মম চিত্তে পর্ব ৫

মম চিত্তে পর্ব ৫
সাহেদা আক্তার

জয়ীতা চাচি মহিলাকে নিয়ে চলে গেছেন। মমর সাথে মাধুরী খালাকে নিয়ে একপ্রকার তর্ক হয়ে গেছে তাঁর। চা দেওয়ার কথাটা জয়ীতা চাচি মেকি হাসি দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার পর মাধুরী খালা জিজ্ঞেস করতে এসেছিলেন আজকে কি রান্না হবে। মম তাকে সোফায় ওর সাথে বসতে বলেছিল। তাতেই জয়ীতা চাচির ঘোর আপত্তি। কাজের লোক কেন তাদের সাথে বসবে। মম জিজ্ঞেস করল, কাজের লোকেরা আমাদের থেকে কোন দিক দিয়ে ভিন্ন? জয়ীতা চাচি বললেন, সবার জায়গা সমান নয়। কাজের লোকদের মাথায় উঠাতে নেই। মম মাধুরী খালাকে টেনে এনে কাছে দাঁড় করিয়ে বলল, এসব পুরান কথা চাচি। তুমি তো মাধুরী খালাকে চেনোই। ছোটবেলা থেকে আমাদের সাথে আছেন। খালাখালু দুজনেই ভালো মানুষ। জয়ীতা চাচি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, তাই বলে সবাইকে মাথায় তুলতে হবে? কোনদিন তোদের উপর ছড়ি ঘোরাবে দেখিস। খালি তোর বুড়ো বাপটা পটল তুলুক। এবার মমর বেশ গায়ে লাগল। এতক্ষণ সম্মান দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছিল। যে মানুষ অন্যকে সম্মান দিতে জানে না তাকে সম্মান করাটাও অযৌক্তিক।

– এজন্যই আপনার কাজের লোকগুলো একমাসের বেশি টেকে না চাচি। মাধুরী খালাকে তো আমি খালা ডাকি। খালা মানে তো মায়ের বোন। তাহলে কি দাঁড়ালো? মাধুরী খালা আমার আম্মুর বোন। তাই না চাচি?
মম হাসি মুখে মাধুরী খালার দিকে তাকিয়ে হাতটা ধরে জোর করে বসালো। তিনি অসহায়ের মতো ওর দিকে তাকালেন। জয়ীতা চাচি এতে অপমানিতবোধ করলেন। “মেয়েটা পুরোই মার মতো হয়েছে। এজন্যই বিয়েটা ভেঙে গেছে৷ চলেন ভাবি, এমন মেয়েকে আপনার ঘরের বউ করার দরকার নেই।” জয়ীতা চাচি এই বলে মহিলাকে নিয়ে উঠে চলে গেলেন। তাঁর কথার ভাঁজে মম বুঝতে পারল জয়ীতা চাচি ওর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল। মাধুরী খালা করুণ দৃষ্টিতে মমর দিকে তাকালে সে একটা সুন্দর হাসি দিল।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

দুপুরের দিকে একটা ফোন এল। মম ফোন নাম্বাটা চিনতে পারল না। অচেনা নাম্বার। ফোন ধরে হ্যালো বলতে একটা মেয়ের কন্ঠ ভেসে এল অপরপাশ থেকে। বলল, কেমন আছিস মম? কন্ঠস্বর চিনতে পেরে বলল, এতদিন পর! কোত্থেকে এলি? আমার কথা তো একটুও মনে পড়ে না। তা আতাবানুর কি খবর? মেয়েটা রাগ করার ভাণ করে বলল, এতদিন পর ফোন করলাম ফের আতা বলে মজা করছিস? মম হেসে বলল, সরি সরি, আদ্রিতা। হয়েছে? এখন বল কি খবর? শুনেছিলাম বিয়ে করে সেটেল হয়ে গেছিস অথচ বিয়ের দাওয়াত দিসনি।
– তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা হয়েছিল। ওর বিদেশে যাওয়ার ডেট কাছে ছিল তাই। তোর কথা খুব মনে পড়ছিল কিন্তু তোর নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছিলাম।

– তা এখন কি করে পেলি?
– স্বপ্নার কাছে।
– ওর সাথে তোর যোগাযোগ আছে?
– হুম। বেচারিও জামাই বাচ্চা কাচ্চা পালতে পালতে হিমসিম খাচ্ছে।
– বিয়ে করেছে তাহলে! কলেজে থাকতে তো বলছিল বিয়ে করব না বিয়ে করব না। শেষমেশ করেই নিল।
– হুম, তোর কি অবস্থা? বিয়ে করিসনি?
– হয়েছিল কিন্তু এখন সিঙ্গেল।
– মানে!? বিয়ে হলে সিঙ্গেল কেন?
– ডিভোর্স ইস্যু। তা কই তুই?

– আজকে দেশে এসেছি। কাছেই একটা হোটেলে উঠেছি আপাতত। আমার শরীরটা ভালো লাগছিল না৷ ভাবলাম বিশ্রাম নিয়ে বিকালের দিকে বাড়ি যাবো।
– তাহলে তো তোর সাথে দেখা করা লাগছে।
– তাহলে সন্ধ্যার দিকে আমাদের বাড়ি চলে আয়। আজকে থাকবি। আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।
– নারে। কালকে অফিস আছে।
– চাকরি করছিস?
– হ্যাঁ, নতুন জয়েন করেছি। তাহলে আমাকে হোটেলের ঠিকানাটা দিয়ে দে। আমি দুপুরে খেয়ে বের হবো।
– ওকে। আচ্ছা শোন তোর ফেসবুক আইডিটা দে তো। এড হয়ে নিই। পরে তাহলে ফোন নাম্বার না থাকলেও যোগাযোগ করতে পারব।

– ফারিহা আফরিন মম। সার্চ দিলেই পেয়ে যাবি।
– একমিনিট,…… পেয়েছি। রিকুয়েষ্ট দিয়েছি একসেপ্ট করিস।
– আচ্ছা, তাহলে রাখ। আমি রান্না বান্না করে খেয়ে বের হই।
– ওকে, ভালো থাকিস।
– তুইও। ফি আমানিল্লাহ।
আদ্রিতা ফোন রেখে দিল। মম ফেসবুক রিকুয়েষ্ট একসেপ্ট করে নিল নাম দেখে। তাড়াহুড়োয় ছবিটার দিকে তাকালও না। তাহলে হয়ত মত পরিবর্তন করত!

মম রান্নাঘরে গেল। অনেক ভেবে মোরগপোলাও রান্না করার সিদ্ধান্ত নিল। মাধুরী খালা ওকে সাহায্য করলেন। একটার মাঝেই রান্না শেষ করে ফেলল দুজনে মিলে। গোসল সেরে সবাইকে টেবিলে ডাকল মম। নিনিটারও খিদে পেয়েছে। কাছে ঘুর ঘুর করছে আর করুণ স্বরে ডাকছে। ও গিয়ে খাবর দিতেই দৌঁড়ে গিয়ে খেতে লাগল। মাধুরী খালা সবাইকে খাবার বেড়ে দিয়ে খেতে বসলেন। মমর খাওয়া দেখে রায়হান সাহেব বললেন, কি রে এত তাড়াতাড়ি খাচ্ছিস যে?

– বের হবো। দেরি হয়ে যাবে।
– কোথায় যাবি? আজ তো অফিস ছুটি।
– কে বলল অফিস যাচ্ছি? আদ্রিতার কথা মনে আছে? আমার কলেজ ফ্রেন্ড ছিল?
– হ্যাঁ, একবার এসেছিল বাসায় বোধহয়।
– হুম। ওর সাথেই দেখা করতে যাবো। আজকেই বিদেশ থেকে ফিরেছে হাসবেন্ডসহ।
– ও, আচ্ছা। সাবধানে যাস তাহলে।
– হুম।
রায়হান সাহেব আর কথা এগোলেন না। কখন ক্ষতে গিয়ে আঘাত হেনে ফেলেন সেই ভয়ে।

আজকে স্কুটিটা নিয়েই বের হলো। সোজা চলে গেল স্বপ্নকানন হোটেলের সামনে। আদ্রিতা তখনই ম্যাসেজ করে দিয়েছে ঠিকানা। ভেতরে গিয়ে রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞেস করল আদ্রিতার রুম কোনটা।
– আপনি ওনার কে হন?
– ফ্রেন্ড।
– প্লিজ এখানে একটা সাইন করুন।

মম খাতায় স্বাক্ষর দিলে রিসেপশনিস্ট বলল, ৩০৬ নাম্বার রুম। এখান থেকে সোজা তিনতলায় চলে গেলে পেয়ে যাবেন। মম ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা দিল। ৩০৬ নাম্বার রুমে এসে নক দিল। ভেতরে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসছে। মম মনে মনে হেসে বলল, বাচ্চা সামলাতে সামলাতে তো নিজেই হিমসিম খাচ্ছে মনে হচ্ছে। ও যখন নিজে নিজে হাসছে তখন একজন লোক দরজা খুলল। সাথে সাথে মমর হাসি উধাও হয়ে গেল। লোকটার পিছন থেকে আদ্রিতা উঁকি দিয়ে বলল, এসেছিস!? তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ভেতরে আয়। মম ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে দেখে ও টেনে ভেতরে নিয়ে এসে বলল, আমরা বের হয়ে যেতাম। তুই আসবি বলে এখনো আছি। মমকে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্রিতা বলল, ও, তোর সাথে তো পরিচয় হয়নি। ও আমার হাজবেন্ড, আলিফ। বিয়েতে তো নিমন্ত্রণ করতেই পারলাম না ওর তাড়াহুড়োয়। কিরে? কি হল? মম ধ্যান থেকে বাস্তবে ফিরে আলিফের দিকে একটা শুকনো হাসি দিল। শেষ পর্যন্ত ওর প্রাক্তন ওর কলেজ ফ্রেন্ডকে বিয়ে করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে!

বাচ্চাটা আবার কান্না করা শুরু করল। আদ্রিতা চলে গেল বিছানার কাছে। সেখানে বালিশ দিয়ে প্রাচীর করে রেখেছে বাচ্চাটার পাশে। মায়ের কোলেও শান্ত হচ্ছে না বাচ্চাটা। মম কি করবে বুঝতে পারল না। রাগে অভিমানে ঘৃণায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো আলিফের দিকে নিবদ্ধ। এদিকে আলিফের কপাল ঘামছে। পাছে মম সব বলে দেয় আদ্রিতাকে। তাহলে ওর সুখের সংসার একেবারে ভেসে যাবে। মম কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই আলিফ বলল, চলো, বেরিয়ে পড়ি। লেট হয়ে যাচ্ছে।
– ওমা সেকি! কি বলছ! আমার বান্ধবী এতদিন পরে এল আর কথাই তো হল না।
– আমিও সেটাই বলছিলাম। তোরা বেরিয়ে পড়। আজ এলি মাত্র। বাড়ির সবাই অপেক্ষা করছে। পরে আরেক সময় কথা হবে।
– মম…, চল সবাই মিলে একটা রেস্টুরেন্টে যাই। তুই তো আমার বিয়ে খেতে পারিসনি। আজ খেতে খেতে কথা বলব।

– তোদের দেখেই খুশিতে পেট ভরে গেছে। তাছাড়া খেয়েই তো এলাম বাসা থেকে।
– তাহলে আমাদের বাড়ি চল। সেখানে মন ভরে কথা বলা যাবে।
– আমার একটু তাড়া আছে। আজ না।
– আজ তো শুক্রবার, অফিস নেই। তাহলে কি তাড়া শুনি।

মম গোপন ভাব করে বলল, সিক্রেট। আদ্রিতাও ফিসফিস করে বলল, আই লাভ সিক্রেট। তারপর দুজনেই হাসল। আলিফের চোখে মমর শুকনো হাসিটা চোখে পড়ল। আদ্রিতা বলল, তাহলে এককাজ করি, তোকে বাসায় দিয়ে আসি। মম আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি স্কুটি এনেছি। চিন্তা করিস না। চলে যেতে পারব। তোরাও বেরিয়ে পড়। আদ্রিতা কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না। মম জোর করে এটা ওটা বুঝিয়ে বেরিয়ে এল। এমন বিশ্বাসঘাতকের সাথে একমুহূর্ত থাকার রুচি নেই ওর।

মম চিত্তে পর্ব ৪

বি.দ্র.: নামে সমস্যা থাকায় ফারিহা আফরিন মম করা হয়েছে।

মম চিত্তে পর্ব ৬