মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১২

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১২
ইফা আমহৃদ

ধ্রুব স্যার ও রাহাত স্যার সন্নিকটে বসে আছে। আমি স্থির দৃষ্টিতে দু’জনকে অবলোকন করছি। পা জোড়া নিশ্চল। স্তব্ধীকৃত হলো নেত্র পলক। দৃষ্টিবিভ্রম নয়। এক’পা ফেলার ন্যায় প্রাণশক্তিটুকু উদ্বৃত্ত নেই। পা জোড়া দৃষ্টি অগোচরে আবৃত কোনো বন্ধনে। পরবর্তী পা ফেলার কথা বিস্মৃত হয়েছে। স্পর্ধা দেখিয়ে অগ্ৰসর হলাম। নতজানু হয়ে সালাম দিলাম। আমাকে দেখে একঝলক চমকালেন ধ্রুব স্যার। তবে ভাবাবেগ বিহীন রাহাত স্যার। ক্লাসে থাকলেও তেমন কথা হলনি আমাদের, অপরিচিতার ন্যায়। বলতে গেলে আমিই শুধু চিনি। ফোন নম্বরটা দেখিয়ে বললাম,

“এটা কি আপনার?”
তিনি সায় দিলেন। ইঙ্গিত করলেন বসতে। আমি বসলাম দূরত্ব বজায় রেখে। যতটা নয় অস্বাচ্ছন্দ্য, তারচেয়ে বেশি বিচলিত। ধ্রুব স্যারের উপস্থিতিতে কারণে। রাহাত স্যার অনুমান করলেন। একগ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“ও আমার বন্ধু ধ্রুব। আমাদের এক আত্মা এক প্রাণ। আমি বিয়ে করব অথচ আমার বন্ধু থাকবে না, এটা হতে পারে না।
আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। পানিটুকু খেয়ে নিন আগে।”
‘আপনি’ শব্দটা বড্ড বেশিই অপ্রস্তুত বোধ বাড়িয়ে দিল। আমি পানি ভর্তি গ্লাসটা হাতে নিয়ে সৌজন্য হাসি হাসলাম। এক চুমুক দিলাম। অতঃপর পাশে রেখে বললাম, “আমি আপনার চেয়ে ছোট, তুমি করেই..

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সমাপ্তি টেনে দিলাম বাক্যে। রাহাত স্যার বুঝতে পারলেন। সংক্ষেপে বলেন, “ঠিক আছে‌।”
আমার কৌতুহলী দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হল ধ্রুব স্যারের মুখপানে। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখের মাঝে হাজারও না বলা কথা। নিমিষেই আমাকে অগ্নিদগ্ধ করে দিতে সক্ষম। আমি দ্রুত দৃষ্টি ফেরালাম। পরক্ষণেই ধ্রুব স্যার বললেন,
“রাহাত, ছেড়ে দে মেয়েটাকে। একজন ছাত্রীকে বিয়ে করাটা ভালো লাগছেনা আমার।”
রাহাত স্যার চমকে উঠলেন। উত্তেজিত হয়ে বলে, “মানে?”
“মানে, কয়েকদিন হয়েছে আমরা দেশে ফিরেছি। প্রফেসর হয়ে একজন ছাত্রীকে বিয়ে করলে কটাক্ষের শিকারে পড়তে হবে। বাংলাদেশ উন্নত দেশ নয়, সব বাজে ভাবেই দেখবে।
ভার্সিটি পড়াশোনার জন্য নয়, প্রেমের জন্য। এইসব রটাবে সবাই।”
পলকহীন, স্থির হয়ে বললেন, “তুমি আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্ট?”
“হম। আমি চড়ুই। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। সেদিন ধ্রুব স্যারের সাথে লাইব্রেরী আপনাকে দেখেছিলাম।”
রাহাত স্যার গভীরতর ভাবনায় লিপ্ত হলেন। স্মৃতির পাতায় প্রকট হতেই বললেন, “মনে পড়েছে, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।”

নিরবতা বিরাজ করছে, সকাল হওয়াতে আশেপাশে তেমন কেউ নেই। আমার মুখোমুখি রাহাত স্যার এবং পাশে ধ্রুব স্যার বসে আছেন। ইতোমধ্যে ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়েছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওয়েটার তিনটে সফ্ট ডিঙ্ক নিয়ে হাজির। কাঁচের বোতল তাই খুলতে ব্যর্থ আমি। একপলক চেয়ে ধ্রুব স্যার খুলে দিলেন বোতলের ছিপি। আমি চুমুক দিয়ে রেখে দিলাম। এখন যাওয়া উচিত এখান থেকে। বললাম, “বিয়েটা হবে কি-না সেটা ফোন করে জানিয়ে দিয়েন। আমাকে একটু ব্যাংকে যেতে হবে। টাকা তুলে চশমার দোকানে‌ যেতে হবে।”
রাহাত স্যার সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন, “এখানে বিয়ে না হওয়ার কারণ দেখছি না, আমি অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করলে সেও আমার স্টুডেন্ট হবে। আমাদের ভার্সিটির না হোক, অন্য ভার্সিটির হবে। তাছাড়া পরিচয় বলে একটা কথা আছে। আমার অনেক ইচ্ছে আছে,
ক্লাসে আমি পড়া বুঝাব, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। ভার্সিটি শেষে পায়ে হেঁটে আমি তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিব। মাঝরাতে ফোন করে বলল, নিচে এসো। তোমার খোঁপায় ফুলের মালা গুঁজে দিব। লাইব্রেরীতে বসে ভবিষ্যৎ বাচ্চাদের নাম ঠিক করব। আরও কত কী!”
আমার চোখজোড়া বেরিয়ে আসার উপক্রম হল। বিয়েতে রাজি হওয়ার পূর্বেই তিনি সবকিছুর পরিকল্পনা করে রেখেছেন। তিনি সত্যিই জানতেন না, আমি তার ছাত্রী। ব্যাপরটা বড্ড সন্দেহপ্রবণ।

বিকেলের হালকা রোদ বালির উপর পড়তেই চিকচিক করে উঠছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি বিশেষ লাইন মনে পড়ছে,
‘চিকচিক করে বালু, কোথাও নেই কাঁদা”
গ্ৰামাঞ্চল হলে কাঁদার দেখা পাওয়া যেত। ব্যালকেনিতে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছি আমি।মাত্রই তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটেছে। বাইরে থেকে ফিরে ঘুমিয়েছিলাম। ড্রয়িং রুম থেকে হাসি শব্দ শ্রবণ হচ্ছে। সচরাচর এমন হাসির শব্দ শোনা যায়না। মামা বাড়িতে এসেছেন। তবে শুধু মামা মামুনি নয়। অন্য কেউ আছে। হাসির কারণ জানতে আমাকে সেখানে উপস্থিত হতে হবে। আমি মুখ ধুয়ে সেদিকে অগ্ৰসর হলাম।
“কেমন করলাম প্লানটা। আমার ছেলে তো হিংস্র বাঘে পরিণত হয়েছে। বাড়ির কোনো জিনিস আস্তো নেই। ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে।”
“একদম পারফেক্ট। বন্ধুর সাথে বউকে দেখে এমন রিয়েকশন। যখন বন্ধু সেজে পরিচয় দিয়েছিলে তখন? একটা কার্ড বানিয়েছি, ধ্রুবকে দিবেন। তাহলে খেলা জমবে।”
তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হলাম সেখানে। অস্ফুট শব্দ শ্রবণপথে গেল। আমাকে দেখে উভয়ই থেমে গেল। পরিবেশ শান্ত হল। কৌতূহলী স্বরে বললাম, “আমাকে দেখে থেমে গেলেন কেন? কীসের প্লানের কথা বলছেন।”

“ভালো আছিস মা?” রমিলা পরিবেশ শান্ত করার জন্য বলেন।
“জি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন আন্টি?”
“তা আছি। এককাপ চা খাওয়াবি মা। তোর মামনির তৈরি চায়ে স্বাদ পাচ্ছি না।”
‘হম’ বলে এগোলাম রান্নাঘরে। ধ্রুবের মা রমিলা হঠাৎ আমাদের বাড়িতে কেন এসেছেন। ডেক্সিতে পানি বসিয়ে আড়ি পাতলাম। এদের কথোপকথনের আওয়াজ ধীর গতিতে চলছে। এতটা কাছে থেকেও শোনার যোগ্য নয়।
তিন কাপ চা নিয়ে ট্রে সমেত টেবিলের উপর রাখলাম। কাপ হাতে তুলে দিয়ে বসলাম। পুনরায় একই প্রশ্ন করলাম,
“মামা, বললে না কীসের প্লান করছ?”
ফট করে জবাব দিলেন, “কীসের আর তোর বিয়ের। বিয়ের কার্ড ছাপানো শেষ। দেখ। দেখ পছন্দ হয় কি-না।”
উত্তর যেন গোছানই ছিল। এগিয়ে দিলেন কার্ডটা। নিলাম না। সৌজন্য হাসি দিয়ে নিজ কামরার দিকে পা বাড়ালাম। দুমড়েমুচড়ে উঠছে অন্তঃকরণ। সহ্য ক্ষমতা শূন্য। পেছন থেকে মামা ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিতে বললেন। কমরায় তখন বাবুই ছিল, তাই যেতে হয়নি। খামটা ওর কাছে দিলাম, পৌঁছে দেওয়ার নিমিত্তে।
দরজা হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম। না চাইতেও আবৃত হয়েছি এই বন্ধনে। এত অবহেলার পরেও ইতি টানতে ব্যর্থ।

অমাবস্যা তিথি। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। মৃদু হাওয়া বইছে। ঈষৎ শব্দ হচ্ছে পাতার সংঘর্ষে। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে অদূরে। হিম মেঝে। ছাদে অবস্থানরত আমি। রেলিংয়ের ওপর বসে আছি। তৎক্ষণাৎ আবির্ভাব ঘটল বাবুইয়ের। ফোন নিয়ে ছুটে এসেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
“আপুই, তোমার ফোন বাজছে। তোমাকে চাইছে।”
“বন্ধ করে রেখে দে, ইচ্ছে নেই।”
‘জরুরী’ বলে হাতে ধরিয়ে দিল। আমি কর্ণকুহরে ধরতেই পরিচিত কণ্ঠস্বর ঠেকল।
“কতবার ফোন করেছি, কোথায় ছিলে? নিচে আছি। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম, নিচে এসো।”
“স্যার, আপনি এতরাতে এখানে? স্যরি, আমি যেতে পারব না।”
“আসতে বলেছি, সো এখনি। আসবে পাঁচ মিনিটের এক সেকেন্ডও এদিক ওদিক যাতে না-হয়। তাহলে তোমার বাড়ির ভেতরে পৌঁছে যাবো। এতরাতে একটা ছেলে বাড়িতে তোমার জন্য এসেছে, ব্যাপারটা কি ভালো দেখাবে?” একরোখা জবাব।
বিনাবাক্যের নির্গত করলাম, “হম।”

অদূরে স্ক্রিনের ঈষৎ আলো দেখে অনুমানসাপেক্ষ এটা ধ্রুব স্যার। সেদিন বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাই ঠিকানা জানা অবাস্তব কিছু নয়, অবাস্তব তার আগমন। ছাত্রীর সাথে দেখা করতে এসেছেন।
ফোনটা পুনরায় বাবুইয়ের হাতে দিয়ে বললাম, “যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। গ্ৰামের ভাষায়, এই রাতটা ভালো নয়। বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। যা!”
গ্ৰামে বসবাস কালীন সময়ে সন্ধ্যা ছয়টার পূর্বেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুম। আর এখন! এখন বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই।
ছাদের দরজা বন্ধ করে নিচের দিকে এগোলাম। ধ্রুব স্যার মেইন দরজার থেকে কিছুটা দূরে অপেক্ষা করছেন।

“আসসালামু আলাইকুম।”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
“জরুরী কোনো দরকার ছিল স্যার। এতরাতে ডেকে পাঠালেন।”
আবদারের সুরে, “আমার জন্য আজকের দিনটা বড্ড যন্ত্রণাদায়ক চড়ুই। সকল থেকে এখন পর্যন্ত, সবকিছু অমাবস্যায় ঘিরে রেখেছে।
একটু হাঁটবে আমার সাথে?
তার বামহাতে একগুচ্ছ গাঁদা ফুল। রাহাত স্যারের কথা অনুযায়ী তিনি আমার খোঁপায় ফুল গুঁজে দিতে চেয়েছিলেন। এখন কি ধ্রুব স্যার আমার খোঁপায় গাঁদা ফুল গুঁজে দিবেন?

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১১

১৫ পর্বের ভেতরেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে, অতএব অপেক্ষা করুন ?

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৩