মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১১

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১১
ইফা আমহৃদ

“সাধারণ একটা নাম নিয়ে এতটা সমস্যা কেন হবে? বিবাহিত মেয়েরা অবিবাহিত ট্যাগ কেন ইউস্ করবে চড়ুই? আমার জানা মতে তুমি বিবাহিত, তাই অবশ্যই মিসেস চড়ুই হবে।”
চোয়াল দৃঢ় করে নিচের দিকে চেয়ে রইলাম। আমি সত্যিই প্রচুর বিরক্ত, ধ্রুবকে নিয়ে। যার সাথে থাকছি না, তার জন্য কেন মিসেস ব্যবহার করব। টেনে টেনে বললাম,
“দেখুন, আমার ধ্রুব নামের কাউকে নিয়ে ভাবতে চাইনা। যে আমার অতীত তাকে নিয়ে তো নয়ই। আপনি আমার টিচার, টিচারের মতো ব্যবহার করলে সন্তুষ্টি হব।”

ধ্রুব স্যার প্রতুক্তি করলেন না। স্থির তার দৃষ্টি পানির গ্লাসে নিবদ্ধ, সরে না। পাথরেতর ন্যায় স্তব্ধ হয়ে গেল। অতিবাহিত হল প্রহর। ইতস্তত বোধ করলাম। ধ্রুব স্যারের স্তব্ধতা সহ্য হল না। তিনি গ্লাস তুলে নিলেন। একঢোক পান পান করে পূর্বের স্থানে রেখে দিলেন।‌ পরিস্থিতি অন্তরে আওড়ালাম। করুন হলাম, ক্লান্ত লাগল। অস্থিরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকল। তার অন্তঃকরণে কী চলছে হলনা বোধগম্য। তবে সোজাসাপ্টা বললেন,
“এবার তুমি আসতে পারো। আমার ক্লাস আছে। কাল সকালে জমা দিয়ে যেও, ঠিক করে দিব। আপাতত আমার সময় নেই।”
বিস্মিত হলাম আমি। তোয়াক্কা করলেন দৃষ্টিকে। অগ্ৰসর হলেন ক্লাসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। মাঝপথে থেমে গেলেন প্রিন্সিপাল স্যারের আগমনে। সালাম দিয়ে স্যারকে ভেতরে আসতে বললেন। আমি সৌজন্য হাসির রেখা ফুটিয়ে সালাম দিলাম। স্যার খুশিতে গদগদ হলেন। আমাকে দেখে একটু বেশিই আনন্দিত হলেন। হাস্যোজ্জ্বল সুকণ্ঠে বলেন,
“বাহ্, মেঘ না চাইতেই জল। চড়ুইকেও দরকার ছিল। একসাথে পেয়ে গেলাম।”
ধ্রুব স্যার সন্দিহান হয়ে ফোড়ন দিয়ে বলেন, “কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি, স্যার?
“তেমন কিছু নয়। কাল না, পরশু আমার বাড়িতে তোমাদের দাওয়াত। মেলা মুখ ভার করেছে, তোমরা না গেলে হাসবে না।”
আমি দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে সম্মতি দিলাম। ধ্রুব স্যারের ‘ঠিক আছে’ দু শব্দের বাক্য কর্ণপথে যেতেই পথ ধরলাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হিম পানি মুখশ্রী স্পর্শ করতেই তাপমাত্রা হ্রাস পেল। মুহুর্মুহু পানির ঝাপটা দিতেই ক্লান্তির অবকাশ নিল। ওড়নার নিম্ন প্রান্ত দ্বারা অবশিষ্ট পানিটুকু মুছে চশমা চোখে পড়লাম। কাঁধে ঝুলে থাকা ব্যাগটা স্পর্শ‌ করার পূর্বেই ধাক্কা খেলাম। একটু হেলে চশমাটা খুলে পড়ল নিচে। ঠেকলাম দেয়ালের সাথে। এমনিতেই ঝাপসা এবং ফাটা গ্লাস, আজ আবার পড়ল। চশমা না তুলে মানুষটিকে দেওয়া প্রয়াস করে পিছু ফিরল। একজন তরুণীর পেছন সাইড প্রকট হল। কিছুটা ঝাপসা। তবে অতিশয় পরিচিত ঠেকল। আমি বসে চশমা খোঁজার প্রয়াস করলাম। হাতের সংস্পর্শে আসতেই মৃদু শব্দ শ্রবণ হল। আমি মাথা তুলতেই মাহিকে নজরে এল। মাহি তো আমাদের ক্লাসের স্টুডেন্ট। ধ্রুব স্যারের পেছনে চুইংগামের আঠার ন্যায় পড়ে আছে। যার ফলশ্রুতিতে যখন তখন ধ্রুব স্যারের ঝাঁঝালো কথা শুনতে হচ্ছে। আমার পেছনে পড়ার কারণ বুঝতে ব্যর্থ হলাম। চশমাটা পা দ্বারা পিষে ফেলেছে ততক্ষণে। চিবিয়ে চিবিয়ে বল,
“ধ্রুব স্যারের সাথে তোর এত কী? স্যার তোকে বারবার কেবিনে কেন ডাকে? স্যারের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চল।”

মুখ চিপে হাসলাম শব্দহীন। অগোছালো চুলগুলো পেছনে হেলিয়ে দিয়ে চশমা হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিলাম। এতক্ষণে বোধগম্য হল তার অ’শ্লীল আচরণের মানে। ফিচেল হেসে দিয়ে বললাম, “এখন যদি কথাগুলো স্যারকে গিয়ে বলি, তাহলে।”
“স্যার কথা বিশ্বাস করবে, প্রুভ ছাড়া?” একরোখা জবাব দিল মাহি।
“ভাঙা চশমা তো আছে, এটা প্রুভ। নিজের চশমা তো নিজে ভাঙব না। আমি বরং যাই।”
মাহি ছুটে এল। বাঁধা দেওয়ায় প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সেদিন অর্থাৎ বসন্ত উৎসবের কিছুদিন পূর্বে উপর থেকে ময়লা পানিগুলো যে ও ফেলেছে, তা বুঝতে অসুবিধে হলনা‌। অহেতুক আমি ধ্রুব স্যারকে এইসবের জন্য দায়ি করেছিলাম। আমি ক্লাসের উদ্দেশ্যে অগ্ৰসর হলাম। মামাকে জানিয়ে একটা চশমা আনতে হবে। ধ্রুব স্যার ক্লাসে। কিন্তু এখন তো রাহাত স্যারের ক্লাস। আজ রাহাত স্যার আসেনি, তাই ধ্রুব স্যার ক্লাস নিতে এসেছেন। তার মুখশ্রীতে গম্ভীর ভাব বিরাজমান। একদম প্রথমদিনের ন্যায়। এতটা গম্ভীর তাকে সরাচার দেখা যায়না।

“আসব স্যার?”
দৃষ্টি বিঘ্ন হল, মনোযোগী বিচ্ছিন্ন হল। ধ্রুব স্যার হাতের সিলভার রঙের হাতঘড়ির দিকে একপলক চেয়ে বললেন,
“পঞ্চান্ন সেকেন্ড লেট। যারা সময়ের সম্পর্কে সচেতন নয়, তাদের আমার ক্লাসে চাইনা। ডিস্টার্ব না করে যাও।”
কিয়ৎক্ষণের নিমিত্তে থমকালাম আমি। কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে তার ব্যবহার পরিবর্তন ঠেকল। পঞ্চান্ন সেকেন্ডে কী-বা যায় আসে? আমি তো পাঁচ মিনিটও লেট করেছি, তার বেলায়। আমার ধ্যানের ছেদ ঘটল। ঝংকার তুলে মুঠোফোনটা বাজছে। বাবুই কল করেছে। কেটে দিলাম। পাশে এলাম। বাবুইয়ের কথা ভুলতে বসেছিলাম। বাড়িতে ফিরতে হবে। ওর সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, পড়াশোনা বলে একটা ব্যাপার আছে না। এমনিতেই ফাঁকিবাজির শেষ নেই।

ঘড়ির দুরন্ত কাঁটা ছুটে চলেছে ক্রমাগত। রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। অতিশয় তন্দ্রায় দেহটা নুইয়ে পড়েছে। আয়রন করছি সালোয়ার কামিজে। ধ্রুব স্যারের বাড়ির থেকে যেটা পড়ে এসেছিলাম। কালকেই ফিরত দিব ভেবেছি। বিছানায় টানটান হয়ে শুয়েছে বাবুই। উবুত হয়ে শুয়ে ইংরেজি ‘প্যারাগ্রাফ’ মুখস্থ করছে। আজ বায়না ধরেছে আমার কাছে থাকবে। ওড়নাটা আয়রন করে ভাঁজে রাখতেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট হল। আঁধারে আবৃত হল কক্ষ। চিৎকার করে উঠল বাবুই। হুট হাট জিনিসগুলোতে ভয় পেয়ে যায় বাবুই। আমি দ্রুত ফোন খুঁজতে ব্যস্ত হলাম। অবশেষে হাতের নাগালে পেলাম। টর্চ জ্বেলে দিলাম। মৃদু আলোয় অন্ধকার দূর হল। জামা কাপড়গুলো ব্যাগে রাখলাম। ইতোমধ্যে বই খাতা গোছানো শেষ বাবুইয়ের। দিনদিন ফাঁকিবাজি হচ্ছে। রাগান্বিত স্বরে বললাম,

“বই গোছালি কেন? তোর প্যারাগ্ৰাফ মুখস্থ হয়েছে?”
“না!” দাঁত কেলিয়ে!
“তাড়াতাড়ি প্যারাগ্ৰাফ মুখস্থ করে পড়া দিয়ে তবে উঠবি।”
“দেখ আপুই, আমার বিদ্যাসাগর হওয়ার ইচ্ছে নেই। এত পড়লে এরিস্টটলের মত মাথায় সিলিং ফ্যান ভেঙে পড়বে।”
“অ্যাহ্! এরিস্টটলের মাথায় ফ্যান ভেঙে পড়েছিল?”
“না আপেল পড়েছিল। আপেল গাছের নিচে পড়ছিল। আসলে তিনি আপেল চু’রি করতে গিয়েছিলেন। সন্দেহ থেকে বাঁচতে বই মেলে বসেছিলেন।”
“কী বলছিস তুই? নিউটনের মাথায় আপেল পড়েছিল, এরিস্টটলের মাথায় না।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্কট কণ্ঠে বলে, “নিউটনের চৌদ্দ গুষ্টির ভাগ্য, মাথায় তাল পড়েনি। তাহলে বুঝত, কত ধানে কত চাল। আচ্ছা এরা কি ভাত খায়?
এ বেডার জন্য আমারে সূত্র মুখস্থ করতে হয়েছে।
আপেল পড়ল, অমনি বুঝে গেল মহাকর্ষ শক্তি। বলি আপেলটা যদি উপরের দিকে যায় থাকলে খাবে কে? ওর বাপ। আপেলটা নষ্ট হয়ে যাবে না। তাই মাটিতে পড়ে।”

“অ্যাহ!”
“অ্যাহ নয় হ্যাঁ। নতুন সূত্র। বিজ্ঞানী বাবুই।”
বাবুইয়ের যুক্তি শুনে আমার স্তব্ধ ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ বিচ্ছিন্ন হল। কিয়ৎক্ষণের নিমিত্তে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। ওর যুক্তি শুনলে মৃত নিউটন লাঠি ভর করে বাংলাদেশে চলে আসত। এসে বলত, “ঐ আমারে চিনছোস।” তখন পৃথিবীর জনগণ ভুত ভুত করে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করত। বাবুইকে সত্যিই জাদুঘরে রাখা উচিত। অন্তত কিছু পয়সা তো উপার্জন হতো।
তৎক্ষণাৎ হাসির শব্দ শ্রাবণ হল। মামা হলদে মোমবাতি সমেত হাজির। বাবুইয়ের যুক্তি উপস্থাপন দেখে নিশ্চয়ই সে হাসছে। মোমবাতি টেবিলের উপর রেখে একশো টাকার নোট এগিয়ে দিল বাবুইয়ের দিকে। বললেন,

“তোর যুক্তি শুনে মন ভালো হয়ে গেল‌। তাই এটা তোর।”
এক লাফে ছুটে এসে টাকা নিল বাবুই। মাঝরাতে বায়না ধরল, আইসক্রিম খাবে। এতরাতে দোকান অবশ্যই খোলা থাকবে না। তাই কালকে রাতে নিয়ে যাবো। বাবুই কক্ষ ত্যাগ করতেই মামা ডাক দিলেন। একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“তোর জন্য একটা ছেলে দেখেছি মা। না করিস না। পড়াশোনার অজুহাত দিস না। বিয়েটা তোর পরীক্ষার পরেই হবে।
এখানে ছেলের ছবি আছে। ধ্রুবের জন্য আর অপেক্ষা নাই বা করলি।”
অজানা দহনে প্রজ্বলিত হল বুক। দুমড়েমুচড়ে উঠল ভেতরটা। মামা একবুক আশা নিয়ে এসেছেন। তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার দুর্সাহস নেই। ছবিটা না নিয়েই বললাম,

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১০

“দেখার দরকার নেই মামা। তোমার ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে।”
“অভিমান করে বলছিস না তো!”
“না, মামা।”
“ঠিক আছে, আগামীকাল দশটা নাগাদ তোর সাথে দেখা করতে চায়। তোর ফোন নাম্বার দিয়েছি রাহাতকে। সরাসরি দেখা করে জানাস আমাকে।”
‘রাহাত’ নামটা বেশ পরিচিত ঠেকল। মিনমিনে গলায় আওড়ালাম, “রা-হা-ত।”
“হম।”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১২