মহাপ্রস্থান পর্ব ৩

মহাপ্রস্থান পর্ব ৩
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

কলেজের প্রথম দিন যাওয়া হয়নি দোলার। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছে। দ্বিতীয় দিন জ্বর নিয়েই কলেজে গেছে সে। বাবা-মায়ের কোনো রকম বারণ শোনেনি। দ্বিতীয় দিন বৃষ্টির পরিমাণ ছিল আরও বেশি। তাতেই বা কী আসে যায়? কলেজ জীবনের শুরুটাই যদি উপভোগ করা না যায় তাহলে শেষে গিয়ে আর কী হবে? শুধু পড়াশোনা?

তা তো দোলা এমনিতেই করবে। পড়াশোনার পাশাপাশি জীবনটাকেও তো উপভোগ করা উচিত। দোলা তাই ছাতা মাথায় দিয়ে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল। কোত্থেকে হুট করে একটা ছেলে ছাতার নিচে চলে আসে। দোলা আকস্মিক ঘটনায় এতটাই চমকে গেছে যে তৎক্ষণাৎ বলার মতো কিছু পেলও না। শুধু হা করে তাকিয়ে রইল নিষ্পলক।
ছেলেটির গায়ে কলেজের সাদা শার্ট। চুলগুলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে কপালে লেপ্টে আছে। দুই কাঁধে ব্যাগ। আর হাতে কালো রঙের একটা ঘড়ি। সেই ঘড়িতেই ছেলেটি সময় দেখে তাড়া দিয়ে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ক্লাস তো শুরু হয়ে গেছে অলরেডি। জলদি চলো!”
দোলা যেন আহাম্মক বনে গেল। নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য যতটুকু সময়ের প্রয়োজন ছিল ততটুকু সময় সে পায়নি। তবুও সম্পূর্ণ দমে না গিয়ে ভারী কণ্ঠে শুধাল,
“আপনি আমাকে চেনেন?”
ছেলেটি ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,

“তুমি এই কলেজেই তো পড়ো? এই তো তোমার গায়ে কলেজের ইউনিফর্ম!”
“তো?”
“তো মানে?”
“আমি জানতে চাই, আপনি কি আমাকে পার্সোনালি চেনেন?”
“না। এক কলেজেই পড়ি। এটাই কি যথেষ্ট নয়?”

“একদম নয়। এক কলেজেই পড়েন বলে হুট করেই একটা মেয়ের ছাতার নিচে ঢুকে পড়বেন এটা কেমনতর ভদ্রতা?”
ছেলেটি আর কিচ্ছু বলল না। তার চোখে-মুখে রাগ, ক্ষোভের প্রতিচ্ছবি। সে দোলার কথার জবাব না দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই ভিজে ভিজে কলেজের ভেতর চলে গেল। দোলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেও কলেজের ভেতর চলে যায়। অফিসকক্ষ থেকে কোন ফ্লোরে ক্লাস হয় এটা জেনে সে তিন তলায় গিয়ে দেখে ছেলেটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।

সাদা শার্ট সম্পূর্ণ ভিজে গায়ে লেপ্টে আছে। দোলার এবার কেন জানি একটু মায়া হলো। ওরকম ব্যবহার হয়তো সে না করলেও পারত। প্রথমদিন দোলার খুব ভালো সময় কেটেছে কলেজে। দ্বিতীয় দিন তৈরি হয়ে গেছে এক ঝাঁক বন্ধু-বান্ধব। সবার মাঝে থেকেও আড়ালে সে একজনকেই লক্ষ্য করত সর্বদা। ছেলেটির নাম রাফসান। ফরসা রাগী মুখখানা এখনও তার নেত্রপল্লবে ভেসে ওঠে।

সেদিনের পর থেকে সাতদিন কেটে যাওয়ার পরও রাফসানের সঙ্গে তার কোনো বাক্য বিনিময় হয়নি। দোলা অনেকবার চেষ্টা করেছে নিজ থেকে কথা বলার। কিন্তু মেয়ে হয়ে সেধে গিয়ে একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলবে, এই বিষয়টাও তার ইগোতে লেগেছে। যার দরুণ মনের ইচ্ছে সে মনেই পুষে রেখেছিল।

কয়েকদিন ভরপুর বৃষ্টি হয়ে আবহাওয়া বদলে গেছে। কাঠফাটা রোদ। ভ্যাপসা গরম। ঘামে টইটুম্বুর মুখ। গরমে মাথা ঝিম ধরে যায়। দোলা আজ চুল উচুঁ করে ঝুটি করেছে। তবুও যেন চুলের গরমটাই তার সবথেকে বেশি লাগছিল। হন্তদন্ত হয়ে ক্লাসে যাওয়ার মুহূর্তে সিঁড়িতেই রাফসানের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। প্রতিবারের মতো রাফসান আজ তাকে ইগনোর করেনি। অনেকটা পথরোধ করেই যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎ-ই সে মুচকি হেসে বলল,

“তোমার ব্যাগ থেকে পানির বোতল নিয়ে পানি খেয়েছি। এজন্য কি আজও ঝগড়া করবে?”
দোলা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে পরক্ষণেই হেসে বলল,
“না।”

রাফসান নিজেও সেই হাসিতে যোগ দিল। একসাথে ক্লাসে যেতে যেতে বলল,
“জানো তো দোলা, একটা মেয়ে না প্রতিদিন আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে।”
দোলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কে?”
“তুমি চেনো। আমাদের ক্লাসেই পড়ে।”
“কার কথা বলছ?”

“মেয়েটার সাথে প্রথম যেদিন আমার দেখা হয়েছিল খুব ঝগড়া করেছিল। তাও সামান্য একটা বিষয় নিয়ে। আমার রাগ বেশি। মেয়েটার ওপর এত রাগ হয়েছিল যে, এরপর থেকে আর কখনও কথাই বলিনি। ক্লাসের সবার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক থাকলেও ঐ মেয়েটাকে আমি এড়িয়ে চলতাম। তাও ঢের বুঝতে পারতাম যে, মেয়েটা আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মেয়েটা কেন এমন করে? তুমি কি বলতে পারবে?”

দোলা লজ্জায় রাফসানের দিকে তাকাতে পারছে না। মুখ ফুটে কোনো কথা বলতেও পারছে না। রাফসান যে এতক্ষণ তার কথাই বলছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। সে স্থির হয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। রাফসানের ওষ্ঠে মুচকি হাসি। সে জানতে চাইল,

“বাই এনি চান্স, মেয়েটা আমাকে ভালোটালো বাসে না তো?”
“দোলা! দোলা…এক্ষুণী আয়। কোথায় তুই?”
শান্তি বেগমের চিৎকার চেঁচামেচিতে দোলা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। থানা থেকে এসে একটু শুয়েছিল। কখন যে রাফসান এবং অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে চোখ দুটো লেগে এসেছে টের-ই পায়নি। সে বিছানা ছাড়ার পূর্বেই শান্তি বেগম রুমে চলে এসেছে। দোলাকে কিছু বলতে না দিয়েই সে হাত টেনে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন।
দোলা বারবার জিজ্ঞেস করছে,

“মা, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? কী হয়েছে?”
“আয়। তুই দেখবি আয়।”
বলে তিনি সিঁড়ি বেয়ে ধুপধাপ শব্দ তুলে মেয়েকে নিয়ে ছাদে উপস্থিত হলেন। ডান হাতের শাহাদাৎ আঙুল দ্বারা অদূরে একটা ছাদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন,

“ঐ দেখ, ঐ ছেলেটা। এর কথাই তোর বাবা বলে। আজও আমাকে হাই দিচ্ছে।”
দোলা ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে।ছেলেটি এতক্ষণ রেলিঙের ওপর বসে থাকলেও দোলাকে দেখামাত্রই বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছে। দু’হাত ওপরে তুলে সে হাই দিচ্ছে এখনও। শান্তি বেগম বিস্মিতকণ্ঠে বলেন,
“দেখেছিস কান্ড? এতক্ষণ এক হাতে হাই দিচ্ছিল। তোকে দেখে এখন দুই হাতে হাই দিচ্ছে। এই ছেলের মতলব কী বল তো? মা-মেয়ে দুজনকেই কি পটাতে চাইছে?”

দোলার মন-মেজাজ ভালো নেই। রাফসান জেলে আসার পর থেকেই তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। না চাইতেও প্রতিদিন দেখা হয়ে যাচ্ছে। তার ওপর রাফসানের এমন কর্মকাণ্ড মানতে তার ভীষণ কষ্ট হয়। এতটা নিচেও কি রাফসান নামতে পারে? এতটা নিষ্ঠুর, নির্দয় কী করে হয়েছে রাফসান? দোলার এসব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না।

তার পরিচিত সেই রাফসানের সঙ্গে তো এই রাফসানের কোনো মিল নেই। কিন্তু সব প্রমাণও যে রাফসানের বিরুদ্ধে! সে রাফসানের বিষয়টা নিয়ে এতটাই বিষণ্ণতায় ভুগছে যে তার কোনোকিছুই ভালো লাগছে না। সে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“বলেছি তো, আমি দেখব বিষয়টা। আর তুমি এত ছাদে আসো কেন?”

শান্তি বেগম চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বললেন,
“কী বলতে চাইছিস তুই? আমি এই ছেলের জন্য ছাদে আসি? শেষমেশ তুইও তোর বাবার মতো আমাকে সন্দেহ করছিস।”
“আমি এই কথা কখন বললাম?”
“তাহলে কেন বললি এই কথা? আমার বাড়ির ছাদে আমি আসতে পারব না?”

“অবশ্যই পারবে। কিন্তু ছেলেটা যখন তোমাকে বিরক্ত করতেছে দেখতেছ, তাও কেন আসতে হবে?”
“তোকে কেন পুলিশ বানিয়েছি হ্যাঁ? বাপ-মেয়ে মিলে তো যু-দ্ধ করছিলি। আর এখন একটা ছেলে তোর মাকে বিরক্ত করছে জেনেও চুপ করে আছিস। কিছু বললেই বলিস পরে দেখছি, পরে দেখছি। পরে কী দেখবি রে তুই? এখনই যাবি তুই।”
“কোথায় যাব?”

“ঐ ছেলের কাছে। সোজা থানায় নিয়ে যাবি। যা। এটা তোর মায়ের আদেশ।”
“বাচ্চাদের মতো জেদ করছ।”
“তুই আমার কথা শুনবি না দোলা?”
দোলা কিয়ৎক্ষণ শান্তি বেগমের মুখপানে তাকিয়ে থেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। ছাদ থেকে সেই বাড়ির ছাদ সহজে দেখা গেলেও বাড়িটা খুঁজে পেতে তাকে খুব বেগ পেতে হয়েছে। সে বাড়ির দারোয়ানকে বলল,

“বাড়ির ছাদে লাল টি-শার্ট পরা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ডেকে আনুন তো।”
দারোয়ান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। দোলা বলল,
“কী হলো? ডাকুন।”
দারোয়ান এবার রাশভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আমনে কেডা?”

“আমার পরিচয় জেনে আপনার কাজ নেই। আপনাকে যা বলেছি করুন।”
দারোয়ানের ডাকতে হলো না। ছেলেটি নিজেই নিচে চলে এসেছে। ভীষণ হাসি হাসি মুখ করে ডান হাতটি হ্যান্ডশেকের উদ্দেশ্যে দোলার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“হাই! আমি হিমেল।”

দোলা শান্ত দৃষ্টিতে পাঁচ সেকেন্ডের মতো তাকিয়ে থেকে শব্দ করে এক থা-প্প-ড় বসাল হিমেলের ডান গালে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে রাখা হাতটি হিমেলের নিজের ডান গালে চলে গেল। দারোয়ানের বিস্ময়ের শেষ নেই। দোলা রাগীকণ্ঠে বলল,
“রুচি এত খারাপ কেন? মায়ের বয়সী এক মহিলাকে প্রতিদিন হাই দিতে লজ্জা করে না?”
দারোয়ান কৌতুহল আটকে রাখতে না পেরে কথার মাঝখানে কথা বলে ফেলল। তবে এবার সে ভয়ে খুবই সমীহ করে বলল,

“আম্মা, আমনের বয়স কত? আমনেরে দেখলে তো মনে হয় না হিমেল বাবার মায়ের বয়সী হইবেন।”
দোলা রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই দারোয়ান চুপসে গেল।
“আমি যদি আর কখনও দেখেছি মাকে বিরক্ত করতে। তাহলে এর ফল কেমন হবে কোনো আইডিয়াও নেই। হাই দেওয়ার জন্য তখন আর এই হাতটা থাকবে না বলে দিচ্ছি।”

হিমেল একটা টু-শব্দও করল না। দোলা চলে আসার পর দারোয়ান হিমেলকে বলল,
“কিছুই তো বুঝলাম না কাহিনি বাবা। তুমি এই মেয়ের মাকে হাই দাও?”
গাল থেকে হাত নামিয়ে হিমেল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“হুম, চাচা।”
“কী আইশ্চর্য (আশ্চর্য) ব্যাপার-স্যাপার! মাইয়ার থেকেও কি মাইয়ার মা সুন্দর বেশি? বয়সের তো একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে।”
“কোনো ব্যাপার-স্যাপার নাই চাচা। আমি পছন্দ করি মেয়েটাকেই।”
“তাইলে মাইয়ার মায়রে হাই দাও ক্যান?”

“মেয়ের আগে মাকে পটাতে চেয়েছিলাম। আই মিন, শাশুড়ি হিসেবেই। কিন্তু ঘটনা ঘটে গেল উলটো!”
“মহব্বত তো খারাপ না। পুরা কথা না শুইনাই মাইয়া তোমারে মারব ক্যান? আর তুমিও কিছু কইলা না ক্যান? পুরুষ মানুষ এত ভীতু হয় নাকি ব্যাটা। কানের নিচে একটা দিয়া কানপট্টি গরম কইরা ফেলতা।”

“এই মেয়ের পরিচয় জানলে আপনার কানই গরম হয়ে যাবে।”
“কও কী! ডা-কা-ত বংশের মাইয়া নাকি?”
“নাহ্। ডা-কা-ত-দের য-ম বলতে পারেন।”
“সেইটা আবার কী?”

“পুলিশ।”
“লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। মাফ চাই, দুয়াও চাই বাজান। আমি কিছু কই নাই। তুমিও কিছু শুনো নাই। যা কইছি তা ভুইলা যাও। আমিও ভুইলা গেছি।”
হিমেল হাসল। ডান গাল ডলতে ডলতে আনমনেই দোলার কথা ভেবে হেসে ফেলে শব্দ করে।

দু’দিন জ্বরে ভুগে এখন কিছুটা সুস্থ হয়েছে পৃথুলা। তার জন্য সুন্দর একটা রুম বরাদ্দ করে দেওয়া হয়েছে। এখন আর তাকে বন্ধ রুমে আটকে রাখা হয় না। এই সুন্দর রুমটিতে সুন্দর একটা বারান্দাও আছে। সেখানে দাঁড়ালে ঠান্ডা বাতাস খাওয়া যায়। প্রকৃতির রূপ দেখে মুগ্ধ হওয়া যায়।

কিন্তু সন্ধ্যার পর এই মুগ্ধতা আর থাকে না। চারিদিকে অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও মনে জেগে ওঠে। ভূ’ত-প্রে’তে’র ভয় লাগে। বারান্দা তো দূরের কথা, রুমে থাকতেও তখন ভয় লাগে। গাছপালাগুলো দেখলে মনে হয় একেকটা অ’শ’রী’রি’র মতো করে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে বাড়িঘর নেই এটা একশো পার্সেন্ট শিওর। রাস্তাও যেই এই বাগানবাড়ি থেকে কতদূরে সেটাও পৃথুলার পক্ষে আন্দাজ করে বলা অসম্ভব।
দরজায় নক করছে শিমুল। পৃথুলা এতক্ষণ শুয়ে ছিল। উঠে গিয়ে দরজা খুলে বলল,

“কী?”
“স্যার, আপনাকে ডাকছে। আসুন।”
শিমুলের সঙ্গেই ড্রয়িংরুমে এলো পৃথুলা। আরশান বসে বসে একটা বই পড়ছিল। পৃথুলাকে দেখে বইটা বন্ধ করে বলল,
“আমি আর শিমুল চলে যাচ্ছি। আপনি খেয়ে-দেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়বেন। ভুলেও এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করবেন না। আর সেই চেষ্টা করেও লাভ নেই। অসম্ভব ব্যাপার। কোনোভাবে যদি বের হতে পারেনও তাহলে বেঁচে ফিরতে পারবেন না। এই জঙ্গলেই বন্য জ-ন্তু-র খাবার হয়ে যাবেন।”

পৃথুলার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে চিৎকার করে বলে,
“চলে যাবেন মানে কী? কোথায় যাবেন আপনারা?”
“আস্তে! এত জোরে কথা বলছেন কেন? কোথায় যাব আর? বাড়িতে যাব। এই দু’দিন আপনি অসুস্থ ছিলেন তাই আমরাও এখানে ছিলাম। এখন তো আপনি সুস্থ। আপনার সঙ্গে সংসার করার জন্য তো এখানে তুলে নিয়ে আসিনি।”
পৃথুলা ধপ করে আরশানের পাশে বসল। আরশানের হাতটা নিজের কপালের ওপর রেখে বলল,

“আমি এখনও অসুস্থ। এই দেখুন গায়ে জ্বর আছে। কোথাও যাবেন না প্লিজ একা রেখে!”
আরশান হাত সরিয়ে নিল। দূরত্ব বজায় রেখে বলল,
“এসব ন্যাকামি আমার সাথে করবেন না। এখন ভালো ব্যবহার করছি বলে যে পরেও ভালো ব্যবহার করব এরকমটা ভাবা বোকামি। আপনি যদি আমার কথা না শোনেন, তাহলে আপনাকে মে-রে গু’ম করে ফেলতেও আমি দু’বার ভাবব না।”
পৃথুলা অসহায়ের মতো বলল,

“আমি সত্যিই শিলা নই। যদি হতামই তাহলে এত অত্যাচার সহ্য করে এই জঙ্গলে পড়ে থাকতাম না। আমার জীবনের মায়া আছে।”
আরশান রাগে উঠে গেল। সে জেদ দমিয়ে রাখতে পারল না।
“এক কথা আর কতবার শুনব? আপনি কেন এরকম করছেন বলুন তো?”

আরশানকে সত্যিটা বিশ্বাস করাতে ব্যর্থ হয়ে চুপ হয়ে যায় পৃথুলা। সে কণ্ঠ খাদে ফেলে বলে,
“বিশ্বাস না করলে কী করব আমি? কিন্তু প্লিজ! আমাকে একা রেখে যাবেন না এখানে।”
আরশান কিছু বলতে যাবে শিমুল তখন থামিয়ে দিয়ে চোখ দ্বারা ইশারা করল। যার অর্থ, তাদের এখানে থাকা উচিত। শিমুল পৃথুলাকে বলল,

“আপনি নিজের ঘরে যান।”
“কেন? আপনারা চলে যাবেন?”
“না।”
“বিশ্বাস করব কীভাবে? কোথাও যাব না। আমি এখানেই থাকব।”

পৃথুলা সেখানে বসে থাকলেও আরশান থাকেনি। সে অন্য রুমে চলে গেছে। থাকতে যখন হবেই তখন আর কী করার! তবে সে বুঝতে পারছে না, কী করে সে তার কার্য হাসিল করবে। মেয়েটার এমন আচরণ! সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে না তো?

রাতে আরশানের ঠিকমতো ঘুম হয়নি। প্রায় সারা রাত জেগে সে প্ল্যান বানিয়েছে। ঘুমিয়েছিল ভোর রাতের দিকে। সকাল সকাল শিমুল বাইরে গেছিল খাবার এবং প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কিনতে। ফিরে এসেছে সে হন্তদন্ত হয়ে। আরশানের রুমে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ডাকতে থাকে,

“স্যার, উঠুন। তাড়াতাড়ি উঠুন।”
আরশান চোখ ডলে উঠে বসল।
“কী হয়েছে?”
“নিউজ দেখেছেন স্যার?”
“কোন নিউজ?”

শিমুল টিভি অন করে নিউজ চ্যানেলে দিল। শিলার ভিডিয়ো ক্লিপ। সেখানে শিলা বলছে,
“আমি এডভোকেট শিলা চৌধুরী। বর্তমানে মানসিকভাবে আমি ডিপ্রেশনে আছি। রাফসান চৌধুরীর কেসটা নিয়ে আপাতত আমি কোনো কাজ করতে পারব না। তাই মানসিক ডেভেলপমেন্টের জন্য দেশের বাইরে আছি।”
ব্যস এইটুকু ভিডিয়ো ক্লিপ-ই যথেষ্ট ছিল বড়োসড়ো ধাক্কা খাওয়ার জন্য। আরশান অস্ফুটস্বরে বলল,
“অবিশ্বাস্য!”

“স্যার, মেয়েটা তাহলে ঠিকই বলেছিল। আমরা শিলা নয় বরং তার বোনকে তুলে নিয়ে এসেছি।”
“শিট! এত বড়ো মিস্টেক হয়ে গেল। কিন্তু আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না, শিলা হঠাৎ করে দেশের বাইরে চলে গেল কেন?”

“আমিও তো বুঝতে পারছি না স্যার। এখন কী হবে? এদিকে যে, আমরা আবার তার বদলে তার বোনকে নিয়ে এসেছি।”
আরশান নিজের চুল নিজে টানছে। মাথা কাজ করছে না একদম। সে বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে বলল,
“যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। এখন পৃথুলা মেয়েটাকে ছাড়া যাবে না। একই তো অসুস্থ। তার ওপর মুখ তো দুজনেরই এক। এই নিউজ ধামাচাপা না পড়া অব্দি মেয়েটা এখানেই থাকবে।”

“আর রাফসান স্যারের কেসটা?”
“ওটা বাবার সাথে আলোচনা করব আগে।”
“ঠিক আছে স্যার।”
“মেয়েটা কি উঠেছে?”
“জানি না স্যার।”

“দেখো গিয়ে। না উঠলে উঠিয়ে খেতে দাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
শিমুল পৃথুলাকে ডাকতে গিয়ে দেখল রুমের দরজা খোলা। তবুও সে দরজায় নক করে গলার স্বর বাড়িয়ে বলল,
“আসব?”

“আসুন। আমি বারান্দায় আছি।” ভেতর থেকে উত্তর দিল পৃথুলা।
শিমুল সোজা বারান্দায় চলে গেল। পৃথুলা আনমনা হয়ে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দু’দিনেই মুখটা শুকিয়ে গেছে একদম। শিমুল বলল,
“স্যার খেতে ডাকছে। আসুন।”
“আসছি।”

বলে পৃথুলা একবার শিমুলের দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,
“টুনটুনি দেখা যাচ্ছে।”
সঙ্গে সঙ্গে শিমুল প্যান্টের চেইনের ওপর হাত রাখল। পৃথুলা ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,

মহাপ্রস্থান পর্ব ২

“কী হলো? আপনি ওমন করলেন কেন? আমি টুনটুনি পাখির কথা বলেছি।”
শিমুল হতাশসুরে বলে,
“আপনি তো আমাকে ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলেন।”

মহাপ্রস্থান পর্ব ৪