মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২০

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২০
ইফা আমহৃদ

“বউ রাগ করেছে দেখছি। বেশি রাগ করেছে বুঝি।”
বলেই কাঁথা টেনে সরালেন ধ্রুব। দৃঢ় করে চেপে রাখা কাঁথা সরে গেল। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে দূরে সরে গেলাম। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,
“আপনি এখান থেকে যান।,”
“যাবো? কোথায় যাবো? কেন যাবো?”
ধপ করে উঠে বসে চ্যাঁচিয়ে বললাম, “আমি গেলে আপনি যাবেন না। আমাকে অসহ্য লাগে। আমার গালে চড় দিয়েছেন।”
বলেই কেঁদে উঠলাম। ধ্রুব চোখ রাঙিয়ে বললেন, “তো! তুমি সত্যিটা বলো নি কেন? এটাই তোমার প্রাপ্ত ছিল।”
আমি হতবাক হলাম। ধ্রুবের কথার ধরনে অন্যরকম বিষাদের সুর। মুখশ্রীতে তৈলাক্ত ভাবটা নেই, হতাশাগ্রস্থ, মলিন।
“রাগ করেছ ভালো কথা, খাবার উপর কেন দেখাবে? খাবার এনেছি খেয়ে নাও।”
গলা টানটান করে বললেন তিনি। অতঃপর খাবারের প্লেটটা টেবিলের উপর রাখলেন। নাক ফুলিয়ে মাথা আঙুল উঁচিয়ে বললাম,

“আপনি কি জানেন, পৃথিবীর সবচেয়ে অসহ্যকর লোক আপনি অরুপে ইরফান মাহতাব ধ্রুব।”
আয়েস ভঙ্গিতে বললেন, “জানতাম না, এবার জানলাম। আরও কিছু থাকলে জানিও দাও।”
তেজ নিয়ে বললাম, “আর যাই হোক, আপনার সাথে থাকা যায় না। আপনার চেয়ে শতগুণে রাহাত স্যার ভালো।”
“বাবুই’ও কিন্তু ভালো। বয়স কম একটু। আমি ম্যানেজ করে নিবো। বাচ্চা মানুষ ঠিক আমার কথা শুনবে। দু’জনকে মানাবেও কিন্তু বেশ।”
“আপনাকে তো আমি..
দাঁতে দাঁত মিশিয়ে টেনে টেনে বললাম। তিনি বুঝতে পারলেন আমার কথার ধরন। ফোড়ন দিয়ে বললেন,
“রাগছ কেন বড়ুই, আমি তো..
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই থেমে গেলেন তিনি। পিছিয়ে গেলেন কয়েক কদম। সৌজন্য হাসি দিলেন। আমি ড্রেসিং টেবিলে সাজানো জিনিসগুলো ছুঁড়লাম তার দিকে। দিকে সরে গেলেন বিধেয় লাগল না তার শরীরে। সবগুলো ছুঁড়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। অতঃপর বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“রিলেক্স চড়ুই, ফেলা শেষ। এবার এগুলো তুলবে। তারপরে আমি ঘর থেকে যাবো।”
পাত্তা দিলাম না। ভেংচি দিয়ে পাশ ফিরে রইলাম। তিনি পুনরায় বললেন, “এগুলো তোমার নয়, আঁখির। দ্রুত তুলো। নাহলে এখন তোমার সাথে কী হবে ভাবতে পারছ না।”
আমি নিশ্চল। তিনি নেশাগ্ৰস্তদের মত পা টেনে টেনে এগিয়ে এলেন। ভরকে গেলাম আমি। পরবর্তী মুহুর্ত কল্পনা করতে করতে চিৎকার করে উঠলাম, “না, তুলছি।”
“গুড গার্ল।”
আমি দ্রুত জিনিস পত্র তুলে রাখতে লাগলাম। তিনি শার্ট টেনে উঁচু করে বলতে বলতে চলে গেলেন, “চড়ুই পাখি বারোটা, ডিম পেড়েছে তেরোটা। একটা ডিম নষ্ট। চড়ুই পাখির কষ্ট।”
আমি জিনিসপত্র না তুলেই দরজার কাছে ছুটে এলাম। ততক্ষণে ধ্রুব আড়াল হয়েছে। আমার বাচ্চা বাচ্চা সুন্দর নামটাকে, এই মুহুর্তের কী করে দিল।

আকাশের প্রথম সূর্য কিরণ পৃথিবীর বুকে পতিত হল। ধীরে ধীরে প্রখর হয়ে এলো সূর্যের রেশ। দোতলা ঘরে জানালা ভেদ করে আলো পৌঁছেছে। চারিদিকে হট্টখোল। বুঝতে পারছি সকাল হয়েছে। আমি নিভু নিভু দৃষ্টিতে সবকিছু অবলোকন করলাম। আঁখির ঘরে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। আমি দ্রুত উঠে বসলাম। হাফ ছাড়লাম। মাথা ব্যথা করছে। তলপেটে ব্যথা করছে। সময় বারোটার কাছাকাছি। এতদিন ভালোভাবে ঘুমাই নি বিধেয় আজ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। বালিশের পাশ থেকে ওড়না বের করে দ্রুত গায়ে জড়ালাম। ধীরে ধীরে অগ্ৰসর বাইরের দিকে। আম পাতা দিয়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে পুকুর পাড়ে দাঁড়ালাম। তৎক্ষণাৎ পেছনে এসে কেউ দাঁড়ালেন, আমি মুখ ফেরালাম। বড়ো চাচী দাঁড়ানো। মাথা নুয়ে পাশ কাটিয়ে আসতে গেলেই তার কথায় থেমে গেলাম। পেছন থেকেই অগোছালো স্বরে বললেন, “শ্রেয়া মা শোন।”

আমি নতজানু হয়ে বললাম, “চাচী কিছু বলবেন?”
তিনি একটা শাড়ি এগিয়ে দিলেন। আমি নিলাম না। তিনি জোর করে হাতে গুঁজে দিলেন। মৃদু হেসে বললেন, “কিরে কথা বলছিস না কেন? অভিমান করে আছিস। রাগ করি না। তখন ধ্রুবের অবস্থা দেখে মাথা ঠিক ছিল না। পরবর্তীতে আম্মা বুঝাইলেন। এখন বুঝতে পারছি।”
আমি এক চিলতে হাসলাম। “তুমি বুঝতে পেরেছ, এতেই খুশি হয়েছি। শাড়িটা কেন দিলে?”
“এটা অর্কের বউয়ের জন্য কিনেছিলাম, কিন্তু তোরা তো আসার সময় জামা কাপড় কিনে আসিস নি। তাই দিলাম। বিয়ের দিন পড়িস।”
আমি সৌজন্য হাসি দিলাম। তিনি হাসলেন। তার হাতে ফাঁকা কলস। পুকুরের পানি নিতে এসেছেন। আমি কলস নিয়ে পানি তুলতে চাইলে বাঁধা দিলেন তিনি। কানে কানে কিছু একটা বলতেই লজ্জানত হলাম। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম। ওড়নাটা পেঁচিয়ে ঘরে ছুটলাম। সব ঘরগুলোতে মানুষের আনাগোনা। ধ্রুবের ঘরটা একটু ফাঁকা আছে। আমি ওয়াশরুমে ঢুকলাম। ওড়না সরিয়ে দাগ মোছার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই উঠছে না। পুনরায় ঘরে এসে জামা কাপড়ের ব্যাগ খুঁজতে লাগলাম। জামা কাপড়ের ব্যাগ ধ্রুবের ঘরেই ছিল, তাই ঘর থেকে বের হতে হয়নি। আমি ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার শেষ করে বেরিয়ে এলাম। জামা কাপড় ভিজিয়ে রাখলাম পানিতে। চুলগুলো খোলা রেখে বসলাম বিছানায়। তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা করছে। ক্ষুধায় একটু বেশিই কাতর। নিচে গেলাম আঁখি, নীর কিংবা বাবুই কাউকেই দেখতে পারছি না। রাহাত স্যার কিংবা ধ্রুব নেই। বালিশ পেটে রেখে শুয়ে পড়লাম বিছানায়।

“কী হয়েছে চড়ুই, ভরদুপুরে শুয়ে আছো কেন? শরীর খারাপ?”
আমি জানালার বাইরে মুখ ফিরিয়ে ছিলাম। ধ্রুবের গলা শুনতেই তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। ধ্রুব হাত ঘড়িটা খুলছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর ওষুধের প্যাকেট। বুঝতে পারলাম, তিনি চ্যাক আপ করতে গিয়েছিলেন। তাকে বলে দিলে তিনিই নিয়ে আসতেন। কিন্তু কীভাবে বলতাম, লজ্জায় সবকিছু ঘিরে রেখেছিল। আমি মিনমিনে স্বরে বললাম, “আপনি চ্যাক আপ করতে গিয়েছিলেন?”
মুখ চেপে হাসলেন মৃদু। ওষ্ঠদ্বয় তখন সরু হয়ে মিলে ছিল একে অপরের সাথে। হাত ঘড়িটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বললেন, “কিছু বলতে চাইলে নির্দ্বিধায় বলতে পারো। জেনেও না জানার ভান ধরো না প্লীজ।”
“আপনি আঁখিকে দেখেছেন?”
“হ্যাঁ, দেখেছি। রাস্তার মাথায়। বিচিকলা চু’রি করতে গেছে। এই গরমে ভর্তা করে খাবে। তোমার কোনো দরকার ছিল আঁখিকে? আমাকে বলো।”
“তেমন কিছু না, তলপেটে একটু ব্যথা করছে।”
ধ্রুব হাঁটুতে ভর দিয়ে দ্রুত এগিয়ে এলেন। বিচলিত কণ্ঠে বললেন, “কোথায় ব্যথা দেখাও, ডান পাশে নাকি বামপাশে? হার্টের সমস্যা নয়ত?”

আমি বিরাগী চোখে চেয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। বিদেশ থেকে পড়াশোনা করে এসেছে। হার্টের সমস্যা তলপেটে দেখা দেয়। ইনি ডাক্তার হলে লেভার পেইন উঠলে হার্টের চিকিৎসা করতেন। টেনে টেনে বললাম,
“হার্টের সমস্যা কি তলপেটে হয়?”
চোখ বড় বড় করে বললেন, “আমি কখন হার্ট বললাম? আমি তো আলসারের কথা বলেছি। তাছাড়া আমি ডাক্তার হলে আমাকে চিকিৎসা দিতে হত না, আমাকে দেখেই অর্ধেক রোগী ভালো হয়ে যেত।”
ফোড়ন দিয়ে বললাম, “আপনার কি মনে হয়, আপনি তখনও ইয়ং থাকতেন। চার পাঁচটা বাচ্চার মা হতেন। দেখা যেত, আপনার নাতিও আছে।”
চাঁপা স্বরে বললেন, “বউ পাত্তা দেয়না। নাতি কিংবা চার পাঁচ সন্তান দূরের কথা, মৃত্যুর আগে বাসর হবে কি-না সেটাই সন্দেহ।”
আমি শুনেও না শোনার ভান ধরলাম। প্রতুক্তি করলেই লজ্জা পেতে হবে।
“আপনি একটু কষ্ট করে আঁখিকে ডেকে দিবেন?”
“তোমার কি বেশি ব্যথা করছে? ডাক্তার ফোন করব? না-হলে আমাকে খুলে বলো, আমি ডাক্তারকে খুলে বলে ওষুধ নিয়ে আসছি।”

কান্না পেল। নাকে কান্না জুড়ে দিলাম। এটা কি বলার ব্যাপার। তিনি হয়ত অনুমান করতে পারলেন, আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। ধ্রুব গাছের আড়ালে চলে গেল। মিনিট দশেক পর তাকে দেখা গেল ঝাপসা। তার হাতের প্যাকেট দেখতেই লজ্জানত হলাম। মাথা তুললাম না। ফিরে এলেন ঘরে। প্যাকেটটা বিছানায় রেখে অগ্ৰসর হলেন ব্যালকেনির দিকে। পেছনে একপা ফেলে বললেন,

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ১৯

“নিজের সমস্যাগুলো মুখ ফুটে বলতে হয়। তোমার চাওয়া না চাওয়া এখনও আমার অজানা। ধীরে ধীরে ঠিক জানব, কিন্তু তার আগে তো তোমাকে বলতে হবে। চুপ করে মুখ ফিরিয়ে রাখলে কীভাবে বুঝব? আমি কোনো জাদুকর নই।
দশ মিনিট সময় দিলাম, দ্রুত যাও। শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসছে। শাওয়ার নিতে হবে।”
আমি দরজার দিকে চেয়ে রইলাম। অজানা কারণে ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসি। প্রসারিত হল মুখশ্রী। তার শরীরের সংঘর্ষে পর্দাটা একটু নড়ছে। ‘কে বলছে আপনি জাদুকর নন, আমি তো আপনাকে বলিনি। তাহলে কীভাবে জানলেন আমার এটাই প্রয়োজন?’

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২১