মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২৯

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২৯
ইফা আমহৃদ

কাঁচ ভাঙা টুকরোগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মেঝে জুড়ে। আলোকিত করা রঙিন বাতিগুলো নেভানো। হয়ত তার প্রভাব চ্যুত হয়েছে। আমি একপাশে পর্দার আড়াল থেকে যাবতীয় কার্যকলাপ দেখছি। ধ্রুব তার টেবিলেই বসে আছে, তবে তখনকার ন্যায় স্বাভাবিক নয়, অস্বাভাবিক। মুখশ্রী জুড়ে বিধ্বস্ত অবস্থা। রক্তিম চোখজোড়া অস্বাভাবিক, কঠোর, গম্ভীর। প্রধান লোকটা সবাইকে ক্ষান্ত হতে বলছেন।

আমার চোখে চোখ পড়ল রাহাত স্যারের। চমকে গেলেন তিনি। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধ্রুবের হাতে আঘাত করে কিছু একটা শুধালেন। পরক্ষণে ধ্রুব স্যার আমার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। ভ্রু কুঁচকে রাহাত স্যারকে তিনি কিছু বললেন। ওষ্ঠদ্বয় অনুসরণ করে বুঝলাম, “ও এখানে কী করছে?”
“আমি কীভাবে জানব।” মৃদু শব্দে।
“ওকে এখান থেকে সরা। ঝামেলা হতে পারে।”
ধ্রুব থামতেই রাহাত স্যার এগিয়ে এলেন। আরেকটু আড়ালে নিয়ে বললেন, “চড়ুই তুমি এখানে কী করছ? তাড়াতাড়ি এখান থেকে যাও।”
“না। আমি যাবো না।” রিনরিনে জবাব।
“চড়ুই প্লীজ যাও।” অসহায় কণ্ঠে।
কিন্তু আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি তো এই ঝামেলার ইতি টানতে এসেছি। তাইলে? রাহাত স্যার হেলান দিয়ে ধ্রুবকে ইশারা করলেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তার ইশারার কারণ অজানা নয় আমার। অবিলম্বে ছুটে এলেন তিনি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “তুমি এখানে কী করছ? সেটা পরে দেখছি। শেষ হোক অনুষ্ঠান। আপাতত এখান থেকে যাও।”
তেড়া ভাষায় বললাম, “বলেছি তো যাবো না। যাবো না মানে যাবো না। সরুন আপনি।”
আমার বলা কথনগুলো একটু বেশি আওয়াজে প্রকট হল। বিনিময়ে সকলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হল আমার পানে। একটু ইতস্তত বোধ হলেও নিজের সংযত করে নিলাম। দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে বললাম, “আমি চড়ুই, এখানে যেই বিষয়টা নিয়ে ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে, সেই বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু আমি।
আমার কিছু প্রশ্ন ছিল, করতে পারি।”

আরেকটু সামনের দিকে অগ্ৰসর হলাম। এই দু’দিনে পায়ের ব্যথাটা একটু ঘুচে এসেছিল বটে। কিন্তু উপর থেকে লাফ দেওয়ার ফলে পুনরায় গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। জুতো জোড়াও ছিঁড়ে গেছে। ক্ষত পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোলাম। সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
“প্লীজ কেউ কিছু মনে করবেন না।
শিক্ষক মানেই কি শুধু শিক্ষকতা? গম্ভীর ভাবে চলা? আমি মনে করিনা। শিক্ষক তো তখনই শিক্ষা প্রদান করতে ভালো পারে, যখন সে ছাত্র ছাত্রীর সাথে মিশে। ক্ষত পা নিয়ে এখানে এসেছি আমার ভার্সিটির সম্মান রক্ষা করতে। কতটা পথ হেঁটে দৌড়ে এসেছি, আমারই জানা।

দু’দিন আগের রাতে আমি কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। মাঝ রাস্তায় বিপদে পড়েছিলাম। তখন ধ্রুব স্যার আমাকে সাহায্য করেছিলেন। এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই ঘটনাটা শেয়ার করতে চাইছি না। পায়ে ব্যথার কারণে আন্টি আমাকে যেতে দেননি। আমার ছোট বোনকে আনার ব্যবস্থা করেছেন। ইভেন্ট এখানে আসার সময় বোনকে পাঠিয়েছেন সাথে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ও।

আমার জন্য ধ্রুব স্যারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, লাঠিচার্জ করেছে‌। আর আপনারা বলছেন সে চরিত্রহীন? উপযুক্ত কারণ দেখান, সে কী চরিত্রহীনতার পরিচয় দিয়েছে। একজন মানুষের ভেতরেটা না জেনে চরিত্রহীন বলাটা কি সাজে?”
সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনছিলেন আমার কথা। ভেতরে কী হল জানা নেই। ধ্রুব আমাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। গাড়ির ভেতরে রেখে পুনরায় ভেতরে গেলেন। দরজা বাইরে থেকে লক করে দিলেন। ফিরে এলেন কখন জানা নেই। বাবুই আর আমি গাড়ির ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন একটা রেস্তোরাঁয় সামনে।

রেস্তোরাঁয় বসে আছি চারজনে। ভিন্নরকম একটা পরিবেশ। রাত গভীর হওয়াতে জনশূন্য পরিবেশ। দুই-চার জন ওয়েটার দেখা যাচ্ছে। হাতে মেনু কার্ড সমেত দাঁড়ানো। ধ্রুব বিরক্তিকর চোখে একবার অবলোকন করে তাকে যেতে বললেন। অতঃপর কিনলে বোতল থেকে পানি পান করলেন। রাহাত স্যারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “কেমন ওয়েটার পুষিস। বসার আগে কার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বলি, কার্ড নিয়ে না দাঁড়িয়ে একটা ভাঙা বাটি নিয়ে দাঁড়াতে বলতে পারিস। কিছু খুচরা দেওয়ার পর অন্তত চলে যাবে।”
রাহাত স্যারকে এইসব বলার কারণ বোধগম্য হলনা। আমি বুঝার চেষ্টাও করলাম না। ক্ষিপ্র হয়ে বসে রইলাম। ধ্রুব আড় চোখে চেয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কী খাবে?”
আমি গভীর ভাবনায় বিভোর ছিলাম বিধেয় খেয়াল করলাম না। ধ্রুব তুরি বাজিয়ে পুনরায় বললেন, “আমি কিছু জিজ্ঞাসা করছি।”

ধ্যান ভাঙতেই অবুঝ স্বরে বললাম, “জি!”
“কী খাবে, অর্ডার করতে বলেছি।”
“আমি কিছু খাবো না। আন্টি বাড়িতে একা, আমরা বরং সেখানে গিয়ে ডিনার করব।”
ধ্রুব অন্য প্রসঙ্গ টেনে নিলেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললেন, “কালকে পরীক্ষা। কতদূর হয়েছে পড়া?”
থমথমে হল পরিবেশ। জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে নীরব হলাম। সৌজন্য হাসি দিলাম। বাবুই বই এনেছে ঠিকই কিন্তু ব্যাগ থেকে বের করাই হয়নি। আবার পড়া। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। লেগে আসছে ক্রমশ। হাই তুলে বলি, “আগের পড়া আছে।”
“তারমানে পড়নি! বাড়িতে কী করেছিলে?”

আমি মাথা নিচু করে রইলাম। ধ্রুব কঠোর রুপ ধারণ করলেন। সরল স্বভাবের মানুষটি সাধারণ একটি কারণে এতটা কঠোর, ভাবা যায়! ওয়েটার ডেকে খাবার অর্ডার করলেন। আমার ভাবনা ফুরিয়ে আসার পূর্বে খাবারে ভর্তি টেবিলের সম্পূর্ণ কোণাকানা। বিয়ে বাড়ির সব খাবার হাজির। তাজ্জব বনে গেলাম। এত খাবার কেন অর্ডার করল। আমি রোস্টের লেগপিচ নিয়ে খাওয়া শেষ করলাম। খাওয়া শেষ হতেই ধ্রুব হাত মুখ মুছলেন টিসু পেপারে। ধীরে ধীরে বললাম,
“এত খাবার কি ফেলে দিবে?”
“কেন তোমার পছন্দ হয়েছে? বাড়িতে নিয়ে যেতে চাও। নিয়ে নাও, বাড়িতে নিয়ে গরম করে খাবে। আধা খালা খাবার খাওয়ার মুরুদ তো নেই, আবার..

বাক্য সমাপ্ত করলেন না। ধ্রুব উঠে দাঁড়ালেন। বিল না দিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে পেছন থেকে বললাম, “খাবারগুলো আমরা এঁটো করিনি। বাইরে কতগুলো পথশিশু দেখেছিলাম। ঘুমিয়ে আছেন। ওদের যদি..
কথা শেষ হওয়ার আগেই গম্ভীর গলায় বললেন, “ওয়েটার, এই খাবারের সাথে কিছু প্যাকেট বের দিন। আর প্রতিদিনের বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো ওদের দিয়ে দিবেন।”
“জি স্যার।”
ঝড়োহাওয়ার বইছে। মেঘে ঢেকে ফেলেছে অন্তরিক্ষ। রাস্তার ধুলো বালি ছাই মিশ্রিত হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টি আসার পূর্ব লক্ষণ। তবে আর্দ্রহীন মেঘ।

আনমনে হাঁটছি। ধ্রুবের এক কথায় ওয়েটার রাজি হয়ে গেল খাবার দিতে। তাও বিনামূল্যে। ভাবতে ভাবতে গাড়ির কাছে গেলাম। ধ্রুব হুডের উপর বসে ফোনে কথা বলছেন। তার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে। আরও দু’কদম ফেলে একটু আবছায়াতেই দাঁড়ালাম। তিনি হেসে হেসে কথা বলছেন। তার দৃষ্টিতে আমি অনুপস্থিত। ধ্রুবের কথার ঝুলি শেষ হতে ঢেড় সময় লাগল। ফোনটা বুক পকেটে রেখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলেন। হেলান দেওয়া রত অবস্থায় চুলগুলো পেছনে হেলিয়ে দিলেন। মাথার উপর হাত দিয়ে ডেকে দিলেন মুখশ্রী। আমার হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। ধ্রুবের আচরণে কয়েকশ’গুন বেড়ে গেল। তিনি মৃদু হেসে কোমলচিত্তে বললেন,
“তুমি গাড়িতে বসো। রাহাত খাবারগুলো দিতে গেছে। চলে আসবে।”

আমি কোনোমতে সম্মতি দিলাম। তাকে পাল্টা প্রশ্ন করার স্পর্ধা উদ্বৃত্ত নেই। কিঞ্চিৎ পূর্বে যেভাবে হুংকার দিয়েছিলেন। আমি নত হয়ে পিছিয়ে এলাম। তৎক্ষণাৎ হিম স্পর্শে থমকে দাড়ালাম। ঘাড় কাত করে মানুষটিকে দেখার প্রয়াস করলাম। ধ্রুব ভারী কণ্ঠে বললেন,
“কিছু বলবে?”

সত্বর জবার দিলাম, “আপনি ভেতরে যাবেন না?”
ধ্রুব হাত ছাড়লেন না। অধিকন্তু কঠোরভাবে ধরে সুকণ্ঠে বললেন, “না, এখানেই বসে থাকব। আর কিছু?”
পুনরায় প্রশ্ন করতেই হতবুদ্ধু হলাম। আমি হাতের পানে একঝলক দৃষ্টিপাত করলাম। হঠাৎ উপলব্ধি করতে সক্ষম হলাম, আমি আমি স্বাভাবিক নেই। হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। অধর জোড়া নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম, “আপনি খাবার দিতে বললেই ওরা দিয়ে দিবে?”
ঈষৎ হেসে বললেন, “এটা রাহাতের বাবার রেস্তোরাঁ। প্রচুর খাবার বেঁচে যায়। অধিকাংশ ফেলে দেওয়া হয়। তাই বলেছি।”
“ওহ্।”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ২৮

সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে দ্রুত ভেতরে ঢুকে বসলাম। হাত আলগা উপলব্ধি করলাম। ধ্রুব তার বলিষ্ঠ পুরুষালি বন্ধন থেকে মুক্ত করেছে আমায়। নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। এজন্যই তখন ওয়েটারের জন্য রাহাত স্যারকে কথা শুনাচ্ছিলেন ধ্রুব। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে নিজেকে বললাম, “তুই আসলেই একটা বড়ুই। পানি বড়ুই। এইটুকু তোর মাথায় ঢুকে না‌। গাধী একটা।”
জানালা টোকা দিলেন। একটু ঝুঁকে বললেন, “ধন্যবাদ।”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩০