মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৬

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৬
ইফা আমহৃদ

“কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানিও, আমি পাশেই আছি। ভিড়ের মধ্যে যাওয়ার দরকার নেই। মনে থাকবে?”
আমি শব্দহীন স্বরে, ‘হম’ উচ্চারণ করলাম। ধ্রুব স্যার আশ্বাস পেলেন না। চটজলদি আমার মুঠোফোন নিয়ে নিলেন। তার ফোন নাম্বার সেভ করে পুনরায় হাতে ধরিয়ে দিলেন। অতঃপর সামনের দিকে অগ্ৰসর হলেন।
প্রিন্সিপাল স্যার ডিনারের আয়োজন করেছেন। প্রিন্সিপাল বলে কথা ছোট খাটো অনুষ্ঠানে তার চলে না, তাই বড় করে আয়োজন করেছেন। উপস্থিত আছেন ভার্সিটির অনেকেই এবং স্যারের আত্মীয় স্বজন। সেদিনের দুর্ঘটনার পর আমাকে একা ছাড়তে নারাজ মামা। তাই বাবুইকে সাথে দিয়েছেন। কালো রঙের শাড়ি পড়েছি দু’জনে।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ব্যথা উপলব্ধি করলাম। বাবুইকে নিয়ে পাশের চেয়ারে বসলাম। ওয়েটার ডেকে সফ্ট ডিঙ্কের গ্লাস নিলাম। বাবুইয়ের হাতে দিয়ে আরেকটা নেওয়ার পূর্বেই ট্রে উল্টে ডিঙ্ক বাবুইয়ের শাড়িতে। বাবুই নাক ফুলায়। বিরক্ত সে। চ্যাঁচিয়ে বলে, “চোখে দেখতে পান না আপনি, কী করেছেন এটা?”
“স্যরি ম্যাম। পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়াতে সামলাতে পারিনি, স্যরি।”
আমি বাঁধা দিয়ে বললাম, “ইটস্ ওকে। গো।”
“আপু তুমি ওকে যেতে দিলে কেন?”
“সে ইচ্ছে করে এইসব করেনি, প্রচণ্ড ভিড়, ধাক্কা লেগেছে।‌”
বেশ খানিকটা ভিজে গেছে শাড়ির। আঠালো ভাব শাড়ি থেকে। বাবুই এখানে এক মুহুর্ত থাকতে নারাজ। বাড়িতে যাবে সে। উপায়ান্তর না পেয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ততক্ষণে ধ্রুব স্যার ও রাহাত স্যার হাজির। তড়িগড়ি করে বেরুতে দেখে প্রশ্ন করলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”
বাবুই উল্টো ঘুরে গায়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমতা-আমতা করে বলি, “ওয়েটার ভুল করে ডিঙ্ক ফেলে দিয়েছে। অনেকটা। এখন থাকা সম্ভব হচ্ছে না।”
ধ্রুব স্যার ও রাহাত স্যার একে অপরের সাথে আলোচনা করলেন। রাহাত স্যার নির্দ্বিধায় প্রস্থান করলেন। কিয়ৎক্ষণ পর ফিরে এলেন একটা ছাই রাঙা শাড়ি নিয়ে। ধন্যবাদ জানিয়ে চড়ুইকে নিয়ে চ্যাঞ্জিং রুমে গেলাম। বাবুই নিজেই চেঞ্জ করে নিল।
এই সামান্য ঘটনাটাকে নিছক দুর্ঘটনায় ভেবে উড়িয়ে দিলেও পরবর্তীতে সহ্য করতে হয়েছিল প্রবল যতনা। কেউ একজন পরিকল্পনা করে সবটা করেছিল। জুসটা আমার শাড়িতে পড়ার পরিবর্তে বাবুইয়ের শাড়িতে পড়েছিল।

পরদিন সকালে ভার্সিটিতে গিয়ে থমকে গিয়েছিলাম। কয়েক মুহুর্তের জন্য চমকে ছিলাম। পুরো ভার্সিটিতে ধ্রুব স্যারের ছবি টানানো। সাথে শুভ জন্মদিন লেখা। আজ ধ্রুব স্যারের জন্মদিন? অথচ আমি জানতামই না। তারিখ দেখার উদ্দেশ্যে মুঠোফোন বের করতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম মিনিটের ব্যবধানে। আজ ২৯শে ফেব্রুয়ারি। চোখজোড়া পূর্ণ হয়ে এলো নোনাজলে। ধ্রুব স্যারই ধ্রুব। এতদিন আমাকে ঠকিয়েছে। ধ্রুবের বন্ধু সেজে আমার অনুভূতি নিয়ে মজা করেছেন। আর যাই হোক, দুজনের জন্মদিন একই দিনে হতে পারে না। আমি কৌতূহল দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়ে অফিস রুমের দিকে অগ্ৰসর হলাম। সেখানে ধ্রুব স্যারের বাবা মায়ের নাম দেখে বেশ চমকেছিলাম। তিনি ধ্রুব এটা পুরোপুরি নিশ্চিত। এর জবাব তাকে দিতেই হবে।

নিশ্চুপ হয়ে ক্লাসে গিয়ে বসলাম। মিনিট দশেকের মাথায় হাস্যোজ্জ্বল মুখে ধ্রুব স্যার প্রবেশ করলেন। সবাই তখন এক দৃষ্টিতে ধ্রুব স্যারকে দেখছিল। আজ গাঢ় সবুজ রঙের শার্ট পড়ছে। নিত্যদিনের মত সাজ হলেও ভিন্ন লাগছে দেখতে। একে একে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে সকলে। ধ্রুব স্যার হাসি মুখে সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। এইসব সহ্য হলনা আমার। অতিশয় ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে এলাম ক্লাসরুম থেকে।‌ পিছু পিছু ধ্রুব স্যার এলেন। হাত ধরলেন মাঝরাস্তায়। আমি এক ঝটকায় সরিয়ে ফেললাম। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম, “একদম আমাকে স্পর্শ করবেন না। একদম না। আপনি ধ্রুবের বন্ধু সেজে আমার অনুভূতি নিয়ে খেলেছেন। কক্ষনো ক্ষমা করব না আপনাকে।”
ধ্রুব স্যার আশাগ্ৰস্থ কণ্ঠে বললেন, “আমার কথাটা শুনো আগে।”
“শুনব না। নিশ্চয়ই আবার মিথ্যা বলবেন।”
ধ্রুব স্যারকে তোয়াক্কা না করে বেরিয়ে এলাম ভার্সিটি থেকে।

পাতা ঝরা বিকেল। সূর্য মেঘের অন্তরালে ঢাকা। আর্দ্র বাতাস বইছে। চোখজোড়ার বাঁধ ভেঙেছে। বুকে চেপে রাখা অসহ্য যন্ত্রনা। তৎক্ষণাৎ পায়ের শব্দ শোনা গেল। আমি পিছু ফিরলাম না। এই সময়ে বাবুই আসে। কঠোর গলায় বললাম,
“বাবুই একটু নিচে যা। একা থাকতে দে।”
গেল না। পায়ের শব্দ প্রবল আকার ধারণ করল। পায়ে এসে দাঁড়াল। ধ্রুব স্যারকে দেখে একটু চমকালাম।
“আপনি এখানে? আমাকে কল্পনায় জ্বালাচ্ছে এবার। স্বপ্নে জ্বালিয়ে হয়নি বুঝি?”
সন্দিহান স্বরে বললেন, “আমি তোমার স্বপ্নেও আসি বুঝি?”
দৃষ্টি ভ্রম মনে করে চোখ পরিষ্কার করে পুনরায় তাকালাম। ধ্রুব স্যার একহাত রেলিংয়ের ওপর রেখে দাঁড়িয়ে আছে। শান্ত কণ্ঠে বললেন, “এটা তোমার দৃষ্টিভ্রম নয়। আমি সত্যিই এসেছি।”

একটু স্তব্ধ হলেও তিনি যে রেলিং টপকে এসেছেন, এটা নিশ্চিত।
আমি উল্টো পথ ধরলাম। পেছন থেকে ধ্রুব স্যার গম্ভীর গলায় বললেন, “চলে যাচ্ছ? আমার কিছু কথা ছিল।”
সোজা হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, “বলুন কী বলবেন?”
ধ্রুব স্যার নিশ্চুপ হয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে আছেন। তার দৃষ্টি আজ শান্ত, বড্ড অচেনা ঠেকছে। হাজারও কথা চোখের মাঝে ভেসে আছে। বিরক্ত নিয়ে বললাম,
“কেন এসেছেন এখানে? আপনার সাথে আমার কোনো কথা থাকতে পারে না। চলে যান। কেউ দেখলে সমস্যা হবে।”
“তোমার নাই বা থাকতে পারে, কিন্তু আমার আছে।” একরোখা জবাব দিলেন।
“চুপ করে না থেকে কী বলবেন, বলুন।”
সংক্ষেপে বলেন, “স্যরি।”

“কেন?”
কিয়ৎক্ষণ স্থির থেকে অসহায় কণ্ঠে বললেন, “কীভাবে শুরু করব, বুঝতে পারছি না। আমি তোমার সাথে এতদিন অনেক অন্যায় করেছি। কী করব বলো, বাবার মৃত্যুর শোকে পাথর হয়ে গেছিলাম। একদিকে বাবার মৃত্যু অন্যদিকে পড়াশোনার চাপ। আমি প্রস্তুত ছিলাম না। হুট করে মা মিথ্যা বলে তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। তোমাকে দেখে বারো তেরো বছরের মেয়ে মনে হয়েছে। আমি বিরক্ত হয়েছিলাম। তাই না জানিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছিলাম।”
সৌজন্য হাসি দিয়ে বললাম, “তো! কী করব আমি। আমি কী প্রস্তুত ছিলাম। মা আমাকেও জোর করেছিল। বিয়ের পর কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে জার্মান চলে গেলেন। আপনার জন্য আমার মা হার্ট অ্যাটাক করেছে। চলে গেছে। আপনার মায়ের কাছে অপরাধী হয়েছি। নিজেকে দোষারোপ করেছি, মায়ের কোল খালি হয়েছে আমার জন্য।”

“মানছি, আমি ভুল করেছি। একটা সুযোগ দেওয়া যায়না। আমি সব ঠিক করে দিবো। তোমার জীবনটাকে গুছিয়ে দিবো।”
“আমার জীবন গোছানোই আছে। অযথা গোছাতে গেলে আরো অগোছালো হয়ে যাবে।”
“কিন্তু আমার জীবন যে অগোছালো? আমি তোমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারব না।”
“এটা আপনার আবেগ। কথাগুলো আপনার মস্তিষ্ক ভাবছে, মন নয়। মানুষের মন ভালো থাকার চাবিকাঠি। অপরাধবোধ থেকে এইসব করছেন। আবেগ কেটে গেলে আমাকে ফেলে দিবেন। একবার অনেক কষ্ট সবকিছু সামলে নিয়েছি আর পারব না।
সেদিন আন্টি এসে ডিভোর্স পেপার নিয়ে গেছে। আমি সাইন করে দিয়েছি। জজ রায় দিলেই আপনি মুক্ত..
কথার সমাপ্তি টানার পূর্বেই হাত চেপে ধরলেন তিনি। অতঃপর রেলিংয়ের সাথে চেপে ধরলেন। ঝুঁকে গেলাম বাইরের দিকে। ভারসাম্য বজায় রাখতে ধ্রুব স্যারের গলা জড়িয়ে নিলাম। অব্যক্ত স্বরে বললাম,

“কী করছেন কী? তুলুন!”
“না, আমার কথায় রাজি না হলে এখান থেকে ফেলে দিবো।”
তাচ্ছিল্যর হাসি দিয়ে বললাম, “পারবেন না, বিশ্বাস আছে।”
ধ্রুব স্যার সোজা করে দাঁড় করিয়ে করুন গলায় বললেন,‌ “এই বিশ্বাসটুকু রাখো। সব ঠিক করে দিবো।”
“সম্ভব নয়।”
বলে পিছু দেখলাম না। দ্রুত পা জোড়া গতিশীল করে নিচে নেমে এলাম। শরীর ক্রমশ কেঁপে কেঁপে উঠছে। ধ্রুব সু্যোগ চাইছে অথচ আমি দিতে পারছি না। মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। কষ্টে ভেতরটা ছিঁড়ে আসছে। আমি নিরুপায়।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৫

রাস্তা পাড় হওয়ার প্রচেষ্টা করছি। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। রাত হয়ে এসেছে। কাঁধে জামা কাপড় ভর্তি ব্যাগ। কিছুদিনের জন্য ছোট মামার বাড়িতে থাকব। মন ভালো হলে ফিরে আসব এই শহরে। বাবুইয়ের সামনে পরীক্ষা, তাই ওকে ছাড়া একাই যাচ্ছি। হুট করেই একটা গাড়ি এসে থাকম সামনে। পথ আঁটকে দাঁড়াল। মাথা তুলে অবলোকন করার পূর্বেই মুখের সামনে স্প্রে করল কেউ। সেকেন্ড খানেকের জন্য থেমে গেলাম। ভারী হয়ে উঠল মাথা। দ্রুত কাঁধের ব্যাগটা খামচে ধরলাম। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে যেতে নিলেই ধরে ফেলল কেউ। ততক্ষণে চোখজোড়া আঁধারে আবৃত। উন্মুক্ত করতে ব্যর্থ। আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। গাড়ির ভেতরে রাখল। সবকিছু স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। পরক্ষণেই জ্ঞান হারালাম।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৭

1 COMMENT

Comments are closed.