মিতুর গল্প পর্ব ১
অনন্য শফিক
‘গত তিনমাস আগে এই মেয়েটি আমার কাছে এসে এবরোশন করিয়েছে আর তুই আমার ছোট ভাই হয়ে একেই বিয়ে করবি?আমি বেঁচে থাকতে এটা কোন ভাবেই পসিবল না!’
বিয়ের ভরা আসরে চিৎকার করে কথাটা বললো তরুণ ডাক্তার ইরম নাসের।ওর মুখ থেকে হঠাৎ করে এমন অদ্ভুত কথাটা শুনে উপস্থিত সবাই হকচকিয়ে গেল। এমনকি আজকের এই বিয়েতে বর সেজে আসা ইরম নাসেরের ছোট ভাই আহনাফ ধ্রুবও ঈষৎ কেঁপে উঠেছে।সে মাথা থেকে পাগড়ি খুলে রেখে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। তারপর উঁচু গলায় বললো,’ভাইয়া কী বলছো এসব তুমি?’
ইরম বললো,’যা বলছি তা একশো পার্সেন্ট সত্যি। এই মেয়ে কারোর সাথে আনলিগ্যেলি রিলেশনে গিয়ে কনসিভ করেছিল।চার মাসের প্রেগন্যান্সি অবস্থায় গিয়েছিল আমার চেম্বারে। আমার হাতে পায়ে ধরে রিকোয়েস্ট করে এবরোশন করিয়েছিল তখন।আমি তো আর জানতাম না এই মেয়ের সাথেই তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।এর আগে ছবি টবিও দেখিনি!ছবি টবি দেখলে তো অনেক আগেই বিষয়টা মিটমাট হয়ে যেতো!’
ধ্রুব কিছু বলার আগেই এবার তার মেজো মামা আলামিন শিকদার বলে উঠলেন,’এই বিয়ে ক্যান্সেল। উঠো, এক্ষুনি আমরা এই বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি!’
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
কী সর্বনাশের কান্ড!কী ভয়াবহ লজ্জার কথা! ওদের সামনে এসে দৌড়ে দাঁড়ালেন ধ্রুবর হবু শশুর আজমল মাস্টার। তিনি এসে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,’আপনারা শান্ত হোন দয়া করে! আমার মনে হয় আপনাদের কোথাও একটা বড়সড়ো ভুল হচ্ছে! আমার মেয়ে এমন মেয়ে না!মিতু খুব ভালো মেয়ে।লক্ষ্মী মেয়ে।আমি তো তাকে চিনি! আমি তো তার বাবা! আমার মেয়ে কখনো কারোর সাথে রিলেশনে জড়ায়নি ! আপনাদের ভুল হচ্ছে কোথাও! হয়তোবা আপনার চেম্বারে অন্য কেউ গিয়েছিল।অন্য কোন মেয়ে।হতে পারে ওর চেহারার সাথে আমার মিতুর চেহারার কিছুটা মিল আছে!’
ইরমের রাগে মাথা খারাপ হয়ে গেছে।সে নিজেকে সামলাতে না পেরে বাবার বয়সী আজমল হোসেনকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো,’নিজের নষ্টা মেয়ের জন্য পা ধরতে আসছেন এখানে লজ্জা করে না আপনার বুড়ো! শিক্ষক হয়েও নিজের মেয়ের চরিত্র ঠিক রাখতে পারলেন না। ওকে বানিয়েছেন নষ্টা।আর এই নষ্টা মেয়েটাকেই কি না আমার ভাইয়ের গলায় ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন! এই জন্যই আমি না করেছিলাম ছোট লোকদের সাথে কোন বৈবাহিক সম্পর্ক হতে পারে না! ছোট লোকদের চিন্তা ভাবনাও থাকে ছোট! কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমার মা গরীবের মেয়ে ঘরে তুলবেন। গরীবের মেয়ে নাকি সংসারের লক্ষ্মী হয়। এবার দেখুক এসে কেমন অলক্ষ্মী জুটেছে কপালে!’
কথাগুলো খুব তিক্ত ছিল। লজ্জায় নুইয়ে পড়ছিলেন তখন আজমল হোসেন।আর পর্দার ওপাশে থেকে মিতুও যেন লজ্জায় ঘৃণায় মরে যাচ্ছিলো! কিন্তু এই মুহূর্তে সে কিছুই করতে পারছিলো না কান্না করা ব্যতীত!
ইরম, ধ্রুব আর তার মামা যখন বিয়ের আসর ছেড়ে গাল বকাবকি করতে করতে চলে যাচ্ছিলো তখনই সুঠামদেহী শ্যাম বর্ণের অথচ মিষ্টি চেহারার একটি ছেলে এসে তাদের সামনে দাঁড়ালো। ছেলেটির চেহারা মিষ্টি হলেও এই মুহূর্তে তার চেহারা ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে।তার হাতে একটি লম্বা রামদা।সে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়ে বললো,’এখান থেকে বিয়ে না করে এক পা ও সামনে এগুতে পারবি না তোরা!যা ভালোই ভালোই বিয়ের আসরে গিয়ে বোস বলছি । এখান থেকে বিয়ে না করে জীবিত যেতে পারবি না তোরা!’
ইরম ধ্রুবরা এমন কিছুর আশা করেনি ঘুণাক্ষরেও।ওরা কেমন যেন থমকে গেছে হঠাৎ!
আজমল হোসেন এসে তখন বাঁধা দিলেন ওকে।রামদাটা ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন,’এসব কী করছিস শুভ !উনারা না মেহমান? মেহমানদের সাথে কেউ এমন অসভ্য কাজ করে শুভ?’
শুভ তখন চেঁচিয়ে বলে উঠলো,’না মামা ওরা মেহমান না।ওরা একেকটা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট!ওরা অমানুষ! এদের উচিৎ শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো আজ!’
ধ্রুবর মামা তখন রেগেমেগে আগুন হয়ে উঠে বললো,’লজ্জা নাই তোমাদের মিয়া? নিজেদের মেয়ের চরিত্রের নাই ঠিক আর আসছো তাকে জোর করে বিয়ে দিতে!’
এই কথাটা আর সহ্য হলো না শুভর। নিজের রাগকে সংবরণ করতে না পেরে ধ্রুবর মামার গাল খসে একটা শক্ত চড় বসিয়ে দিয়ে বললো,’কুত্তার বাচ্চা, আরেকবার যদি মিতুকে নিয়ে এমন নোংরা কোন কথা বলিস তবে তোর জিভটা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো আমি!’
আজমল হোসেন এবার শুভকে টেনে আনলেন। তারপর ওকে দুটো চড় থাপ্পড় দিয়ে বললেন,’যা এখান থেকে ভাগ বেয়াদব! আমার চোখের সামনে আর পরবি কখনো তুই!’
মামার চড় খেয়ে একটু পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো শুভ। কিন্তু ওখান থেকে চলে গেল না একেবারে।
আর তখনই আরেকটি ঘটনা ঘটলো আচমকা।ধ্রুব হুট করে বলে উঠলো,’আমি এই বিয়েটা করবো।যা হয়েছে তা অতীতে হয়েছে। কিংবা কিছুই হয়নি।তোমরা ভুল অনুমান করছো। কিন্তু এসব নিয়ে আমি লোক হাসাতে চাই না আর!’
ইরম ছোট ভাইয়ের কথাটা শোনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো একেবারে!সে ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বললো,’এসব কী বলছিস তুই ধ্রুব? পাগল টাগল হয়ে গিয়েছিস নাকি তুই?’
ধ্রুব তখন এক কথায় বললো।সে বললো,’আমি এই বিয়েটা করবো এটাই ফাইনাল কথা।আর কোন কথা হবে না এখানে। আমার বিয়ে আমি করবো। কারোর কথা শুনবো না আমি!’
ইরম রাগে ক্ষোভে লজ্জায় এতো টুকু হয়ে গেল যেন।সে এই অপমান সহ্য করতে না পেরে ধ্রুবকে বললো,’তুই আর কখনো আমায় ভাই বলে ডাকতে পারবি না!তুই আমার চোখের সামনেই পরবি না কখনো!আজ থেকে আমি একা। আমার কোন ভাই টাই নাই!’
কথাটা বলে তরুণ অহংকারী ডাক্তার ইরম নাসের দ্রুত পা ফেলে এখান থেকে প্রস্থান করলো।সে আর এক মুহূর্তও এখানে থাকবে না।গাড়ি নিয়ে চলে যাবে বাসায়।
ইরমের পেছন পেছন তার মেজো মামা আলামিন শিকদারও চলে গেল। শুধু যাওয়ার সময় ছোট ভাগ্নে ধ্রুবকে বলে গেল,’তোর মতো নীচু মানসিকতার ছেলে আমার ভাগ্নে এটা ভাবতেও আমার লজ্জা করে! এই বাড়িতে আমি অপদস্থ হয়েছি।একটা হাঁটুর বয়সী ছেলে আমায় অপমান অপদস্থ করেছে। আমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছে।আর আমার অপমানের কোন প্রতিশোধ না নিয়ে তুই ওই নষ্টা মেয়েটাকেই বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস! আচ্ছা কর তুই বিয়ে। কিন্তু মনে রাখিস চিরদিনের জন্য তুই তোর মেজো মামাকে হারাচ্ছিস!’
কথাগুলো বলেই আলামিন শিকদার চলে গেল।সে তার বড় ভাগ্নের গাড়ি করে চলে যাবে বাসায়।এতো অপমানের পর এখানে থাকার কোন প্রশ্নই আসে না। ছিঃ!তার ঘেন্নায় বমি আসছে মুখ ভরে!
এখানে শুধু রয়ে গেল ধ্রুব। আর একটি মানুষও নেই বর পক্ষের।সবাই চলে গেছে ইরম আর আলামিন শিকদারের পেছনে পেছনে।তারা এমন অপমানজনক বিয়েতে থাকতে চায় না কিছুতেই।যার বিয়ে সে একাই থাকুক এখানে। থেকে বিয়ে করে বিয়ের শখ পূরণ করুক!
ধ্রুব অবশ্য এতে মোটেও ঘাবড়ে যায়নি। বিচলিত হয়নি একটুও।সে তার হবু শশুর আজমল হোসেনের কাছে ক্ষমা চায়লো।বললো,’যা হয়ে গেছে এর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে ওরা ভুল বুঝেছে। আমি জানি মিতু এরকম মেয়ে নয়।আমি ওকে বিয়ে করে ওদের দেখিয়ে দিবো আমিও ওদের আজগুবি কথায় বিশ্বাস করিনি!’
আজমল হোসেন সীমাহীন খুশি হলেন।খুশি হলো বাড়ির আর সবকজন মানুষও। এমনকি মিতু যে এতোক্ষণ বসে বসে মরা কান্না কাঁদছিলো সেও এখন আনন্দে আগডুম বাগডুম বাজাচ্ছে!
শুভ দৌড়ে গিয়ে কাজী সাহেবকে ডেকে নিয়ে এলো। এবং সুন্দর পরিপাটি ভাবে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হলো। বিয়ের পর আজমল হোসেন খুব করে কাঁদলেন।ধ্রুবর হাত ধরে বললেন,’বাবা, এই মেয়েটি আমার মা হীন! ছোট থেকেই বড় কষ্টে কষ্টে বড় হয়েছে। ওকে তুমি কষ্ট দিও না বাবা!ও তো ছোট মানুষ। বয়সে কাঁচা।ওর ভুল ত্রুটি গুলো আপন গুণে ক্ষমা করে দিও। ওর ভুল গুলো ওকে ধরিয়ে দিও!’
ধ্রুব বললো,’বাবা আপনি একটুও ভাববেন না!মিতু কোনদিন আপনার কাছে কোন অভিযোগ করার সুযোগই পাবে না ইনশাআল্লাহ! তাছাড়া আমার মা কতোটা ভালো মানুষ সে ওখানে গেলেই টের পাবে!’
আজমল হোসেন যেন এবার একটু স্থির হতে পারলেন। তিনি মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে এবার বললেন,’মা, কখনো কোন ভুল করো না। ওখানে অনেকেই অনেক কিছু বলবে!তুমি বড়দের সাথে কখনো উঁচু গলায় কথা বলো না।সব সময় মনে রেখো তুমি আজমল মাস্টারের মেয়ে।সবাই জানে আজমল মাস্টারের মেয়ে কতটা লক্ষ্মী! তাছাড়া তোমার কোন চিন্তা নাই।সব কথার জবাব ধ্রুব বাবাই দিবে!’
ধ্রুব আবার বললো আজমল হোসেনকে।বললো,’বাবা আপনি একটুও টেনশন করবেন না।আমি তো আছিই। ওদের কারোরই সাহস হবে না কিছু বলার! আমার সামনেই ওরা দাঁড়াতে পারবে না!’
তারপর গাড়িটি ছেড়ে দিল।ড্রাইভার ছাড়া এই গাড়িতে শুধুমাত্র ওরা দুজন।ধ্রুব আর মিতু। মিতুর খুব কান্না পাচ্ছে।কান্না পাচ্ছে বাবার জন্য। শৈশব কৈশোর খাটানো কাঠ বাঁশের বাড়িটির জন্য। মিষ্টি বড়ই গাছটির জন্য। আর সুপুরি গাছ ভর্তি বাবুই পাখির বাসাগুলোর জন্য।
ধ্রুব ওর পাশেই বসা ছিল।সে শান্ত গলায় মিতুকে বললো,’মিতু,আর কেঁদো না! এখন কেঁদে গলাটা ভেঙে ফেলো না! ‘
মিতু কিছুই বুঝতে পারলো না। তবে সে চুপ হয়ে গেল। চোখের জল মুছে ফেললো সবুজ রুমাল দিয়ে। তারপর খানিক পরপর চোরা চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো ধ্রুবকে।এর আগে সামনাসামনি একবার দেখেছে সে ধ্রুবকে।ধ্রুব সুন্দর। দেখার মতো ওর চেহারা। তবে ওর চেহারায়ও ওর ইরম ভাইয়ের মতো অহংকার পূর্ণ। দেখলেই কেমন ভয় ভয় করে!মনে হয় এই যেন তেড়ে মারতে আসবে!
ধ্রুব বউ নিয়ে তাদের বাসার গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারছে না কিছুতেই।কেউ ওকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না।ওর মা তো এসে ভয়াবহ এক কান্ডই করলো।ছেলে আর ছেলের নতুন বউয়ের দিকে নিজের পায়ের জোড়া স্যান্ডেল ছুড়ে মেরে বললো,’এখান থেকে বেরিয়ে যা বলছি!এই বাসায় তোদের কোন ঠাঁই নেই!’
সবাই ওদের দূর দূর করছে।যেন ধ্রুব কোন মানুষ বিয়ে করে নিয়ে আসেনি।সে একটি কুকুর বিয়ে করে এনেছে। কিংবা কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট কোন কিছু!
অবশ্য ধ্রুব তখন এক কাজ করলো।সে জোর
করেই একা একা তার মার কাছে এগিয়ে আসলো। এবং তার মায়ের একটা হাত ধরে জোর করেই টেনে নিয়ে গেল একটু আঁড়ালে। কানাকানি ফিসফিস করে মাকে সে কী যেন বললো। এরপরই সবকিছু কেমন সহজ হয়ে গেল।তার মা অহনা শিকদার আর মানা করলেন না।সাদরে গ্রহণ করলেন তিনি তার পুত্রবধূকে!
মিতু এতে বিগলিত হয়ে গেল।সে ভাবলো ওরা বুঝি সবকিছু ভুলে গেছে।ভুলে গিয়েই তাকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু সত্যিটা সে বুঝতে পারলো এর আরো কয়েক ঘণ্টা পরে। অর্থাৎ —–
খুব সুন্দর হয়েছে❤️❤️❤️