মহাপ্রস্থান পর্ব ২৫

মহাপ্রস্থান পর্ব ২৫
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

পৃথুলা নিজের চেয়ারটি আরশানের একদম সন্নিকটে নিয়ে এসেছে। দুজনে মুখোমুখি, দৃষ্টি একত্রিত। চারপাশে নিস্তব্ধতা। লোকালয় থেকে যে তারা এখন ভীষণ দূরে আছে তা খুব ভালো করেই স্পষ্ট। লম্বা দম নিয়ে পৃথুলা বলা শুরু করে,
“আপনাকে আমার লাইফ স্টোরি যেটা শুনিয়েছিলাম, সেটা ছিল মিথ্যে। আজ সত্যিটা বলছি শুনুন।

তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। আমার এস.এস.সির টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়েছে। শীলা তখন ঢাকায় মামার বাড়ি। মা-ও ঢাকায় গেছিল বেড়াতে। বাড়িতে আমি আর বাবা। পরীক্ষার দিন সকালে গ্রামের উচ্চবিত্ত গণ্যমান্য ব্যক্তি এলেন বাড়িতে। তাদের সঙ্গে বাবার পূর্ব একটা শত্রুতা ছিল। আমার বাবা ছিলেন স্পষ্টভাষী। সবসময় সত্যের পথে অটল ছিলেন। গ্রামের সবাই বাবাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করত। গ্রামের সেইসব ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রকাশ্যে বিরোধ মিটে গেলেও মনের ক্ষো’ভ, দ্ব’ন্দ্ব যে ছিল সেটা আমরা সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম। বাড়িতে টাকা-পয়সা যা ছিল তা তো নিয়েছেই এমনকি বাবাকে গলা টি’পে তারা মা’রা’র চেষ্টা করছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমি পাশের রুমে রেডি হচ্ছিলাম। গোঙানোর শব্দ শুনে দৌঁড়ে যাই ড্রয়িংরুমে। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। আমার হাত-পা কাঁপছিল। বাবার মৃ’ত প্রায় মুখটি দেখে আর কোনো কিছু ভাবার সুযোগ হয়নি। আমি দৌঁড়ে যাই বাবাকে বাঁচাতে। পারিনি। উলটো…”
এতটুকু বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠে পৃথুলা। তার চোখে পানি। আরশান শীলার দিকে তাকাল। তার চোখের দৃষ্টি দ্বারা বোঝা যায়, পৃথুলা যা বলছে সেসব সত্যি কিনা। শীলার দুই চোখেও পানিতে টইটুম্বুর। সেই কালো রাতের কথা মনে পড়লে আজও তার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। সে কাঁদতে কাঁদতে আরশানের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল। এর অর্থ, পৃথুলার বলা কথাগুলো সত্য।

পৃথুলা চোখের পানি মুছে নিল। চোখ-মুখ শক্ত করে এরপর যা বলল তা শোনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। বিশেষ করে আরশান তো নয়-ই! পৃথুলা দৃষ্টি নামিয়ে বলা শুরু করে,
“উলটো নিজের স’তী’ত্ব হারিয়েছি সেদিন চেয়ারম্যানের ছেলের কাছে। র‍ে’প করেছিল আমায়!”
আরশানের মনে হলো ধারালো কিছু তার বুকে বিঁধেছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকটায়। আর কোনো কিছু শোনার মতো ইচ্ছে তার নেই। পৃথুলা বলে যাচ্ছে তার মতো করে,

“বাবাকে ওরা মে’রে ফেললেও কেন জানি আমাকে মারেনি। ওরা চলে যাওয়ার পর বাবার নিথর দেহটা নিয়ে আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার জন্য আমার বান্ধবী আমায় ডাকতে এসে এই অবস্থা দেখে। আমার জামা-কাপড়ের করুণ অবস্থা। দেহে মা’রে’র দা’গ, আ’ঘা’তে’র চি’হ্ন। বাবার নিথর দেহ দেখে কোনোকিছুই আন্দাজ করতে ওর কষ্ট হয়নি। ও মুখে হাত দিয়ে প্রথমে চাপাকান্না করলেও পরবর্তীতে জোরে কান্নাকাটি করে লোক জড়ো করে। খবর পেয়ে মা তৎক্ষণাৎ ঢাকা থেকে ছুটে আসে। আমরা অফিস-আদালত, থানা কম জায়গায় যাইনি।

কিন্তু কোথাও কোনো বিচার পাইনি। কার দ্বারা বিচার পাব? পুলিশের লোক-ই তো সাথে ছিল সেদিন, যারা আমার বাবাকে হ’ত্যা করেছে। আমাকে ধ’র্ষণ করেছে। আমরা কোথাও বিচার পাইনি। টাকা দিয়ে সব ধামাচাপা দেওয়া হয়। গ্রামের লোক ছি ছি করে আমায় দেখলে। কানাঘুষা করে। মা এই শোক সইতে না পেরে স্ট্রোক করল। মানতে পারিনি এসব। নিজের ওপর, নিজের জীবনের ওপর ঘৃণা চলে আসে। সিদ্ধান্ত নিই পানিতে ঝাপ দিয়ে সু’ই’সা’ই’ড করব। গিয়েছিলামও নিজের জীবন শেষ করতে। তখন মনোয়ার চাচা আমাকে আটকায়।

যাকে আপনারা দে’শ’দ্রো’হী’র লিডার বলেন। সে আমাকে নতুনভাবে বাঁচায়। নতুন জীবন দেয়। মেয়ের মতো আগলে রাখে। এই দেশ, দেশের মানুষ, আইনের প্রতি আমার প্রবল ঘৃণা, রাগ, জেদ জন্মেছিল। এখানে কখনো ন্যায়ের বিচার পাওয়া যায় না। তাই আমিও দে’শ’দ্রো’হী’র দলে যোগ দিলাম। মনেপ্রাণে চাই এদেশের ধ্বংস হোক। যারা আমার বাবাকে হ’ত্যা করেছিল, যেই জা’নো’য়া’র আমার স’তী’ত্ব হরণ করেছিল ওরা সবাই এখন মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। কাউকে ছাড়িনি। শীলার সাথে যোগাযোগ আমিই বন্ধ রেখেছিলাম। তবে ঠিকই এখানকার সব খবর আমরা রাখতাম। সেদিন শীলা আমাকে দেখা করতে বলেনি, বরং এত বছর বাদে আমিই শীলাকে ফোন করেছিলাম দেখা করার জন্য। আমরা জানতাম, শিলাকে কি’ড’ন্যা’প করতে চাওয়ার বিষয়টি।অবাক হবেন না। আমাদের লোক আপনাদের দলেও রয়েছে। তারাই সব খবর দিয়েছে। এরপর আপনার কাছাকাছি যাওয়া, ভালোবাসার মায়ায় জড়ানো সবটাই তো আপনার জানা।”

পৃথুলা থামল। তার সামনে উপস্থিত তিনজনই তখন নির্বাক। শুধু শীলা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আরশানের চোখেও বোধ হয় মৃদু অশ্রুকণা। পৃথুলা সরাসরি চোখের দিকে তাকাতে পারল না। সে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“আমাকে কি’ড’ন্যা’প করার পর ভয় পাওয়া, সেন্সলেস হওয়া এগুলো আমার অভিনয় ছিল। সেদিন রাস্তায় আমাকে আঘাত করা লোকগুলো আমাদেরই দলের। এসবকিছু করেছিলাম আপনার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য।

কারণ আমি জানতাম আপনার সত্যিকারের পরিচয়। আপনার কাছেই যে আমি সবথেকে বেশি ইনফরমেশন কালেক্ট করতে পারব সেই সম্পর্কে আমরা দ্বিধাহীন ছিলাম। তবে সেগুলো কালেক্ট করাও যে কতটা টাফ এটাও বোধগম্য ছিল আমাদের। তাই আপনার কাছাকাছি যাওয়ার পূর্বে আপনাকে আগে আমার প্রতি দুর্বল করেছি। ভালোবাসার অভিনয় করেছি। নিজেকে সাজিয়েছি ভালোবাসার কাঙাল। দিবা আপুর সাথে আমার সম্পর্ক তৈরি করাটাও ছিল নাটকীয়। ইচ্ছে করে ধাক্কা খেয়ে, হাত কা’টার অভিনয় করে তার বাড়ি পর্যন্ত যাই।

কারণ তার স্বামীও একজন পুলিশ অফিসার। ওখান থেকেও আমার শক্ত কিছু ইনফরমেশন চুরি করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল সন্দেহজনক। পাছে সে আমাকে পুরোদস্তুর সন্দেহের তালিকায় না ফেলে এজন্য ঐ বাড়িতে তখনকার সময়ের জন্য যাওয়া বন্ধ করে দিই। এরপর একদিন খবর আসে, তার স্বামী তৌসিফ দরকারী কাজে বাইরে যাবে। তাই আমিও তখন একটা নাটক সাজিয়ে ফেলি।

রুমমেট সীমন্তির ওপর সব দোষ চাপিয়ে দেই। আসল সত্যিটা হচ্ছে, সীমন্তি ভালো ধরণের মেয়ে। ও সম্ভবত হিমেলের সম্পর্কে একটা কিছু আন্দাজ করেছিল বা দেখেছিল যার জন্য আমাকে হিমেলের সঙ্গে মিশতে বারণ করত। এছাড়া ও যে আমাকে অপমান, অপদস্থ করত এসব মিথ্যে। সেদিন রাতে সীমন্তি নয় বরং আমিই ওকে ড্রা’গ নিতে বাধ্য করেছিলাম। যাতে করে ও বাড়ি থেকে চলে যায়। আর আমিও ওর ওপর দোষ দিয়ে দিবা আপুর বাসায় আশ্রয় নিতে পারি। সেই সাথে ওখানকার কাজ শেষ করে আমার নেক্সট গন্তব্যস্থল তো আপনার কাছেই ছিল। আপনাকেও তো গল্পটা বলতে হবে। আপনার সেই সিক্রেট গার্ল যে আপনার টিমের সদস্য তা আমি জানি। জেনেও ওভার রিয়েক্ট করেছি আমার ভালোবাসার গভীরতা বোঝাতে। আপনাকে আমি এটাই বোঝাতে চেয়েছি যে, কতটা ভালোবাসি আমি আপনাকে।”

পৃথুলা থামল। আরশান বলল,
“কিন্তু সেই সব ভালোবাসা মিথ্যে ছিল তাই না পৃথু?”
হঠাৎ করে আরশানের কণ্ঠস্বরের যেন ভোল্ট পালটে গেল। আরশান শব্দ করে হাসতে হাসতে বলে,
“তোমাদের অভিনয়, নাটক সবই সুন্দর ছিল। ঠিক ছিল। কিন্তু এখানে এমন একটা কিছু আছে যেটা তুমি জানো না।”
“মানে?”
“পেছনে তাকাও।”

পৃথুলা পেছনে তাকাতেই দেখে অনেকগুলো পুলিশ এখানে। একজন পুলিশ পৃথুলার দিকে পি’স্ত’ল তাক করে রেখেছে। বাকি পুলিশরা দে’শ’দ্রো’হীর সদস্যদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তিনজন এসে আরশান, শিমুল এবং শীলার হাত-পা, মুখের বাঁধন খুলে দেয়। আরশান হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আড়মোড়া ভেঙে স্তব্ধ পৃথুলার দিকে তাকিয়ে থাকে। পুলিশ অফিসার পৃথুলাকে নিয়ে যেতে চাইলে আরশান বাঁধা দিয়ে বলে,
“দাঁড়ান। ওকেও কিছু সত্য গল্প শোনাই।”
পৃথুলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরশান বলা শুরু করে,

“আমাদের টিমে যে একজন আমাদেরই শত্রু ছিল এটা আমরা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু কে সেই ব্যক্তি তা আমরা জানতাম না। আমাদের সব পরিকল্পনা যখন একেরপর এক লিক হয়ে যাচ্ছিল তোমাদের কাছে তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তোমাদের ফাঁদেই এবার তোমাদেরকে ফেলব আমি। লিক করা খবর পেয়ে সেই অনুযায়ী দেশের ক্ষতি করে তোমাদের মধ্যে ওভাব কনফিডেন্স চলে এসেছিল। আর এরই সুযোগ নিয়েছিলাম আমরা। তোমার ঢাকায় আসার খবর পাই আমাদেরই টিমের এক সদস্যের কাছে। তখন ঠিকই আসল কাহিনি বুঝতে পেরেছিলাম।

নিশ্চয়ই কোনো তালগোল পাকাতে চাইছ তোমরা। আর এটাও ক্লিয়ার হয়ে গেছিল যে, আমাদের টিমে কে গাদ্দারি করছিল। সব বুঝেও তখন আমরা তার বিরুদ্ধে কোনো স্টেপ নিইনি। কারণ আমাদের পরিকল্পনায় সে ছিল মূল অ’স্ত্র। আরও নাটকীয় ঘটনা ঘটল যখন তুমি শীলার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে। বলাই বাহুল্য, আমাদের টিমের সদস্যকে নিয়ে করা পরিকল্পনার কথা তুমি জানতে। শীলাকে কি’ড’ন্যা’প করব যখন জানলে তখন মোক্ষম একটা ফাঁদ পাতলে। শীলার সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত মূলত তুমি তখনই নিয়েছ। যাতে ভুল করে শীলার জায়গায় আমরা তোমাকে তুলে আনি।

শীলাকে কি’ড’ন্যা’প করতে চাওয়ার কথা যে তুমি জানো এটা আমরা জানতাম। তাই শীলার সাথে প্ল্যানিং করেই এই নাটক সাজিয়েছিলাম। ইচ্ছে করেই আমরা ওর বদলে তোমায় নিয়ে এসেছি। তবে এটা বুঝতে পারিনি যে, তোমাদের লোক আবার শীলাকে কি’ড’ন্যা’প করে ফেলবে। আবার ওকে দিয়ে একটা লাইভও করে নিয়েছ তোমরা। তবে নার্ভাস হইনি। তোমাদের দল পর্যন্ত আসার জন্য তুমিই যথেষ্ট ছিলে আমার জন্য।

গতকাল রাতে তুমি একাই পালিয়ে আসতে চেয়েছিলে আমি জানি। কিন্তু তোমাকে নিয়েই তো আমার পথচলা। তোমার সূত্র ধরে এখানে আসব বলেই তো আমাকেও ভালোবাসার অভিনয় করে যেতে হয়েছে। খেয়াল করোনি, কেন তোমায় এত চোখে হারিয়েছি? যাতে হাত ছাড়া না হয়ে যাও। সেদিন আমাদের পিছু ধাওয়া করা লোকগুলো শুধু তোমার দলেরই লোক ছিল ভেবেছ? বোকা! আমার টিমেরও অনেক সদস্য ছিল। আমার ফোনের লাইভ লোকেশন অন ছিল। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী আগানোর জন্যই তখনই তোমাদের আমরা ধরিনি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এই আস্তানা পর্যন্ত আসা।”

মহাপ্রস্থান পর্ব ২৪

কথাগুলো শেষ করেই পুলিশ অফিসারের পি’স্ত’ল’টা নিজের হাতে তুলে নেয় আরশান। পৃথুলার দিকে তাক করে বলে,
“তুমি গেইম শুরু করেছ আর শেষটা করব আমি। তুমি ভালো খেলোয়াড় হতে পারো। কিন্তু আমি খেলার মাস্টারমাইন্ড।”
পৃথুলা বাকহারা। শূন্য দৃষ্টি মেলে সে কুচক্রী আরশানের মুখপানে তাকিয়ে আছে।

মহাপ্রস্থান শেষ পর্ব