মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৭

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৭
ইফা আমহৃদ

পিটপিট করে চোখ মেলে অবলোকন করতেই অচেনা, অজানা জায়গা দৃষ্টিতে বন্দি হল। আমি দ্রুত উঠে বসার প্রয়াস করলাম। ধীরে ধীরে মনের মাঝে দৃশ্যগোচর হল তখনকার স্মৃতি। তীব্রতর ভীত হলাম। অতিশয় দ্রুত ছুটে গেলাম বাইরের দিকে। মাঝপথে থেমে গেলাম কারো শান্ত কণ্ঠে,
“জ্ঞান ফেরার পর শক্তি বেড়েছে দেখতে পাচ্ছি।”

থেমে গেল পা। স্তব্ধ হল মন। মুহুর্তে জন্য প্রশান্তির হাওয়া স্পর্শ করল দেহ। উৎকণ্ঠা মিলিয়ে গেল। চটজলদি পেছনে ফিরলাম। ধ্রুব সোফায় আয়েস করে বসে ফোন টিপছে। বোধগম্য হতে দ্বি মুহূর্ত লাগল না, তিনিই আমাকে অপ’হর’ণ করেছেন। অতি মাত্রায় ক্ষোভে গজগজ করতে করতে ধ্রুবের সামনে গিয়ে রাগান্বিত স্বরে বললাম,
“আপনি নিশ্চয়ই আমাকে কি’ডন্যা’প করেছেন, তাই না ধ্রুব স্যার।”
“কার এত সাহস তোমাকে স্পর্শ করবে? আমি কাউকে কি’ডন্যা’প করিনি। শুধু আমার বউকে আমার কাছে নিয়ে এসেছি।সে রাগ করে চলে যাচ্ছিল, তাই অজ্ঞান করে এনেছি। সোজাসুজি বললে তো আসত না, তাই।”
বলেই ফোন দিয়ে মুখ আড়াল করে নিলেন। তড়তড় করে রাগের মাত্রখ বেড়ে গেল। এবার দিগুন ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম, “বড় বড় কথা বলতে লজ্জা করছে না আপনার। আমি কত ভয় পেয়েছিলাম। আপনি না জানিয়ে আমাকে কিডন্যাপ করেছেন।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আর কতবার বলব, আমি আমার বউকে এনেছি। তাছাড়া কি’ডন্যা’প কি জানিয়ে করে?”
“তা কেন আপনার বউকে এনেছেন, শুনি?”
“কেন আবার বাসর করতে। আবহাওয়া দেখেছ কী সুন্দর। তারউপর আজ আমার জন্মদিন। এইটুকু গিফ্ট তো পেতেই পারি।”
“আপনি আবার মজা করছেন?”
তিনি ফোন রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “একদমই নয়, আ’ম সিরিয়াস।”
“আপনি আবার মজা করছেন। দেখুন..
“সময় নেই, তাড়াতাড়ি দেখাও। এমনিতেই সব দেখা হয়ে গেছে। নতুন কিছু নেই, তুমি খুশি হয়ে দেখাতে চাইছ, না করতে পারি?”
মুখ কুঁচকে এলো অস্বস্তিতে। অব্যক্ত স্বরে বললাম, “মানে, ক কী দেখেছেন আপনি?”

ধ্রুব সৌজন্য হাসি দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলেন। ধ্যান ভাঙতেই দৃষ্টির অগোচরে তিনি। দুইরুমের একটা ফ্লাট। পরিবেশ দেখে মন হচ্ছে, এখানে কেউ থাকত। আমি ব্যালকেনিতে দাঁড়ালাম। চারিদিকে সবুজ গাছ-গাছালি। এখান থেকে দূরে অস্পষ্ট নদী দেখা যাচ্ছে। পাল তোলা নৌকা। তাতে মৃদু হলদেটে আলো জ্বলছে। আমাকে যে করেই হোক এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে। আমি দ্রুত ওড়নাটা রেলিংয়ের সাথে শক্ত করে বেঁধে নিলাম। ধীরে ধীরে রেলিংয়ের ওপর দাঁড়াতেই দরজা খোলার মৃদু শব্দ পেলাম। অতিদ্রুত নামার প্রয়াস করতেই ছিটকে পড়ে যেতে নিলাম। দ্রুত রেলিং ধরে ফেললাম। এখান থেকে পড়লে হাত পা ভাঙবে না, সামান্য একটু ব্যথা পাবো। ততক্ষণে ধ্রুব ছুটে এসেছে ব্যালকেনিতে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার আমার পানে তো একবার বাঁধা ওড়নাটার পানে দেখছে। হাতের উপর তার আর্দ্র হাত স্পর্শ করলেন। হিমশীতল রুপ ধারণ করল। রেলিং আয়ত্ত থেকে বেরিয়ে গেল। দ্রুত হাত ধরলেন তিনি। টনক নড়ল আমার। শঙ্কিত কণ্ঠে বললাম, “ক কী করছেন?”

“কিছু না, শক্ত করে ধর। নতুবা পড়ে যাবে।”
হাত ছাড়লেন না, উপরে তোলার প্রয়াসও করলেন না। রেলিংয়ে বসলেন। ফোনের স্ক্রিনের মৃদু আলো পড়ছে তার মুখে। চোখের পলক সেকেন্ডের ব্যবধানে বেশ কয়েকবার পড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে ওষ্ঠদ্বয় ঈষৎ নড়ে উঠছে। নজরকাড়া হাসি। একহাতের সাহায্য ফোনে অ্যাঞ্জেলা গেমস বের করে তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। এই বয়সে এসে এইসব করছে। অবিলম্বে ক্ষুধায় কাতর হয়ে উঠলাম। সকাল থেকে না খেয়ে আছি। গোটা একদিন অতিবাহিত হয়েছে। এদিকে মামাকে জানানো হয়নি। নিশ্চয় দুঃচিন্তা করছেন। আদুরে গলায় বললাম,
“শুনছেন, তুলুন আমাকে।”
“না। তুমি যেথায় যাচ্ছিলে, যাও। ” রিনরিনে গলায়।
“আমি যাবো না, প্লীজ তুলুন।”
পরক্ষণেই হাত ধরে টেনে তুললেন। ইতস্তত করে বললাম, “আমি বাড়িত যাবো।”
ভ্রু কুঁচকালেন ধ্রুব। রেলিংয়ে বাঁধা ওড়নাটা খুলে কাঁধে রাখলেন। ঈষৎ ঝুকে কোলে তুলে নিলেন ধ্রুব। কক্ষে এনে বিছানায় ছুঁড়ে ফেললেন। ওড়না দিয়ে হাত পা বেঁধে দিলেন। উৎকণ্ঠা হয়ে বললাম, “হাত পা বাঁধছেন কেন?”
“চুপ না করলে মুখটাও বেঁধে দিবো।”

আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। ধ্রুব চলে গেলেন। আমি এদিক ওদিকে অবলোকন করলাম। মন মুগ্ধকর সৌন্দর্যে নিবদ্ধ সবকিছু।‌ ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ হল। দেয়াল ঘড়িতে রাত একটা ছুঁই ছুঁই। যখন জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম, তখন আনুমানিক ছয় কি সাতটা বাজে। এতক্ষণ জ্ঞানহীন অবস্থায় ছিলাম, ভাবতেই শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে।
ততক্ষণে ধ্রুব ফিরে এসেছে। হাতে আমার মুঠোফোন। কললিস্ট দেখিয়ে রাগান্বিত গলায় বলে, “রাহাত তোমাকে কেন ফোন করেছে? ওর কাছে তোমার নাম্বার গেল কীভাবে?”
হতবাক হলাম কিঞ্চিৎ। “কীসব বলছেন? রাহাত স্যারের সাথে এখন অবধি আমার কথাই হয়নি।”
ঝংকার তুলে মুঠোফোনটা বেজে উঠল পুনরায়। ধ্রুব এগিয়ে দিলেন কথা বলতে। আমি রিসিভ করতে ব্যর্থ হলাম। বিনিময়ে তিনি রিসিভ করে কর্ণকুহ্বরে ধরলেন। কথা বলতে বললেন।

“চড়ুই, কোথায় তুমি? কতবার ফোন করেছি রিসিভ করনি কেন!”
সৌজন্য হাসি দিয়ে বলি, “আমি একটু বান্ধবীর বাড়িতে এসেছি, সময় পাইনি।”
অবিলম্বে ধ্রুব ফোনটা ছুঁড়ে ভেঙ্গে ফেললেন। ডাগর ডাগর চোখ চেয়ে বললাম, “আমার ফোন?”
ঝাঁজালো গলায় বললেন, “নেই। আমি তোমার বান্ধুবী হই? হবু বরকে সত্যিটা জানাতে ভয় পাচ্ছ?”
বলেই হুরমুরিয়ে বিছানায় আসন পেতে বসলেন। বামহাতে আবদ্ধ করলেন নিজের বাহুডোরে। ভরকে গিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম তার মুখপানে। সময়ের ব্যবধানে নিজের ফোনটা পকেট থেকে বের করে ফোন করলেন কাউকে। পরিচিত কণ্ঠ চিনতে বিন্দু পরিমাণ অসুবিধে হয়নি। ইনি রাহাত স্যার। হাতপা ছোড়াছুড়ি করে বললেন,
“শোন রাহাত, তোর হবু বউ বান্ধবীদের বাড়িতে যায়নি। তোকে মিথ্যা বলেছে। সে তো তোর বন্ধুর সাথে এক বাড়িতে, এক ঘরে, এক বিছানায় আছে।
কেমন মেয়ে ভেবে দেখ, এখনও কি তুই বিয়ে করবি?”

“চড়ুই তোর সাথে, ফোনটা ওকে দে।”
“ওর লজ্জা করছে। তুই তো প্রথম থেকেই জানিস, ও কেমন। সুতরাং বিয়েতে না করে দে।”
কল কেটে ফোনটা রাখলেন টেবিলের উপর। হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলেন। অতঃপর বিছানায় শুয়ে পড়লেন টান টান হয়ে। আদুরে গলায় বললেন চুলগুলো টেনে দিতে। আমি দ্বিধা দ্বন্দ্বকে অবকাশ দিয়ে মাথায় হাত রাখলাম ধ্রুবের। তিনি ভাঙা গলায় বললেন,
“জানো শ্রেয়া। আমি সত্যি অসহায় ছিলাম। তোমাকে অবহেলা করেছি। মানুষ ভুল শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে, আমিও তাই করেছি। কিন্তু পারছি না। চার বছর অন্তর অন্তর আমার জন্মদিন আসে। এবারও এসেছিল। তোমার সাথে কাটাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সম্ভব হয়নি। আমার জীবনের সবচেয়ে কালো দিন ছিল এটা। সারাদিন টেনশনে চলে গেছে। [দীর্ঘশ্বাস নিয়ে]
পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তুমি পাশে ঘুমিয়ে পড়।”

শ্রেয়া নামটা শুনে একটু থমকে গেলাম। চমকালামও বটে। আমি ধ্রুবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবতে লাগলাম। কষ্ট লাগল, মন খারাপ হল। ভাবতে ভাবতে ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গেল। ততক্ষণে ধ্রুব তলিয়ে গেছে তন্দ্রাঘোরে। ফাঁকা হাতটা চোখের সামনে এনে পরখ করে উঠে দাঁড়ালাম। তিনি গভীরতর তন্দ্রায়। ভাঁজ করে রাখা কম্বলটা টেনে গায়ে জড়িয়ে দিলাম। রান্নাঘরের দিকে অগ্ৰসর হলাম। দেখতে তো বসবাসের উপযোগী, রান্নার সামগ্রী থাকতে পারএনা, এটা হতেই পারেনা। কেক তৈরি করার সকল উপকরণ পেয়ে গেলাম। কেকটা মাইক্রোওভেনে রেখে চায়ের পানি চুলায় দিলাম। চিনি, চায়ের পাতা দিয়ে দাঁড়ালাম। ফুটছে দেখে চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে অন্যরুমে গেলাম। সেখানে আমার জামা কাপড় ভর্তি ব্যাগটা পড়ে আছে নিচে। একটা সবুজ রঙের শাড়ি পেলাম। সন্তুষ্ট হলাম এতেই।

অনিচ্ছার সত্বেও সাথে চলে এসেছে, এতেই ঢের। শাড়িটা গায়ে জড়ালাম। পুনরায় রান্নাঘরে ফিরে এলাম। কেক ইতোমধ্যে হয়ে এসেছে। কাপে চা ঢেলে ধ্রুবের রুমে গেলাম। শাড়ি পড়ে নতুন বউয়ের ন্যায় লজ্জা নামক জিনিসটা ঘিরে ধরেছে। কাবু হলাম। নিজেকে শান্ত করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ধ্রুব উবুত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। বালিশটা সরে গেছে। মুখশ্রীতে তৈলাক্ত ভাবটা জেগে উঠেছে। মায়াবী লাগছে তাকে। ইচ্ছে করে হাত বাড়িয়ে তার মুখশ্রী স্পর্শ করতে। নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জানত হলাম। কম্পন সৃষ্টি হল। চায়ের কাপটা রীতিমতো ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। দুইহাতে আগলে ধরলাম দ্রুত। ছ্যাকা লাগল হাতে। আহ্ করে আর্তনাদ করে উঠলাম। অবিলম্বে ধ্রুব লাফ দিয়ে উঠে বসলেন। বিচলিত হয়ে বললেন, “ক কী হয়েছে?”
ক্রমাগত কাঁপছে হাত। চটচটে গলায় বললাম, “চা, আপনার চা।”
আমার মাথা থেকে পা অবধি অবলোকন করে শান্ত গলায় বললেন,
“বাহ্! আজকে তোমাকে বউ বউ লাগছে।”

“বাহ্! আজকে তোমাকে বউ বউ লাগছে। তবে শাড়ি পড়ে এসেছ কেন? তুমি তো সবসময় খালি গায়ে ঘুড়াগুড়ি করতে।”
কর্ণকুহ্বরে পৌঁছাতেই চোখের মণি জ্বলজ্বল করে উঠল। অবিলম্বে মাথা ঘুরে উঠল। এবার সংযত করতে ব্যর্থ হলাম চায়ের কাপ। হাত ফসকে মেঝেতে পড়ে টুং টুং শব্দে ভেঙে গেল তৎক্ষণাৎ। কয়েক খন্ডে খন্ডিত হল। গরম চা পায়ের পাতার উপর পড়তেই জ্বলে উঠল জায়গাটা। পিছিয়ে গেলাম দুকদম। ধ্রুবের ধ্যান ভাঙল। লাফ দিয়ে মেঝেতে উঠে দাঁড়াল। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন,
“কী হয়েছে চড়ুই? বেশি লেগেছে? একটু সাবধানে ধরবে না, পড়ে গেল কীভাবে? নিশ্চয় জ্বলছে?”
“আপনি কিসব আবোলতাবোল বলছিলেন? সেগুলো শুনেই তো!”
ধ্রুব শুনলেন না। অগ্রাহ্য করলেন। বসে পড়লেন হাঁটু মুড়ে। পায়ের কাছ থেকে শাড়ি সরিয়ে স্পর্শ করলেন পায়ের পাতা। পা সরাতেই খপ করে ধরলেন। অস্ফুট স্বরে শুধালাম,

“ছাড়ুন, কী করছেন? পা ছাড়ুন।”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গম্ভীর গলায় বললেন, “পা এখানে রাখো।”
পরক্ষণে নিজেই পা তার হাঁটুর উপরে রাখলেন। লালচে হয়ে আসা স্থানটায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অপেক্ষা করলেন না। হুট করেই কোলে তুলে নিলেন। কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ। দ্রুত গলা পেঁচিয়ে ধরলাম। মাথা রাখলাম বুকে। তিনি অতিদ্রুত পা চালিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলেন। ট্যাপের নিচে পা রেখে ট্যাপ ছেড়ে দিলেন। হাত বুলিয়ে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করলেন। মিনমিনে গলায় বললাম, “ভেতরে চলুন। পানি দিবো না, জ্বলছে।”
“জ্বলুক। জ্বলতে দাও। ধীরে ধীরে কমে যাবে।”

আরও কিয়ৎক্ষণ পানির নিচে অপেক্ষা করলেন তিনি। পুনরায় কোলে তুলে নিলেন। বিছানায় বসিয়ে দিলেন। ড্রয়ারে খুঁজতে লাগলেন কিছু। বিরক্ত মাখা গলায় বললেন, “ব্যথার স্প্রে কিংবা মলমটা কোথায় রাখল। খুঁজেই পাচ্ছিনা।”
মায়া হল বড্ড। আমার সামান্য একটু ব্যথায় উদাসীন তিনি। একটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল। এত ভালোবাসা হঠাৎ কোথা থেকে এলো। এর ছিটেফোঁটাও যদি থাকত, এতটা দূরত্ব থাকত না আমাদের মাঝে। তাচ্ছিল্য করলাম ব্যাপারটা। দীর্ঘশ্বাস নিলাম। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললাম, “ছেড়ে দিন। সামান্য একটু ব্যথা। কমে যাবে।”
“তুমি বললেই তো কমে যাবেনা। চুপচাপ বসে থাকো।”
খুঁজে পেতে ব্যর্থ হলেন। উপায়হীন হয়ে ব্রাশদানী থেকে টুথপেস্ট নিয়ে এলেন। স্বযত্নে লাগিয়ে দিলেন পায়ে। জ্বলে উঠল দ্বিগুন। আঁচল চেপে গ্ৰথণ করলাম নেত্রযুগল। টলটল করছে, মাথানত। অতিবাহিত হল কিছু মুহুর্ত। কমে এসেছে ব্যথা। তিনি হাত পা ছড়িয়ে বসলেন। অগোচরে হাসলাম মৃদু। আমি ধীর কণ্ঠে শুধালাম,
“আপনার জন্য চা করেছিলাম, অসাবধানতায় পড়ে গেছে। আরেক কাপ করে দিব?”
আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, “দরকার নেই, অনেক করেছ। করতে করতে পায়ের এই হাল করেছ। এই পা নিয়ে আর করার দরকার নেই। পরে হসপিটালে যেতে হতে।”

“কিন্তু আমি যে ভালোবেসে করেছি। সমস্যা নেই, এককাপ সমপরিমাণ আছে। শুধু গরম করলেই হবে। পায়ের পাতায় ছ্যাকা খেয়েছি, তলায় নয়। বসুন এখনই নিয়ে আসছি।”
একগাল হেসে বললেন, “এখন চা খাবো না। চা খেলে ঘুম হয়না। কালকে ঘুম থেকে উঠলে বরং করে দিও।”
আমি তোয়াক্কা করলাম না। সন্তর্পণে পা ফেলে ধীরে ধীরে অগ্ৰসর হলাম রান্নাঘরের দিকে। কেক মাইক্রোওভেনের থেকে বের করে রেখেছিলাম। নতুবা এতক্ষণে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। কেক খাওয়ার পরিবর্তে সেই ছাই দিয়ে দাঁত মাজা যেত। আমি রান্নাঘরের ড্রয়ারে মোমবাতি খুঁজতে কৌতূহল প্রকাশ করলাম। পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে সামান্য উঁচু করলাম। হাতের নাগালে পেয়ে গেলাম। লাইটার দিয়ে চারটে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলাম।

বিদ্যুৎ সার্কিট বোর্ডের নিকট গেলাম। বিদ্যুৎ সকেট খুললাম। তৎক্ষণাৎ আঁধারে মিলিয়ে গেল আলোর রেখা। মৃদু হলদেটে আলোয় আলোকিত হল রান্নাঘর। আমি মোমবাতি নিয়ে ফিরে এলাম ঘরে। পুনরায় রান্নাঘরে গিয়ে কেক নিয়ে হাজির হলাম। ধ্রুব কোথাও নেই। বিশ্রী গন্ধে গাঁ গুলিয়ে উঠছে। হাত গিয়ে ঠেকল মুখশ্রীতে। ব্যালকেনি থেকে হাওয়ায় ভেসে আসছে এই দুর্গন্ধ। আঁচলে নাক চেপে ধরলাম। মোমবাতি নিয়ে ব্যালকেনিতে প্রবেশ করলাম। মৃদু তীক্ষ্ণ আলো দেখা যাচ্ছে। ধ্রুব মেঝেতে বসে সিগারেট টানছে।
আমার পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই হাত থেকে খসে পড়ল সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ। পায়ের উপর পড়তেই আঁতকে উঠল। দ্রুত অবশিষ্ট অংশটুকু তুলে নিল। দেয়ালের সাথে ঘসে নিভিয়ে ফেলল। অতঃপর উপর থেকে নিচে ফেলে দিল। আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, “তুমি এখানে?”

মাথানত করে ফেললাম। দুকদম পিছিয়ে গেলাম। মিনমিনে গলায় বললাম,
“আপনি সিগারেট খান? গন্ধ আসছে।”
অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন আমার পানে। পরক্ষণেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন ভেতরে। আমিও পিছুপিছু ভেতরে এলাম। তিনি ব্রাশদানি থেকে ব্রাশ তুলে নিলেন। টুথপেস্ট লাগিয়ে ব্রাশ করতে লাগলেন। আমি জ্ঞানহীন, বোধশক্তি হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কার বাড়ি এটা? নিশ্চয় ব্রাশটা তার নয়, অন্যকারো ব্রাশ। ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ!
মিনিট খানেক ব্রাশটা মুখে রাখলেন না। অতিদ্রুত ট্যাপ ছেড়ে কুলি করে নিলেন। ব্রাশটা পূর্বের স্থানে রেখে বেরিয়ে এলেন বাইরে। ঈষৎ উঁচু করে শুকলেন গায়ের শার্টটা। এক টানে খুলে ফেললেন শার্ট। যার দরুন দেহখানা উন্মুক্ত। বিন্দু বিন্দু পরিমাণ ঘামগুলো জ্বলজ্বল করছে মোমের হলদেটে আলোর শিখায়। প্রথমবার কোনো সুপুরুষকে দেখে শিহরিত আমি। চোখের পলক থেমে গেল। বোতামগুলো আলাদা হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল নিচে। তিনি তুললেন না। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে স্প্রে নামিয়ে পুরো রুমে স্প্রে করে দিলেন।

“ওভাবে সং সেজে না দাঁড়িয়ে থেকে ঘুমাও। রাত তো পেরিয়ে গেল।
আমার পাশেই শুতে পারো, একা একা অন্যঘরে ঘুমালে ভয় পাবে।”
বলেই টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন মাঝবরাবর। আমি নিশ্চুপ থেকে বেরিয়ে তাকে টেনে তুললাম। একটা মোমবাতি সামনে ধরে বললাম, “ফুঁ দিন।”
তিনি ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দিলেন। আলো একটু কমে গেল। কেক আর ছু’রি এগিয়ে দিয়ে কাটতে বললাম। তিনি কেক কেটে এক টুকরো এগিয়ে দিলেন। আমি মুখে না তুলে তাকে খাইয়ে দিলাম। তিনি তৃপ্তিকর হাসি দিয়ে বললেন, “এতকিছুর কী দরকার ছিল। তুমি আমার কাছে আছো এতেই আমি খুশি।
লাভ ইউ চড়ুইপাখি।”
অহেতুক লজ্জামিশ্রিত হলাম। অস্ফুট স্বরে বললাম, “দরকার ছিল। ছিল দরকার।”
“কেন দরকার ছিল?”
“জানি না।”

ভ্রু নাচিয়ে বললেন, “তাই বুঝি! এতই যখন দরকার ছিল তাহলে আমার গিফ্ট কোথায় আর এত সাজার কারণ কী?”
নিজের অন্তরে আওড়ালাম কিয়ৎক্ষণ ‘গিফ্ট’ শব্দটা। অতঃপর বললাম, “গিফ্ট তো আনি নি। আমি তো আমাকে কিড’ন্যাপ করেছেন। যদি জানতাম তাহলে কিড’ন্যাপ হওয়ার আগে গিফ্ট ব্যাগে রেখে দিতাম।”
“তুমি চাইলে গিফ্ট দিতে পারো।”
“কোথায় পাবো?”
আমি হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তিনি মুচকি হাসলেন‌। হাত টেনে কোলে বসিয়ে দিলেন। ঘোরের ইতি পড়ল।
“তুমি তো নিজ ইচ্ছায় দেবে না, আমিই নিয়ে নিলাম।”
“মানে..
বাক্য অসম্পূর্ণ থেকে গেল। অধরে শীতল অধরের স্পর্শ পেলাম। চোখজোড়া পলকহীন হয়ে থেমে রইল।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৬

মুক্ত হতেই ফুঁপিয়ে উঠলাম। নাক টেনে কেঁদে উঠলাম। ধ্রুব অনুশোচনায় পড়লেন। হতাশ হয়ে গেলেন। তিনি সামলাতে বললেন, “আ’ম স্যরি চড়ুই। ভেরি ভেরি স্যরি। প্লীজ কেঁদো না। আমার উচিত হয়নি।”
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললাম, “আপনি ইচ্ছে করে করছেন। আমি থাকব না আপনার সাথে।”
“ঠিক আছে কালকে চলে যেও, এখন শুয়ে পড়। এতরাতে গাড়ি পাবে না।”
“গাড়ি না পেলে হেঁটে যাবো। তবুও যাবোই যাবো। আপনি কখন কী করেন ঠিক নেই।”
“চিন্তা নেই, তোমার অমতে কিছু করব না। শুধু পাশে শুয়ে পড়। আমি মন ভরে দেখব।”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৮