মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৯

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৯
ইফা আমহৃদ

রক্তে ভিজে রঙিন দেহ। পা থেকে দ্বিধাহীন রক্ত ঝরছে। গাল গড়িয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রুধারা। মোছার বিন্দুমাত্র স্পৃহা নেই। এই অশ্রু ব্যথার নয়, বুকে চেপে রাখা নিরব যান্ত্রনার। ক্ষণে ক্ষণে ফুঁপিয়ে উঠছে দেহখানা। আমি নির্বাক, বাকহীন, নিশ্চল, স্তব্ধ। ভেতরটা হাহাকারে ভরপুর। ধ্রুবকে ফার্মেসির ভেতরে নেওয়া হয়েছে। আলাদা ঘরে তার প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে। তখনকার দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে। ক্ষণে ক্ষণে আঁতকে উঠছি সেই ভয়ংকর অনুভূতির কারণে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম তখন। অচেনা পরিবেশ। কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। মনে সাহস সঞ্চয় করে অতি কষ্টে রাহাত স্যারকে কল করেছিলাম। রাহাত স্যারকে সবটা খুলে বলতে তিনিই লোকেশন চ্যাক করে গাড়ি পাঠিয়ে ছিলেন। আশেপাশে তেমন কোনো হসপিটাল না থাকায় ফার্মেসিতে পাঠিয়েছেন। আশ্বাস দিয়েছেন, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তিনি চলে আসবেন।

রাহাত স্যার এলেন। তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখলেন। সাথে এলো বাবুই। ডাক্তার জানালেন, ধ্রুব সুস্থ আছে এখন। তেমন গুরুতর আঘাত পায়নি। মাথায় আঘাতের ফলে জ্ঞান হারিয়েছে। এখন ঘুমিয়ে আছেন। ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। রাহাত স্যারের সহায়তায় ফ্লাটে ফিরলাম। রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না। ধ্রুবের সন্নিকটে বসে চেয়ে রইলাম তার মুখপানে। চোখজোড়া থামছেনা। এই মানুষটার একটু কষ্টে ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, এটাই হয়ত স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা। নতুবা এমন অনুভূতির সম্মুখীন কেন হতে হবে?
পরদিন সকালে জ্ঞান ফিরল ধ্রুবের। নির্ঘুম রাত্রি পার করার ফলে ভোর রাতে চোখের পাতা মিলেছে। তন্দ্রা ব্যঘাত ঘটল কথোপকথনে। আমি দ্রুত চোখ মেললাম। ধ্রুব আধশোয়া। দ্রুত কণ্ঠে বললাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কী করছেন? একা একা উঠে বসেছেন কেন? আমাকে ডাকতেন।”
ধ্রুব মুচকি হাসলেন। পাশেই রাহাত স্যারকে ইশারা করলেন। রাহাত স্যার পাশেই বসা। সকাল সকাল বাবুই চা, পরোটা সবজি করেছে। সেগুলো খাচ্ছে। বোনটা বড় হয়ে গেছে। আমার ভাবনার ফোড়ন টেনে বলেন ধ্রুব, “তাহলে টিকেট বুকিং কর। শাওয়ার নিয়ে তৈরি হচ্ছি।”
রাহাত স্যার চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, “গাড়ি নিয়ে এসেছি। চারজনে আস্তে আস্তে ঠিক পৌঁছে যাবো।”
“তুই চিনতে পারবি গ্ৰামে রাস্তা। কখনো তো যাসনি।”
“তো! ম্যাপ অনুযায়ী ঠিক পৌঁছে যাবো।”

তাদের কথোপকথন বোধগম্য না হলেও এইটুকু বোধগম্য হয়েছে, কোথাও যাচ্ছি। তড়িগড়ি করে বললাম, “কোথায় যাবেন, এই অবস্থায়। আপনি অসুস্থ। কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে বলুন।”
“হ্যাঁ। তোমাকেই তো বলব। দেখতেই তো পাচ্ছি, এক রাতে চোখ মুখের কী অবস্থা করেছ। চুলগুলো এলোমেলো। রক্তমাখা জামাটাও পাল্টাও নি।”
“তাতে কী? আপনার জ্ঞান ফিরেছে, আমি সব সামলে নিবো।”
“জানি কী সামলাবে, আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। তারচেয়ে আমরা এখন গ্ৰামে যাবো। মা ওখানেই আছে। ছোট ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। তুমি তো জানোই। এখন সেখানেই যাবো। সবার মাঝে আদর যত্নে থাকলে সুস্থ হয়ে যাবো।”
অব্যক্ত স্বরে বললাম, “কিন্তু..
“কীসের কিন্তু?”

“সবাই চিন্তা করবে আপনাকে নিয়ে। বিয়ে বাড়ি।” ইতস্তত বোধ করে।
ধ্রুব ইশারা করতেই বাবুই রাহাত স্যার চলে গেলেন। স্মিত হেসে বললেন,
“আমার জন্য তোমার আর কোনো ক্ষতি হোক, আমি তা চাইনা। না করো না।”
আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। কিছুটা অভিমান জড়ো হল। কেন হল? জানা নেই! শান্ত কণ্ঠে বললেন, “সারারাত রক্তমাখা জামা পড়ে আমার পাশে বসেছিল। এই অবস্থায় তোমাকে ভালো লাগছে না? জামাটা পাল্টে নাও। একটা পলিথিনে রেখে দিও। যাওয়ার সময় ফেলে দিবো।”
“প্লীজ না, এটা আপনার রক্ত। আমার কাছে অনেক দামী। ফেলব না। রেখে দিবো।”
“ঠিক আছে, তবে আলাদা ব্যাগে নিও। অন্য কাপড়ে দাগ লাগলে বিষয়টা..
থেমে গেলেন তিনি। তবে তার ইঙ্গিত শেষ হল না। ধ্রুবের কোলে মাথা রাখলাম। শুনলাম না তার বারণ। আশ্চর্য নিজের চিন্তা ভাবনায়। ‘ব্লাড ফোবিয়া’ ভয়ংকর রোগটাকে তুচ্ছ করে রক্তমাখা জামা পড়ে ঘুরেছি। আজ সাথে রাখতে চাইছি। তৃপ্তিদায়ক লাগছে বড্ড। ক্লান্তির অবকাশ।
আমাদের জামা কাপড় ব্যাগ ভর্তি করে ফেলেছে। আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সেখানে গিয়ে ধ্রুবের কয়েকটা টেস্ট করিয়ে চিন্তা মুক্ত হতে হবে।

চারিপাশে সারিবদ্ধ গাছ। নীল মেঘশূন্য অন্তরিক্ষ হাতছানি দিচ্ছে। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, বহুদূরে। পাখিরা কিচিরমিচির ডাকছে। মাটির রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলেছে। কাঁচ নামানো। দক্ষিণা হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে অবাধ্য চুলগুলো। ভেজা দরুন মুক্ত, বাঁধাহীন চুলগুলো। আমি মাথা হেলিয়ে দিলাম নামানো কাঁচের ভেতর দিয়ে। সিটি বাজালেন রাহাত স্যার। আমি দ্রুত মাথা ভেতরে নিয়ে এলাম। ধ্রুব ধমকে উঠলেন।
“চুলগুলো সামলাতে যেহুতু পারবেনা, বেঁধে তো রাখতে পারিস।”
রাহাত স্যার পেছনে না দৃষ্টি ফিরিয়ে মধুর সুরে বললেন, “বাঁধবে কেন? প্রেমিকার চুলের মিষ্টি সুবাসে মাতাল হবে প্রেমিক। এটাই সে চুলের অদ্ভুত ক্ষমতা।”
“আমার প্রেমিকা না-কি তোর? দুদিন আগ অবধি বিয়ে করতে পাগল হয়ে গেছিলিস, এখন শান্ত। ব্যাপারটা কী তোর?”

“পরে বলব, আগে সুস্থ হ।”
ভেজা চুল। হাওয়াতে জলকণা ধ্রুবের মুখের উপর আঁচড়ে পড়ছে। বাঁধলে বিশ্রী দুর্গন্ধ আসে। এই দুর্গন্ধে মাথা ধরে থাকে প্রায়ই। অন্য কোনো সময় হলে ঠিকই বাঁধতাম। আজ বাঁধলাম না। ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে নিলাম মুখশ্রী। হাত ধরলেন তিনি। কোমল কণ্ঠে বললেন, “ওড়না ভিজে যাবে তো। বাঁধছ কেন?”
অভিমানী সুরে বললাম, “আপনিই তো বাঁধতে বললেন।”
স্মিত হেসে বললেন, “আমি কী বলেছিলাম, মনে মনে একটু আওড়াও। আমি রাহাতকে বাঁধতে বলেছি, [থেমে] চোখ।”
“চুলগুলো সামলাতে যেহুতু পারবেনা, বেঁধে তো রাখতে পারিস।” আমি নতজানু হয়ে লজ্জামিশ্রিত হাসি দিলাম। তিনি এক কথায় দু’জনকে বেঁধে ফেলেছেন। অথচ অভিমানে জর্জরিত হয়েছি।

আমরা পৌঁছেছি ঘণ্টা দুই পূর্বে। পৌঁছেই ধ্রুব ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়েছে। রমিলা আন্টি কাঁদতে কাঁদতে নাজেহাল অবস্থা করেছেন। নিজের হাতে ছেলেকে খাবার খাইয়ে দিয়েছেন। অতঃপর ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছেন। মায়ের ভালোবাসা হয়ত এমনিই হয়। যেটা হয়েও থাকল না আমার। সবকিছু লুকিয়ে আড়ালে হাসি দিয়ে তবেই শান্তি আমি।
রমিলা আন্টি ফিরে এলেন ধ্রুবের ঘর থেকে। বাবুইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “ও কে শ্রেয়া? চিনলাম না।”
“ও বাবুই। মামাত বোন।”
“ভালো। তোমার একা থাকতে কষ্ট হবেনা। তা খাওয়া-দাওয়া করেছ তোমরা।”
বাবুই ফট করে বলল, “হ্যাঁ। আমরা রাস্তায় খেয়েছি। চিন্তা করবেননা।”
“ঠিক আছে, কিছু লাগলে আমাকে বলবে। এবার এসো, সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। অবশ্য সবাই তোমার পরিচিত, গ্ৰামটাই তো তোমার।”

বাড়ি ভর্তি মানুষজন। গিজগিজ করছে চারিপাশ। বিয়ের বাড়ি বলে কথা, মানুষজন তো থাকবেই। তাছাড়া যৌথ পরিবার। সবসময়ই গিজগিজ ভাবটা থাকবেই। গ্ৰাম বাংলায় এটা সাধারণ একটি ব্যাপার। রমিলা আন্টি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে নিয়ে গেলেন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে। তখন ধ্রুবকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়েছিল বিধেয় কথা হয়নি কারো সাথে। রান্নাঘরের দিকে অগ্ৰসর হলেন। আমি পিছুপিছু অগ্ৰসর হলাম।
রাতের রান্নার তোড়জোড় চলছে। বড়ো বড়ো ডেক্সিতে রাঁধছে। আমি সালাম দিয়ে আন্টির পাশে দাঁড়ালাম। সবাই বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন ধ্রুবের চাচি, “এটা শোয়াত ভাইয়ের মেয়ে শ্রেয়া না।”
রমিলা আন্টি সায় দিয়ে বললেন, “হম। কিন্তু আপাতত আমার ছেলের বউ।”
বসতে বললেন না। নিজেদের কাজে মশগুল তারা। আমতা-আমতা করে বললেন, “ওকে না আনলে হতো না?”

“কীভাবে হবে? ও এই বাড়ির বউ। নতুন বউ আসবে ও থাকবে না।”
সৌজন্য হাসি মিলিয়ে গেল। রমিলা আন্টি আমাকে দাদিমার ঘরে পাঠালেন চায়ের কাপ সমেত। আমি এগোলেও এগোলাম না। তাদের কথোপকথনের কেন্দ্রবিন্দু আমি। শোনার তীব্র স্পৃহা। সকলের অগোচরে আঁড়ি পেতে দাঁড়িয়ে রইলাম।
ধ্রুবের চাচি পুনরায় বললেন, “ভাবী তুমি তো জানো, এটা শুভ অনুষ্ঠান। এখানে শ্রেয়ার মত একটা অশুভ মেয়েকে নিয়ে এলে। যদি আমার ছেলের বিয়েতে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।”
“মানে?” রমিলা।
ধ্রুবের ছোট চাচী বললেন, “গ্ৰামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে মাঝপথে আমাদের ধ্রুবের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। কিছু বছর আগে শ্রেয়ার জন্য ধ্রুব বিদেশে চলে গেছিল। ওর বাবা মা চলে গেল। তোমার স্বামীকে নিয়ে গেল। এখন মামার বাড়িতে থাকে।
বুঝতেই পারছ, আমি কী বলছি।”

রমিলা প্রত্যুত্তর দিলেন না। আঁচলের থেকে গিট খুলে পান মুখে পুড়ে চিবুতে লাগলেন। আশেপাশে পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি অবগত নয়, এমন ভাব ভঙ্গিমা। তবে আমি সহ্য করতে পারলাম না। সোজাসুজি না হলেও সবকিছুর জন্য আমাকে দায়ী করেছেন। ভবিষ্যতে বিয়েতে বিঘ্ন সৃষ্টি হলে, তাতেও আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। উতলা মন নিয়ে অগ্ৰসর হলাম সামনের দিকে। হাসি মুখের আড়ালে লুকিয়ে ফেললাম ঝাঁপসা কষ্টকে। হুট করে সত্যিটা ধীরে ধীরে সমুখে আসছে যেন।

একবুক হাহাকার নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ানো। অশ্রুসিক্ত নেত্রযুগল মুছে নিলাম ওড়নার ভাঁজে। পাজোড়া স্থির, বড্ড ভারী, লোহার ন্যায়। কাঁপা কাঁপা হাতে চা ভর্তি কাপ। ভেতরে বয়স্ক মহিলা মনোযোগী হয়ে ডাইরী পড়ছে। মোটা ফ্রেমের চশমায় চোখজোড়া ঢাকা। নিম্ন দৃষ্টি বইয়ে নিবদ্ধ। হেলান দেওয়া জানালার কাঠের তৈরি শীক। বাইরে আলো নেই। আঁধারে নিমজ্জিত। হয়ত খেয়ালই করেননি। তিনি ধ্রুবের দাদি। ছোটবেলা থেকেই তাকে দেখছি ডাইরী পড়তে এবং লিখতে। আমার সাথে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। আমি অব্যক্ত স্বরে বললাম, “আসব।”
তিনি দৃষ্টি ফিরিয়ে আমার পানে চাইলেন। ডাইরী ভাঁজ করে রাখলেন পাশে। গম্ভীর গলায় বললেন, “হ্যাঁ, এসো।”
আমি চায়ের কাপ বাড়িয়ে তার সন্নিকটে বসলাম। ঝুঁকে কাঠের জানালার দ্বার টেনে দিলাম। সরল ভাষায় বললাম, “কেমন আছো বলো?”

“আমি ভালো আছি, কিন্তু তুমি কে-গো মা?”
“এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে আমাকে বুড়ি। একটুও ভালোবাসো না আমায়।”
“বিশ্বাস কর মা, ঠাওর করতে পারছি নে।”
“তা চিনবে কেন? আশেপাশে কত মানুষ। বাদ দাও, চা খাও। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। সামনের পাটির দাঁত নেই। ওষ্ঠদ্বয় রাজহাঁসের ন্যায় এক ইঞ্চি বাইরে বেরিয়ে এসেছে। চা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। অথচ এককালে শক্ত খাবার চিবিয়ে চিবিয়ে খেত।
আমি তার কান ধরে কাছে টেনে এনে কামড় বসিয়ে দিলাম গালে। জিভ দিয়ে ওষ্ঠ ভিজিয়ে লোভাতুর কণ্ঠে বললাম, “ইমামি।” তিনি ‘আহ্’ করে উঠলেন। ব্যথা পেলেন কি-না জানা নেই। তার ঠোঁটে উচ্চে পড়া হাসি। চোখের তৃপ্তিদায়ক রেখা। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলেন আমায়‌। আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন। ছোটবেলায় প্রায়ই তার গালে কামড় দিয়ে ‘উমামি’ শব্দটা বলে পালাতাম। কতবার মায়ের হাতে মা’র খেয়েছে তার হিসেব নেই।

“চড়ুই।”
ধ্রুবের উত্তেজিত কণ্ঠ শ্রবণ হতেই তড়িগড়ি করে উঠে বসলাম। তিনি অসুস্থ, এখানে কী করছেন? তৎক্ষণাৎ ধ্রুব লাঠিতে ভর দিয়ে হাজির হলেন এখানে। আমি একবার ধ্রুব আরেকবার পেছনে থাকা বাবুইয়ের দিকে দেখছি। ধ্রুবের চোখজোড়া স্বাভাবিক নেই, রক্তিম হয়ে আছে। চোয়াল শক্ত হয়েছে। হাতের লাঠিটা শক্ত করে ধরেছে। মুখে তৈলাক্ত ভাব। অনেকক্ষণ যাবৎ ঘুমের ফলে এমনটা হয়েছে। আমি দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে ফেললাম। তিনি ভুবন কাঁপানো কণ্ঠে বললেন, “দৃষ্টি সরাচ্ছে কেন? কারা দৃষ্টি লুকাই জানো, চোরেরা। তুমি কি চোর।”
“আপনি বসুন। এত কষ্ট..

“চুপ, একদম চুপ স্টুপিড। কে তোমাকে কী বলেছে?”
“কেউ কিছু বলেনি তো।”
মিথ্যা বলেও শান্তনা পেলাম না। ধ্রুবের চোখ রাঙানিতে সবকিছু ভুলে গেলাম। বাবুইয়ের পানে চেয়ে দেখলাম। সে নাক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয় বাবুই এইসব বলেছে ধ্রুবকে।
দাদিমা সন্দিহান গলায় বললেন, “কোনো সমস্যা হয়েছে, ধ্রুব। এত রেগে আছিস কেন?”
নির্ভয় কণ্ঠে বললেন ধ্রুব, “সেটা তোমার শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করো। নিচে এতকিছু হয়ে গেছে, সবাই ওকে যা নয় তাই বলেছে আর ও কিছু বলেনি।”
দ্রুত কণ্ঠে বললাম, “কেউ আমাকে কিছু বলেনি।”

ধ্রুব এবার চোখ রাঙালেন না। ফাঁকা চায়ের কাপটা তুলুন শব্দে ছুঁড়ে ফেললেন মেঝেতে। ঝনঝনিয়ে ভেঙে গেল কাপ। কেঁপে উঠলাম আমি।‌ ধ্রুব এতেও ক্ষান্ত হলেন না, দৃঢ় বল প্রয়োগ করে চায়ের প্রীজটা ছুঁড়ে ফেললেন। মুঠোয় চেপে ধরলেন হাত। বড়ো বড়ো পা ফেলে অগ্ৰসর হলেন সামনের দিকে। ড্রয়িং রুমে এসে ভাঙলেন সাজানো ফুলের টপ। তুমুল শব্দে তৎক্ষণাৎ হাজির হল বাড়ির সকলে। চ্যাঁচিয়ে বললেন,
“একটু আগে চড়ুইকে কী বলেছেন? সাহস থাকলে আমার সামনে বলুন।”
সবাই হাজির হলেও নিশ্চুপ। ছোটবেলায় প্রখর রাগের কারণে তাকে হোস্টেলে থাকতে হতো। দ্বিগুন তেজ নিয়ে বললেন, “কে তোমাকে বা’জে কথা বলেছে চড়ুই? [জবাবহীন বিধেয় আবার বললেন] আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি চড়ুই।”
“কেউ কিছু বলেনি, আপনি..

থেমে গেল শব্দ। হারিয়ে গেল অজানায়। ওষ্ঠদ্বয় ঈষৎ বিচ্ছেদ রয়ে গেল একে অপরের থেকে। গালের চড়ের আঘাত অনুভব করলাম। হাত গিয়ে ঠেকল গালে। অবিলম্বে নতজানু হলাম। রমিলা আন্টি এগিয়ে এলেন। আমাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলেন দ্রুত। পরক্ষণেই ধ্রুবকে চড় বসিয়ে দিলেন।‌ রাগান্বিত স্বরে বললেন, ‘পাগ’ল হয়েছিস তুই? মাথা খারা’প? ওকে শুধু শুধু মা’রছিস কেন?”
“ওকে বারবার সাবধান করার সত্বেও আমার সামনে মিথ্যা বলে কোন সাহসে। আমার হাতে তুলে দাও, আরও কয়েকটা চড় দিয়ে সিধে করে দেই। এককথা বারবার বলতে বলতে আমি ক্লান্ত।”
বাবুইকে বলতেই একটু আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করল সে। আমি বরাবরের ন্যায় নতজানু। ধ্রুব একে একে বললেন,

“আমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, এতে চড়ুইয়ের কোনো হাত নেই। বরং ও না থাকলে আমি থাকতাম না। দ্বিতীয়ত, ওর বাবা আর আমার বাবা বিমার দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে। ও খু’ন করেছে কীভাবে? ও কি তখন প্লেন আকাশে উড়াচ্ছিল? আমি পড়াশোনার জন্য বিদেশে গেছি, ওর জন্য ফিরে এসেছি। আমার স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের টানে। ও কি আমাকে ধাক্কা দিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছ যে ওর জন্য আমি বিদেশে গিয়েছিলাম? এবার আসা যাক অন্য প্রসঙ্গে,
বড় চাচী অনেক বছর তোমার কোনো সন্তান হয়নি। তুমি ছিলে বন্ধ্য। কবিরাজ, পীর মাজার কিছুই বাকি রাখোনি। বিয়ের সাত বছরের মাথায় অর্ক হয়েছে। কয়েকদিন পর তার বিয়ে। অর্কের জন্ম সালেই আমাদের দাদা চলে গেছে। এখন কী বলবে, অর্কের জন্য দাদা চলে গেছেন? তখন তোমাকে আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হয়নি কিন্তু।

দাদাজানের মৃত্যুর পর বাবা পরিশ্রম করে এই বাড়ি তৈরি করেছে। তোমরা থাকছ এবং বাবার টাকায় খাচ্ছ। বাবার অবর্তমানে এই বাড়ি আমার। হাউ ফানি, আর তোমরা আমার স্ত্রীকে চলে যেতে বলছ?”
বড় ফুফুর গায়ে লাগল। বললেন, “তোর বাবার টাকায় খাচ্ছি বলে সত্যিটাও বলতে পারব না।”
“তোমার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে বলিও, এখানে নয়। নিজে তো বনিবনা করে থাকতে পারোনি, এখন আরেকজনকে থাকতে দিবে না।”
তৎক্ষণাৎ দাদি উপস্থিত হলেন। ধীরে ধীরে আসতে তার সময় লাগল বেশ। সবাইকে তার ঘরে ডাকলেন। আমি সেদিকে অগ্ৰসর হওয়ার প্রয়াস করতেই ধমকে উঠলেন ধ্রুব, “ঘরে যাও, এদিকে কী?”
দাদিমা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “তুই বারবার ওকে বকছিস কেন? ও কী করেছে?”
“আমার ওকে সহ্য হচ্ছে না। ও গেলে আমি যাবো না।”

একে একে সবাই দাদিমার ঘরের দিকে অগ্ৰসর হল। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করলাম সবকিছু। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। আঁখি আমার কষ্ট বুঝতে পেরে বলল,
“তুই আমার ঘরে আয়।”
ধ্রুবের বাবারা তিন ভাই। দুই বোন। তিনি মেজো। বড়ো ভাইয়ের এক ছেলে অর্ক। তার বিয়েতে এসেছি আমরা। ছোট ভাইয়ের দুই মেয়ে। আঁখি ও নীর। বড় ফুফু নিঃসন্তান। বিয়ের কয়েকবছর পরই বাবার বাড়িতে থাকে। ছোট ফুফুর এক মেয়ে এক ছেলে। সাঈদ আর সর্মি।
আমি আঁখির ঘরে গেলাম। দোতলায় থাকে। ওরা দুই বোন একঘরে থাকে। নীর পড়ছে। বছর ছয় হতে পারে। ওকে দেখিনি আমি। ছোট একটা বিড়াল পোষে তারা। বিড়ালের নাম পুষি। সাদামাটা হলেও রঙ চঙের কারণে দেখতে কিন্তু বেশ নজরকাড়া।
আঁখি নীরের বই গুছিয়ে রাখল। নীর হতবাক হয়ে বলে, “আপু, পড়মু না। তুই বলছিলি পড়লে অ্যাঞ্জেলা গেমস খেলতে দিবি।”

আঁখি প্রত্যুত্তর না করে ফোনটা বাড়িয়ে দিল। নীর ফোন পেয়ে ছুটল। আমি বালিশ টেনে শুয়ে পড়লাম। কাঁথা দিয়ে মুখ ঢেকে বলি, “বাবুই না খেয়ে থাকতে পারেনা, ওকে কিছু খাইয়ে দিস।”
পাল্টা স্বরে বলে, “তুই খাবি না?”
“না।” একরোখা জবাব।
“রাত অনেক বড়, খেয়ে নে।”
আমি চোখজোড়া গ্ৰথণ করে নিলাম। ঝাঁপসা চোখজোড়া ক্ষণে ক্ষণে মুছে যাচ্ছি। পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। অতিবাহিত হল প্রহর। চোখের পাতায় ধরা দিল না ঘুমপরীরা। আমি তবুও চোখ মেললাম না। টলটল চোখ। শেষ কবে চড় খেয়েছি জানিনা, তিনি কীভাবে পারলেন আমায় আঘাত করতে? সবার সামনে। কাঁথার ভেতরে অনবরত কেঁদেই চলেছি। পেছন থেকে জাপ্টে ধরল তৎক্ষণাৎ। ভরকে গেলাম আমি। পেছনে না ফিরেই হাত সরানোর চেষ্টা করলাম। এতে ক্ষান্ত হলনা। কাঁথা সমেত চেপে ধরলেন। উচ্চে পড়ল ক্ষোভ। কণুয়ের সহায়তায় গুঁতা দিলাম পরপর। হাতের বাঁধন হালকা হতেই ধাক্কা দিলাম সর্বশক্তি দিয়ে। ধপাস করে পড়ল মেঝেতে। আক্ষেপ নেই। চ্যাঁচিয়ে বললাম,

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৮

“বাবুই বিরক্ত করিস না। যা এখান থেকে।”
“দেখে তো নিবে, মানুষটি তোমার কাঙ্ক্ষিত নাকি অনাকাঙ্ক্ষিত।”
কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আংশিক কেঁপে উঠলাম। অশ্রুকণার পরিমাণ বৃদ্ধি পেল। ফুঁপিয়ে উঠল দেহ। ওষ্ঠদ্বয় চেপে রাখলাম। নড়লাম না। দেখলাম না তাকে।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২০