মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৮

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৮
ইফা আমহৃদ

সূর্যের তীর্যক রশ্মি মুখের উপর লম্বভাবে পড়তেই তন্দ্রার রেশ কমে এলো। ক্ষণে ক্ষণে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। হাত দিয়ে আড়াল করার প্রয়াস করলাম বিরক্তিকর রোদের অংশকে। ব্যর্থ হচ্ছি বরাবরই। নিভু নিভু এক চোখ মেলে তাকাতেই নজর সর্বপ্রথম আঁটকে গেল জানালার দিকে। মৃদু হাওয়ার সাথে রোদ লাগছে। আজ একটু বেশিই বেলা হয়েছে বৈকি। এত দেরীতে কখনো বিছানা ছাড়া হয়না। পায়ের উপরও পড়ছে মৃদু। পুড়ে যাচ্ছে জায়গাটা। ইশ্! কেউ যদি পর্দাটা টেনে দিত। উপায়ান্তর না পেয়ে উঠে বসার প্রয়াস করলাম। থ্যালামাস হচ্ছে।ধীরে ধীরে দৃষ্টি পাশে নিবদ্ধ করতেই ভরকে গেলাম। চিত হয়ে শুলেও আমার একপা ধ্রুবে পায়ের উপর। নেত্রযুগল বড়ো বড়ো হল। পলক থেমে গেল। আমার ঘুম তো এমন নয়। একদম পরিপাটি ঘুম। তাহলে?
অতিদ্রুত পা সরিয়ে পরিপাটি হয়ে বসলাম। যেন বিড়াল চু’রি করে মাছ খেতে গিয়ে ধরা পড়েছে। সরতে হবে, তিনি আবার আমাকে দেখে ফেলেন নি তো! জানালার পর্দা টেনে দিলাম। এলোমেলো হয়ে আসা কম্বলটা টেনে জড়িয়ে দিলাম গায়ে। হাই তুলে উঠে দাঁড়ালাম। অগ্ৰসর হলাম অন্যরুমে। সেখান থেকে জামা কাপড় ভর্তি ব্যাগ থেকে লাল রঙের একটা থ্রী পিস বের করলাম। সেই রুমের ওয়াশরুমে ঢুকলাম শাওয়ার নেওয়ার উদ্দেশ্যে। শাড়ি পড়ে হাঁপিয়ে উঠেছি।

“চড়ুই, কোথায় তুমি?”
ভেতর থেকেই অস্পষ্ট ধ্রুবের গলা ভেসে আসছে। আমি সাড়া দিলাম না। একদম শাওয়ার শেষ করে বেরিয়ে এলাম। ধ্রুব বিছানায় একপা তুলে দরজার পানে মুখ করে চেয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে বললাম, “ডাকছেন কেন? গলার আওয়াজ শুনেছেন? ভাঙা বাশও ফেল। আপনার গলা শুনে পালিয়ে যাবে সবাই।”
“সবাই যাক, তুমি তো যাওনি। এতেই হবে।”
“আমি এখানকার কিছু চিনি বলে মনে হয় আপনার? যাবো কীভাবে?”
চিবুকে স্লাইড করতে করতে ভ্রু কুঁচকে বলল, “কালকে রাতে কিছুই তো করলাম না। এত সকাল সকাল শাওয়ার নিলে যে। সামান্য কিস্ করেছি বলে সকাল সকাল শাওয়ার নিলে, অন্যকিছু করলে সারাদিনে বের হতেই না। আবার একদম লাল পড়েছ। ভাবা যায়।”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুখশ্রী ফিরিয়ে নিলাম। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে লাগলাম। সাদামাটা কণ্ঠে বললাম, “এখন দুপুর হয়ে এসেছে। আযান দিল বলে, আমার তো কাজ নেই ওয়াশরুমে সারাদিন বসে থাকব।”
প্রত্যুত্তর দিলেন না। হাত থেকে ভেজা টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোলেন। আমি নিষ্পলক চেয়ে রইলাম। চুল শুকিয়ে এসেছে ততক্ষণে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নামাজ আদায় করে বিছানায় শুয়ে আছি। ধ্রুবও নামাজ আদায় করেছে একসাথে। অতঃপর বেরিয়েছে খাবার আনতে। আমি ফোনের স্ক্রিনে গেমস খেলছি। তৎক্ষণাৎ ফোন বাজল। অপরিচিত নাম্বার দেখে ইতস্তত বোধ করলাম। ‘রং নাম্বার’ কি-না এতেই বিব্রত। বাজতে বাজতে কেটে গেল লাইন। পুনরায় বেজে উঠল। দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে রিসিভ করলাম। পরক্ষণেই মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সালাম বিনিময় করে ‘কে’ জানতে চাইলে তিনি অস্পষ্ট জবাব দিলেন।
“আমি কে, তা না জানলেও চলবে। শুধু জেনে রাখো, তোমার ছোট বোনের চেঞ্জিং ভিডিওটা আমার কাছে স্বযত্নে রাখা আছে।”
অবিলম্বে হার্টবিট বেড়ে গেল। ঘামতে শুরু করলাম ক্রমশ। হতবাক হয়ে বললাম, “মানে? কীসের চেঞ্জিং ভিডিও?”
“শাড়িতে জুস ফেলেছিলাম না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তোমার বোনের শাড়িতে পড়ে। তারপর রাহাত নামক একটা ছেলে শাড়ি এনে দিল। বাবুই চেঞ্জ করতে গেল।

ক্যামেরা ফিট করা ছিল, উঠে গেছে ভিডিও। কী করব এটা দিয়ে বুঝতে পারলাম না। আমার তো তোমার চেঞ্জিং ভিডিও দরকার ছিল। পরে ভাবলাম, এটা দিয়ে না-হয় আমার সার্থ হাসিল করে নেই। ফোন কাছেই রেখো, যখন তখন কল করতে পারি।”
লাইন কেটে গেল। মুহুর্ত অতিক্রম হল।
সেদিন বাবুইকে নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের মেয়ের জন্মদিন গিয়েছিলাম। তখনকার দুর্ঘটনা ছিল সাজানো পরিকল্পনা। বিস্মৃত হলাম কর্ণকুহর থেকে ফোন সরাতে। মাটির দিকেই চেয়ে রইলাম। বাকশক্তি লোপ পেল। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম। দ্রুত দেয়াল ধরে সামলে নিলাম। ‘কে তিনি? কী শ’ত্রুতা আমার সাথে? বাবুইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়নি তো!’
ভরে এলো নেত্রযুগল। বাবুইকে কল করতে গিয়েও থেমে গেলাম। মেয়েটা বড় কিছু করে ফেললে। নিরব তৌফিককে জানাতে হবে ব্যাপারটা। দ্রুত ধ্রুবের ফোন খুঁজতে লাগলাম। ধ্রুব ফোন রেখে গেছে। নাম্বার তুলে কল করলাম নিরবকে। সবাই হয়ত একত্রে ছিল। কল করতেই রিসিভ হল। কৌতূহলী স্বরে বলল,

“কে?”
“আমি চড়ুই বলছি।”
“চড়ুই তুই! কোথায় আছিস এখন? কালকে রাত থেকে তোর কোনো খবর নেই।”
নিরবকে থামিয়ে বললাম, “থাম, আগে আমার কথাটা তো শোন। আমি একটা সমস্যা পড়েছি। অনেক বড় সমস্যা। প্লীজ হেল্প কর আমায়। প্লীজ।”
“কী সমস্যা, তাড়াতাড়ি বল। তুই ঠিক আছিস তো।”
“হম, আমি ঠিক আছে। কিন্তু বাবুই..
ফুঁপিয়ে উঠলাম পরক্ষণেই। ওপাশ থেকে ক্রমাগত থামতে বলছে, পারছি না। কিছু বলতে পারলাম না। বলার মত ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই শরীরে। ফোন নম্বরটা দিয়ে খোঁজ নিতে বললাম।
ইতোমধ্যে ধ্রুব এসে হাজির হল। অতিদ্রুত কললিস্ট থেকে নম্বরটা রিমুভ করে রেখে দিলাম। সৌজন্য হাসি দিলাম। ধ্রুব একটু আধটু অনুমান করলেন। সন্দিহান গলায় বললেন, “কোনো সমস্যা হয়েছে চড়ুই? কিছু লুকাচ্ছ আমার থেকে?”

“না। কী লুকাব? [প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম] খাবার এনেছেন? খুব ক্ষুধা লেগেছে।”
“দেরী হয়েছে যেতে। হোটেল বন্ধ।”
মেজাজ চটে গেল মুহুর্ত। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম, “কাল থেকে আজ পর্যন্ত না খেয়ে আছি। আপনার কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। আশ্চর্য আমি। কিড’ন্যাপ করার সময় মনে ছিলনা আপনার। আমি এক্ষুনি বাড়িতে যাবো।”

“ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।”
কথাটা আজ আমার জন্য প্রযোজ্য।
মিনিট বিশেক হল খাবারের প্যাকেট সমেত বসে আছি। অনেক খাবার। অনেক আগেই অনলাইনে অর্ডার করেছে ধ্রুব। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে দিয়ে গেছে। তখন বাবুইয়ের চিন্তায় ধ্রুবকে কথা শুনিয়ে দিয়েছি। একজনের ক্ষোভ অপরজনের উপর ঝেড়েছি। সামান্য একটা কথায় এতটা কষ্ট পাবেন, বুঝতে পারলে কখনো বলতাম না। এখন অনুশোচনায় ভুগছি। খাবার প্লেটে সাজিয়ে ধ্রুব ডাকতে রুমে গেলাম। ধ্রুব শুয়ে আছে। একহাত মুখের উপর রেখে চোখজোড়া আড়াল করা। সন্তর্পণে পা ফেলে ডাকলাম তাকে, “শুনছেন, তিনটা বাজতে চলল। খাবেন না?”
ধ্রুব অতিশয় শান্ত বালকের মত বললেন, “পরে খেয়ে নিব, তুমি খাও।”

“আমি সত্যিই দুঃখিত। আমার এতটা রিয়েক্ট করা উচিত হয়নি।”
“এটা স্বাভাবিক। ক্ষুধা লাগলে চারিপাশের কিছু খেয়াল থাকেনা। খেয়ে নাও। অবশিষ্ট থাকলে আমি খাবো।”
অবশিষ্ট থাকলে, মানে কী? আমি রাক্ষসের মত খাই। ললাটে সরু ভাঁজ ফেলে বললাম, “তারমানে কী বলতে চাইছেন আপনি? আমি রাক্ষসের মত খাই?”
ধ্রুব এবার উঠে বসলেন। ফিচেল হেসে বললেন, “আমি কখন তোমায় রাক্ষস বলেছি?”
“সরাসরি বলেননি, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেছেন। রাক্ষস ছাড়া কে খাবে এতগুলো।
আমি মহান মানুষ, আপনাকে ছাড়া খাবো না।”
ধ্রুব একঝলক হাসলেন। খাবার নিয়ে আসতে বলেন। আমি তৃপ্তিকর হাসি দিয়ে খাবার নিয়ে এলাম। দুজনে একসাথে খেলাম।

নিরিবিলি পরিবেশ পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেছি। গ্ৰামের মাঝে হওয়াতে তেমন গাড়ি চলার সুবিধা নেই আবার অসুবিধাও নেই। ছোটো ছোটো দুইএকটা গাড়ি চলছে। ধ্রুব আর আমি পাশাপাশি হাঁটছি। শুকনো পাতার উপর হাঁটার ফলে খচখচ শব্দ হচ্ছে। ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছি। তাই সাথে নিয়ে এসেছে। হাতে চকবার আইসক্রিম। গলে গলে মাটিতে পড়ছে কিছুটা। আমার মন মস্তিষ্ক সবকিছু বাড়িতে। কী করব এটাই ভাবনা। ধ্রুবের আইসক্রিম শেষ। কাঠি চিবিয়ে চিবিয়ে কয়েক খণ্ড করেছে। এরমধ্যে হঠাৎ উদয় হল চলন্ত গাড়ি। দ্রুত চলছে। আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৭

হাত থেকে খসে পড়ল আইসক্রিম। সেকেন্ডের মাঝে অতিরিক্ত সামনে চলে এসেছে। আমি দ্রুত ধ্রুবের হাত ধরলাম। ধ্রুব হাত ছাড়িয়ে ধাক্কা দিল সর্বশক্তি দিয়ে। ভারসাম্যহীন হয়ে ছিটকে পড়লাম দূরে। আর্তনাদ শুনতে পেলাম ধ্রুবের। পরক্ষণেই বিকট শব্দ। আমি দ্রুত পেছনে ফিরলাম। ধ্রুব নিচে পড়ে আছে। গাড়িটা গাছের সাথে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ধ্রুবের নিকট ছুটে গেলাম। মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। হাত পা ছিলে গেছে অনেকটা। হাঁটু মুড়ে বসে ধ্রুবের মাথাটা নিজের কাঁধে নিলাম। রক্তে ভিজে যাচ্ছে আমার জামা। ওড়নাটা হালকা করে বেঁধে দিলাম মাথায়। এই অসহায় পরিস্থিতিতে আমি একা, কী করব? কোথায় যাবো? কার কাছে সাহায্য চাইব? কিছু বুঝতে পারছি না।
‘বিপদ যখন আসে, সবদিক থেকে আসে।’

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৯