মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৪

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৪
ইফা আমহৃদ

“তাজ্জব ব্যাপার তো, মিস মাহি! চড়ুইয়ের হাতের লেখা তোমার সাথে কীভাবে মিলে গেল। আবার তুমি গড়গড় করে পড়ছ, মনে হচ্ছে কবিতা মুখস্থ বলছ?”
নির্বিকার কণ্ঠে বললেন ধ্রুব স্যার। আমতা-আমতা করল মাহি। তার কথায় অস্পষ্টতার ছাপ। উপস্থিত ক্লাসের সবাই তখন উদ্বিগ্ন। বুকে হাত গুজলেন। কিছু বলার প্রয়াস করার পূর্বেই মাহি বলে উঠে,
“স্যার, আমি তো অনুমানের বসে বলেছি। বইটা যেহুতু ওর, চিঠিটাও ওর হবে।”
মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে দৃঢ় গলায় বললেন, “মিথ্যা বলতে জানতে হয়, মিস্ মাহি। গুছিয়ে রাখতে হয়। তুমি এতবড় মিথ্যাবাদী এখনো তৈরি হওনি। পরশুদিন যখন চড়ুইয়ের চশমা ভেঙেছিলে, তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমি চাইলে তখনই তোমাকে শাস্তি দিতে পারতাম। কিন্তু কাজ পড়ে যাওয়ায় সম্ভব হয়নি।
এবার বলো, তোমাকে কী শাস্তি দেওয়া যায়?”

ভীত হল মাহি। অনুরোধ করল স্যারের নিকট, “প্লীজ স্যার, আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো করব না।”
“সেদিনও তুমি চড়ুইকে কথা দিয়েছিলে, কিন্তু কথা রাখোনি। এবার রাখবে তার কি নিশ্চয়তা আছে?
আমি চাইলে তোমাকে ভার্সিটি থেকে বহিষ্কার করতে পারি। কিন্তু আমি তোমার মত না। তবে তোমার মত স্টুডেন্টকে আর পড়াব না। প্রয়োজনে তোমাদের ক্লাসই করাব না। বেরিয়ে যাও।”
শেষ কথাটা জোর দিয়ে উচ্চারণ করলেন তিনি। কেঁপে উঠলাম ক্লাস। তৎক্ষণাৎ বেল বেজে উঠল। ধ্রুব স্যার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাহির দিকে তাকিয়ে ক্লাসের ইতি টেনে বেরিয়ে গেলেন। একগাল হাসলাম আমি। চোখ টিপলাম মাহিকে। আর কোনো টিচার পেল না, শেষে ধ্রুব স্যারকে ধরলেন আমার জন্য। হা! হা! হা!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে বসে ছিলাম। বন্ধুদের সাথে গান গাইছি। আমার এই আনন্দ সহ্য হয়নি ধ্রুব স্যারের। তাই জুনিয়র দ্বারা ডাক পাঠিয়েছেন, তিনি লাইব্রেরীতে আছেন। আমাকেও যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি ব্যাগ সমেত অগ্রসর হলাম সেদিকে। তিনি লাইব্রেরীতে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছেন। যেন পড়ে আর রাখবে না। আমার দিকে না চেয়েই বললেন,
“আমাকে দেখার অনেক সময় পাবে। সময় অপচয় না করে পড়তে শুরু করো।”
আমি এগোলাম। বসলাম স্যারের সামনের বেঞ্চিতে। কৌতূহলী স্বরে বললাম, “আপনি তো আমার দিকে তাকাননি, তাহলে জানলেন কীভাবে আমি এসেছি? আপনার মাথার পেছনে অদৃশ্য কোনো চোখ আছে না-কি?
বইয়ের দিক থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই জবাব দেয়, “চোখ থাকার দরকার পড়ে না, আমার মস্তিষ্ক একটু বেশিই প্রখর। ছোট খাটো জিনিস নজরে এসে যায়। বই বের কর।”

আমি সৌজন্য পূর্ব হাসি দিয়ে বই এগিয়ে দিলাম। তিনি গাঢ় সবুজ রঙের কলম দ্বারা কিছু লাইনে দাগ কাটলেন।‌ গাঢ় সবুজ রংটা তার প্রিয় রং। বেশিভাগ সময়ই তাকে এই রঙের শার্ট পড়তে দেখা যায়। ফিরিয়ে দিয়ে পড়তে বললেন। আমি পড়ায় মনোযোগ স্থাপন করলাম। পড়ার মাঝপথে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল মেঘময় আকাশে। মেঘগুলো জড়ো হয়ে কালো বর্ণ ধারণ করেছে। যখন তখন মাটি কম্পিত করতে পারে জলধারায়। বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালাম। ধ্রুব স্যার তখনও নিকটে বসে আছেন, তবে তার কথা বেমালুম ভুলে গেছি। আমাকে তড়িগড়ি করে উঠতে দেখে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“কোনো সমস্যা? উঠে পড়লে যে।”
“আকাশে দেখুন মেঘ করেছে, বৃষ্টি হতে পারে। বাড়িতে যাবো।”
“বসো, আগে পড়া। বৃষ্টি হলে থামলে বাড়িতে যাবে। আমি পৌঁছে দিবো।”
উপায়হীন হয়ে বইয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। কিন্তু আমার ছটফটে মন সে কি মানবে আমার বারণ? যা ক্রমাগত জানালার বাইরে উঁকি দিচ্ছে। কাশি দিয়ে বললাম, “তেষ্টা পেয়েছে, পানি খাবো।”

আরো কিছু বলার পূর্বেই বোতল এগিয়ে দিলেন তিনি। ছোট বোতল। আমি দ্রুত সম্পূর্ণ পানির বোতল ফাঁকা করে ফেললাম। পুনরায় বললাম, “পানি খাবো।” এবার তার চেয়ে বড় বোতল এগিয়ে দিলেন। উদ্যমহীন হয়ে বসে রইলাম। নিশ্চয়ই পানির ট্যাংক নিয়ে এসেছে। দুই ঘণ্টার পূর্বে ছাড়বেন না। বৃষ্টিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও না।
ঘণ্টাখানেক অতিবাহিত করলাম পড়তে পড়তে। কোমর ব্যথা করছে বিধেয় একটু উঠে হাঁটাচলা করলাম লাইব্রেরীতে। তিনি নিশ্চেষ্ট। ওষ্ঠদ্বয় পুঁটি মাছের ন্যায় নড়ছে। কোমর ব্যথা করে না বুঝি। কী দিয়ে তৈরি।
আগমন ঘটল রাহাত স্যারের। আমাদের একত্রে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলেন। অতঃপর দ্রুত কণ্ঠে বললেন,
“তোরা এখানে, আমি কখন থেকে খুঁজছি। তাড়াতাড়ি বাড়িতে চল।”
ধ্রুব স্যারের সোজাসাপ্টা উত্তর, “আমি খুঁজতে বলেছি? বাড়িতে মানে কী হ্যাঁ। দেখছিস না, পড়াচ্ছি। এখন যাওয়া যাবেনা।”

“আকাশের অবস্থা দেখেছিস, বৃষ্টি এলো বলে। ভার্সিটি ছুটে দেওয়া হয়েছে। এতক্ষণে সবাই চলেও গেছে, আমরা বাদে।”
ধ্রুব স্যার হাতের করতল মেলে দিয়ে চাবি বললেন। রাহাত স্যার বিরাগী হয়ে চাবি দিয়ে দিলেন এবং দ্রুত বাড়িতে যেতে বললেন। কিন্তু ধ্রুব স্যার, সে তো নিশ্চল। বাকহীন। তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পড়ার মনযোগী হলাম। বিলম্বে বৃষ্টি আরম্ভ হল। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে শ্রবণের বারোটা বাজাচ্ছে। পানির শব্দ ছাড়া কিছুই কর্ণদ্বয়ে যাচ্ছে না। ধ্রুব স্যারের টনক নড়ল। জানালার কাছে গিয়ে বৃষ্টি দেখলেন। বন্ধ করে দিলেন, দরজাও বন্ধ করলেন ভেতর থেকে। বাতি জ্বালিয়ে দিলেন। শব্দ অস্পষ্ট হল। বইয়ের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মনে মনে আওড়ালাম,
“আজ যা হয়ে যাক না কেন, পড়াবেনই। আমিও তাড়াতাড়ি মুখস্থ করে বাড়ি যেতে পারলে বাঁচি।

বৃষ্টির হিম জলধারা ছাতার উপর ঝমঝমিয়ে পড়ছে। অতঃপর গড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। মাঝে মাঝে দু এক ফোঁটা শরীরের উপর পড়ছে। ভিজে গেছে খানিকটা। পানিতে হাঁটার ফলে খ্যাচ খ্যাচ শব্দ হচ্ছে জুতায়। একই ছাতার নিচে দু’জনে সামনের দিকে অগ্ৰসর হচ্ছি। অনেক কষ্টে একটা ছাতার জোগাড় হয়েছে। ধ্রুব স্যারের গাড়ি সকালে সমস্যা হয়েছে, তাই মেকানিকের কাছে রেখেছে। রাস্তাঘাটে যানবাহন নেই, হাতেগোনা রিক্সাও নেই। এরজন্যই বলে, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। সব ঝামেলা একসাথে। ধ্রুব স্যারের উপর রাগ হচ্ছে, কি দরকার ছিল এতক্ষন পড়ানোর। ধ্রুব স্যারের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে যাচ্ছিলাম। হয়ত প্রকৃতির সহ্য হয়নি। হুট করে হোঁচট খেয়ে ধপাস করে পড়লাম রাস্তায়। অকস্মাৎ ঘটা ঘটনায় আমি হতভম্ব। বৃষ্টির পানিতে ডুবে ছিল রাস্তা। যার ফলশ্রুতিতে ভিজে জবুথবু হয়েছি। যেভাবে রাস্তার উপরে পড়েছিলাম, সেভাবেই রয়েছি। আমার এই অবস্থায় না তুলে উল্টো রাগ ঝাড়লেন তিনি,
“চোখ কি আকাশে রেখে হাঁটছিলে? আশ্চর্য। দেখতে পারছ, পানি। তবুও হাঁটার ঢক নেই।”

আমি নাক ফুলিয়ে ধীরে ধীরে উঠলাম। এর এরুপ কথা মোটেও প্রত্যাশা করিনি। ভিজেছি তবে ব্যথা পাইনি। কেন যে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর জন্য গলিতে ঢুকলাম। জুতা পড়তে গিয়ে দেখলাম, ছিঁড়ে গেছে। পড়ার উপযুক্ত নেই। এমনিতেই ছেঁড়া ছিল। আজ বিপদের দিনে এমন করবে বুঝতে পারিনি। ধ্যাত, ভালো লাগে না।
‘চলুন’ বলে আমি হাঁটতে লাগলাম। ধ্রুব স্যার নিজের জুতা খুলে পড়তে বললেন। কিন্তু আমার পায়ের মাপ তুলনামূলক ছোট। বিনিময়ে নোংরা পানি সালোয়ারে ভরে যাবে। আমি পড়লাম না।

ধ্রুব স্যার প্রত্যুত্তর করলেন না। মাথার উপর ছাতা ধরলেন, যাতে ঠান্ডা না লাগে। কিছুটা দূর এগোতেই পানির মাত্রা বেড়ে গেল। পারাপারের জন্য ইটের ছোট ছোট টুকরো ব্যবহার করা হয়েছে। জুতা থাকলে পানি দিয়ে হেঁটে যেতাম। কিন্তু পানিতে বিষাক্ত কিছু থাকতে। ইতোমধ্যে ধ্রুব স্যার পানিতে নেমে গেছেন। হাত ধরলেন আমার। আশ্বাস দিয়ে হাঁটতে বললেন। আমি মুচকি হাসলাম। দুহাত দিয়ে শক্ত করে ধরে পেরিয়ে এলাম পথ। পুরোপুরি বাড়ির কাছে এলেন না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বললেন, ভেতরে যেতে।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৩

আমি একা একাই অগ্ৰসর হলাম। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার পূর্ব অবধি দাঁড়িয়ে রইলেন। চেয়ে রইলেন বাড়ির দিকে। আমি নিজের কক্ষে পৌঁছালাম। স্যার এখনও দাড়িয়ে আছেন কি-না যাচাই করতে ব্যালকেনির দিকে পা বাড়ালাম। তিনি যায়নি, পূর্বের স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন। শুধু দৃষ্টি ব্যালকেনির দিকে। হয়ত জানতেন, আমি আসব ব্যালকেনিতে। দূরে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বললেন। দূর থেকে শোনা গেল না স্পষ্ট। তবে আমাকে ফ্রেশ হতে বলেছে, এর ব্যাপারে নিশ্চিত। শরীর থেকে নোংরা গন্ধ আসছে। নিজেরই গা গুলিয়ে উঠছে, ধ্রুব স্যার কেমনে সহ্য করেছেন এমনটা। আমি হাত নাড়িয়ে ভেতরে এলাম। জামা কাপড় নিয়ে ছুটলাম ওয়াশরুমে। চুল পরিষ্কার করতে হবে। ঠান্ডা লাগবে না, আশা করা যায়।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৫