মহাপ্রস্থান গল্পের লিংক || মুন্নি আক্তার প্রিয়া

মহাপ্রস্থান পর্ব ১
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

পৃথুলাকে কি’ড’ন্যা’প করে একটা অন্ধকার রুমে আটকে রাখা হয়েছে। তার ওপর ভ্যাপসা গরমে কেমন গা গুলানো একটা দুর্গন্ধ! কীসের গন্ধ কে জানে! পেটের নাড়িভুঁড়ি উলটিয়ে ব’মি আসতে চাইছে। ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। হাত-পায়ের সাথে মুখও বাঁধা; যার দরুণ তার ভেতরটা গগনবিদারী চিৎকার করলেও বাইরে সেই শব্দ বেরিয়ে আসতে পারছে না।

কিন্তু একটা জিনিসই তার বোধগম্য হচ্ছে না, তাকে কারা কি’ড’ন্যা’প করল? আর কেন-ই বা করল? কিছুক্ষণ বাদে অন্ধকার রুমটিতে আলো জ্বলে ওঠে। এক রোগা-পাতলা লোক এসে রুমের লাইট জ্বালিয়েছে। পৃথুলা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে। এই লোককে দেখতেই তো মনে হয় নে’শা’খো’র। নে’শা’টে’শা করে তুলে এনেছে নাকি? ভয়ে তার কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিয়ৎক্ষণ বাদে তার পিছু পিছু কালো স্যুট পরা একজন লোক ভেতরে এলো। পাশ থেকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে পৃথুলার সামনা-সামনি বসে। পৃথুলা আগুন্তুক লোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছে না। এর কারণ তার মুখে মাস্ক। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে লোকটিকে পর্যবেক্ষণ করার বৃথা চেষ্টা করে। কালো ডেনিম প্যান্টের সাথে, ফুল হাতা সাদা শার্ট পরেছে। শার্টের ওপর কালো ব্লেজার। গলায় কালো টাই এবং চোখে কালো চশমা। বৃথা চেষ্টা এজন্যই বললাম, কারণ সরু দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেও পৃথুলা মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারেনি।

”অবাক হয়েছেন?”
লোকটির হঠাৎ প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় পৃথুলা। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঢোক গিলে। লোকটা এবার ব্লেজার খুলে পাশে দাঁড়ানো সেই রোগা-পাতলা গড়নের লোকটির হাতে দিল। গলার টাইয়ের বাঁধন কিছুটা ঢিলা করে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে একবার আড়চোখে পৃথুলার দিকে তাকাল। একটু বেঁকিয়ে বসে নিজের চেয়ারের ওপর এক হাত রেখে বলল,
“ফেইক নিউজ তৈরি করার মানে কী?”

পৃথুলা এবারও মাথামুণ্ড কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারচেয়েও বড়ো কথা হচ্ছে এই লোকটা পাগল নাকি? দেখতেই পাচ্ছে, পৃথুলার মুখ বেঁধে রাখা। তারপরও একটা একটা করে প্রশ্ন করে চলেছে। উত্তর দেবে কী করে সে? আগুন্তুক লোকটি বোধ হয় তার মনের কথাগুলো বুঝতে পারল। তাই ইশারায় পাশের লোকটিকে বলল,
”মুখের বাঁধন খুলে দাও।”

মুখের বাঁধন খুলতেই ভয়-ডর সবকিছুকে উপেক্ষা করে পৃথুলা গড়গড় করে বলা শুরু করল,
“আপনার সাহস হয় কী করে আমাকে কি’ড’ন্যা’প করার হ্যাঁ? কে আপনি? কেন আমায় কি’ড’ন্যা’প করেছেন? কী উদ্দেশ্য আপনার?”

পৃথুলার চিৎকার-চেঁচামেঁচিতে কানের পোকা নড়ে যাওয়ার উপক্রম। লোকটি এবার জোরে ধমক দিয়ে বলল,
”চুপ করুন! একদম চুপ। নয়তো মে’রে একদম গু’ম করে দেবো বলে দিলাম।”
ধমক খেয়ে ফুটা বেলুনের মতো চুপসে যায় পৃথুলা। নিরীহ প্রাণীর মতো চুপটি করে বসে থাকে। কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা চলার পরে লোকটি আবারও একই প্রশ্ন করে,

“ফেইক নিউজ কেন ছাপিয়েছেন?”
”আগে আপনার পরিচয় দিন।”
মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলল পৃথুলা। সে জানে না, লোকটি কীসের অথবা কোন নিউজের কথা জিজ্ঞেস করছে। তবে তার পরিচয় আগে জেনে নেওয়াটা জরুরী মনে হলো।

”আমার পরিচয় জেনে আপনার কোনো কাজে আসবে না।”
”তাহলে আমিও আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবো না।”
”ওয়েল! আমি আরশান। আরশান চৌধুরী।”
দাঁতে দাঁত চেপে বলল সে।
”ওহ। হাত খুলে দিন।”

”সরি? মামার বাড়ি আবদার? আপনাকে এখানে তুলে এনেছি কি আপনার কথা শোনার জন্য?”
”ভয় পাচ্ছেন? দু’জন পুরুষ মানুষ একটা মেয়েকে ভয় পাচ্ছেন?”
তাচ্ছিল্যর স্বরেই কথাটা বলল পৃথুলা। রীতিমতো সে অপমান করছে আরশানকে। তবুও আরশান নিজের রাগকে কন্ট্রোলে রেখে নিজেই এক হাতের বাঁধন খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পৃথুলা আরশানের হাতে জোরেশোরে চি’ম’টি কা’টে। বিস্ময়ে হা হয়ে যায় আরশান এবং তার সেক্রেটারি শিমুল।

‘আরশান চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
”রা’বি’শ! এটা কী হলো?”
পৃথুলা মুখ টিপে হেসে বলল,
“আপনার পদবী চৌধুরী এবং আমার পদবীও চৌধুরী। মিলে গেছে তাই চি’ম’টি দিলাম। তবে হ্যাঁ, আমার নামের শেষে চৌধুরী থাকলেও কাজে কিন্তু আমি একদম মিসকিন, ফকির।”
আরশান অবাক না হয়ে পারল না। এই মেয়ে কি মানসিক রোগী? এরকম মানসিক রোগী কী করে একজন উকিল হয়? সে ধমকের সুরে বলল,

“শিমুল, এক্ষুণী এই মেয়ের হাত বাঁধো।”
শিমুল তাই করল।
”কী আজব! হাত বাঁধার কী আছে?”
প্রশ্নটি করল পৃথুলা। তবে আরশান এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। সে মুখোমুখি বসে বলল,
”অনেক হয়েছে ড্রামা। এবার আমার কথা শুনুন। রাফসান চৌধুরীর নামে যেই নিউজ আপনি ছাপিয়েছেন তা পুরোপুরি মিথ্যে এবং ভিত্তিহীন। মিডিয়ার সামনে আপনার সব স্বীকারোক্তিও ভিত্তিহীন।”
পৃথুলা বিরক্তের সাথে বলল,

”আরে ধুর! কখন থেকে সেই একই কথা বলছেন। কীসের নিউজ? আমি কোনো নিউজ লিখিনি। মিডিয়াতে কিছু বলিওনি।”
”আমি ড্রামা করতে বারণ করেছি মিস শিলা।”
পৃথুলা এবার নিশ্চুপ হয়ে যায় নামটি শুনে। বুঝতে পারে, আরশান তাকে শিলা মনে করে কি’ড’ন্যা’প করেছে। তখন তার এটাও মনে পড়ে যায় তার বোন পেশায় একজন উকিল। আরশান এতক্ষণ যা যা বলছিল সেসব কিছুর সাথে তাহলে শিলা জড়িত রয়েছে। বোনের বদলে তাকে তুলে আনার জন্য সে একটুও অবাক হয়নি। কেননা শিলা এবং সে জমজ বোন।
”আমি কী বলেছি আপনি বুঝতে পেরেছেন?”

আরশানের প্রশ্নে ভাবনার ঘোর কাটে পৃথুলার। সে পালটা প্রশ্ন করে,
”আপনি কী করে শিওর যে ঐ নিউজটা আমি ছাপিয়েছি?”
আরশান বাঁকা হেসে বলল,

“হঠাৎ এরকম ইনোসেন্ট সাজার কারণ কী বলুন তো? ভয়ে? মিস শিলা আবার ভয়ও পায় নাকি। জানতাম না তো! লিসেন, নিউজের কথাটা আপনি নিজে মিডিয়ার কাছে বলেছেন। আপনার কথামতোই জার্নালিস্ট রাত্রি ইসলাম এই নিউজ ছাপিয়েছে। আপনি নিজে সেটা মিডিয়ার সামনে বলেছেন। পুরো সোশ্যাল মিডিয়াতে এখন এসব নিয়ে তোলপাড় চলছে। রাফসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা মিথ্যে কেসের বিরুদ্ধেও আপনি ওকালতি করছেন। মিস শিলা, আপনি মিডিয়ার সামনে জাস্ট বলবেন এগুলো সব মিথ্যা। এই কেসটিও আপনি লড়বেন না। তাহলেই আমরা আপনাকে ছেড়ে দেবো।”

”আপনি রাফসান চৌধুরীর কী হন?”
পৃথুলার মিডিয়া সম্পর্কে আগ্রহ একদম নেই। সে কখনও পত্রিকাও পড়ে না। এমনকি দেখে না কোনো খবরও। তার বোনের কাজকর্ম নিয়েও তার মধ্যে কোনো আগ্রহ নেই। তার পরিবার বলতে আছে শুধু ঐ বোন-ই। কিন্তু তার সাথেও পৃথুলার কোনো যোগাযোগ নেই আজ পাঁচ বছরেরও বেশি।

গতকাল রাত্রে সে কোত্থেকে যেন পৃথুলার ফোন নাম্বার জোগার করে ফোন করেছিল। বলল আজ সন্ধ্যায় যেন কলেজ স্ট্রিটে দেখা করে। এত বছর বাদে হঠাৎ কী মনে করে জরুরী তলব, সেটি জানার জন্য মনের ভেতর খুব কিউরিসিটি জেগেছিল। আর এই কিউরিসিটিই যত নষ্টের মূল! এজন্যই আজ সে কি’ড’ন্যা’প হলো। সে সত্যই কিছু বুঝতে পারছে না। তাই সে সত্যিকার অর্থেই জানেও না, কার সাথে কার কোন প্যাচ লেগে আছে।
আরশান নিজের রাগকে কোনোভাবেই কন্ট্রোলে রাখতে পারছে না।

”আপনার সমস্যা কী? কেন করছেন এই নাটক? আপনি জানেন না আমি রাফসান চৌধুরীর কী হই?”
পৃথুলা নিশ্চুপ। পাশ থেকে শিমুল বলল,
”স্যার, আপনি মাথা ঠাণ্ডা করুন। এখন বরং আপনি বিশ্রাম নিন।”
পৃথুলা তখন দুম করেই ক্ষেপে গেল। ধমক দিয়ে বলল,
”এই শিমুল তুলা, আপনি আমাদের মধ্যে কথা বলছেন কেন? দেখতে পাচ্ছেন না আমরা কথা বলছি? মাঝখানে একদম কাবাব মে হাড্ডি হবেন না বলে দিচ্ছি।”

”আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন?” অসহায়ের মতো প্রশ্নটি করল শিমুল।
”কারণ আপনার মধ্যে কোনো মানবিকতা নেই। সেই কখন থেকে আমার হাত-পা বেঁধে রেখেছেন। কই আমাকে রেস্ট নিতে বলবেন! তা না করে আপনি উনাকে বলছেন রেস্ট নিতে। বে’কু’ব!”
পৃথুলার কথা শুনে শিমুল থ বনে চলে যায়। মনে মনে স্বগতোক্তি করে,

“এইটা কী মেয়ে? মনে একটুও ভয়-ডর নেই। আল্লাহ্ মালুম!’
পৃথুলা এবার আরশানকে বলল,
“হ্যাঁ, আপনি যেন কী বলছিলেন? বলেন।”
আরশান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। পা দিয়ে ঠেলে চেয়ারটা ফেলে দিয়ে বলল,
“এই মেয়ে সহজে আমাদের কথা মানবে না। একে সারা রাত এভাবেই চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখবে। রাতে কোনো খাবারও দেবে না।”

কথাগুলো সে শিমুলের উদ্দেশ্যে বলে সেখান থেকে চলে যায়।
পৃথুলা শিমুলকে বলে,
“এই লোকের সমস্যা কী? কুমিরের মতো এমন খ্যাঁক খ্যাঁক করে কেন?”
”কুমির খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দ করে নাকি?”
শিমুলের কণ্ঠে কৌতুহলের উদ্রেক উতলে পড়ছে। যেন এমন আচানক কথা সে ইতঃপূর্বে কখনও শোনেনি। পৃথুলা বিরক্ত হয়ে ঠোঁট টিপে বলল,

“জানি না আমি। আমি তো আর প্রাণীবিদ নই যে, কোন প্রাণী কীভাবে ডাকে ঐটাও জানব।”
”আপনি তো মাত্রই বললেন।”
”আপনি কি হাতে-পায়েই শুধু বড়ো হয়েছেন? মাথায় কি একটুও বুদ্ধিশুদ্ধি নাই? আমি তো ওটা কথার কথা বলেছি।”
”আপনি অনেক বেশি কথা বলেন। আপনার মুখও বেঁধে রাখা উচিত।”
”খবরদার! না। আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।”

”তাহলে এত কষ্ট কেন করছেন বলুন তো? স্যারের কথা শুনলেই তো স্যার আপনাকে ছেড়ে দেবে।”
”কেন শুনব? আপনার স্যার কি আমার প্রশ্নের জবাব দিয়েছে? দেয়নি তো! তাই আমিও তার কোনো কথাই শুনব না। তাছাড়া সে কি দেশের নেতা নাকি ডন যে তার কথা আমার শুনতে হবে।”
”শিমুল,উনাকে বলে দে। আমার কথা শুনলে উনার জন্যই ভালো হবে।”

রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল আরশান। সে এসেছে নিজের ব্লেজারটি নিতে। পৃথুলা দাঁত-মুখ খিঁচে বলল,
”নিকুচি করেছি আপনার ভালোর! কত যে ভালো চান, তা তো বুঝতেই পারছি। একটা মেয়েকে কি’ড’ন্যা’প করে এনে জোরজুলুম করে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করতে চান। কা’পু’রু’ষ যেন কোথাকার!”
আরশানের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে জি’দ্দে। সে বলে,

“আমি মেয়ে মানুষের গায়ে হাত তুলি না বলে, আজ বেঁচে গেলেন।”
”নয়তো কি ম’রে যেতাম? তা এতই যখন ইচ্ছে তখন মে’রেই ফেলুন। এত কষ্ট করার চেয়ে ম’রে যাওয়াও তো ঢের ভালো।”
”যত্তসব সেন্টিমেন্টাল! থাকুন এই বন্ধ রুমে আটকে। শিমুল, উনার মুখটাও বেঁধে দিয়ে চলে আসো। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।”

পৃথুলাকে আর কিছু বলতে না দিয়েই আরশান চলে যায়। শিমুলও আর সময় বিলম্ব না করে পৃথুলার মুখ বেঁধে, দরজা বাইরে থেকে লক করে চলে যায়। কিছুক্ষণ হাত-পা ছোড়াছুঁড়ি করে ক্ষান্ত হয়ে যায় পৃথুলা। বুঝতে পারে এতে কোনো লাভ নেই। উলটা শক্ত দড়িতে হাত টাইট করে বাঁধা ছিল বলে এখন ব্যথা করছে। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। বারবার মনে পড়ছে হঠাৎ শিলার ফোন কারণ কি এটাই ছিল? সে কি এসব জেনে-বুঝেই করেছে নাকি সবটা কো-ইন্সিডেন্স?

মহাপ্রস্থান পর্ব ২