যদি তুমি বলো গল্পের লিংক || আফনান লারা

যদি তুমি বলো পর্ব ১
আফনান লারা

তিথিকে আজ দেখতে আসবে মস্ত বড় এক পরিবার।পাত্রের পরিবারের সদস্য সংখ্যা গুনে গুনে ছাপ্পান্ন জন।
একেবারে যৌথ পরিবার।পাত্রর বয়স এই তো ত্রিশ ছুঁই ছুঁই।
তিথির কাছে সেটা সমস্যা ছিল না মোটেও।তার কাছে সমস্যা হলো আসলে কিছুই না।পাত্র কিংবা পাত্রের পরিবার নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই।অভিযোগটা এক জায়গায় আর তা হলো সে বিয়েটাই করবেনা।কেন করবেনা তার কারণটি হলো সে অন্য কাউকে ভালবাসে।যাকে ভালবাসে তাকে সে এই নিয়ে ছাপ্পান্ন বারই ফোন দিয়েছিল।কিন্তু ওপাশের মানুষটাকে কল দিলেই ভয়েস আসে তিনি ব্যস্ত আছেন।একটু পর কল করতে।

তিথি একবার ভাবে এরকম কাপুরুষের সাথে রাগ করে ত্রিশ বছরের এই ছেলেটাকে বিয়ে করে নেওয়াই বুঝি উত্তম ।পরে ভাবে এত গুলো দিনের প্রেম,কি করে ভোলা যায়।ছেলেটা যখন পাশে এসে বসবে তখনই তো আদিলের কথা মনে পড়ে যাবে।আদিলকে ছাড়া এইসব তো সে কল্পনাও করতে পারেনা।
বারান্দার গ্রিল ধরে মাথা ঠুকরাচ্ছিল তিথি।পেছন থেকে ওর ছোট ভাই রিদম এসে ওকে ঝাপটে ধরে বললো,’টুকু,ভোউউউউউউউউ!’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তিথি বিরক্ত হয়ে দিলো এক চড়।রিদম গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তারপর বললো ‘তোমার এই ছেলের সাথে বিয়ে হবেনা দেখিও।আমি অভিশাপ দিলাম’
তিথি অন্যদিকে মুখ করে বললো,’অনেক ধন্যবাদ’
রিদম মুখ বাঁকিয়ে ড্রয়িং রুমে ফেরত এসে সাজিয়ে রাখা মিষ্টির থালা থেকে দুটো নিয়ে পগারপার হয়ে গেছে।
এদিকে তিথি সাতান্ন তম বার আদিলকে কল করে।
এইবার আদিল ধরে কলটা।

তিথি কল রিসিভ হয়েছে দেখে শুরুতেই আদিলকে এক গাদা গালি ছুড়ে দেয়।তার এত রাগ হচ্ছিল যে আদিল সামনে থাকলে সে ওকে আজ খুনই করে ফেলতো।
আদিল ওর বকাঝকা শুনে শান্ত গলায় বলে,’আমি তোমাদের বাসার কাছের পার্কটাতে এসে বসে আছি,দশ মিনিটের জন্য আসবে?’
‘নিশ্চয়তা দাও আমাকে নিয়ে পালাতে পারবে?’

আদিল অবাক হলো তিথির এমন কথায়।তার আর তিথির সম্পর্ক প্রায় দেড় বছরের।প্রেমের সম্পর্ক মানে অন্তত একবার হলেও হাতটা ধরা।কিন্তু আদিল আজ অবধি তিথিকে ছুঁয়েও দেখেনি।সেও ছোঁয় না,তিথিও নিজ থেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেনা।কেন করেনা তার পেছনে আবার ইতিহাস আছে!

তিথির এমন উদ্ভট কথার জবাবে হ্যাঁ বা না নিয়ে কিছুই বললোনা আদিল।শুধু বললো সে যেন দ্রুত চলে আসে পার্কে।
তিথি ধরে নিলো আদিল তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে।ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে বের হবার সময় তার মনে হলো আদিলকে সে যতটুকু চিনে, এই ছেলেটা যেকোনো সময়ে পাশা পালটাতে পারে।বিশ্বাসের মার নাই!
তাই সে একটা ছুরি নিলো সাথে।যদি সে বলে সরি তিথি আমি তোমায় বিয়ে করতে পারবোনা,তুমি ঐ ত্রিশ বছরের ছেলেটাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও তবে গর্দভটার পায়ে আচ্ছা করে কুপিয়ে আসবে।অন্য কোথাও কোপাবে না।নাহয় মরে যাওয়ার চান্স আছে।ভালবাসার মানুষকে কি করে খুন করা যায়?

ছুরিটা ব্যাগে পুরে তিথি বাহিরের রুমে উঁকি দেয়।
মা,খালা আর ফুফু মিলে রান্নাঘরে খাসির মাংস রাঁধছেন।আজ পাত্রপক্ষকে দুপুরে খাওয়াবে তারা।ওরা নাকি আংটিও পরিয়ে যেতে পারে।
রিদমের একটা পা দেখা যায় সোফার তলা থেকে।সম্ভবত এক কেজি মিষ্টি সে সাবাড় করে ফেলেছে।
ওকে পাত্তা না দিয়ে তিথি পা টিপে টিপে দরজাটা খোলার জন্য হাত রাখতেই রিদম বললো,’টুকু ব্যাগটা আমি আগাইয়া দেবো?’

তিথি পেছনে ফিরে ফিসফিস করে বলে,’নো থ্যাংকস!’
‘যাওয়ার আগে এখানে একটা সই করে যাও।’
এটা বলে রিদম সোফার তলা থেকে একটা কাগজ আর কলম বের করে দিলো ফ্লোরে।তিথি বিরক্ত হয়ে ব্যাগটা রেখে নিচে বসলো।রিদমের কথা না শুনলে এক চিৎকারে সবাইকে ড্রয়িং রুমে এনে হাজির করবে সে।
কাগজটা পড়ে তিথি দেখলো তাতে লেখা আছে

“”””আমি রিদমের টুকু বলছি।আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আজ যে পালিয়ে যাচ্ছি এরপর থেকে আমার রুমটা রিদমের নামে দলিল করে দিলাম।এই রুম নিয়ে আমার কোনো দায় দাবি থাকবেনা।””’
সই এর জায়গায় তিথি সই করে কাগজটা সোফার তলায় ঠেলে দিয়ে সে বেরিয়ে গেলো।
দ্রুত যেতে হবে।পার্কটা খুব বেশি দূরে না।
অনেক কষ্টে গায়ের ভারী শাড়ীটাকে আর ব্যাগটাকে বয়ে এসেছে তিথি।পার্কে এসে এদিক সেদিক চোখ বুলাতেই আদিলের দেখা পেলো সে।আদিল পার্কে বসে ফোন টিপছিল।
তিথি ওর কাছে এসে বলে ফেললো এখনই বিয়ে করবে তারা।আদিল কথাটা শুনে এমনভাবে তাকালো যেন সে বিয়ের ব নিয়েও ভাবছেনা।

তিথি বিরক্ত হলো ভীষণ।আদিলের আসলে সমস্যা টা কোথায়!
তার মুখে বিরক্তির ছাপ দেখে আদিল ওকে পাশে বসতে বললো।
তিথি ও বসলো ওর পাশে।তারপর বললো বিয়ে না করলে কিসের জন্য ডেকেছে।
সে কি চায় তিথির অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাক!
‘না চাইনা।শোনো তিথি,আমি আজ তোমায় একটা কথা বলতে এখানে ডেকেছি।আমি আসলে!!’

ওমনি তিথি তার ছুরিটা বের করে আদিলের দিকে ধরে বললো,’সিনেমার ডায়ালগ দিতে হবেনা।বিয়ে করবানা বলে দিছোনা?ব্যস আর কোনো ডায়ালগ দিওনা।আমি বেশ ভালমতনই জানি তুমি আমায় বিয়ে করবেনা।সম্পর্কের শুরু থেকেই দেখেছি কেমন মাঝখানে এক হাত দূরুত্ব রেখে চলো তুমি।
শুধু চলে যাওয়ার আগে বলে যাও এরকম নাটকের কি দরকার ছিল?এটা সম্পর্ক ছিল নাকি গেমস ছিল?কেন খেললে এমন গেমস?’

আদিল তার ফোনে কার সাথে যেন মেসেজ করছিল।তিথি ভাবলো হয়ত কোনো মেয়ে,৩য় ব্যাক্তি।সে ওমনি আদিলের ফোনটা কেড়ে নেয়।তাতে লেখা ছিল,’বস’
এটা দেখে তিথি আর মেসেজ পড়েনা,ফোনটা পাশে রেখে দিয়ে বলে,’আমার ফিলিংস নিয়ে খেলে কি পাইলা?’
আদিল মুচকি হাসি দিয়ে বলে,’অনেক কিছুই পেয়েছি।’

তিথির মাথাটা আরও গরম হয়ে যায়।কিন্তু বেশি কিছু বলতে পারেনা।প্রচণ্ড রেগে গেলে ওর মাথা কাজ করেনা,মাথা ঘোরায়।প্রেশার বেড়ে যায়।আর তাই চুপ করে সে বসেই থাকলো।আদিল তার ফোনটা নিয়ে আবারও মেসেজ করছে।তিথি তখন তার হাতের ঘড়িতে সময় দেখে।আর দশ মিনিট পর পাত্র পক্ষ আসার কথা।তিথি তার ফোন নিয়ে বাসায় একটা কল দেয়।বাসার নাম্বারে কল আসলে সেটা সবসময় রিদম রিসিভ করে।এবারও তাই হলো।

‘হ্যালো,অরিজিৎ সিং স্পিকিং!!হু আর ইউ?’
‘আমি’
‘টুকু! তুমি বিয়েও করে নিছো?সেটা জানাতে কল দিছো?’
‘পাত্রপক্ষ এসেছে?’
‘আসতেছে।বাবা নিচ তলা থেকে আনতে গেছে,ঐ তো এসেও গেছে।আসসালামু আলাইকুম’
‘ছেলে কেমন?’
‘সবই ঠিক আছে কি তার পেট দেখি দশ তলা!’
‘আর কিছু?’

‘সবই ঠিক আছে কিন্তু মানুষ এত বেশি কেন!একুশ,বাইশ তেইশ,পঞ্চাশ ছাপ্পান্ন।টুকু তুমি আর বাসায় ফিরিও না।’
তিথি ফোনটা রেখে দেয়।আদিল পার্কের বাহিরে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছে।
তিথি ব্যাগটা রেখে ওর সামনে গিয়ে বলে,’তুমি সত্যি সম্পর্কটার ইতি টানতেছো?’
‘হ্যাঁ।আমার সময় শেষ’
‘ক্যানসার?কাল পরশু মরে যাবা?তাই কুরবানি দিচ্ছো নিজেকে?’
‘ওসব কিছুনা।তবে আমি তোমায় বিয়ে করতে পারবোনা।যদি করি তবে কুরবানি আমায় হতে হবে’
‘মানে কি!আশ্চর্য। এরকম করে কথা কেন বলছো!’

আদিল রিকশা পেয়ে উঠেও গেছে।তিথির দিকে টাটা দিতে দিতে সে বললো,’ওল দ্যা বেস্ট’
তিথি রাগ করে পায়ের জুতা খুলে রিকশার দিকে মেরে বললো,’তোর অল দ্যা বেস্টের গুষ্টি-তুষ্টি!’
রিকশা চলে গেলো বহুদূর।তিথি খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাস্তায় কাঠগোলাপের ছড়াছড়ি। ফুলগুলো দেখে মেজাজটা আরও খারাপ হলো তিথির।এই ফুল দিয়েই আদিল তাকে প্রোপোজ করেছিল।রাগ করে পার্কে এসে ব্যাগটা তুলে সে তার একটা বান্ধবীকে কল করে।আপাতত ঐ পাত্রপক্ষ চলে যাওয়া অবধি ওর বাসাতেই থাকবে।খালি পায়ে হেঁটে যাবার সময় পায়ে বিঁধে গেলো কাঁচ।পার্কে কাঁচ ফেললো কে!

পায়ের পাতা ধরে কাঁচটা ফেলে হাঁটতে গিয়ে হলো মহাঝামেলা।হাঁটতেই পারছেনা সে।কোনোমতে রোডে এসে একটার রিকশার খোঁজ করছে এখন।জুতা গুলাও নিয়ে গেছে ঐ ছেলেটা!!!
“”কি অভিশাপ দিলে ওর আক্কল হবে!

হুমমমমম!তোর বউয়ের কারেন্ট থাকবেনা।এটাই ঠিক আছে।সারাদিন সৌরবিদ্যুৎ চলবে।বর্ষাকালে বন্যা বইবে’
হাসি দিয়ে তিথি খেয়াল করে তার সামনে একটা সাদা প্রাইভেট কার এসে দাঁড়িয়েছে।তার ভেতরে বসে থাকা মেয়েটি ইশারা দিয়ে তিথিকে উঠতে বলছে।কিন্তু তিথি হাত নাড়িয়ে না করে দেয়।এরপর মেয়েটা জানালার কাঁচ নামিয়ে বলে,’তোমার পায়ে জুতা নাই দেখলাম,মনে হয় বিপদে পড়েছো।ভাবছি হেল্প করলে সওয়াব পাবো,উঠে এসো’
তিথির সন্দেহ হলো তাই সে মানা করে দেয়।কিন্তু মেয়েটা তাকে রিকুয়েস্ট করতে থাকে।এদিকে তিথিও বিপদে পড়ে আছে, এই হেল্পটা তার দরকার ছিল।

ইতিউতি না ভেবে সে উঠে পড়ে।বসতেই তার মনে পড়লো গাড়ীতে বসে তিথির পা কিভাবে দেখলো এই মেয়েটা।সে ওমনি প্রশ্নটা সেই মেয়েটিকে করে।মেয়েটি তখন হাসিমুখে বলে,’আমি এতক্ষণ জানালার ওপাশেই ছিলাম।তাই দেখেছি।তোমায় দেখেই এই পাশে চলে এলাম।তুমি কি সন্দেহ করছো?আমি কিন্তু তোমায় কিডন্যাপ করবোনা।’

তিথি আড় চোখে তাকায় মেয়েটার দিকে।হঠাৎ তার চোখ চলে যায় ড্রাইভারের সিটে বসা ছেলের দিকে।ছেলেটা মুখে মাস্ক পরে ছিল,আর বারবার বাম হাত দিয়ে নিজের যে টুকু মুখ দেখা যায় সেটা লুকানোর চেষ্টা করছিল।তিথি মাথা উঁচু করে আরও ভালভাবে দেখার চেষ্টা করে ওমনি সেই মেয়েটা তিথির দিকে ফিরে বলে,”কোথায় যাবে?ঠিকানা তো দাও।তোমায় নামিয়ে দিবো’

যদি তুমি বলো পর্ব ২