচমকা ঠা’শ করে চ’ড় লাগিয়ে দিলেন ছেলের গালে! জীবনে প্রথমবার মায়ের হাতে চ’ড় খেয়ে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নিল! সামিরা ও রাহিতা মাত্র তখন সিড়িতে এসে দাঁড়িয়েছে!

বলাবাহুল্য সকলের সামনে এভাবে চড় পড়ায় রাগে-অপমানে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার! ঘাড় ঘুরিয়ে একবার সিড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা রাহিতার দিকে তাকালো সে। লালচে হওয়া সে চোখের দৃষ্টি দেখে ঘাবড়ে গেলো রাহিতা! যে আদরের ছেলেকে কখনো ধমক দিয়েও কথা বলেননি দিলারা বেগম তাকে আজ ওর জন্য চড় খেতে হলো! ইশ। এবার নির্ঘাত স্বপ্নিল ওকে আরও ঘৃণা করবে! এটা ভেবেই চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো রাহিতার।

—বারবার মুক্তি চাস কেন, স্বপ্নিল? কেন চলে যেতে চাস, বাবা? আমাদের কি ভালো লাগেনা তোর? যে তোকে ছেড়ে চলে গেছে তার জন্য বাকি সবাইকে কস্ট দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত আমাকে বুঝা! আনিকা তোকে ছেড়ে গেছে এটাতে তোর কি দোষ? আমার কি দোষ? রাহিতার কি দোষ? নিজের সাথে সাথে আমাদেরও কেন তুই এভাবে কস্ট দিচ্ছিস? জবাব দে আমায়!

স্বপ্নিল এবার কিছু বললোনা। শান্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিক তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। অতঃপর চুপচাপ বের হয়ে গেলো বাসা থেকে। দিলারা বেগম সেদিক তাকিয়ে একবার কিছু বলতে গিয়েও বললেন না! আজ হয়তো আবেগের বশে ছেলেটাকে একটু বেশিই বলে ফেলেছেন এই ভেবেই তৎক্ষণাত অপরাধবোধ জন্মালো তার মনে! কিন্তু এই আঘাতটা দেওয়া দরকার ছিলো স্বপ্নিলকে। নয়তো সে উপলব্ধি করবেনা তার আচরণের কিরুপ প্রভাব পড়ছে তার সাথে জড়িত বাকিদের জীবনে!
স্বপ্নিল চলে যেতেই পুনরায় সোফায় বসে পড়লেন দিলারা বেগম। কপালে হাত ঠেকিয়ে ব্যথিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,

—আজ আমি জীবনে প্রথমবার হাত উঠিয়েছি আমার ছেলের উপর! ওর কস্ট দেখে বুকটা ফেটে গেলেও তখন রাগের বশে কখন মেরে বসেছি নিজেও টের পাইনি রে, মা। ছেলেটা আমার এমনিতেই কস্টে আছে, এখন তো নির্ঘাত আমার উপরেও অভিমান করবে। আমার জন্যই বিয়েটা করলো আর আমার থেকেই এতকিছু শুনলো! কিন্তু আমিও বা কি করবো, বল? ওর কস্ট আর সহ্য হচ্ছিলোনা আমার।

আনিকার মারা যাওয়ার পর আমি কাছে থেকে দেখেছি ওকে কস্ট পেতে। প্রতিদিন রাতে ওর ছাদে একা একা কাটিয়ে দেওয়া, ওর লালচে চোখ আর ছাদে পড়ে থাকা সিগারেটের টুকরোগুলো আমায় রোজ মনে করিয়ে দিতো আমার ছেলেটা কতটা নিঃসঙ্গতায় ভুগছে! তাইতো মা হিসেবে ওর জন্য তোকে একটা সঙ্গী নিয়ে আসি আমি! এটা কি আমার ভুল ছিলো বল? কিন্তু ছেলেটা আমার বুঝলোনা। এমনিতেই আমার উপর চাপা অভিমান ছিলো ওর, আজ হয়তো অভিমানের পাল্লাটা আরও ভারী করে দিলাম আমি!

মন বিনিময় পর্ব ৬

শাশুড়ির মুখে এসব শুনে জলে চোখ টইটম্বুর হলো রাহিতার। পাশে দাঁড়ানো সামিরারও একি দশা! সে নিজেও যে তার ভাইয়ের এহেন করুণ দশার সাক্ষী, তাইতো চেয়েছিলো রাহিতাকে মেনে নিয়ে সুখে থাকুক তার ভাই! কিন্তু এখন যেন পপরিস্থিতি আরও জটিল রুপ ধারণ করলো? কারও কোনো দোষ নেই, সকলেই যে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিস্থিতির শিকার! ফলশ্রুতিতে সবাই একে-অপরকে ভুল বুঝছে! এ ভুল বুঝাবুঝির তবে জট খুলবে কবে? ভাবার বিষয়!

মন বিনিময় পর্ব ৮