ভালোবাসার ফোড়ন শেষ পর্ব 

ভালোবাসার ফোড়ন শেষ পর্ব 
লেখনিতে : মিমি মুসকান

– হ্যাঁ সব জেনে বসে আছেন তো। আর এখানে এসব কিছুর প্ল্যান কে করলো।
– অবশ্যই সব আমি করেছি তবে আইডিয়া টা বাবা’র ছিলো!
– কিহহহহ!
– আরে আগে পুরো কথা শুনো! তারপর চিৎকার করো।
– মানে..
– মানে আমি শুধু বাবা কে বলেছি তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো, কিন্তু কিভাবে দেবো সেটা বলতে। বাবা বললো ছাদে ডেকোরেট করে সারপ্রাইজ দাও। অতঃপর কিভাবে ডেকোরেট করবো সেটা বলে দিলো ব্যস এতো টুকু’ই।
আমি কপালে হাত দিয়ে বলি..

– তাই বলে বাবা কে! আপনার ফ্রেন্ড দের কি অভাব পড়েছিল। আকাশ ভাইয়া কে জিজ্ঞেস করলে সেও বলতে পারতো।
– হ্যাঁ পারতো কিন্তু ওরা তোমার সাথে আমাকে নিয়ে সবসময় মজা করে। তাই এসব জিজ্ঞেস করিনি না হলে আমাকে যেখানে সেখানে ধরতো। তাই!
– তাই বলে বাবা কে!
– কেন বাবা’র আইডিয়া কি খারাপ ছিল নাকি! ইমপ্রেস হও নি তুমি! এমনে তে আমার বাবা আমার মা কে এরকম অনেক সারপ্রাইজ দিয়েছে তো এখন ছেলের দরকার পরলে বাবা’ই তো বলবে নাহ!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– আমার মান – সম্মান এর বারো টা বাজিয়ে দিয়েছেন!
উনি দাঁড়িয়ে বললেন…
– এতো কষ্ট করে এতো কিছু করলাম আর তুমি আমায় কথা শুনাচ্ছো!
আমি দাঁড়িয়ে উনার সামনে দাঁড়িয়ে বলি..
– হুম শুনাচ্ছি বেশ করেছি!
– দেখো ভালো হবে না বলছি।
– আপনার সাথে থেকে আমার কোন ভালো টা হয়েছে শুনি!
– ভূতনি একটা!
– ঘোড়ার ডিম!
– দেখেছো তুমি কখনো..

– না তবে দেখলে নিশ্চিত আপনাকে আগে খাওয়াতাম ‌
– এতো ঝগড়া কিভাবে করো তুমি।
– আমার মুখ আপনার সমস্যা।
উনি আমার কোমর টেনে কাছে টেনে বলেন..
– তুমি নিজেই একটা সমস্যা, যে কি না আমার জীবনে এসে জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছে।
– ঢং ছাড়ুন আমায়!
– তোমার কথা আমি আর শুনি, সেদিন শুনে শিক্ষা হয়ে গেছে আমার।
আমি একটা মুখ ভেংচি দেই। উনি বলে উঠে..

– এতো আনরোমান্টিক কেন তুমি! এতো কিছু করে একটা রোমান্টিক একটা মুহূর্ত বানালাম আর তুমি…
– কি আমি!
– আমার আনরোমান্টিক ভূতনি বউ তুমি!
– একদম আমাকে ভূতনি বলবেন না!
– আমি তো ভূতনি’ই বলবো, আর আমাদের বাচ্চাদের ও শিখিয়ে দেবো ভূতনি আম্মু বলে ডাকতে!
– বাচ্চা!
– হ্যাঁ..
– কার বাচ্চা?
– তোমার আমার!
– আপনি এতো দূরে চলে গেছেন।
– গেলে দোষ কোথায়?
– ভালোবাসি এখনো বলেছেন!
– কি মেয়েরে বাবা! এতো কিছু’র পরও উনার ভালোবাসা কথাটা শোনা লাগবে!
– হুম হুম লাগবে! বলুন আগে..
– যাও বলবো না কি করবে!
– তাহলে ছাড়ুন আমায়।
– ছাড়বো না কি করবে?
– তাহলে দাঁড়িয়ে থাকেন।

– সমস্যা নেই তোমাকে নিয়ে সারাজীবন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো আমি!
উনার কথায় আমি বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। মুখ সরিয়ে ফেলি। হঠাৎ উনি এক হাত দিয়ে আমার চুল গুলো কানে গুঁজে দেয়। অতঃপর আমার কানে হালকা ভাবে ফুঁ দেয়, আমি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে দেই। অতঃপর চোখ দেখি উনি আমার সামনে একটা শিউলি ফুল ধরে রেখেছে। বলে উঠে..

– নাও আমার ভালোবাসা’র ছোট একটা ফুল!
আমি মুচকি হেসে ফুলটা নেই! উনি আমাকে বলেন..
– ফুল তো নিয়ে নিলে এখনো কি ভালোবাসি বলা লাগবে..
উনার কথায় আমি মাথা নাড়ায়। উনি কিঞ্চিত হেসে বলে..
– অনেক জেদি তুমি!
অতঃপর আমার কোমর হালকা চেপে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আম উনার বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উনি বলে উঠেন….

– আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমার এই ভূতনি বউ টাকে খুব ভালোবাসি!
উনার কথায় আমি মুচকি হেসে বলি…
– আমি ভালোবাসি নাহ!
– কেন?
– কারন আমি আনরোমান্টিক!
উনি আমার কথায় বাঁকা হাসি দেন। অতঃপর হুট করেই আমার ঠোঁট জোরা দখল করে নেন। হঠাৎ এরকম করায় আমি অনেকটা ভয় পেয়ে যাই। উনার পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরি। আমার পুরো শরীর কাঁপছে। ৫ সেকেন্ড বাদেই উনি ছেড়ে দেন আমায়। কিন্তু আমি চোখ তুলেই তাকাতে পারছি না। পুরো শরীর দিয়ে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে আমার। হঠাৎ করেই আমাকে কোলে তুলে নেন উনি। অতঃপর আমাকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠেন..
– এখন ভালোবাসতে পারি তোমায়!
আমি লজ্জায় উনার বুকে মুখ লুকাই!

ভোরে আমার ঘুম ভাঙে উনার বুকে মাঝে, উনার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলো আমার কপালে লাগছে। আমি সত্যি উনার চেয়ে অনেকটা খাটো। না আমি খাঁটো না, বরং উনি অনেক লম্বা! উনি এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি ভোরের অবছা আলোতে উনার মুখ দেখছি। সূর্য এখনো মেঘে ঢাকা, পাখিরা বোধহয় এখনো উঠেনি। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে হাঁটতে গিয়ে শাড়িতে টান খাই। পিছনে তাকিয়ে দেখি উনি আমার শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছেন। কিন্তু উনি উঠলেন কখন? বলে উঠি..

– আপনি উঠলেন কখন!
– যখন তুমি চুপিচুপি উঠে যাচ্ছিলে!
– চুপিচুপি যাচ্ছিলাম না।
– ওহ্ আচ্ছা তাহলে আমাকে কেন ডাকোনি!
– এমনেই। এখন শাড়ির আঁচল ছাড়ুন আমার, আপনি এই আকাম কখন করলেন বলুন তো।
– কতোই তো আকাম করলাম রাতে, আর তুমি শুধু এটার কথাই বললে।
– ছিঃ লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছেন নাকি।
– একটু খেয়েছি।

– নাহ অনেক খেয়েছেন এখন ছাড়ুন আরেকটু পর সবাই উঠে যাবে।
– হুম তুমি এসে শাড়ির আঁচল ছাড়িয়ে নাও। এটা আমার হাতে বাধা।
– যখন বাঁধতে পেরেছেন তখন ছুটাতে পারছেন না কেন?
বলে উনার কাছে গেলাম শাড়ির আঁচল ছুটাতে। শাড়ির আঁচল ছুটিয়ে আসতে যাবো হঠাৎ উনি আমার হাত ধরে ফেললেন। আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি মুচকি হেসে বলেন..
– আর একটা আকাম এখনো বাকি!
বলেই আমার কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ দিয়ে দেন।
আমি মুচকি হেসে উনার দিকে তাকিয়ে থাকি। কখনো ভাবিনি আমার ভালোবাসা এভাবে পূর্ণতা পাবে। উনি কখনো ভালোবাসবেন আমায় এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।

ভার্সিটিতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি আর উনি নিচ থেকে ভূতনি ভূতনি বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কান্ডজ্ঞান কিছু নেই উনার। আমি দ্রুত তৈরি হয়ে উনার কাছে গেলাম। উনি
আমাকে দেখে দাঁত বের করে হাসছে। আমি উনার দিকে তাকিয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলি..
– কি শুরু করেছেন বলুন তো! এভাবে চেঁচামেচি করছেন কেন!
– আমার বউ কে আমি ডাকছি কার কি শুনি!
– যেই ভূতনি ভূতনি বলে ডাকছেন কেউ বুঝবে না বউ কে ডাকছেন নাকি সত্যি সত্যি ভূতনি কে।
– এটা কিন্তু সত্যি তোমাকে বউ এর থেকে ভূতনি ডাকতে বেশি ভালো লাগে!
– সরুন তো আপনার আজাইরা পেচাল শুনার ইচ্ছে নাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
– হুম উঠো!
অতঃপর আমি গাড়ি তে উঠি। উনিও গাড়িতে উঠে গাড়ি ড্রাইভ করা শুরু করলেন। ভার্সিটিতে পৌঁছে বের হতে যাবো হঠাৎ উনি আমার হাত ধরে ফেলেন। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি..

– কি হলো?
– তোমার এফ বি আইডি আছে আমাকে বলো নি কেন?
– এটা আপনার এখন মনে পড়ল, এই সময়!
– হ্যাঁ দেখি তোমার ফোন দাও!
– কেন? চেক করবেন কে কে আছে আইডি তে!
– না তোমার রিলেশন স্ট্যাটাস single দেওয়া সেখানে married দিতে হবে তাহলে কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না।
– ঢং যতসব বাসায় গিয়ে দেবো।
– না এখন দাও! আর শোন কোন ছেলের সাথে কথা বলবে না।
– আরে আমি কখন বলি, দেখেছেন কখনো বলতে!
– আগে বলতে না এখন বলবে আমি জানি!
– মানে..

– দেখো আগে বলতে না কারন তখন কোনো কারন ছিল কিন্তু এখন থাকবে আমি তোমার সাথে ঝগড়া করলে তুমি ইচ্ছে করেই অন্য ছেলের সাথে কথা বলবে যাতে আমি জেলাস ফিল করি।
– মানে আপনি জেলাস!
উনি রাগি চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি চুপ হয়ে যায়। উনি বলেন..
– যা বলেছি মনে থাকবে।
আমি মুখ টিপে হাসছি আর মাথা নাড়ছি। উনি বলেন
“যাও এখন” বলেই বেরিয়ে পড়ি। বাইরে এসে যেন আমার হাসি থামছেই না। খুব হাসি পাচ্ছে এখন আমার। কিসব ভাবনা চিন্তা উনার। উনাকে দেখানোর জন্য নাকি আমি অন্য ছেলের সাথে কথা বলবো। এটা তো ভেবেই দেখেনি। হঠাৎ একটা ছেলের সাথে ধাক্কা খাই। আমার হাত থেকে বই গুলো পড়ে যায়। আমি উঠাতে যাবো ছেলেটা নিজেই উঠাতে লাগল । এর মধ্যে ইতি ডাক দিলো আমায়। আমি সামনে ফিরে ইতি কে দেখে হাত নাড়ি। অতঃপর ছেলেটার হাত থেকে বই নিয়ে তাকে ধন্যবাদ বলতে গিয়ে দেখি এটা উনি। প্রথমে উনাকে দেখে আমি চমকে যাই । অতঃপর আশপাশ তাকাই। উনি বলে উঠেন

– কাকে খুঁজছো ছেলেটাকে নাকি!
– আপনি কেন? ছেলেটা কোথায়?
– মাত্র’ই বললাম কোনো ছেলের সাথে কথা বলবে না আর এখানে এসে ছেলেকে খুঁজছো!
– আরে এটা তো… কিন্তু আপনি এখানে কেন? আমাকে ফলো করছেন আপনি।
– নাহ আমার আরো অনেক কাজ আছে। আমি ফোন নিতে এসেছি। ফোন দাও!
আমি উনাকে ফোন দিলে উনি সেটা নেন। অতঃপর আমি উনার হাত থেকে বই নিয়ে চলে আসতে গেলে উনি ইতি কে ডাক দেন। আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছি। উনি কিসব ইতি কে বলে চলে যান আর ইতি মুখ টিপে হেসে হেসে আসছে। আমি বলে উঠি…

– কি এমন হয়েছে যে তোর হাসি থামছে না।
– আগে বল কি হয়েছে?
– মানে..
ইতি আমার হাত টেনে বলে..
– সামথিং সামথিং!
– এভরিথিং এভরিথিং!
– কিহহহ?
– হুম।
– এই অপ্রকাশিত ভালোবাসা প্রকাশ হলো কিভাবে?
– যেভাবে তোর হলো!
– মানে..

– মানে… ( কাল রাতে ছাদের ডেকোরেট এর কথা গুলো শুধু বললাম )
– হাউ রোমান্টিক! ভাইয়া এতো রোমান্টিক আগে তো জানতাম না।
– আমি কবে জানতাম! কিন্তু এমন ভাবে কেন বলছিস ভাইয়া কি কম করেছিলো নাকি।
– আরে ও তো রেস্টুরেন্টে করেছিল। তো ডেকোরেট এর সব কিছু ওখানকার লোকজন সাজিয়েছে তবে ভাইয়া’র‌ টা সে নিজে সাজিয়েছে। মানে বুঝিছ! কতো কষ্ট করে সাজিয়েছে, কতো ভালোবাসা দিয়ে!

– মনে হচ্ছে তোর বিয়ে টা এবার দিয়ে দিতে হবে।
– সেটার জন্য আমি কতোদিন ধরে অপেক্ষা করছি!
– ছিঃ লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বসে আছিস দেখছি।
– সবাই যদি তোর মতো হতো তাহলে হতো ‌।
– তা আপনার রোমান্টিক ভাইয়া কি বললো?
– বলেছে আপনাকে দেখে রাখতে, আপনার সব খবর উনাকে দিতে। তাহলে আমাকে ট্রিট দিবে।
– আর তুই রাজি হয়ে গেলি।
– হি হি হি!
– রাখ তোর হি হি হি!
– আচ্ছা ক্লাসে চল এখন, দেরি হচ্ছে।
– হুম!

অতঃপর দুজনে গিয়ে ক্লাসরুমে গিয়ে বসলাম। স্যার এখনো আসে নি। আমি ব্যাগ থেকে কলম’টা বের করতে একটা চিরকুট পড়ে গেল। উনার লেখা চিরকুট! আমি এখানে রেখেছিলাম। ইতি সেটা ধরে ফেলল। অতঃপর চিরকুট পড়তে লাগল

“কাছে এসে জড়িয়ে ধরা বাকি,ভালোবাসি তোমাকে বলা বাকি…!”
– বাহ! কে লেখেছে এটা!
– তুই আগে দে এটা।
– ভাইয়া! ওয়াও কি রোমান্টিক!
– শেষ এখন দে এটা ‌
– কি করবি এগুলো!
– রেখে দেবো!
– স্মৃতি হিসেবে!
– হুম!
– অনেক সূক্ষ্ম ভালোবাসা দেখছি!

ইতি’র কথায় আমি হেসে দিলাম। সত্যি উনার ভালোবাসা আসলেই সূক্ষ্ম। দেখতে দেখতে প্রায় ১ মাস কেটে গেল! আপু’র বিয়ে ও হয়ে গেল। আপু চলে গেল শশুড় বাড়ি। উনার আর আমার ভালোবাসা আরো স্নিগ্ধ হতে থাকলো। সবার মতোই উনার আমার ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো। এই পূর্ণতা নিয়েই শেষ হলো আমার ভালোবাসা’র গল্প। আমার এই গল্প আমি স্মৃতি হিসেবে আজ ৮ বছর পর এই ডায়রিতে লিখে রাখছি। প্রতি বছর গ্রীষ্ম, বর্ষা,শরৎ, হেমন্ত,শীত আর বসন্তের মতো আরো ৮ টি বছর পার করলাম উনার সাথে। কোনো অভিযোগ নেই উনার প্রতি। আর হবে ও না! উনার ভালোবাসা আমার জীবনের ১৮ বছরের দুঃখ আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। এই ৮ বছরে আমি ‌যা সুখ পেয়েছি তা আমার ১৮ বছর দুঃখ কে ভুলাতে সক্ষম। আজ এই গল্পের সমাপ্তি হলো কিন্তু আমার ভালোবাসার না। এই ডায়রির প্রতি পাতায় উনার আর আমার কাটানো মুহূর্তগুলো লিখে লেখেছি কালো কালি দিয়ে, উনার দেওয়া প্রথম কাঠগোলাপ ,লাল – সাদা শিউলি আজ ও শুকিয়ে আছে এই ডায়রিতে। উনার দেওয়া সেই ভালোবাসার চিরকুট ও আছে এই ডায়রির একটি পাতায়। সযত্নে রেখে দিয়েছি সব কিছুই। সবশেষে একটা কথাই বলবো। আমি উনাকে ভালোবাসি! খুব ভালোবাসি..!

ডায়রির টা বন্ধ করে জানালার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। এই ৮ বছরে বদলেছে অনেক কিছু শুধু বদলায় নি উনার আর আমার ভালোবাসা। হঠাৎ করেই গাড়ির ঢোকার আওয়াজ পেলাম। আমি জানি কে এসেছে এখন। মুচকি হেসে ঘর থেকে বর হলাম। ভিতরে ঢুকেই চিৎকার শুরু হয়ে গেল..
– আহি’র ভূতনি বউ, আহি’র ভূতনি বউ! কোথায় আপনি!

আমি শাড়ির আঁচল টা কোমরে গুজে তাকিয়ে আছি অরনি’র দিকে। ছোট একটা মেয়ে, মাথায় দুই জুটি, পরনে স্কুল ড্রেস। ৬ বছরের মেয়ে একটা মেয়ে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। দেখতে পুরো উনার মতো। হাতের নখ থেকে শুরু করে পায়ের নখ পুরোটাই উনি। তবে কথা বলার তেজ নাকি আমার মতো। কারন উনি খুব শান্তশিষ্ট আর উনার মেয়ে ঠিক ততোটাই রাগী। কিন্তু আমার মটেই এটা মনে হয় না। যাই হোক এই আমার আর আহিয়ান এর মেয়ে অরনি! ৬ বছরের মেয়ে আমাদের। উনি উনার কথাটা ঠিকই রেখেছিলেন। মেয়ে জন্ম হওয়ার পর’ই মা বলা শেখানোর পরিবর্তে ভূতনি বলতে শিখালেন। তাও কি আহি’র ভূতনি বউ! সত্যি এটাও কি সম্ভব। নিজের মেয়েকে কেউ এসব শিখায়। এটা উনার পক্ষেই সম্ভব। অরনি আবার বলে উঠে…

– কি হলো কথা বলছেন না কেন?
– কি হয়েছে তোমার!
– অনেক কিছু!
– মানে..
– মানে এটাই আজ টিফিনে কি দিয়েছো।
সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে বলি…
– কেন? কি হয়েছে? খারাপ কি নুডুলস খেতে, সবসময় বার্গার খাওয়া ঠিক না।
– আজ বাপি আসুক আমি বলবো!
অরনির ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বের করে…
– খাওনি কেন?
– এই টিফিন কেউ খায় নাকি। পঁচা টিফিন! এভাবে এভাবে তোমাকে আহি’র ভূতনি বউ বলি!
– তবে রে দাঁড়া!

অরনি দৌড়াচ্ছে আর আমি ওর পিছু পিছু দৌড়াচ্ছি। অরনি চেঁচাচ্ছে আর বলছে…
– বাপি , দাদু দাদি কোথায় তোমরা তোমাদের ভূতনি বউ আজ আমাকে মেরে ফেলবেই। কোথায় তোমার! এই অসহায় মেয়েটাকে বাঁচাও!
– অসহায় মেয়ে আর তুমি! দাঁড়াও হচ্ছে আজ তোমার!
বলতে বলতে বাবা এসে পড়ল। অরনি গিয়ে বাবা’র পিছনে লুকালো। মা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন..
– কি হয়েছে নিহা!
– আপনার আদরের নাতনীকে জিজ্ঞেস করুন। আজও টিফিন শেষ করেনি আবার বড় বড় কথা বলছে।
বাবা বলে উঠে..
– অরনি এটা একদম ঠিক হয় নি। না খেয়ে থাকলে কেন তুমি! এভাবে না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে যে..
– কে বললো আমি খায়নি! আমি খেয়েনি!
আমি বলি উঠি..

– আচ্ছা কি খেলে তুমি!
– বার্গার, আইসক্রিম, চকলেট আর..
– কে খাওয়ালো এইসব!
– আমি খাইয়েছি..
বলতে বলতে আহিয়ান শার্টের হাতা ফ্লোট করতে করতে ভিতরে ঢোকে..
– আপনি! অফিসে যান নি আপনি!
– হুম গিয়েছি তো কিন্তু..
এর মধেই পিছন থেকে “মামানি” বলে ডাক দেয় ইয়ান। ইয়ান হলো আপু’র মেয়ে। ৭ বছর বয়স ওর। আমাকে দেখে জরিয়ে এসে আমাকে ধরে। উনি বলে উঠেন..
– আপু আর ভাইয়া আজ কাজে বাইরে যাবে। তাই বলেছে ইয়ান কে নিয়ে আসতে। ওকেই আনতে গিয়েছি।
– আর মেয়েকে এইসব হাবিজাবি খাইয়েছেন।
অরনি বলে ওঠে..

– হাবিজাবি না এইসব হেলদি জিনিস বুঝলে! নাহ বাপি!
– আসছে মহারানি!
অরনি এসে উনার কোলে উঠে বলে…
– নট মহারানি, আমি শেহজাদি আমার বাপি’র প্রিনন্সেস!
– হ্যাঁ প্রিনন্সেস’ই তো। যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে! ইয়ান যাও ফ্রেশ হয়ে নাও আমি তোমার জন্য খাবার‌ মিল্ক শেক নিয়ে আসছি।
– ওকে মামানি। অরনি আয়..
– হুম ভাইয়া! আহি’র ভূতনি বউ আপনাকে বলছি কাল থেকে এমন টিফিন দিবেন না আমাকে ঠিক আছে।
– তোমাকে কে তো আমি..
আর আগেই দুইজন দৌড়ে চলে গেল। মা বাবা হাসতে হাসতে চলে গেলেন। আমি রেগে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনার গলার টাই লুজ করতে করতে বলেন..
– তাকিয়ে আছো কেন এমন ভাবে..
– আপনার জন্য সব হয়েছে, আমার মেয়ে আমাকে মা বলেই ডাকে না।
– ডাকে তো মাঝে মাঝে!
– হ্যাঁ ডাকে তো, আপনার মতো। যখন আপনার দরকার হলে আপনি নিহা বলে ডাকেন তেমনি আপনার মেয়ের দরকার হলে মা বলে ডাকে।
– হুম আমার মেয়ে যখন বলছো আমার মতোই তো হবে।
– হ্যাঁ এটাই আমার দুর্ভাগ্য।
উনি আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে উপরে চলে যান। আমি রেগে রান্না ঘরে ঢুকি।

দুইজনকে রাতে খাইয়ে দিতে গিয়ে আমি শেষ, ইয়ান তাও শান্ত। একবার বললেই হয় কিন্তু আমার মেয়ে সে তো দুষ্টু’র সর্দার। এটা খাবো না ওটা খাবো না কতো বাহানা। পাগল হয়ে যাবার উপদ্রব। একটু আগে আমার রুমে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে মা বলে ডাকে। তখন’ই বুঝে যাই কিছু দরকার তার। সে গুটিগুটি পায়ে আমার কোলে এসে বসে। আমি বলে উঠি..
– কি লাগবে তোমার।
– মা শোন না।
– হুম আমার কান খোলাই আছে তুমি বলো!
– আমি না তোমার কতো ভালো মেয়ে বলো।
– হ্যাঁ তা তো অবশ্যই, কেন কি হয়েছে!

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ৩৬

– হুম এটাই টিচার আসবে বাসায় ‌ভিসিট করতে। তখন তুমি আমার নামে অনেক ভালো ভালো কথা বলবে, না হলে টিচার ক্লাসে গিয়ে সবাইকে বলে দিবে তখন সবাই আমাকে নিয়ে হাসবে।
– জানতাম এই জন্যই মা বলে ডাকছেন। তা আপনার বাপি কে বললেন না কেন?
– আরে মা তোমাকে কি এভাবেই আমার বাপি ভূতনি বলে নাকি। তুমি জানো না বাপি অফিসে থাকবে সে কিভাবে আমার সুনাম করবে বলো।
– ওহ আচ্ছা তাই না।
বলেই আমি ওকে শুড়শুড়ি দিতে থাকি। সে হেসে হেসে আমার কোলেই লাফাতে থাকে। অতঃপর মা আর ইয়ান এসে তাদের নিয়ে যায় গল্প শুনাবে বলে।‌সে নাচতে নাচতে চলে যায়।
বেলকনির গ্রিল ঘেসে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ করেই উনি আমার হাতে হাত রেখে পেছন থেকে আমার ঘাড়ে থিতুনি রাখে। আমি নিরব হয়ে উনার নিঃশ্বাস অনুভব করছি। হঠাৎ উনি বলে উঠে..

“Happy marriage anniversary ভূতনি”
উনার কথায় আমি হেসে উনার দিকে ফিরি। উনি বলে উঠেন..
– আজ ৮ টি বছর পেরিয়ে গেলো তোমার সাথে।
– সময় কিভাবে চলে যায় নাহ!
– হুম এই মনে হচ্ছে সেদিন ‌আমার অরনি কে প্রথম কোলে নিলাম আমি!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিঞ্চিত হেসে উনাকে বলি…

– Thank you আমার জীবনের বেস্ট এই ৮ বছর আমাকে দেওয়ার জন্য।
– তোমাকে Thank you, আমাকে একটা ছোট শেহজাদি দেওয়ার জন্য।
উনি হালকা ভাবে আমাকে জরিয়ে ধরলেন। আমি উনার বুকে মাথা রেখে বলি…
– বাকি টা জীবন এভাবে আমার পাশে থাকবেন!
– সারাটা জীবন থাকবো!