মেইড ফর ইচ আদার পর্ব ৮

মেইড ফর ইচ আদার পর্ব ৮
অনামিকা রহমান

সন্ধ্যার আযান শোনা যাচ্ছে। গেরুয়া যাওয়ার রাস্তার দুপাশে প্রকান্ড গাছ গুলোতে পাখিরা কিচিরমিচির করছে। সন্ধ্যার লালচে আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কাঠবিড়ালি গুলো গাছে একডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে চলছে। রাস্তার একপাশ থেকে হেটে চলেছে তৃনা আর আবির। কথা বলতে বলতে গেরুয়া এসে অটো তে উঠে আবির আর তৃনা। বাম পাশের রাস্তা ধরে উত্তর জামসিং যাচ্ছে অটো।রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট গুলোতে টিম টিম আলো জ্বলছে।মিষ্টি হাওয়া ছুয়ে যাচ্ছে দুজনকে, যেতে যেতে নানা কথা হয় দু’জনের মাঝে।বাসায় পৌছে ডিনার শেষে আবির তার মাকে নিয়ে ফের ছুটে চলে উত্তরার দিকে।

কাল দেখা করবে রোদেলা, বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে তোমায়। ফোনের ওপাশ থেকে রিয়াদ রোদেলাকে উদ্দেশ্য করে বলল।রোদেলা হেসে রিয়াদকে বলল, মনে আছে তো কিভাবে আসতে হবে। রিয়াদ লম্বা শ্বাস টেনে জবাব দিলো মনে আছে, লোকাল বাসে আসতে হবে। আমি বাঙলা কলেজ থেকে বের হয়ে মিরপুর ২এর পূর্নিমা রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করবো রোদেলা রিয়াদকে জানালো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রিয়াদ ফের আবার রোদেলাকে প্রশ্ন করলো, আমার তো তেমন আইডিয়া নেই বনশ্রী দিয়ে কত নেয় ভাড়া?রোদেলা হেসে জবাব দেয় মশাই ৭০টাকা নিবে। তবে আপনি এই লোকাল বাসের ঝামেলা সামলে যদি আমার সাথে দেখা করতে পারেন,বুঝতে পারবো আপনি জীবনে যত ঝামেলা আসবে আপনি আমার সাথে টিকে থাকতে পারবেন? যদি একবার পেরেই যান পরের বার থেকে আর লোকাল বাসে আসতে হবে না।
রিয়াদ মৃদু হেসে জবাব দেয় দেখা যাক, তাহলে ওই কথাই রইলো আসছি কাল। এই বলে রিয়াদ রোদেলাকে বিদায় জানলো।

বনশ্রী থেকে রিয়াদ বাসে উঠে। প্রথম দিকে বাস ফাকা থাকলেও ধীরে ধীরে পূর্ন হয় বাস। গন্তব্যর দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছে মানুষের কোলাহল তত বাড়ছে। লাইফে প্রথমবার রিয়াদ লোকাল বাসে যাত্রা করছে তাও প্রেয়সীকে দেখার টানে। এমন বিদঘুটে সময় কখনও পাড় করে নি রিয়াদ। বাস এসে থামে টেকনিক্যাল এর মোড়ে। ট্রাফিক আইন মেনে রাস্তা ক্রোস করছে বাস। কিছু বাস থেমে আছে, কিছু বাস বাক ঘুরে চলে যাচ্ছে। এরই মাঝে একদল হিজড়া বাসে উঠে পড়লো, যা রিয়াদের জীবনে কখনো ঘটে নি, তাই ঘটে গেলো।

এই দুষ্ট টাকা দে, এই দে না, হাতে তালি দিতে দিতে এক হিজড়া রিয়াদের বুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিল।রিয়াদ হতভম্ব দৃষ্টিতে চাইলো, তার সামনে দাড়িয়ে আছে একটা হিজড়া, দুহাত ভর্তি কাচের চুড়ি, সাথে লাল লিপ্সটিক,কপালে বড় একটা লাল টিপ। এর মাঝে আরেকজন হিজড়া রিয়াদকে ঢং লাগানো সুরে বলল, এই দুষ্ট ম্যারিড নাকি আনম্যারিড।রিয়াদ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাপা গলায় বলল, আনম্যারিড।হিজড়াটা রিয়াদের গালে আঙুল দিয়ে স্লাইড করে বলল, ওওওওও আই সি।

রিয়াদ দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। এমন পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিবে রিয়াদের জানা নেই। রিয়াদ তার মানিব্যাগ টা বের করে খুচরো টাকা খুজতে লাগলো, কিন্তু এবারেও রিয়াদ ব্যর্থ। ওদিকে হিজড়া রা রিয়াদকে ঘিরে আছে, তাই বাধ্য হয়ে ৫০০ টাকার একটা নোট তুলে দিলো।

এই টাকা পেয়ে যেনো খুশিতে নেচে উঠেছে হিজড়ারা। ফ্লাইং কিস করে হিজড়ারা বাস থেকে নেমে গেলো।আধঘন্টা বাদেই রিয়াদ মিরপুর ২ এসে পৌছায়। সিঁড়ি ভেঙে উঠে রেস্টুডেন্টে। এক কর্নারে বসে আছে রোদেলা। রোদেলা কে দেখে রিয়াদ একটা মিষ্টি হাসি দেয়, রোদেলা রিয়াদকে অবলোকন করে, শরীরে থেকে ঘামে ভিজে গেছে। রিয়াদ গিয়ে বসে পড়ে রোদেলা সম্মুখে,রোদেলা নিজ ব্যাগ হতে রুমাল বের করে রিয়াদকে দেয়।

তা মশাই আসলেন কিভাবে, বলেন তো আপনার জার্নি টা কেমন হলো। রিয়াদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে, ফের বলতে থাকে আসার পথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। রিয়াদের কথা শুনে রোদেলা খিল খিল করে হাসে। খুনসুটি ভরা কথার জুড়ি নিয়ে কেটে যায় অনেক সময়, দুই মানব-মানবীর মাঝে।রোদেলা সিএনজি ভাড়া করে রিয়াদকে উঠিয়ে দিয়ে, রোদেলা বাসে উঠে পড়ে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে।

এই মাইয়া রাস্তাটা কি তোমার বাবার। সাইকেল চালাতে না জানলে সেটা চালাও কেনো।
তুলি সাইকেলটা রাস্তা থেকে উঠাতে উঠাতে বলতে লাগলো সানিকে, হ্যা এটা আমার বাবার রাস্তা আপনার কি সমস্যা।

সানি ভ্রু কুচকিয়ে বলল যত্তসব আজাইরা।
ওই হ্যালো, কি বললেন, হাতে তুরি বাঝিয়ে তুলি বলল।
সানি আবার বলল যা শুনেছেন তাই বললাম।
আপনার মত ছেলেদের সাথে কথা বলাই উচিত হয় নি।
কথা কে বলতে বলেছে? যান না বাসায় যান এখানে দাঁড়িয়ে আমার সাথে ঝগড়া করছেন কেন? ঝগড়াটে মেয়ে কোথাকার.।

তুলি ভেংচি কাটে, সাইকেলে উঠে চলে যায় বাসার দিকে।
সানি তুলির পানে একবার চেয়ে, ফের নিজ রাস্তায় হাঁটা শুরু করলো।
কিছুক্ষন আগের কথা, তুলি কোচিং করে বাসায় ফেরার পথে সানির সাথে এক্সিডেন্ট করে।তখন তাদের মাঝে ঝগড়া ঝামেলা হয়।এই ঝগড়া ই তাদের জীবনের সাথে মিশে যাবে কে জানতো?

ওই তৃনার বাচ্চা তোগো বাসা কই,খুইজা পাইতাছি না।
তৃনা ফোনের ওপাশ থেকে বলতে লাগলো, আরে ছেকাখোর তোর নাম বদলে কালই রাখবো গজাল।আশেপাশে মানুষজন আছে কিনা দেখ। জিজ্ঞেস কর আহমেদ ভিলা কই, তাহলেই দেখিয়ে দিবে।

আর শোন মা যদি আমার কথা জিজ্ঞেস করে বলবি টিউশন গিয়েছে, আজ ইমতিয়াজ ভাইয়ের সাথে মিটিং আছে, তুই কিন্তু ভালো করেই জানিস আমার ফ্যামিলির কেউ জানে না, আমি রাজনীতির সাথে জড়িত। কথা বুঝে শুনে বলবি। আর যদি উল্টো পালটা যদি কিছু শুনি তাহলে তোর নামে একটা গুলি আমার পিস্তলে ঢুকতে ১সেকেন্ড ও সময় নেবো না, মাথায় কথাটা ঢুকিয়ে নে।
সানি শুকনো ঢোক গেলে,তৃনার কথায় জবাব দেয়, ঠিক আছে কমরেড আফা।

তুলি, তুলি
সাহেলা খানম চেচানোর সুরে তুলিকে ডাকছে।
কি হয়েছে আম্মা।
আজ তোদের রহিমা খালা আসতে পারবে না কাজ করতে। ঘরটা একটু ঝাড়ু দিয়ে দে।

তুলি ঝাড়ু হাতে নেয়।ধীরে ধীরে ঝাড় দিতে থাকে রুমের পর রুম। নিচে বসার ঘরে তুলি ঝাড় দিতে আসা মাত্রই কলিং বেল বেজে উঠে, ঝাড়ু থাকা অবস্থায় তুলি গেট খোলে, এইটা তৃনা পাঠিয়ে দিয়েছে বলতে বলতে তুলির পানে সানি তাকায়। তুলির ধুলোমাখা চেহারা,অগোছালো চুল দেখে সানি হেসে উঠে। আপনি নিশ্চিত এই বাসায় কাজ করেন।

তুলি চেচিয়ে বলতে লাগলো কেন ভাই আমায় কোন দিক থেকে এই বাসার কাজের লোক মনে হয়। আমি এই বাসার ছোট মেয়ে।
সানি মাথায় হাত দিয়ে বলল, হায় সবর্নাশ, আপনি তৃনার বোন।
তুলির চেচামেচির আওয়াজ শুনে সাহেলা খানম গেটে আসে, সানি সাহেলা খানমকে দেখে মিষ্টি করে সালাম দিয়ে তৃনার পাঠানো জিনিস গুলো সাহেলা খানমের হাতে তুলে দেয়। তৃনাদের বাসার কাজ সেরে সানি রিকশায় চেপে রেডিও কলোনি চলে যায়।

বড় ভাই কমরেড তৃনা এসেছে,
ওকে পাঠিয়ে দেও উসমান।
কিছুক্ষন বাদেই তৃনা প্রবেশ করে। আসসালামু আলাইকুম ইমতিয়াজ ভাই।

ইমতিয়াজ তৃনাকে বলল বসো। তৃনা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। আপনি যে কাজ গুলো আমায় দিয়েছিলেন, সেই গুলো আমি করিয়ে দিয়েছি। সামনে আমায় ২য় সেমিস্টারের পরিক্ষা তাই আমি কাজ থেকে বিরত থাকতে চাই। ইমতিয়াজ ভাই আপনি তো জানেন, আমি এই কমরেড পদ থেকে এক দিন না একদিন পদত্যাগ করবোই।

এটা আমার ফ্যামিলির ব্যাপার। আপনার সাথে কাজ করার সবার যোগ্যতা থাকে না। তাই যথা সম্ভব ফ্যামিলি যতদিনে না জানতে পারবে ততদিন রাজনৈতিক কমরেড হয়েই কাজ করবো। অনেক ভালোবাসা, সম্মান দিয়েছেন আমায়।
ইমতিয়াজ হাসে, তৃনাকে জবাব দেয় ঠিক আছে। তাহলে ওই কথাই রইলো ৩য় সেমিস্টারে উঠে আবার কাজ শুরু করবে।
তৃনা হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বাকি কথা শেষ করে ওই জায়গা থেকে বিদায় হয়।

হেই হেন্ডসাম বিজ্ঞানী মশাই । কোথায় আছেন, আজতো একবার ও কল করলেন না।
ফোন কলের ওপাশ থেক নরম গলায় আবির জবাব দিলো ল্যাবে আছি। এখন প্রফেসরের রুমে যাবো, কিছুক্ষন পর বাসায় যাবো।

হুম তা আমার সাথে ডেটে যাবেন। আমি আপনার গবেষণাগারের সামনে। আবির বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। জানালার কাচে চোখ ভুলিয়ে দেখে তৃনা স্কুটার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনে আবির বলতে থাকে ২মিনিট অপেক্ষা করো আমি স্যারকে বলে আসছি।

এখন বাজে ৩টা।ভার্সিটি থেকে বের হয়েছো কখন। এইতো দেড়টা নাগাত। আমি যতদূর জেনেছি আপনি তো আগে গবেষণা পড়াশোনা নিয়েই পড়ে থাকতেন তাই আমি ভাবলাম আপনাকে ঘুড়ানোর দায়িত্বটা আমিই নিয়ে নেয়, চলুন চলুন দেরি হয়ে যাচ্ছে। আবির গাড়ির দিকে হাটা শুরু করলে, তৃনা বলে উঠল, এই যে বিজ্ঞানী মশাই আমার সাথে ঘুরতে হলে ওই গাড়ি টাড়ি চলবে না। আমার স্কুটারের পিছনে বসতে হবে।
আবির মুচকি হেসে বলল সত্যি নাকি।

দাড়াও আমি কিছু খুচরো টাকা নিয়ে আসি।
স্কুটারের পেছনে আবির বসে আছে, উত্তরা হয়ে আব্দুল্লাহপুর এসে গাড়ি বিড়ুলিয়া যাওয়ার রোডে বাক ঘোড়ালো তৃনা। আবির তৃনাকে বলতে লাগলো আমরা যাচ্ছি কই পুতুল। গোলাপগ্রামের নাম শুনেছেন। আবির বলল, হুম। আমরা সেই জায়গায় যাচ্ছি। তৃনা হু জবাব দিলো।

কিছুক্ষনের মাঝেই গোলাপগ্রামের গেটে ঢুকে পড়লো তৃনার স্কুটার।
সুদূর দূরে বসে থাকার জন্যে যে ছাউনি বানানো হয়েছে, সেখানে গিয়ে স্কুটার থামায় তৃনা। এ এক অপরুপ সৌন্দর্যে ঘেরা গোলাপগ্রাম। চারদিকে গোলাপের বাগানের সমাহার। আবির আর তৃনা বাগানের পথে পথে হেটে হেটে দেখে চলেছে গোলাপগ্রাম।

এই মামা ১০০ গোলাপ দেন তো তোরা করে দিবেন,তৃনা বলতে লাগলো গোলাপের বাগানের প্লটের মালিক কে। কিছুক্ষণের মাঝেই তোড়াটা তৃনার হাতে দেয়, তৃনা টাকা বের করে মালি মামাকে দেয়। তৃনা কি করছে আবির তা দেখতে থাকে। ফের তৃনা গোলাপের গুচ্ছটা আবিরের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
❝শীতের বিরহী ভাব থেকে বেরিয়ে আবার পত্র-পুষ্পে ভরে উঠবে বৃক্ষরাজি। প্রকৃতিতে তারই আমেজ। ফুলে ফুলে ভরে যাবে গাছগাছালি। মনের আনন্দে পাখিরা গান গাইতে শুরু করবে। হাজার রঙ নিয়ে ফোটার অপেক্ষায় ফুলগুলো।

কবি ও লেখকের মননের বিচরণও ঘটে যেনো বসন্তকে ঘিরে। যুগে যুগে কবি ও লেখকরা বসন্তকে ঘিরে গেঁথে গেছে নানান কথা।আমিও তেমন এক ক্ষুদ্র নারী কবি হয়ে গেঁথে ফেললাম কবিতা।এটা ভালোবাসা নাকি ভালোলাগা আমি জানি না। সত্যি জানি না। তবে জনম সঙ্গি হিসেবে এই মন শায় দেয় আপনাকে বিজ্ঞানী মশাই। ❞

মেইড ফর ইচ আদার পর্ব ৭

আবির মৃদু হেসে ফুল গুলো নেয় নিজ হাতে। তৃনার হাত ধরে বুকের কাছে টেনে নিয়ে তৃনার কপালে অধর ছুয়ে বলল, আমি রাজি তোমার পথ চলার সঙ্গি হতে। ভরসা রাখতে পারো পুতুল।

মেইড ফর ইচ আদার পর্ব ৯