মহাপ্রস্থান পর্ব ৫

মহাপ্রস্থান পর্ব ৫
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

শিমুলের প্রচণ্ড জ্বর। গত পরশু থেকে সে বাড়িতে বিছানায় পড়ে আছে। জ্বর আসার হেতুও রয়েছে। বাড়ি ফেরার পথে অসময়ের বৃষ্টিতে পেয়েছিল। অসুস্থ থাকায় সে বাগানবাড়িতে আসতে পারছে না। আপাতত আরশানকেই এদিকটা সামলাতে হচ্ছে। সারাদিন রাত সে নিজের ঘরে দরজা আটকিয়ে বসে থাকে। বিষয়টা এমন হয়ে গেছে যে, পৃথুলা ছেলে এবং সে-ই মেয়ে। সত্যি বলতে পৃথুলার অত্যাচারে সে অতিষ্ঠ। মাঝে মাঝে রাগে ইচ্ছে করে মে-রে ফেলতে। কিন্তু অযথা চাইলেই কি আর একটা মানুষকে মে-রে ফেলা যায়?

আজ তাকে বাড়ির বাইরে যেতে হবে। অফিসে জরুরী কাজ রয়েছে। এছাড়া বাবার সাথেও রয়েছে তার জরুরী আলাপ। রাফসানের কেসটা এখনো ঝুলে আছে। কোনো এডভোকেটই চাচ্ছে না এই কেস নিতে। এসব নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা দরকার। সকালে বাবা তাই ফোন করেছিলেন। আরশান রেডি হয়েই পৃথুলাকে ড্রয়িংরুমে আসতে বলেছে। যেই না পৃথুলা শুনেছে আরশান তাকে এখানে একা রেখে যাবে, ওমনি তার নাটক শুরু হয়ে গেছে। এইতো পৃথুলা এখন সদর দরজার সামনে দু’হাত মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার এক কথা সে তোতাপাখির মতো বলে চলেছে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমাকে একা রেখে আপনি কোথাও যেতে পারবেন না। কোথাও না মানে কোথাও না।”
আরশান কোমরে হাত গুঁজে অনেকক্ষণ যাবৎ পৃথুলার বকবক শুনছিল। এবার সে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
“তিড়িংবিড়িং না করে দয়া করে একটু শান্ত হয়ে দাঁড়ান। ফড়িং এর মতো এমন লাফাচ্ছেন কেন?”
“আপনি আমাকে একা রেখে যাবেন কেন?”
“আমাকে যেতে হবে।”

“তাহলে আমাকেও সাথে নিয়ে চলুন।”
আরশান কিছুক্ষণ ভাবুকচিত্তে দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
“ওয়েট।”
পৃথুলা দাঁড়িয়ে রইল। আরশান নিজের ঘরে গিয়ে আবার চট করেই ফিরে এলো। তার হাতে মাস্ক এবং একটা কালো কাপড়। সে পৃথুলার উদ্দেশ্যে বলল,

“এদিকে আসুন।”
“কেন?” ভ্রুঁ কুঁচকে জানতে চাইল পৃথুলা।
“এত প্রশ্ন করছেন কেন? আপনি যাবেন নাকি এখানেই থাকবেন?”
“অবশ্যই যাব।”
“তাহলে কথা না বাড়িয়ে যা বলছি শুনুন। আপনাকে আমি খেয়ে ফেলব না।”

পৃথুলা এগিয়ে এলো। আরশান তাকে মাস্ক পরতে দিয়ে কাপড়টি দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলল। পৃথুলা নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
“এসবের আবার কী দরকার ছিল?”
আরশান পৃথুলাকে গেটের বাইরে নিয়ে দরজায় তালা দিতে দিতে বলল,
“অনেক প্রয়োজন ছিল।”

“ছাই! এখন যে আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না অন্ধকার ছাড়া। আমি হেঁটে যাব কীভাবে?”
“সেই চিন্তা আমার। আসুন আপনি।” বলে আরশান পৃথুলার এক হাত ধরল।
“ওহ আচ্ছা! হাত ধরার বাহানায় এত কিছু?”

আরশানের মেজাজ চড়ে গেল। তারা বাড়ি থেকে জঙ্গলের পথে হাঁটা শুরু করেছে। পাশেই পানিতে পরিপূর্ণ একটা খাল। পানির রঙ সবুজ। শ্যাওলা রয়েছে চারিদিকে। আস্ত মানুষ মে-রে ফেলে রাখা যাবে। আরশানেরও এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো পৃথুলাকে ধাক্কা দিয়ে খালে ফেলে দিতে। তাহলে বকবক করার মজা বুঝত। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“মেয়ে মানুষের শরীরের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই।”
পৃথুলা অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,

“কী? তার মানে কি ছেলেদের শরীরের প্রতি আপনার আগ্রহ রয়েছে? ছি, ছি আপনি তাহলে একজন গ…”
কথাটি সম্পূর্ণ করার আগেই আরশান ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
“আর একটা বাজে কথা বললে এখানেই মে-রে ফেলে রেখে যাব। জানের মায়া থাকলে চুপ থাকেন।”
পৃথুলা চুপসে গেল। সে আর কথা না বাড়িয়ে এখন চুপচাপ হাঁটছে। জঙ্গলের পথ এখনো শেষ হয়নি। কিছুটা ভয় এবং সাহসের মিশ্রণ ঘটিয়ে পৃথুলা জানতে চাইল,

“আর কতক্ষণ লাগবে?”
আরশান গম্ভীরসুরে বলল,
“দুই মিনিট।”
মিনিট দুয়েক মাঝে ওরা রাস্তায় চলে আসে। আরশান আগে পৃথুলাকে গাড়িতে বসিয়ে সে পরে ড্রাইভিং সিটে বসে। এর মাঝে আরশানের একটা ফোন আসে। বেশি কথা সে বলেনি। শুধু ‘কেন, হু, আচ্ছা’ এই তিনটা শব্দই পৃথুলা শুনতে পেয়েছে। এদিকে এরকম চুপ করে বসে থাকতে থাকতে পেট ফুলে যাচ্ছিল তার। সে বিরক্ত হয়ে বলল,

“এভাবে কি চুপ করে থাকা যায় নাকি?”
আরশান একবার তাকাল ওর দিকে। ফের ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিয়ে বলল,
“সারাক্ষণ টেপ রেকর্ডারের মতো বকবক করতে পারলে এখন চুপ করেও থাকতে পারবেন।”
“আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”
“কেন?”

“এইযে আপনি কথা বলতে দিচ্ছেন না। কিছু বললেই মে-রে ফেলার ভয় দেখাচ্ছেন।”
“আপনি ভালো কথা বলতে পারেন না বলেই কথা বলতে দিচ্ছি না।”
“কেন? আমি খারাপ কী বলি? আমি তো শুধু আপনার কথার প্রেক্ষিতেই উত্তর দেই। এই যেমন একটু আগে বললেন আপনার নাকি মেয়ে মানুষের শরীরের প্রতি আগ্রহ নেই। তাহলে নিশ্চয়ই ছেলেদের শরীরের প্রতি আগ্রহ আছে? আর ছেলে হয়ে ছেলেদের শরীরে আগ্রহ! ছি, ছি। এদেরকে তো গে বলে। কিন্তু আমি তো আপনাকে একবারও বলিনি। আপনিই বলেন। বলেছি আমি?”

আরশান সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ব্রেক কষল। আ-গু-ন ঝরা দৃষ্টিতে সে পৃথুলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পৃথুলা তার নিজের মতো করেই বলে যাচ্ছে,
“এবার আমার কাছে সবটা পরিষ্কার। আপনি আর শিমুল তুলা একই ওয়াশরুমে!”
“আপনি থামবেন?” ধমকে উঠল আরশান।

“আজব! ধমকাচ্ছেন কেন আমায়? একই তো চোখ বেধে রেখে কানা বানিয়ে রেখেছেন। এখন আবার মুখ বন্ধ করিয়ে বোবা বানাতে চাচ্ছেন। কেন বলুন তো? আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি?”
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে আরশানের। সে পৃথুলার ওড়না এক টানে হাতে নিয়ে এলো। পৃথুলা হতবিহ্বল হয়ে বলল,
“কী করছেন আপনি? আপনি যে ঐটা না তা প্রমাণ করতে চাইছেন এখন? আমি একদম কিন্তু আপনাকে কিছু বলিনি আপনি…”

ওড়না দিয়ে পৃথুলার মুখ বেঁধে দেওয়ায় কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল তার। এতক্ষণে একটু দম নিতে পারছে আরশান। সে শান্তিমতো ড্রাইভ করতে পারছে। গাড়ির শব্দ ছাড়া সব চুপচাপ। পৃথুলা হাত বাড়িয়ে আরশানের মুখ, হাত ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করছে পাশে আদৌ কেউ আছে কিনা। আরশান হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“আছি, আছি। ভয় নেই।”

শপিংমলের সামনে এসে গাড়ি থামায় আরশান। পৃথুলার চোখ, হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে গাড়ি থেকে নামে। বলা বাহুল্য, এখনো সে পৃথু্লার হাত ধরে রেখেছে। পৃথুলার মুখে মাস্ক। সে চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে বলল,
“এখন তো চোখ খোলা। হাত ধরে রেখেছেন কেন?”
আরশান কোনো উত্তর দিল না। ওরা এসেছে একটা বোরকার দোকানে। বোরকা আর হিজাব, নিকাব কিনে পৃথুলার হাতে দিয়ে বলল,

“কোনো প্রশ্ন না করে পরে আসুন যান।”
“জান? জান ডাকলেন আমাকে?”
“যেতে বলেছি! আর একটাও প্রশ্ন করলে কিন্তু…”
পৃথুলারও সাহস হলো না প্রশ্ন করার।ট্রায়াল রুম থেকে বোরকা পরে আবার ফিরে আসে আরশানের কাছে। আরশান পূণরায় ওর হাত ধরে শপিংমল থেকে বের হয়। দুজনে যাচ্ছে বাস স্ট্যান্ডে। এটা দেখে পৃথুলা প্রশ্ন করে,
“আমরা কোথায় যাচ্ছি? গাড়ি কোথায়?”

আরশান অন্য হাত দিয়ে মাস্ক বের করে নিজে পরে নিল। দুজনে মিলে উঠল লোকাল বাসে। একটাও সিট নেই। লোকে গিজগিজ করছে। পৃথুলা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না বাসে। এজন্য সে সিট না থাকলে বাসে ওঠেও না। কিন্তু এখন কী করবে সে? তার রাগে কান্না পাচ্ছে। সে বাসের সিট শক্ত করে খামচে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তার পেছনে আরশান দাঁড়িয়ে আছে। এত মানুষের মাঝে ঠিকমতো দাঁড়ানোও যাচ্ছে না।

আরশান তার এক হাত পৃথুলার সামনে রাখল, যাতে করে কারও সাথে পৃথুলার ধাক্কা না লাগে। পৃথুলা পড়ে আছে তার বুকের কাছে। বলা বাহুল্য, সে আরশানের বুকের সাথে মিশে আছে। বাস চলতে শুরু করলে সে এক হাত দিয়ে আরশানের হাত চেপে ধরে। বিড়বিড় করে বলে,

“কেন যে ম-র-তে এই বাসেই উঠতে গেল। কা-না! বাসে যে সিট নাই দেখে না নাকি।”
আরশান কথাগুলো শুনতে পেয়েছে। সে ভাবলেশহীনভাবে বলল,
“ভয় কী? আমি তো আছি!”
“এজন্যই তো আরও বেশি ভয়।”

আরশান কটমট করে তাকায় পৃথুলার দিকে। পরের বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার পর কয়েকটা সিট খালি হয়। আরশানের পাশের একটা খালি সিটে পৃথুলাকে বসতে দিয়ে সে পাশে দাঁড়িয়ে রইল। বসতে পেরে এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে পৃথুলা। জানালার পাশের সিটটা পেলে আরেকটু ভালো লাগত। সে যা হোক, বসতে যে পেরেছে এটাই তো অনেক। বাস আবার চলতে শুরু করেছে।

কিছুক্ষণ বাদে সে স্পষ্ট টের পায় তার পাশে বসা লোকটি এদিকে চেপে আসছে। পৃথুলা ঘাড় ফিরিয়ে দেখল এবার। মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ। এতক্ষণ ঠিকঠাকভাবে বসলেও এবার তার বসার ধরণ পালটে গেছে। পৃথুলা বিরক্ত হয়ে আরশানের কাছ ঘেঁষে বসল। তবুও লোকটার স্পর্শ থেকে যেন রেহাই নেই। হাতের কনুই দিয়ে, পা দিয়ে নানান অজুহাতে সে পৃথুলাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছে। ঠিক সেই সময়ে সশব্দে চ-পে-টা-ঘা-ত পড়ে লোকটির গালে। ঘটনার আকস্মিকতায় পৃথুলাসহ বাসের অন্যান্য যাত্রীরাও চমকে যায়। আরশান পৃথুলাকে উঠিয়ে তার পাশে দাঁড় করাল। এরপর লোকটির কলার ধরে টেনে সামনে এনে আরও কয়েকটা থা-প্প-ড় বসিয়ে বলল,

“মেয়ে মানুষ দেখলেই কি শরীরের চু-ল-কা-নি বেড়ে যায়? আয় মলম লাগিয়ে দিচ্ছি।”
কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই আরও কয়েক ঘা পড়ল। বাসের সবার ঘটনা কী আর বুঝতে বাকি রইল না। তবুও একজন জিজ্ঞেস করল,

“কী হইছে ভাই?”
“আমার ওয়াইফ এখানে বসা। পাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি। তবুও এই জা-নো-য়া-রে-র কলিজা কত বড়ো ভাবেন একবার! নোংরামি ওর বের করছি আমি। কলিজা টেনে ছিঁড়ে ফেলব ওর।”
ঝামেলা বেশি হওয়ার পূর্বেই বাসের হেল্পার লোকটাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দিল। আরশান পেছন থেকে বলছে,

“তোকে যদি কোনোদিন আমি সামনে পাই সেদিনই তোর শেষদিন হবে মনে রাখিস।”
বাসের সবাই আরশানকে শান্ত হতে বলছে। এসব ঘটনা আজকাল অহরহ ঘটছে। কোথাও মেয়েরা নিরাপদ নিয়ে। এসব নিয়েই একেকজন কথাবার্তা বলছিল। পৃথুলা এবং আরশান এখন পাশাপাশি সিটে বসে আছে। পৃথুলা আড়চোখে আরশানের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,

মহাপ্রস্থান পর্ব ৪

“আপনি কি এখনো রেগে আছেন?”
আরশান কোনো উত্তর দিল না। পৃথুলা নিজের বুকের ওপর হাত রেখে ফিদা হওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“কী সুন্দর সবার সামনে আমাকে বউ বললেন! হায়ে! আপনার আমাকে মে-রে ফেলতে হবে না। আমি তো আপনার এ কথাতে এমনিতেই ম-রে গেলাম।”

মহাপ্রস্থান পর্ব ৬